ঢাকার মান বাঁচান by ড. হারুন রশীদ
যুক্তরাজ্যের
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী
বিশ্বের ১৪০টি নগরীর মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৯তম। অর্থাৎ বসবাসের অনুপযোগী
শহরের মধ্যে ঢাকার পরে মাত্র একটি শহরের স্থান। সেটি হচ্ছে সিরিয়ার
গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দামেস্ক। এ অবস্থা যে আমাদের জন্য কতটা লজ্জাজনক তা
বলার অপেক্ষা রাখে না। দুর্নীতিতে আমাদের দেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। এখন দেখা
যাচ্ছে বাস অনুযোগী শহরে বসবাসের ক্ষেত্রেও আমরা চ্যাম্পিয়ন! হায়রে অভাগা
কপাল! জরিপকারী ওই প্রতিষ্ঠানটি একটি শহরের বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এর
মান নির্ণয় করে। এর মধ্যে রয়েছে নগরীতে বসবাসের সুযোগ-সুবিধা, জনসংখ্যার
ঘনত্ব, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসা পাওয়ার
সুযোগ-সুবিধা, অপরাধের হার, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা,
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন, পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামোর গুণগতমান,
পানি সরবরাহের মান, খাদ্য, পানীয়, ভোক্তাপণ্য, সেবা, সরকারি বাসগৃহের
প্রাপ্যতা ইত্যাদি। এসব দিক থেকে আমাদের নগরগুলোর কী অবস্থা তা বলার
অপেক্ষা রাখে না।
এছাড়া ঢাকা ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। এর আগে অন্য জরিপে প্রকাশ পেয়েছে ঢাকা বিশ্বের দূষিত নগরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর করুণ অবস্থায়ই এ জরিপের সত্যতা প্রমাণে যথেষ্ট। এছাড়া যানজট, যানবাহন ও কলকারখানার কালো ধোঁয়া, ট্যানারি বর্জ্য, খাদ্যে ভেজাল, সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিুমানও ঢাকার জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অধিক জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ এ শহরে নেই পয়ঃনিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা। জনসংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি-ঘোড়া। কিন্তু সে তুলনায় রাস্তাঘাট, হাসপাতাল স্কুল-কলেজ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি নাগরিক সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। সবকিছুতেই পরিকল্পনাহীনতার ছাপ। অথচ রাজধানী ঢাকাই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। দেশের এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় ৫ কোটি মানুষ এখন শহরে বাস করছে। এজন্য পরিকল্পিত নগরায়নের কোনো বিকল্প নেই। ঢাকা আবাসস্থল থেকে পরিণত হয়েছে বিরাট বাজারে। বস্তুত এ শহরের সুনির্দিষ্ট কোনো চরিত্র নেই। যত্রতত্র যে যেখানে পারছে, যে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এতে নগরী তার বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। এক জগাখিচুরি অবস্থায় রাজধানীবাসী এখানে বাস করছে। ফলে অনেক নাগরিক সুবিধা থেকেই তারা বঞ্চিত হচ্ছে। শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এ নগরী যেন নরকতুল্য। খেলার মাঠ নেই, নেই জলাশয়। সবুজ গাছগাছালির দেখা মেলাও ভার।
দুই
যানজট ঢাকা নগরীকে কার্যত এক অচল ও স্থবির নগরীতে পরিণত করেছে। এটি একটি স্থায়ী সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়ায় পরিবহন খাতে বড় ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো ছাড়া কোনো উপায় নেই। যানজট সমস্যার সমাধান না হওয়ায় প্রতিদিনই অনেক কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। পিছিয়ে যাচ্ছে উন্নয়ন। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অগ্রগতি। শুধু তাই নয়, শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণে নানা সংক্রামক ব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছে রাজধানীর বিপুলসংখ্যক মানুষ। যানজটে নগরবাসীর প্রাত্যহিক জীবনযাত্রাও মারাÍকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে দিন দিন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, যানজটের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সব রুটে যাত্রীদের চলাচলে কমপক্ষে ৩ কর্মঘণ্টা সময় অপচয় হয় প্রতিদিন। যানজটের কারণে বিপুল পরিমাণ জ্বালানিরও অপচয় হয়। কিন্তু এ থেকে পরিত্রাণের যেন কোনো উপায় নেই। বিভিন্ন সময়ে নানামুখী কর্মসূচি-পরিকল্পনা হাতে নেয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়েছে খুবই কম। ফলে সমস্যা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেছে। রাজধানীতে দিন দিন জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি। সে তুলনায় রাস্তাঘাট বাড়ছে না। ফলে যানজট এক অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ফলাফল হবে ভয়াবহ।
তিন
শিল্প-কারখানার দূষিত বর্জ্য পানিতে মিশে ঢাকার পরিবেশকে করে তুলছে বিষাক্ত। বিশেষ করে ট্যানারি বর্জ্যরে দূষণ নগরবাসীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার যেন কেউ নেই। হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্প স্থানান্তরের জন্য হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেও তা একযুগেও কার্যকর হয়নি। স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হলেও হাজারীবাগে এখনও আড়াইশ’রও বেশি ট্যানারি রয়েছে। ট্যানারির তরল বিষাক্ত বর্জ্য স্থানীয় জলাশয় থেকে হাজারীবাগ খাল হয়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় বাঁধের ভেতরের স্লুুইসগেটসহ নানা পথে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে মেশে। ট্যানারির বর্র্জ্য অত্যন্ত বিষাক্ত। এ বর্জ্য পানিতে মিশলে তা দেখে মনে হবে রঙ মেশানো পানির মতো। আর এ রঙিন পানিই দিনের পর দিন নদীতে গিয়ে পড়ে পানিকে দূষিত করছে। বুড়িগঙ্গাকে বলা হয় ঢাকার প্রাণ। কিন্তু দখল দূষণে এ নদীর অবস্থা এখন বড়ই করুণ। বিশেষ করে ট্যানারির বর্জ্য নদীর পানিতে মিশে পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। যে পরিমাণ অক্সিজেন আছে তাতে জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হলে ট্যানারি শিল্পের বর্জ্য যাতে নদীতে আর না পড়তে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি কারখানা সাভারে স্থানান্তরের কোনো বিকল্প নেই। এ নিয়ে অনেক গড়িমসি হয়েছে, আর নয়।
চার
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। বুয়েটের মেধাবী ছাত্রী সনি হত্যার প্রতিবাদে যারা অনশন করছিলেন, কবি শামসুর রাহমান গিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে। কবির বুয়েটে যাওয়ার ঘটনা ফলাও করে প্রচার হয় সবক’টি দৈনিকে। ফলে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা আরও প্রত্যয়ী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বিয়ষটি ভালো ঠেকেনি বুয়েট ভিসির কাছে। তাই তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘উনি কবি মানুষ, আমরা ইঞ্জিনিয়ার, কবিতার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ তৎকালীন ভিসির ওই অসার মন্তব্য দেশব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। তখন তা হাসির খোরাক জুগিয়েছিল অনেকের। সত্যি কবিতার সঙ্গে মানুষের, বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ারদের সম্পর্ক না থাকলে তার পরিণতি যে কী ভয়াবহ হতে পারে তা যেন বলে দিচ্ছে রাজধানীর কংক্রিটের এ জঙ্গল।
প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীন ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে দৈনিক বাংলার সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘মান্দাই নৃ-গোষ্ঠী’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে এ জনগোষ্ঠীর মাটির ঘরের অপূর্ব সুন্দর স্থাপত্য রীতি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আধুনিক কালের স্থাপত্যকলায় পরিবেশের সঙ্গে গৃহনির্মাণের একটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ মিলন প্রত্যাশিত। চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের পাশ্চাত্যের গৃহ-স্থাপত্যের সাধারণ নকশাটা আমাদের দেশের স্থাপত্যকাররা গ্রহণ করেছিলেন নির্বিচারে। ঢাকা শহরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, রুগ্ন গৃহ-স্থাপত্যের এক দিকচিহ্নহীন অভিযাত্রায় নেমেছি আমরা। সাদা চুনকাম করা দেয়ালের সঙ্গে ঢাকা শহরের মৃত্তিকার কোনো সামঞ্জস্য নেই। যে কাঠামোকলা ভূপ্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন, তাই যেন চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সর্বত্র। পাশ্চাত্যে গৃহ-স্থাপত্যের আঙ্গিক ও বৈচিত্র্য তাদের শিল্পায়ন ও বিজ্ঞানের ধারায় স্বাভাবিক। আমাদের প্রকৌশলীরা সেখানকার সেই নকশাই জুড়ে দিলেন এখানে। আমাদের চাঁদ সূর্য, শীত, বর্ষা আড়ালে চলে গেল। পুঁথিগত বিদ্যাটাকে ধ্র“বজ্ঞানে বিশ্বাস করার যে কী ফল, তা আমাদের শহরের নানা অংশের স্থাপত্যরীতি দেখলেই বোঝা যায় অবশ্য।’
রবীন্দ্রনাথ বলাকার একটি কবিতায় তাজমহল সম্পর্কে বলেছেন, ‘প্রেমের করুণ কোমলতা/ফুটিল তা/সৌন্দর্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে’।
পাষাণে প্রাণ দেয়ার জন্য যে নান্দনিক বোধ থাকা প্রয়োজন তার জন্য বিষয়াতিরিক্ত জ্ঞানের অন্য শাখাগুলোরও অধ্যয়ন জরুরি। আমাদের স্থাপত্যকলায় যার তীব্র অভাব পরিস্ফুট। আমাদের নগরায়নে যেমন পরিকল্পনার অভাব, তেমনি সৌন্দর্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণের অভাব। স্থাপত্যকলায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত সৌন্দর্যের অনুসন্ধান আমাদের ঐতিহ্যের কারণেই বড় বেশি প্রয়োজন। ঢাকাকে অসম্মান থেকে রক্ষার জন্য তাই এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট
এছাড়া ঢাকা ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। এর আগে অন্য জরিপে প্রকাশ পেয়েছে ঢাকা বিশ্বের দূষিত নগরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর করুণ অবস্থায়ই এ জরিপের সত্যতা প্রমাণে যথেষ্ট। এছাড়া যানজট, যানবাহন ও কলকারখানার কালো ধোঁয়া, ট্যানারি বর্জ্য, খাদ্যে ভেজাল, সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিুমানও ঢাকার জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অধিক জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ এ শহরে নেই পয়ঃনিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা। জনসংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি-ঘোড়া। কিন্তু সে তুলনায় রাস্তাঘাট, হাসপাতাল স্কুল-কলেজ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি নাগরিক সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। সবকিছুতেই পরিকল্পনাহীনতার ছাপ। অথচ রাজধানী ঢাকাই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। দেশের এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় ৫ কোটি মানুষ এখন শহরে বাস করছে। এজন্য পরিকল্পিত নগরায়নের কোনো বিকল্প নেই। ঢাকা আবাসস্থল থেকে পরিণত হয়েছে বিরাট বাজারে। বস্তুত এ শহরের সুনির্দিষ্ট কোনো চরিত্র নেই। যত্রতত্র যে যেখানে পারছে, যে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এতে নগরী তার বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। এক জগাখিচুরি অবস্থায় রাজধানীবাসী এখানে বাস করছে। ফলে অনেক নাগরিক সুবিধা থেকেই তারা বঞ্চিত হচ্ছে। শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এ নগরী যেন নরকতুল্য। খেলার মাঠ নেই, নেই জলাশয়। সবুজ গাছগাছালির দেখা মেলাও ভার।
দুই
যানজট ঢাকা নগরীকে কার্যত এক অচল ও স্থবির নগরীতে পরিণত করেছে। এটি একটি স্থায়ী সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়ায় পরিবহন খাতে বড় ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো ছাড়া কোনো উপায় নেই। যানজট সমস্যার সমাধান না হওয়ায় প্রতিদিনই অনেক কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। পিছিয়ে যাচ্ছে উন্নয়ন। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অগ্রগতি। শুধু তাই নয়, শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণে নানা সংক্রামক ব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছে রাজধানীর বিপুলসংখ্যক মানুষ। যানজটে নগরবাসীর প্রাত্যহিক জীবনযাত্রাও মারাÍকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে দিন দিন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, যানজটের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সব রুটে যাত্রীদের চলাচলে কমপক্ষে ৩ কর্মঘণ্টা সময় অপচয় হয় প্রতিদিন। যানজটের কারণে বিপুল পরিমাণ জ্বালানিরও অপচয় হয়। কিন্তু এ থেকে পরিত্রাণের যেন কোনো উপায় নেই। বিভিন্ন সময়ে নানামুখী কর্মসূচি-পরিকল্পনা হাতে নেয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়েছে খুবই কম। ফলে সমস্যা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেছে। রাজধানীতে দিন দিন জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি। সে তুলনায় রাস্তাঘাট বাড়ছে না। ফলে যানজট এক অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ফলাফল হবে ভয়াবহ।
তিন
শিল্প-কারখানার দূষিত বর্জ্য পানিতে মিশে ঢাকার পরিবেশকে করে তুলছে বিষাক্ত। বিশেষ করে ট্যানারি বর্জ্যরে দূষণ নগরবাসীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার যেন কেউ নেই। হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্প স্থানান্তরের জন্য হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেও তা একযুগেও কার্যকর হয়নি। স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হলেও হাজারীবাগে এখনও আড়াইশ’রও বেশি ট্যানারি রয়েছে। ট্যানারির তরল বিষাক্ত বর্জ্য স্থানীয় জলাশয় থেকে হাজারীবাগ খাল হয়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় বাঁধের ভেতরের স্লুুইসগেটসহ নানা পথে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে মেশে। ট্যানারির বর্র্জ্য অত্যন্ত বিষাক্ত। এ বর্জ্য পানিতে মিশলে তা দেখে মনে হবে রঙ মেশানো পানির মতো। আর এ রঙিন পানিই দিনের পর দিন নদীতে গিয়ে পড়ে পানিকে দূষিত করছে। বুড়িগঙ্গাকে বলা হয় ঢাকার প্রাণ। কিন্তু দখল দূষণে এ নদীর অবস্থা এখন বড়ই করুণ। বিশেষ করে ট্যানারির বর্জ্য নদীর পানিতে মিশে পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। যে পরিমাণ অক্সিজেন আছে তাতে জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হলে ট্যানারি শিল্পের বর্জ্য যাতে নদীতে আর না পড়তে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি কারখানা সাভারে স্থানান্তরের কোনো বিকল্প নেই। এ নিয়ে অনেক গড়িমসি হয়েছে, আর নয়।
চার
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। বুয়েটের মেধাবী ছাত্রী সনি হত্যার প্রতিবাদে যারা অনশন করছিলেন, কবি শামসুর রাহমান গিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে। কবির বুয়েটে যাওয়ার ঘটনা ফলাও করে প্রচার হয় সবক’টি দৈনিকে। ফলে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা আরও প্রত্যয়ী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বিয়ষটি ভালো ঠেকেনি বুয়েট ভিসির কাছে। তাই তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘উনি কবি মানুষ, আমরা ইঞ্জিনিয়ার, কবিতার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ তৎকালীন ভিসির ওই অসার মন্তব্য দেশব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। তখন তা হাসির খোরাক জুগিয়েছিল অনেকের। সত্যি কবিতার সঙ্গে মানুষের, বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ারদের সম্পর্ক না থাকলে তার পরিণতি যে কী ভয়াবহ হতে পারে তা যেন বলে দিচ্ছে রাজধানীর কংক্রিটের এ জঙ্গল।
প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীন ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে দৈনিক বাংলার সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘মান্দাই নৃ-গোষ্ঠী’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে এ জনগোষ্ঠীর মাটির ঘরের অপূর্ব সুন্দর স্থাপত্য রীতি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আধুনিক কালের স্থাপত্যকলায় পরিবেশের সঙ্গে গৃহনির্মাণের একটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ মিলন প্রত্যাশিত। চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের পাশ্চাত্যের গৃহ-স্থাপত্যের সাধারণ নকশাটা আমাদের দেশের স্থাপত্যকাররা গ্রহণ করেছিলেন নির্বিচারে। ঢাকা শহরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, রুগ্ন গৃহ-স্থাপত্যের এক দিকচিহ্নহীন অভিযাত্রায় নেমেছি আমরা। সাদা চুনকাম করা দেয়ালের সঙ্গে ঢাকা শহরের মৃত্তিকার কোনো সামঞ্জস্য নেই। যে কাঠামোকলা ভূপ্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন, তাই যেন চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সর্বত্র। পাশ্চাত্যে গৃহ-স্থাপত্যের আঙ্গিক ও বৈচিত্র্য তাদের শিল্পায়ন ও বিজ্ঞানের ধারায় স্বাভাবিক। আমাদের প্রকৌশলীরা সেখানকার সেই নকশাই জুড়ে দিলেন এখানে। আমাদের চাঁদ সূর্য, শীত, বর্ষা আড়ালে চলে গেল। পুঁথিগত বিদ্যাটাকে ধ্র“বজ্ঞানে বিশ্বাস করার যে কী ফল, তা আমাদের শহরের নানা অংশের স্থাপত্যরীতি দেখলেই বোঝা যায় অবশ্য।’
রবীন্দ্রনাথ বলাকার একটি কবিতায় তাজমহল সম্পর্কে বলেছেন, ‘প্রেমের করুণ কোমলতা/ফুটিল তা/সৌন্দর্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে’।
পাষাণে প্রাণ দেয়ার জন্য যে নান্দনিক বোধ থাকা প্রয়োজন তার জন্য বিষয়াতিরিক্ত জ্ঞানের অন্য শাখাগুলোরও অধ্যয়ন জরুরি। আমাদের স্থাপত্যকলায় যার তীব্র অভাব পরিস্ফুট। আমাদের নগরায়নে যেমন পরিকল্পনার অভাব, তেমনি সৌন্দর্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণের অভাব। স্থাপত্যকলায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত সৌন্দর্যের অনুসন্ধান আমাদের ঐতিহ্যের কারণেই বড় বেশি প্রয়োজন। ঢাকাকে অসম্মান থেকে রক্ষার জন্য তাই এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট
No comments