দৃষ্টান্ত- ভারতের ও আমাদের জনপ্রশাসন by আলী ইমাম মজুমদার

ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি মহকুমা নয়দা। সাত-আট মাস আগে থেকে তথাকার মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ভারতীয় প্রশাসনিক সার্ভিসের (আইএএস) একজন নবীন কর্মকর্তা।
দুর্গাশক্তি নাগপাল তাঁর নাম। ২০০৯ ব্যাচের এ কর্মকর্তার বয়স ২৮। এরই মধ্যে নিষ্ঠা, দৃঢ়তা আর কর্মতৎপরতার জন্য সুনাম অর্জন করেছেন। সেই মহকুমার প্রত্যন্ত গ্রামের পাশ দিয়ে বহমান যমুনা নদীর তীর থেকে প্রতি রাতে বহু ট্রাক বালু পাচার হতো দিল্লির রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের কাছে। বহু কোটি টাকার সরকারি সম্পদ বেআইনিভাবে অন্যত্র পাঠানোর খবর পান মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট। ছয় মাসব্যাপী প্রায়ই বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশসহ তিনি হানা দিয়ে ৬৬টি মামলা দায়ের, ১০৪ জন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও ৮১টি লরি বাজেয়াপ্ত করেন। পাশাপাশি তিনি সরকারি জায়গায় নির্মিত অনেক অবৈধ স্থাপনাও ভেঙে দেওয়ার ব্যবস্থা নেন।

বালু চোরাই ব্যবসার সঙ্গে টাকার ভাগাভাগিতে জড়িত ছিলেন প্রভাবশালী অনেকেই। এঁরা তাঁকে এ ধরনের অভিযান থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেন আবার হুমকিও দিতে থাকেন। একপর্যায়ে এঁরা উত্তর প্রদেশ সরকারের তরুণ মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবকে তাঁদের পক্ষে নিতে সমর্থ হন। ভেঙে দেওয়া অবৈধ স্থাপনার মধ্যে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দেয়ালও ছিল। দেয়ালটি ছিল সরকারি জায়গায় বিনা অনুমতিতে নির্মিত। আর যেকোনো ধর্মের এ ধরনের স্থাপনা ভেঙে দেওয়ার জন্য নির্দেশ রয়েছে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের।
দেয়াল ভাঙাকে অজুহাত হিসেবে নিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয় তাঁকে। বালু চুরির মাফিয়া চক্রের বিরুদ্ধে সফল অভিযান এবং এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপের কথা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। সোনিয়া গান্ধী চিঠি লেখেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। তাঁর অনুরোধ, এ কর্মকর্তার প্রতি যেন সুবিচার করা হয়। সুশীল সমাজ সোচ্চার হয়ে ওঠে। এর মধ্যে প্রবীণ আইনজীবী রামজেঠ মালানিও ছিলেন। তিনি বিনা পয়সায় তাঁর মামলা লড়তে রাজি বলে আহ্বান জানান তাঁকে। কিন্তু দুর্গাশক্তি ধীর, শান্ত আর নীরবই রইলেন। তবে নীরব রইলেন না তাঁর সহকর্মীরা। অবশ্য চাকরিবিধির নিয়ম মেনেই তাঁরা প্রতিবাদ জানালেন কর্তৃপক্ষের কাছে। সুশীল সমাজের একটি বিরাট অংশ অব্যাহতভাবে প্রতিবাদ করতে থাকে এই অবিচারের। এলাহাবাদ হাইকোর্ট আর ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থের মামলা হয় একাধিক। আদালত তাঁকে অবিলম্বে চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ দেন। নির্দেশটি প্রতিপালিতও হয়েছে।
ঘটনাগুলো গত জুলাই ও আগস্ট মাসের। আর খবরের উৎস ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা। দুর্গাশক্তি এরই মধ্যে আইএএসের ‘আইকন’ রূপে চিহ্নিত হচ্ছেন। ঘটনার সর্বশেষ পরিণতিতে অপশক্তি সতর্ক বার্তা পেল। প্রেরণা পেলেন সদাচারি ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তারা। তাঁরা আইন প্রয়োগে অধিকতর দৃঢ় হবেন। আর তা হওয়াই তো স্বাভাবিক। দুর্বলকে রক্ষা আর দুর্জনকে শাসন করার জন্যই সরকার।
একই দর্শন তো প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের। আমাদের প্রশাসনিক উত্তরাধিকারের উৎসও এক। সেটি ব্রিটিশ প্রবর্তিত শাসন ও বিচারব্যবস্থা। স্বাধীনতার পর ভারত এদের গঠনকাঠামোতে তেমন কোনো পরিবর্তন না এনে ভারতবাসীর স্বার্থকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়ার দর্শনে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হয়েছে। একটি মেধাবী, দক্ষ, কর্মনিষ্ঠ প্রশাসনব্যবস্থা তারা সফলভাবে তৈরি করেছে। আর আমাদের যাত্রা অনেক ক্ষেত্রে উল্টো পথে বললে ভুল হবে না। ভারতের একজন কর্মকর্তার ওপর সরকারের অবিচার ও এর প্রতিকারের নজিরটির সঙ্গে আমাদের অবস্থান তুলনা করার সুযোগই নেই। এভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে চান এমন কর্মকর্তা আমাদের আছে সব ক্যাডারেই। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে চেষ্টাও করেন। কিন্তু তাঁদের উদ্যোগ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় সূচনাতেই। সরকারপরম্পরায় তা-ই করে চলছে।
সাম্প্রতিক কালের একটি ঘটনা। পাবনার একজন জেলা প্রশাসক রাজনৈতিক মহলের অনৈতিক চাপ উপেক্ষা করে নিয়মনীতির মধ্যে তাঁর কার্যালয়ে কতিপয় নিম্নপদস্থ কর্মচারী নিয়োগ দিতে সচেষ্ট হন। প্রতিরোধ আসে। তছনছ করা হয় পরীক্ষাকেন্দ্র। নাজেহাল করা হয় পরীক্ষা পরিচালনাকারী পদস্থ কর্মকর্তাদের। ভন্ডুল হয়ে যায় জেলা প্রশাসকের আইনানুগ প্রচেষ্টা। মামলা হয় বটে। কয়েক দিন হাজতবাস করেন কিছু ব্যক্তি। কিন্তু যাঁরা মূল সাক্ষী হবেন, সেই সব কর্মকর্তাসহ জেলা প্রশাসককে ত্বরিত বদলি করে দেওয়া হয়। ফলে প্রমাণের অভাবে খালাস পেলেন সব আসামি। ঘটনাটি অন্য সব কর্মকর্তাকে এ ধরনের অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে সতর্কসংকেত দিল। আর সবুজ সংকেত পেলেন অবৈধ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিরা।
কথায় কথায় ইউএনওরা অপদস্থ হন ক্ষমতায় যারা থাকে, তাদের কর্মী-সমর্থকদের হাতে। এখন ওসিরাও হচ্ছেন। অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদেরও হরহামেশাই এরূপ পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। আছে হয়রানিমূলক বদলি আর ওএসডি করার বিষয়টিও। অকালীন অবসর দেওয়া হয় ক্ষেত্রবিশেষে। তাই প্রায় সবাই পিছু হটার নীতি নিয়ে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট। কেউবা দলীয় সমর্থক সেজে ভাগ-বাঁটোয়ারার উৎসবে মেতে উঠেছেন। তাহলে আইনের শাসন কিংবা সুশাসন কীভবে প্রতিষ্ঠিত হবে? যাঁরা নিজেদের রক্ষার চেষ্টায় সদা সচেষ্ট, তাঁরা দুর্বলকে কীভাবে রক্ষা করবেন? দুর্জনের গায়ে হাত তোলার সাহস আদৌ তাঁদের থাকার কথা নয়।
ভারতের ঘটনাটিও কিন্তু অভিনব নয়। কয়েক বছর আগে তো বিহারের একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। কিন্তু অপরাধীরা সেখানে দণ্ডিত হয়েছে। এ ধরনের যেকোনো ঘটনায় ভারতের সুশীল সমাজ সোচ্চার হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও হয়। তবে দুর্ভাগ্য, আমাদের এ সমাজ খুব সংগঠিত নয়। আর বিভক্তির ছাপ এখানে প্রকট। আমরা বিস্মিত ও আহত হই, যখন দেখি সমাজের শ্রদ্ধাভাজন ও বিবেকবান কোনো কোনো ব্যক্তি নিছক দলীয় সমর্থকের ন্যায় মতামত দিচ্ছেন। তবু ক্ষীণকণ্ঠেও এ সমাজই, বিশেষ করে এর অন্যতম অঙ্গ গণমাধ্যম প্রতিবাদী হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। পাবনার ঘটনায়ও হয়েছিল প্রায় সব পত্রপত্রিকা। সোচ্চার হয়েছিল অবিচারের বিরুদ্ধে।
এটা ঠিক, উপরস্থ কর্মকর্তারা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের অধস্তনদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন না। তাঁরা আইন ও জনস্বার্থের বিষয়টি বারংবার রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে পারেন। তদুপরি এমন কিছু কর্মকর্তাও হেনস্তার শিকার হন, যাঁরা সুধী সমাজে সমাদৃত নন। কেউ কেউ তাঁদের অতিরক্ষণশীল আচরণ আর কেউবা দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে। আবার কোনো কোনো কর্মকর্তা দলবাজি করে সেই দলের অন্য কারোর কাছে নাজেহাল হন। এঁদের সমর্থনে সুশীল সমাজ এগিয়ে আসবে, এটা আশা করা যায় না। কিন্তু সবাই তা নন। অনেক ব্যতিক্রম আছেন। তাঁরা দাবি রাখেন, অবিচারের মুখোমুখি হলে সুশীল সমাজের নৈতিক জোরালো ও কার্যকর সমর্থন। এ ধরনের সমর্থন ও অব্যাহত প্রচেষ্টা এসব বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকার সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তা আছেন বেশ কিছু। এ ক্ষেত্রে যেটুকু ঘাটতি, তার পেছনেও যেসব কারণ রয়েছে, সে বিষয়েও সুশীল সমাজ জোরালো অবস্থান নিতে পারে। নিয়োগকালে বিবেচনাহীন কোটা পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য মেধার বঞ্চনা, অপ্রতুল বেতন-ভাতাদি আর পদায়ন ও পদোন্নতিকালে রাজনৈতিক বিবেচনা মেধাবীদের সামনে আসার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।
বাংলাদেশের কোনো কোনো কর্মকর্তা প্রচেষ্টা নিয়েও পরিবেশগত কারণে সফল হন না। এঁদের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতি জানাতে আমরা ক্ষেত্রবিশেষে কার্পণ্য দেখাই। কেউ কেউ বিনা কারণে হয়রানিরও শিকার হন। যেমন রামুর বৌদ্ধপল্লিতে হামলা শুরু হওয়ার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তথাকার ইউএনও দেবী চন্দ। ত্বরিত সহায়তা কামনা করেন দলনির্বিশেষে সব জনপ্রতিনিধি ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, হিংস্র মারমুখো ব্যক্তিদের নেতৃত্বে পরিচালিত এ পৈশাচিক কাজটি দমনে তিনি সফল হননি। তবে এ সাহসী কর্মকর্তা উন্মত্ত জনতাকে দেখে মধ্যরাতে পালিয়েও যাননি। প্রচেষ্টা চালিয়েছেন বিভিন্নভাবে। এ ঘটনা প্রতিরোধে তাঁর কোনো ধরনের শৈথিল্য ছিল না—এটি প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকের মতামত। ব্যর্থতা ছিল অন্য কারও কারও। ঘটনার পর কিছু কর্মকর্তা বদলি হন। একপর্যায়ে তাঁকেও বদলি করা হয়। অথচ তথায় তাঁর নির্ধারিত মেয়াদকাল অসম্পূর্ণ ছিল।
এ ধরনের বদলি তাঁর জন্য গ্লানিকর ও মনোবল ভেঙে দিতে প্রভাব ফেলতে পারে। একজন সাহসী, নিষ্ঠাবান কর্মকর্তার ভূমিকা অনালোচিতই রইল। বরং পরোক্ষ শাস্তি পেলেন তিনি। এসব বিষয় যদি আমরা খতিয়ে না দেখি, তবে দেবী চন্দরা দুর্গাশক্তি নাগপালের মতো হবেন কবে? আর কীভাবে? আর জনপ্রশাসন আজ সময়ের চাহিদার সঙ্গে সাড়া দিতে তো দরকার দুর্গাশক্তি নাগপালের মতো কর্মকর্তা।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.