শেষ পর্বে হিংসা ও সন্ত্রাসের সাক্ষী থাকল পশ্চিমবঙ্গ
যাবতীয় আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে গতকাল সোমবার লোকসভা নির্বাচনের শেষ পর্বে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ব্যাপক হিংসা ও সন্ত্রাসের সাক্ষী থাকল। সকাল থেকেই বুথ দখল, বিরোধী দলের এজেন্টদের বুথ থেকে জোর করে েবর করে দেওয়া এবং ভোট দেওয়া ঠেকাতে গ্রামবাসীর ওপর সশস্ত্র হামলার অসংখ্য ঘটনার খবর আসতে শুরু করে। প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই অভিযোগের তির শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে। সবচেয়ে বড় হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে বসিরহাট লোকসভা আসনের অন্তর্গত হাড়োয়া বিধানসভা এলাকার ব্রাহ্মণচক গ্রামে। সেখানে প্রায় ২০০ গ্রামবাসী তৃণমূল কংগ্রেসের সন্ত্রাসে দীর্ঘদিন গ্রামছাড়া থাকার পরে মাত্র দুদিন আগে গ্রামে ফিরেছিলেন ভোট দিতে। এদিন সকালে তাঁরা একসঙ্গে বুথের উদ্দেশে রওনা দিলে একদল দুষ্কৃতকারী তাঁদের ওপর গুলি চালায়৷ এতে একজন নারীসহ চারজন গুলিবিদ্ধ হন৷ আরও ১৭ জন চপার ও অন্যান্য ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন। দুষ্কৃতকারীদের নেতৃত্ব দিতে স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক ঊষা রািন মণ্ডল ও তাঁর স্বামীকে দেখা গেছে বলে গ্রামবাসী অভযোগ করেন। বহরমপুর, বনগাঁ, ব্যারাকপুর, দমদম, জয়নগর মথুরাপুর, কাঁথি, ঘাটাল, যাদবপুর, দক্ষিণ কলকাতা, উত্তর কলকাতাসহ বিভিন্ন আসন থেকে গন্ডগোলের খবর পাওয়া গেছে৷ শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের সশস্ত্র লোকজন বুথে ঢুকে বিরোধী এজেন্টদের বের করে বুথ দখল করেছে।
কোথাও কোথাও বিরোধীদের বুথে না আসতে হুমকি দেওয়া হয়৷ হামলা থেকে নারীদেরও নিষ্কৃতি মেলেনি। প্রায় প্রতিটি জায়গায় রাজ্য পুলিশ উপস্থিত থাকলেও গুন্ডামিতে বাধা দেয়নি। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কোথাও কোথাও দেখা গেলেও তাদের স্থানীয় প্রশাসনের আজ্ঞাবহ করে রাখায় তারাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় ছিল৷ সকাল থেকেই সংবাদমাধ্যম দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জায়গার ভোট-প্রক্রিয়ায় হিংসার মাধ্যমে বাধা দেওয়ার খবর পরিবেশন করলেও রাজ্যে নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক সুধীর কুমার রাকেশ দুপুর পর্যন্ত দাবি করেন, ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই চলছে। পরে দিল্লি থেকে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে তিনি হাড়োয়ার গ্রামে যান ও পুলিশকে অবিলম্বে তৃণমূলের সেই বিধায়ককে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের মুখে রাকেশ স্বীকার করেন, পুলিশ প্রশাসন গ্রামবাসীর নিরাপত্তা ও ভরসা জোগাতে ব্যর্থ। এর পরই পুলিশ সেই বিধায়ক ও তাঁর স্বামীর খোঁজে তাঁদের বাড়ি তল্লাশি করে। কিন্তু তাঁদের পাওয়া যায়নি। আগের দফায় ভোট চলাকালে বাঁকুড়া আসনে এক জায়গায় স্থানীয় বিধায়ক দলবল নিয়ে বুথে ঢুকে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও তাঁর সহকর্মীদের মারধর করে পরে গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপন করেন। নির্বাচন কমিশন আশ্বাসের পরও ভোট দিতে না পেরে বিভিন্ন এলাকায় মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখায়। বনগাঁ আসনের কল্যানীতে বুথ দখল করে শাসক দল ছাপ্পা ভোট দিচ্ছে বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হলেও তারা হস্তক্ষেপ করেনি৷
এরপর ক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বনগাঁয় সিপিএম প্রার্থী দেবেশ দাস দাবি করেন, কল্যানীতে অন্তত ৫০টি বুথ দখল করেছে তৃণমূল কর্মীরা। ব্যারাকপুরের এক গ্রামে ভোটাররা ভোট দিতে না পারায় ক্ষোভে নির্বাচন কমিশনের পরিদর্শকের গাড়ি ভাঙচুর করেন। এবারের নির্বাচনে বারবারই একশ্রেণির প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যেই শাসক দলের হয়ে পক্ষপাতিত্ব করতে দেখা গেছে। টেলিভিশন ক্যামেরায় ধরা পড়েছে বিষয়টি৷ এ নিয়ে হইচই হলে নির্বাচন কমিশন হাতে গোনা কয়েকজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে সরিয়েছে, তবে প্রকৃত সংখ্যাটা অনেক বেশি বলেই ইঙ্গিত পাওয়া েগছে। গতকাল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ডায়মন্ডহারবার আসনের বিষ্ণুপুরে একটি বুথে বিরোধী দলের এজেন্টদের েবর করে দিয়ে ছাপ্পা ভোট দিতে দেখে একটি নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করলে তিনি ফোনে বাইরে খবর পাঠিয়ে সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীদের ডেকে আনেন। তারা সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানকে মারধর করে, ক্যামেরা ভেঙে পাশের পুকুরে ফেলে দেয়। দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেস প্রার্থী মালা রায় অভিযোগ করেন, গার্ডেনরিচে বহু বুথেই প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা উদ্যোগী হয়ে বিরোধী দলের এজেন্টদের েবর করে দিচ্ছেন৷
হিংসার কবল থেকে কলকাতা রেহাই পায়নি। সকাল থেকেই উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিরোধী দলের এজেন্টদের মারধর, ভোটদাতাদের আটকাতে রাস্তায় রাস্তায় তৃণমূলের কর্মীরা হাজির ছিলেন। উত্তর কলকাতা কেন্দ্রের বিজেপির প্রার্থী রাহুল সিংহ দাবি করেন, এভাবে সন্ত্রাস করলেও মানুষ ব্যালট বাক্সে ঠিকই এর জবাব দেবেন। গতকাল সকাল থেকেই বুথে বুথে দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তা সত্ত্বেও ভোটের লাইনে নারী ও নতুন প্রজন্মের ভোটদাতাদের ভিড় ছিল উল্লেখযোগ্য। এই তরুণ প্রজন্মের কাছে এবারের ভোটের গুরুত্ব কতখানি, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে দমদম কেন্দ্রের দুই নতুন ভোটার উষসী মিত্র ও সোমা মিত্র। তাঁদের কথায়, নারীর নিরাপত্তা ও উন্নয়ন এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আবার, বাম জমানার অবসানের পর এখনো মমতা জমানায় শিল্পে নতুন উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ নেই। বন্ধ কারখানার সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে বেকারত্ব। উষসী ও সোমা সে কথাটাও মনে করিয়ে দিয়েছে।
No comments