অপরাধ, সমাজ ও রাষ্ট্র
তঁার কোনো নিকট আত্মীয়স্বজন ছিল না। আমরা ডাকতাম সাধু ভাই। সাধু তিনি ছিলেন না। প্রথম জীবনে তো নয়ই। ছিলেন লম্পট। তঁাকে ডাকা উচিত ছিল লুচ্চা ভাই। কিন্তু আমি যখন তঁাকে দেখি তখন তিনি লম্পট নন, নিম্ন আয়ের নিরীহ সজ্জন ব্যক্তি। জিন্দাবাহার লেনে এক ছাপাখানার দপ্তরি। ভালো বইবঁাধাই করতেন। সারা দিন বসে বসে কাজ করে রাতে নিয়মিতভাবে গঁাজা সেবন করে বুঁদ হয়ে থাকতেন। আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। আমার বইটই পড়ার অভ্যাস ছিল বলে সেই পঞ্চাশের দশকে তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন কার্ল স্যান্ডবার্গের পথে প্রান্তরে, সরদার জয়েনউদ্দিনের গল্পের বই বীরকণ্ঠীর বিয়ে, খরস্রোত প্রভৃতি বই। তিনি শুধু গাঞ্জুটিয়া ছিলেন না, ছিলেন একজন খুনি। কীভাবে তিনি সাধু আখ্যা পেলেন সেই কাহিনি তঁার মুখেই শুনেছি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যে তিনি চাকরি করতেন কলকাতার এক ছাপাখানায়। পদ্মাপারে তঁাদের গ্রামের এক প্রান্তে বাস করতেন এক বোবা জেলে ও তঁার যুবতী বউ। একবার ছুটিতে বাড়ি এসে জেলের বউয়ের সঙ্গে গড়ে তোলেন অনৈতিক সম্পর্ক। মাছ ধরতে জেলে থাকেন সারা রাত পদ্মায়। একদিন মধ্যরাতে বাড়ি ফিরে দুইজনকে ঘরের মধ্যে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে জেলের মাথার রক্ত চড়ে যায়। বঁটি দিয়ে তঁাকে মারতে উদ্যত হতেই দা দিয়ে জেলেকে তিনি কোপ দেন। রক্তপাতে জেলে মারা যান। আদালতে তিনি দোষ স্বীকার করেন। তঁার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। বছর আটেক জেল খাটার পর পঞ্চাশের শুরুতে তিনি ছাড়া পান। মুক্তি পেয়ে যখন গ্রামে আসেন, তখন তঁার দীর্ঘ চুল ও লম্বা দাড়ি। লোকে নাম দিল সাধু। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি বিয়ে করেছিলেন তঁার চেয়ে ১৫ বছরের বড় এক বিধবাকে। বছর দুই ঘর করার পর তঁাকে তালাক দেন। বিয়ে করেন তঁার চেয়ে ৩০ বছরের ছোট অতি অঁাটসঁাট শরীরের এক দরিদ্র সদ্যযুবতীকে। সন্তানসন্ততি নিয়ে এ সংসার তঁার সুখের হয়েছিল।
দোষের মধ্যে দোষ ছিল গঁাজার কলকেতে দম দেওয়া। তঁাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, খুনের মামলা করেছিল কে? জেলের বউ? তিনি বলেছিলেন, সকালে উঠানে জেলের মৃতদেহ দেখে ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বর চৌকিদারকে দিয়ে থানায় খবর দেন। থানা নিজের থেকেই মামলা করে। আমাকে গ্রেপ্তার করে চালান দিলে আমি কোনো উকিল মোক্তার রাখিনি। সরকার থেকে আমাকে উকিল রেখে দেয়। কোর্ট দারোগার সঙ্গে আমার উকিলের জেরা হতো। অর্থাৎ অপরাধী বিত্তহীন হওয়ায় তঁার আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যবস্থা রাষ্ট্রই করে দেয়। তিনি জানান, তঁার উকিল তঁাকে বঁাচানোর জন্য বা কম শাস্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। হিন্দু জেলের হত্যাকাণ্ডে মুসলমান আসািমর পক্ষে হিন্দু উকিল তঁার সাধ্যমতো পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। সেটা ব্রিটিশ আমলের একেবারে শেষের দিক। আইনের শাসন বলতে যা বোঝায় তখন তা ছিল, যদিও দেশটি ছিল পরাধীন। পাকিস্তানি আমলেও আইনের শাসনের এই ধারা অব্যাহত ছিল, যদিও দেশে গণতন্ত্র ছিল না অধিকাংশ সময়। রাজনৈতিক মামলা-মোকদ্দমা ছাড়া সাধারণ অপরাধের বিচারে কোনো রকম হস্তক্ষেপ ছিল না। পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট-আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করতেন। সে জন্য জেলা ও দায়রা জজ তো দূরের কথা, মুনসেফ পর্যন্ত সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে যেতেন না, পাছে কেউ তঁার কাছে তদবির করে। উল্লেখ করা কাহিিন থেকে যে জিনিসটি বোঝার আছে তা হলো, কোনো সভ্য সমাজে যে ব্যক্তি যেখানেই অপরাধ করুক, রাষ্ট্রের কর্তব্য তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া। পুলিশ ও প্রশাসনের কাজ অপরাধ আমলযোগ্য হলেই তা আইনের আওতায় আনা, অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা। আদালতের দায়িত্ব নিরপেক্ষভাবে বিচারকাজ সম্পন্ন করা। আসািম নিঃস্ব না বিত্তবান, অসহায় না প্রভাবশালী, তা বিবেচ্য নয়। ভাওয়ালের রাজকুমারের চাঞ্চল্যকর মামলার কথা অনেকেই জানেন। অপরাধ মধ্যরাতে নির্জনে, না দিনদুপুরে প্রকাশ্য রাস্তায় বহু লোকের সামনে সংঘটিত হলো, তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভাবার বিষয় নয়। আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, থানার পুলিশ বলে, ‘আমরা জানি না’, ‘কেউ মামলা করে নাই’, ‘অভিযোগ এলে আমলে নেব’ ইত্যাদি। এসব আইনের শাসনের কোনো কথা হতে পারে না। ওই লোকটি মধ্যরাতে পরস্ত্রীতে উপগত হয়েছিলেন। খুনেরও কোনো সাক্ষী ছিল না। জেলের বউ ছিলেন খুনির পক্ষে। থানায় কেউ এজাহার দেয়িন। সংবাদ পেয়ে পুলিশ নিজেই বাদী হয়ে মামলা করে। আসািমকে খঁুজে বের করে। চার্জশিট দেয়। মামলার সময় আসািমকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য রাষ্ট্র নিজের অর্থে তঁার জন্য আইনজীবী নিয়োগ দেয়। আইন-আদালত যদি নির্ভুল ও নিরপেক্ষভাবে নিজস্ব গতিতে চলে, তাহলে দণ্ডপ্রাপ্ত আসািমরও কোনো
No comments