পথশিশুদের সঙ্গে আনন্দঘন একদিন
‘কতদিন গোশত দিয়া খাই না। অনেক দিন পর
পেটটা ভইরা খাইছি। অনেক ভাল লাগছে।’ কথাগুলো বলছিল সুবিধাবঞ্চিত শিশু
ফিরোজ। ১২ বছর বয়সী ফিরোজকে ডিপজল নামেই চেনে তার পরিচিতরা। মা-বাবা নেই।
রাত্রি যাপন করে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায়।
ফুটপাথে।
মার্কেট, অফিসের বারান্দায়। ‘টোকাই’ ও ‘পথশিশু’ হিসেবে পরিচিত ফিরোজসহ ৪০
জন শিশু-কিশোরকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ভুঁইগড়ের হাকিমাবাদে গতকাল আনন্দময় দিন
কাটিয়েছেন কবি মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ১১টা।
হাকিমাবাদের সড়ক থেকেই শোনা যাচ্ছিল শিশু-কিশোরদের হই-হুল্লোড়। ‘মাছ ধরছি,
মাছ। বড় মাছ।’ ভেতরে ঢুকতেই চোখে দৃশ্যমান হয় ছোট্ট পুকুরে এক ঝাঁক
শিশু-কিশোরের মাছ ধরা-জলখেলা। পুকুরের পাশে কয়েকটি ঘর। একটি ধর্মীয় শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান। আছে কবি মামুনুর রশীদের বাসস্থান। বাড়িটি ‘হাকিমাবাদ খানকায়ে
মোজাদ্দেদিয়া’ নামে পরিচিত। এই বাড়ির পুকুরেই আনন্দের ঢেউ তুলেছে
সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা। কেউ উলঙ্গ, কেউ অর্ধউলঙ্গ হয়ে মাছ ধরার প্রতিযোগিতায়
জলে নেমেছে। এ সুযোগে ক্ষুদে মৎস্য শিকারিতে পরিণত হওয়া শিশুরা জানায়, ঢাকা
শহরে পুকুরে সাঁতার কাটা ও মাছ ধরার সুযোগ নেই। এরকম সুযোগ পেয়ে তারা
উল্লসিত। অনেকে জানিয়েছে, আনন্দঘন এই পরিবেশে তারা সবসময় থাকতে চায়। দুপুর
১২টার পর ডাকাডাকি, অনেকটা অনুরোধ-অনুনয় করেই তাদের পুকুর থেকে ডাঙায় ওঠাতে
হয়েছে ওই খানকায়ে মোজাদ্দেদিয়া সংশ্লিষ্ট কর্মীদের। তখন পরম মমতায়
সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুর শরীরে তেল মাখাচ্ছিলেন কবি মামুনুর রশীদের নাতি,
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র
মুহাম্মদ সোলায়মান ও কবি’র গাড়িচালক সোহাগ। চিরুনি হাতে দীর্ঘদিন
অযতেœ-অবহেলায় থাকা পথশিশুদের চুলগুলোও আঁচড়ে দিচ্ছিলেন সোলায়মান। তারপর
দুপুরের খাওয়ার পালা। না। খেতে তেমন কোন আগ্রহ নেই চঞ্চল শিশুদের। তাদের
নজর পুকুরে, পুকুরের মাছে। মূল ঘরের বারান্দায় ছয়টি সারিতে খাওয়ার জন্য
বসানো হয় শিশুদের। খাওয়াচ্ছিলেন বাড়ির নারীরা। বাড়ির সবার জন্য অভিন্ন
আয়োজন। অভিন্ন ভালবাসা। শিশুদের পাতে তুলে দেয়া হচ্ছিল গরুর মাংস, মুরগির
রোস্ট, সবজি, সঙ্গে সালাদ। সেই সঙ্গে আছে কোল্ড ড্রিংকস ও বিভিন্ন ধরনের
ফল। বাহারি আয়োজন ও অকৃত্রিম আতিথেয়তায় মুগ্ধ ক্ষুদে মেহমানরা। চোখে-মুখে
তৃপ্তির ঝিলিক। ঠোঁটে মিষ্টি হাসির আভা ছড়িয়েই তাদের অনেকে জানিয়েছে, এরকম
খাবার বহুদিন খাওয়া হয়নি। মামুনুর রশীদ তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে
করমর্দন করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তারা। একে একে করমর্দন করছিল সবাই। এক পর্যায়ে
মামুনুর রশীদ খুঁজছিলেনÑ আর কেউ করমর্দন করার বাকি আছে কিনা। আশেপাশের
সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো যে কোন বিপদে, সঙ্কটে ‘হাকিমাবাদ খানকায়ে
মোজাদ্দেদিয়া’-তে আশ্রয় নেয়। সহযোগিতা করেন খানকায়ের সংশ্লিষ্টরা। ‘মানুষের
কল্যাণকামিতাই ধর্ম’ বলে বিশ্বাস করেন মামুনুর রশীদ। এ বিষয়ে তিনি আরও
বলেন, ‘আমি বলি রিলিজিওন অব লাভ। অন্যরা বলেনÑ রিলিজিওন অব পিস। আমরা
রাসুলের সুন্নত ও পীর-আউলিয়াদের অনুসরণ করি।’ মামুনুর রশীদের অনুসারীদের
মধ্যেও রয়েছে এই বিশেষ গুণ। এরকম একজন জাফর আহমেদ সোহেল। পেশায় ব্যবসায়ী।
বাসা রাজধানীর মোহাম্মদপুরের তাজমহল সড়কে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কাছে তিনি
‘মামা’ হিসেবে পরিচিত। সমস্যায় সঙ্কটে ‘মামা’র সহযোগিতা নেন তারা। প্রায়
রাতেই জাফর আহমেদ সোহেলের অফিস কক্ষেই রাত কাটায় পথশিশুরা। তার মাধ্যমেই
পথশিশুদের ‘হাকিমাবাদ খানকায়ে মোজাদ্দেদিয়া’য় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কবি
মামুনুর রশীদ। মোহাম্মদপুর ও এর আশেপাশের এলাকা থেকে রাজধানী পরিবহনের একটি
বাসে করে পথশিশুদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। আনন্দঘন দিন শেষে সন্ধ্যার আগেই
তাদের ফেরার পালা। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুরা বাসে উঠছিল আর
বলছিল-‘আবার আসমু।’
No comments