শ্রদ্ধাঞ্জলি- রংগলাল সেন: কীর্তিময় জীবন by শিপ্রা সরকার
বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও
সমাজ উন্নয়নের ধারায় বিশিষ্ট ও উজ্জ্বল নাম রংগলাল সেন (১৯৩৩-২০১৪)। দীর্ঘ
৮০ বছরের এক কীর্তিময় জীবন অতিবাহিত করে গত ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোকগমন
করেন। একজন প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে তিনি রেখে গেছেন অতুল কীর্তির স্বাক্ষর।
বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান নামের জ্ঞানকাণ্ড বিকাশে রংগলাল সেনের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক এ কে নাজমুল করিমের নেতৃত্বে এ দেশে সমাজবিজ্ঞান চর্চার যাঁরা গোড়াপত্তন করেন, ড. রংগলাল সেন তাঁদের অন্যতম। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে একাডেমিক বিষয় হিসেবে সমাজবিজ্ঞানশাস্ত্র যখন তেমন পরিচিতি লাভ করেনি, তখনই তিনি এই শাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন। ইউনেসকোর সহযোগিতায় ১৯৫৭-৫৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা পায়। রংগলাল সেন ছিলেন এই বিভাগের কৃতী ছাত্র, ছিলেন এই বিভাগের নন্দিত অধ্যাপক। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সঙ্গে ছিলেন সংশ্লিষ্ট।
রংগলাল সেন ছিলেন একজন কৃতী শিক্ষক। শিক্ষকতাকেই তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ পেশা হিসেবে বিবেচনা করতেন। আপন অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ক্লাসে তিনি যথাসময়ে উপস্থিত হতেন, ঘণ্টা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি শ্রেণীকক্ষেই পাঠদান করতেন। পরীক্ষার উত্তরপত্র তিনি যথাসময়ে শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে দেখিয়েছেন, কখনো ‘অনিবার্য কারণে বিলম্ব হয়েছে’ এমন কথা তাঁকে বলতে শুনিনি। উত্তরপত্র পরীক্ষা করতেন নিখুঁতভাবে, প্রতিটি শব্দ তিনি পাঠ করতেন।
এমএসএস শ্রেণীতে আমি গবেষণাপত্র রচনা করি রংগলাল সেনের তত্ত্বাবধানে। সে সময় দেখেছি, কী নিপুণভাবে তিনি প্রতিটি শব্দ নিরীক্ষা করছেন—বলতে গেলে প্রায় প্রতিটি বাক্যে স্যারের লাল কালির স্পর্শ লেগেছে। নিষ্ঠাবান আদর্শ শিক্ষক বলতে যা বোঝায়, রংগলাল সেন ছিলেন তার উজ্জ্বল প্রতিমূর্তি। নিজে রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত থাকলেও শিক্ষার্থীর প্রতি তাঁর ব্যবহার কিংবা উত্তরপত্র মূল্যায়নে তিনি ছিলেন এক আদর্শবাদী নিরপেক্ষ মানুষ। এ কারণেই তাঁর প্রতি শিক্ষার্থীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল কিংবদন্তিতুল্য, ছিলেন তিনি জনপ্রিয় শিক্ষক।
রংগলাল সেন শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষক আন্দোলনেও রেখেছেন উল্লেখযোগ্য অবদান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম সারির একজন সংগঠক। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য, শিক্ষকদের পেশাগত স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি ছিলেন সর্বদা সরব ও সনিষ্ঠ। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলাদেশের শিক্ষক আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। এই সংগঠনের নেতা হিসেবে তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন প্রগতিশীল শিক্ষক আন্দোলন।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ড. সেনের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সদস্য, ছিলেন ওই সংগঠনের বিশিষ্ট এক নেতা। একজন কমিউনিস্ট হিসেবে বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ড. সেনকে দেখা যেত প্রথম সারিতে। প্রগতিশীল রাজনীতিচেতনা আর অসাম্প্রদায়িক মানস-প্রবণতা ছিল তাঁর জীবনদর্শনের মৌলভিত্তি। কঠিন বিপর্যয়ের মুখেও এই আদর্শ থেকে তিনি কখনো বিচ্যুত হননি—সমষ্টির স্বার্থকে তুচ্ছ করে কখনোই তিনি ব্যক্তিস্বার্থকে বড় করে দেখেননি। বরং বলা যায়, সমাজস্বার্থের কথা বিবেচনা করে ব্যক্তিস্বার্থকে তিনি সর্বদা তুচ্ছ ভেবেছেন—মানুষের কল্যাণ আর মঙ্গলই ছিল তাঁর সব কর্ম ও ধ্যানজ্ঞানের মৌল ব্রত।
একজন সনিষ্ঠ লেখক হিসেবে রংগলাল সেনের অবদান বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়। এ দেশে সমাজবিজ্ঞান-শাস্ত্রটিকে জনপ্রিয় করার মানসে তিনি গবেষণা করেছেন, রচনা করেছেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশের এলিট শ্রেণীর ওপর গবেষণা করে তিনি অর্জন করেছেন পিএইচডি ডিগ্রি। সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে তিনি রচনা করেছেন গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই। তাঁর এসব বইয়ের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: বাংলাদেশের সামাজিক স্তরবিন্যাস (১৯৮৫), সমাজকাঠামো: পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র (১৯৯৭), প্রারম্ভিক সমাজবিজ্ঞান (বিশ্বম্ভরকুমার নাথ সহযোগে, ২০০৩), Middle Class Elites Civil Society And Other Essays (২ খণ্ড, ২০১১) প্রভৃতি। অনুবাদক হিসেবেও তাঁর ভূমিকা স্মরণীয়। জর্জ সিমসনের Man is Society তিনি অনুবাদ করেছেন মানুষের সমাজ (১৯৭২), স্যামুয়েল কোনিগের Sociology বইটি অনুবাদ করেন সমাজবিজ্ঞান (১৯৭৩) নামে।
রংগলাল সেন দীর্ঘ ৮০ বছরের এক কীর্তিময় জীবন অতিবাহিত করে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন অতুলনীয় কিছু আদর্শ। তাঁর সেই আদর্শ অনুসরণ করাই হবে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রকৃষ্ট পথ।
শিপ্রা সরকার: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
No comments