ভারতে সশস্ত্র বাহিনীর প্রভাব
আগামী মে মাসে ভারতের নাগরিকেরা পার্লামেন্টে তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার জন্য আবার ভোটের লাইনে দাঁড়াবেন। সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রতিনিধিদের মান প্রত্যাশার চেয়ে কম। তবে আমার ভরসা আছে, আগামী সংসদ তুলনামূলকভাবে উৎকৃষ্ট হবে, কারণ আম আদমি পার্টির আবির্ভাব দেশের রাজনীতির চালচিত্র বদলে দিয়েছে। এটি এখন আগের চেয়ে কিছুটা পরিষ্কার ও স্বচ্ছতাপূর্ণ। আরেকটি লোকসভা (ধারাক্রম অনুযায়ী ১৫তম) তার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করল। বিদায়ী সংসদের কার্যক্রম সত্যিই ছিল চরম তিক্ততা আর হট্টগোলে ভরা। এটি একটি দুঃখের বিষয় যে, গণতান্ত্রিকব্যবস্থাকে প্রতিনিধিত্বকারী এ প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ জাতীয় পার্লামেন্ট, এশিয়ার অনেক দেশেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। তার পরও সশস্ত্র বাহিনীর ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিষয়টি আমার পছন্দ নয়। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি যথার্থই বলেছেন, ভারতে কখনোই সেনা অভ্যুত্থান হতে পারে না। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে স্বাধীনতা লাভের পর সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বেছে নেওয়ার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু একই রকম মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, ভারত দেশ হিসেবে বেশি রকম বড় আর এখানে রয়েছে বহুসংখ্যক বর্ণ, সম্প্রদায় ও ধর্মের উপস্থিতি। তবে আমার উদ্বেগটা হচ্ছে প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনীকে মতামত দেওয়ার যে সুযোগ দেওয়া শুরু হয়েছে, তা নিয়ে। সিয়াচেন হিমবাহে সেনা মোতায়েনের বিষয়টিই ধরা যাক।
এর কোনো কৌশলগত গুরুত্ব নেই—বেশ কয়েকজন সাবেক শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা এ কথা বলার পরও কি তা করার দরকার ছিল? যদি তার বিপরীতটাও ঠিক হয়, ভারত ও পাকিস্তানের দুই পররাষ্ট্রসচিব একটি মতৈক্যে পৌঁছার পর আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর উচিত ছিল ওই সিদ্ধান্তের আলোকে কাজ করা। কিন্তু তাঁরা বরং এটিকে স্থবির করে দিলেন। দুর্গম ওই ভূখণ্ডকে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ হিসেবে রেখে দেওয়ার বদলে সেখানে উভয় দেশ সেনা মোতায়েন করেছে। সেখানে নিয়মিতভাবে ঘটছে প্রাণহানি। আরেকটি উদাহরণ হতে পারে আর্মড ফোর্সেস (স্পেশাল পাওয়ার্স) অ্যাক্ট (এএফএসপিএ)। এই বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে সন্দেহবশত একজন ব্যক্তিকে আটক, এমনকি হত্যা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীকে কোনো আইনগত ব্যবস্থার সম্মুখীন হতে হবে না। উত্তর-পূর্ব ভারতে বহুদিন ধরে এটি বহাল আছে। সরকারের নিযুক্ত একটি কমিটি ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে অভিমত দিয়ে এটি প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীরই জয় হয়েছে, যার ফলে এএফএসপিএ এখনো বহাল আছে। জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ তাঁর রাজ্যকে ওই আইনের আওতা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য নয়াদিল্লির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছেন। এমনকি প্রকাশ্যেও এ বিষয়ে কেন্দ্রের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর আরজিতে সাড়া দিচ্ছে না, কারণ সশস্ত্র বাহিনী চায় এএফএসপিএ বহাল থাকুক। জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়ার মতো সাধারণ ছাড় পর্যন্ত দিতে রাজি হয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক বিষয় হচ্ছে জম্মু ও কাশ্মীরের পাথরিবালের ‘এনকাউন্টার’ (বন্দুকযুদ্ধ) নিয়ে তদন্তের ঘটনা। সেনাবাহিনী বলছে, তারা সেখানে পাঁচজন ‘সন্ত্রাসবাদীকে’ হত্যা করেছে।
তবে স্থানীয় গ্রামবাসী বলছেন, নিহতরা ছিল সাধারণ নিরপরাধ মানুষ। কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (সিবিআই) বিষয়টি তদন্ত করে সুপ্রিম কোর্টের কাছে এর প্রতিবেদন দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ওই পাঁচ ব্যক্তিকে হত্যা করে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা বন্দুকযুদ্ধের কাহিনি সাজানো হয়েছে। কুপওয়ারার ডেপুটি কমিশনার এস এম ইয়াসিন তাঁর ২৩ বছরের নীরবতা ভেঙে সম্প্রতি বলেন, ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কোনাম পশপোরা এলাকায় সংঘটিত কথিত গণধর্ষণের বিষয়ে প্রতিবেদনের ভাষ্য বদলে দেওয়ার জন্য তাঁকে হুমকি ও পদোন্নতির প্রস্তাব—দুই-ই দেওয়া হয়েছিল। এটা সত্যিই অদ্ভুত যে সেনাবাহিনী সে রকম ঘটনা আদৌ ঘটেনি বলেই দাবি করে। শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা এভাবে নিজেদের নির্দোষ বলে ঘোষণা করায় জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার বোধ আর ক্ষোভ কেবল বেড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত, সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারকের নেতৃত্বে ভুয়া বলে সন্দেহ হওয়া বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাগুলোর তদন্ত করা। এদিকে পাথরিবাল এনকাউন্টারের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২০১২ সালের জানুয়ারিতে সম্ভাব্য এক অভ্যুত্থানের খবর প্রকাশ পায়। দুটি সেনা ইউনিট (একটি সাঁজোয়া ব্যাটালিয়ন) আগ্রা থেকে দিল্লি অভিমুখে অগ্রসর হয়। রাজধানীর সীমানার মধ্যে কোনো ধরনের সেনা চলাচলের জন্য পূর্বানুমতির বিধান রয়েছে। কিন্তু সেনা ইউনিট দুটি অনুমতি ছাড়াই অগ্রসর হয়। প্রতিরক্ষাসচিব মিলিটারি অপারেশনসের মহাপরিচালক (ডিজিএমও) লে. জেনারেল এ কে চৌধুরীকে মধ্যরাতে তলব করে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ক্ষোভ ও উদ্বেগের বিষয়টি প্রকাশ করার পরই কেবল সেনা ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
তখন একটি দৈনিক পত্রিকা খবরটি প্রকাশ করলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি তা ভিত্তিহীন বলে নাকচ করে দিয়েছিলেন। কয়েকজন শীর্ষ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা একই প্রতিক্রিয়া দেন। কিন্তু লে জেনারেল এ কে চৌধুরী অবসর গ্রহণের পর খবরটির সত্যতা নিশ্চিত করেন। আরও চমকে দেওয়ার মতো খবর দিয়েছেন বিমানবাহিনীর তখনকার প্রধান এন এ কে ব্রাউন। তিনি বলেছেন, দিল্লির কাছে অবস্থিত হিন্দন বিমানঘাঁটিতে সি ১৩০ বিমানে তোলার সম্ভাবনা যাচাই করতে ছত্রীসেনাদের তৈরি করা হচ্ছিল। এর পরও প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, এটি ছিল ‘নিয়মিত প্রশিক্ষণ মহড়া’। ডিজিএমও-কে সচিবের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দেওয়ার পর সেনারা সত্যিই আগ্রা ফিরে যাচ্ছে কি না, তা যাচাই করতে সরকারের তরফ থেকে একটি হেলিকপ্টার পাঠানো হয়। এতে স্পষ্ট হয়ে যায়, এর পেছনে নিছক সেনা মোতায়েনের চেয়েও বড় কিছু আছে। ওই দিনটিতেই তখনকার সেনাপ্রধান ভি কে সিং তাঁর জন্মতারিখ নিয়ে মামলায় সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। এ কারণেই সরকার সেনা ইউনিটের চলাচলের বিষয়টিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিল। ওই ‘নিয়মিত মহড়ার’ প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রবল অস্বীকৃতির পরও একে অস্বীকারের পর্যায়ে ফেলে রাখা যায় না।
আর বেসামরিক বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনীকে সীমিত পরিসরেও কথা বলার সুযোগ দেওয়া শুভ লক্ষণ নয়। ভারতের সশস্ত্র বাহিনী বরাবর রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছে, যা তাদের পেশাগত প্রশিক্ষণ ও অঙ্গীকারের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন; যেখানে কিনা পাকিস্তান ও বাংলাদেশ অতীতে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। উপমহাদেশের এ দেশ দুটির সেনাবাহিনীও ভারতের মতো একই প্রশিক্ষণ পেয়েছে। তার পরও তারা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেছে। সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে গেলেও সেখানে তাদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। ভারতের সেনাবাহিনী একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তাদের নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন এবং তা মেনে চলে। তবু আমি যে দৃষ্টান্তগুলোর উল্লেখ করলাম, সেগুলোকে গুরুতর সতর্কবাণী হিসেবে নেওয়া উচিত। ভারতের মাটিতে গণতন্ত্রের চেতনা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হলেও একে অবধারিত বলে ধরে নেওয়া যাবে না। কোনো সেনা কর্মকর্তার উচ্চাভিলাষের ক্ষুদ্র নজিরও সবিস্তারে তদন্ত করে দেখতে হবে। সশস্ত্র বাহিনীর কাজ হচ্ছে দেশের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা। আর তাদের কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নির্বাচিত সরকারের। এটা একেবারেই মৌলিক বিষয় এবং একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোতে এ নিয়ে কোনো আপস করা চলবে না।
No comments