গার্ড সাহেব by অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
'বাবু, কিতাব!' ঠিক বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ির ঘা পড়ে। শুনেও শোনে না নিবারণ। ঘুমের ঘোরে পাশ ফেরে একবার।
কিন্তু ও-ডাক কি ভুল শোনবার? কল-পিওন আবার হাঁক পাড়ে : 'গার্ডবাবু, কিতাব হ্যায়।' বই হয়েছে! তার মানে সর্বনাশ হয়েছে।
কিন্তু ও-ডাক কি ভুল শোনবার? কল-পিওন আবার হাঁক পাড়ে : 'গার্ডবাবু, কিতাব হ্যায়।' বই হয়েছে! তার মানে সর্বনাশ হয়েছে।
দুখানা ছোট-ছোট কুঠুরিতে অধস্তন কোয়ার্টার। উনুনে আগুন দিচ্ছে লতিকা। ডাক শুনে সেও আঁতকে ওঠে।
'বাবু, কিতাব!'
সমস্ত সংসার-শান্তির উপরে উদ্ধত বজ্র।
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে লতিকা। সত্যি-সত্যি কল-পিওন। নিজের চুল ছিঁড়বে না কল-পিওনের কিতাবটা_বুঝে উঠতে পারে না।
'এ কি, আজ না তোমার রেস্ট বেশি হবে বলেছিলে?'
'হ্যাঁ, রোস্টার আজ ভালো ছিল। ভেবেছিলাম_' গলায় স্বর ফোটে না নিবারণের।
কিন্তু চোখ ফোটাও। পিওন কল-বুকটা চোখের সামনে মেলে ঘরে। হ্যাঁ, সই করো। দেখে নাও ঠিকঠাক। কোন ট্রেন, ইয়ার্ডে কোন লাইনে আছে, কোথায় যেতে হবে এ-যাত্রা। সব বিতং করে লেখা আছে বইয়ে। দেখে নাও। মনে মনে টুকে রাখো।
'তবে কী হবে!' লতিকা ককিয়ে ওঠে।
'আর কী হবে!' তক্তপোশ ছেড়ে উঠে পড়ে নিবারণ।
দশ বছর আগে এমন দিনে তাদের বিয়ে হয়েছিল। প্রথম পাঁচ বছর তারা ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়িয়েছে_নিবারণ মেসে, লতিকা বাপের বাড়ি, নয়তো বা শ্বশুরবাড়ির কোনো আত্মীয়ের আশ্রয়ে। ছ বছরের মাথায় তারা প্রথম কোয়ার্টার পায় ইনসাইড কোয়ার্টার। সেও দু-কুঠুরিরই আস্তানা_একটার মধ্যে আরেকটা ঘর। এবার, দশ বছরের বার, পাশাপাশি ঘরের কে-টাইপের কোয়ার্টার পেয়েছে। সামান্য একটু ভদ্রতা এসেছে বসবাসে। ইলেকট্রিক আলো হলে আরো একটু সুন্দর হতো। রেন্ট-সেকশানের বড়বাবুকে ধরেছিল নিবারণ_তিনি একটা আঙুল তুলে দেখিয়েছিলেন। তার মানে ঘুষ চাই এক শ টাকা।
বড় ছোট ঘরে, ছোট জীবনের মধ্যে আছে নিবারণ। স্ত্রীর সঙ্গে খুব একটা সংকীর্ণ সম্বন্ধের মধ্যে একটু অন্য রকম অর্থ দিতে চেয়েছিল আজ। আনতে চেয়েছিল একটু অন্য রকম লাবণ্য। ঠিক করেছিল, আজ, দশ বছর বাদে এই প্রথম, সে তার বিয়ের তারিখে একটু উৎসব করবে। উৎসব আর কি, কজন বন্ধুবান্ধবকে ডেকে একটু চা খাওয়ানো, চায়ের সঙ্গে কিছু না-হয় খাবার তৈরি করে দেবে লতিকা। বাইরে বসবার ঘরের মতো করতে পারা যাবে একটা ঘরকে। তাই যা সুবিধা। বন্ধুরা কিন্তু জানতেও পাবে না কেন কী হচ্ছে_শুধু জানবে তারা দুজনে, একটু বা নতুনতর অর্থে। কিছু ফুল জোগাড় করবে হয়তো। বিশেষ একটি অনুভবের লালিত্যে ফর্সা ও আস্ত একখানা শাড়ি পরবে লতিকা, বিকেলের দিকেই না-হয় দাড়ি কামাবে নিবারণ। মুহূর্তের জন্যে হোক, তবু সব আবার কেমন নতুন মনে হবে, মনে হবে আরম্ভের মতো, অজানার মতো_
রাত-ভোর ডিউটি করে সকাল চারটেয় আজ ফিরেছে নিবারণ। বাড়ি ফেরবার আগে রোস্টার দেখে এসেছে, অবস্থা বেশ ভালো_অনেক নম্বর গার্ড 'ইন' করেছে আজ। এমনিতে ডিউটির পর বারো ঘণ্টা মামুলি রেস্ট, তবে রোস্টারে বেশি গার্ড 'ইন' থাকলে আশা থাকে যে পালা আরো দূরে গিয়ে পড়বে। কিন্তু বিপদ এই, মামুলি রেস্টের পর সব সময়ে বাড়িতে তৈরি থাকো কখন 'কিতাব' এসে হাজির হয়। আজ নিবারণ আন্দাজ করেছিল, বারো ঘণ্টার কায়েমি বিশ্রামের পর আরো কয়েক ঘণ্টা ফাউ মিলবে বোধহয়। সেই ভরসায় করতে গিয়েছিল সে এই হাঙ্গামা। কিছু ফুল-পাতা কিনেছিল, কিনেছিল কিছু গন্ধওয়ালা চা, ছোট্ট এক শিশি দামি এসেন্স।
'বন্ধুদেরও তো বলেছ'_মনে করিয়ে দেয় লতিকা।
'তেমন করে কিছু বলিনি। বলেছিলাম রোস্টার ভালো আছে, দু-চার ঘণ্টা মিলে যেতে পারে একস্ট্রা। এক হাত তাস হবেুখন এসো। আর এলেই_এটা সর্বদা উহ্য_একটু চা-টা।'
তেমন করে কিছু বলিনি। একটু যেন বাজল লতিকাকে। বলতে লজ্জা হয়েছিল নিশ্চয়ই। নিমন্ত্রিত বন্ধুরা এসে ফিরে যাবে তার চেয়ে সে-লজ্জা অনেক বেশি।
'বা, লজ্জা কী! চাকরি যখন করছি তখন চাকরি তো করতেই হবে।'
'এ চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভিক্ষে করাও ভালো।'
এই কথাটা আরো একদিন বলেছিল লতিকা। তখন ছিল তারা ইনসাইড কোয়ার্টারে, এক ঘরের মধ্যে আরেক ঘরে। শীতের রাত, পাশাপাশি শুয়ে আছে দুজনে। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে তার ওপর। বেশ একটা ঘুম-না-আসা অথচ ঘুমেরই মতন মনোহর রাত। হঠাৎ রাত দুপুরে দরজায় কে ঘা দিলে। 'বাবু! বাবু! কিতাব!' চোর-ডাকাত নয়, কল-পিওন। মাথায় ছেঁড়া ছাতা, হাতে হাতবাতি। গাড়ি বুকিং হয়েছে তারই খবর দিতে এসেছে। এখন যদি রাত বারোটা হয়, গাড়ি নিয়ে নিবারণকে বেরুতে হবে দুটোয়। দু ঘণ্টা আগে নোটিশ আসে কিতাবের। কী গাড়ি জিজ্ঞেস করছ? রাগ কোরো না_মালগাড়ি। একে গার্ড, তায় মালগাড়ির গার্ড।
তবু, তবু সেই তপ্ত শয্যা ছেড়ে উঠে পড়তে হয়েছিল নিবারণকে। দু ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিতে হবে। লতিকাকে উঠে খাবার-দাবার করে ভরে দিতে হবে টিফিন-কেরিয়ার। ইউনিফর্ম পরে গায়ে বর্ষাতি চাপিয়ে এক হাতে টিফিন-কেরিয়ার, আরেক হাতে হ্যান্ড-সিগন্যাল ল্যাম্প নিয়ে কাদা-জলের মধ্যে ছপ ছপ করতে-করতে যেতে হবে ইস্টিশান।
বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে সেদিন বলেছিল লতিকা : 'এর চেয়ে ভিক্ষে করা ভালো ছিল।'
কিন্তু আজ যেন রাগ নয়, আজ দুঃখ। সেই ছোট ঘরে ছোট হয়ে থাকার হুকুম। একটা নতুন কিছু দেখবার নতুন কিছু বোঝবার থেকে বঞ্চনা।
কাছে এসে গলা নামাল লতিকা। 'সিক রিপোর্ট করে দিলে হয় না?'
নিবারণ হাসল। সে হাসির অর্থটা ভয়ের মতন স্পষ্ট।
সেবার মিথ্যেমিথ্যি সিক রিপোর্ট করেছিল নিবারণ। ফলে বড় ছেলে অন্তুর ডবল-নিউমোনিয়া হয়েছিল। আরেকবার হয়েছিল নিজের রক্ত-আমাশা। এমনিতে কত মিথ্যের মধ্যে তো আছে তারা, ছোট-বড় কত জুয়াচুরির মধ্যে_সেগুলি যেন গায়ে লাগে না, সেগুলির যেন বোধস্পর্শ নেই কিন্তু অসুখের ভয়টা যেন বুক চেপে-ধরা, দম-বন্ধ করার মতন। লতিকা কথা ফিরিয়ে নিল তাড়াতাড়ি। বললে, 'আর কোনো উপায় নেই?'
আরেক উপায় কেতাবে সই না করা। অর্থাৎ বাড়িতে না-থাকা। মামুলি রেস্টের পর পরোয়ানার প্রত্যাশায় তুমি বাড়িতে তটস্থ হয়ে থাকবে না, এ হতেই পারে না। নিজের কর্মদণ্ড নিজেকেই সই করতে হব। তা যদি না করো, তবে তোমার জরিমানা হবে, নামিয়ে দেবে নিচু মাইনেতে, পাশ-ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করে দেবে। চাকরি করতে বসে এ-সব গুনাগারে সাধ্য থাকতে কে রাজি হয় বলো?
তবু ওরই মধ্যে জিজ্ঞেস করে লতিকা : 'এবার কোথায় ট্রেন হলো?'
'গয়া'।
যেন কত উপেক্ষার সুর। মোকামায় না গিয়ে এবার যে নিবারণ গয়া যাচ্ছে আর লতিকা যে কোথাও যাচ্ছে না, থাকছে বাড়ির মধ্যে বন্ধ হয়ে_দুই-ই যেন একই কথা।
একজন যাচ্ছে আরেকজন যে বসে থাকছে দুই-ই যেন সমান নিরর্থক।
কিন্তু এখন আর বসে থাকা চলবে না লতিকার। খাবার-দাবার তৈরি করে দিতে হবে নিবারণকে। যে উনুন সে আজ জ্বালতে যাচ্ছিল, মাখতে যাচ্ছিল যে আটা, তাতে আজও সে কোনো নতুন অর্থ দিতে পারল না।
শুরু হয় সেই মামুলি কর্মচক্র।
সেজেগুজে বেরিয়ে পড়ে নিবারণ। যেন বাজারে যাচ্ছে বা বেড়াতে যাচ্ছে_তার যাওয়ার চেহারাটা যেন এমনি। লতিকা একটু দাঁড়িয়ে পর্যন্ত দেখে না। ছেলেমেয়েগুলো কে কোথায় ছিটকে রয়েছে তার কোনো খোঁজ-খবরের দরকার নেই। যাবার আগে লতিকাকে কোনো বিষয়ে কিছু বলতে বা সতর্ক করে দিতে হবে না। কবে ফিরবে, কাল না দু-তিন দিন পর সে প্রশ্নও অবান্তর। দিন-দিন কেরানি যেমন অফিস করতে যায় এও তেমনি। এদিকে হোক মোকামা বা গয়া, ওদিকে খিদিরপুর বা চিৎপুর সব একই চর্বিতচর্বণ। একই থোড়-বড়ি-খাড়া। এতটুকু রহস্য নেই কোথাও। নেই এতটুকু কোথাও নতুনতরো অনুভূতি!
'এ-এস-এম'-এর অফিসে গার্ডের হাজিরা বইয়ে সই করে নিবারণ। ঠিক কটার সময় গাড়ি সাজানো হবে জেনে নেয়। বঙ্-গোডাউনে গিয়ে বোতলে খাবার জল ভরে। জল আর টিফিন-কেরিয়ার বাঙ্ েভরে চলে যায় অয়েল গো-ডাউনে। ওখান থেকে টেইল-ল্যাম্প নিতে হবে সই করে। ট্রেনের পিছনে যে লাল বাতি জ্বলে সেইটেই টেইল-ল্যাম্প। আরো, নিতে হবে কেরোসিন তেল। সেই তেলে হাতবাতি জ্বালাবে, জ্বালাবে টেইল-ল্যাম্প আর সাইড-ল্যাম্প। আজ চারটের সময় বই হয়েছে যখন, ষোলো আউন্স তেল পাওয়া যাবে। একটু যেন আশ্বস্ত হলো নিবারণ। তেল কিছুটা সরানো যাবে আজকে।
তেলও ভরা হলো লাইন-বঙ্।ে কী না আছে এই বাঙ্টায়! টাইমটেবল, একটা লাল আরেকটা সবুজ নিশান, টেইল-ল্যাম্প, আর সাইড-ল্যাম্পের তিনটে বার্নার, দুটো লাল স্লাইড আর ডিটোনেটর। তা ছাড়া গার্ডস মেমো-বই_তাতে লেখা থাকবে ট্রেনের নম্বর, যাবে কোথা, কটার সময় অ্যারেঞ্জ, কটা ওয়াগন_তাদের টেয়ার-ওয়েট কত, কতই বা লোড-ওয়েট_স্টেশনের কোড, কোন স্টেশন কোন সময় পার হলো তার ফিরিস্তি। তারই এক পাশে টিফিন-কেরিয়ার, জলের বোতল, গ্লাস_সঙ্গে ছোট্ট ভাঁড়ার ঘর_চাল ডাল আটা নুন তেল মসলা আলু পেঁয়াজ চা আর চিনি। হ্যাঁ, মাথার তেল-সাবান, দাড়ি কামাবার সরঞ্জামও আছে।
বাঙ্-কুলির টিন্ডেল এসে ল্যাম্প টিন্ডেলের থেকে জেনে নেয় ইয়ার্ডে কোন লাইনে গাড়ি দাঁড়িয়ে। লাইন-নম্বর বলে দেয় সে বাঙ্-কুলিকে। বাঙ্-কুলি সেই নম্বরের ট্রেনের ব্রেক-ভ্যানে তুলে দিয়ে আসে বাঙ্।
বাঙ্ পাঠিয়ে দিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইয়ার্ড-মাস্টারের ক্যাবিনে যেতে হয় নিবারণকে। সেখানে নাম্বার-টেকাররা ট্রেনের ফর্দ বা 'গাইডেন্স' বানিয়ে রেখেছে। মানে, কতগুলো ওয়াগন আছে, কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাবে, টেয়ার-ওয়েট লোড-ওয়েট কত_তার হিসেব। ফর্দ মিলিয়ে একধার থেকে গাড়ি চেক করতে শুরু করো এবার। দেখ সিল আর রিভেট ঠিক আছে কিনা,_এধার দেখেছ তো ওধার পরখ করো। বয়ে গেছে অত মিলিয়ে দেখবার। একটা মাল-গাড়ির ফুল-লোড হলো ষাট ওয়াগন_এটার মধ্যে আছে বুঝি পঞ্চান্নটা। কোথায় কোনো ফ্ল্যাপ-ডোর আলগা থাকে তো থাক না_তার কি। যারা মাল বুক করে তারা দেখতে পারে না? কিন্তু গাড়িতে গাড়িতে কাপলিং ঠিক আছে কি না, অর্থাৎ শেকল দিয়ে গাঁটছড়া বাঁধা আছে তা আঁট হয়েছে কি না_তা তো দেখবে। বয়ে গেছে। তার জন্যে মাইনে দেয়া হয় না নিবারণকে।
ওয়াচম্যানের খাতায় তাড়াতাড়ি সই করে দেয় নিবারণ। হ্যাঁ, পঞ্চান্ন ওয়াগন সিল-রিভেট করেক্ট। ঠিক আছে। ও-কে।
তারপর ড্রাইভারের সঙ্গে দেখা করে। ঘড়ি মিলিয়ে নেয়। কোম্পানির থেকে ঘড়ি দিয়েছে দুজনকে। সে যেমনতরোই ঘড়ি হোক, মিল থাকলেই হলো। গাইয়ে-বাছুরে মিল থাকলে বনে গিয়েও দুধ দেবে।
ড্রাইভার জেটিআর ফর্ম আর ফুয়েল ফর্ম বের করে দেয় নিবারণকে। জেটিআর মানে জয়েন্ট ট্রেন রিপোর্ট_কটার সময় কোন স্টেশন পার হচ্ছে ট্রেন তার হিসাব দুজনকে রাখতে হবে আলাদা। শেষ স্টেশনে পেশ করতে হবে। মিল না থাকলেই মুশকিল। তা একযাত্রায় কি পৃথক ফল হয় কখনো? কী বলো হে ইয়াসিন?
এঞ্জিনের টেন্ডারে কটন কয়লা নিয়েছো নয় টন। দেখো এই ফুয়েল-ফর্ম।
সিগন্যাল ডাউন হলেই স্টার্ট কোরো। ইয়াসিনকে বলে দিয়ে নিবারণ তার ব্রেক-ভ্যানে গিয়ে ওঠে।
হ্যাঁ, এই ইয়ার্ডে সিগন্যাল আছে। যে ইয়ার্ডে সিগন্যাল নেই সেখানে ট্রেন অ্যারেঞ্জ করলেই ঝামেলা। ড্রাইভারকে গিয়ে স্টার্টিং অর্ডার নিয়ে আসতে হবে। তটস্থ হয়ে বসে থাকো ততক্ষণ। স্টার্টার সিগন্যাল আর অ্যাডভান্স স্টার্টার সিগন্যালের মধ্যে অল-রাইট সিগন্যাল দেখাও_রাত হলো শাদা আলো দেখিয়ে, দিন হলে হাত নেড়ে, তুমিও দেখাও ড্রাইভারও দেখাক। একটু ভুলচুক হলেই কেলেঙ্কারি। ভাগ্যিস এই ইয়ার্ডটা তেমনি কানা নয়_লাল-সবুজ চোখ আছে জ্বলজ্বলে। তাই ড্রাইভারের উপর ভার দিয়ে ব্রেক-ভ্যানে গিয়ে বসেছে চুপচাপ। যখন ছাড়তে হয় ছাড়বে।
একেবারে চুপচাপ। পঞ্চান্নখানা মালবোঝাই ওয়াগনের পিছনে একা-একা চুপ করে বসে থাকা। সেই কত দূরে এঞ্জিন, সেইখানে যা প্রাণস্পর্শ। তবু তো এঞ্জিনে ড্রাইভারের পাশে ফায়ারম্যান থাকে জ্যাক থাকে_গল্প করা যায়। কিন্তু গার্ডের কেউ নেই কিছু নেই। মাইলের পর মাইল চলেছে গাড়ি, সে একেবারে একা। চলেছে বন-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, অন্ধকার চিরে-চিরে, তাকে ঘিরে সমস্ত বিশ্ব-সংসার যেন অনন্ত শূন্যে ভরে রয়েছে। তার যেন কোনো আত্মীয় নেই, প্রতিবেশী নেই_কেউ এসে তাকে খুন করে গেলেও কেউ বাধা দেওয়া দূরে থাক অস্ফুট আপত্তিও করবে না। ইয়াসিনও বুঝতে পারবে না সে খুন হলো। যদি কারা গাড়ি থামিয়ে ওয়াগন লুট করে, মুখ বাড়িয়ে একবার দেখবেও না নিবারণ। ঘুম না এলেও ঘুমুবার ভান করবে। ডাকাতদের সঙ্গে সে লড়তে যাবে নাকি খালি-হাতে। এই একটানা একঘেয়েমির চেয়ে রাস্তার মাঝে দু-একটা রাহাজানি মন্দ নয়। অন্তত খানিক লোকজনের হৈ-চৈ কানে আসে।
দশ দিক আঁধার করে রাত নেমেছে। এটা থ্রু গুডস-ট্রেন, ওয়াটারিং স্টেশনে ছাড়া থামবে না। কিন্তু মেইল ও এঙ্প্রেস, এমনকি প্যাসেঞ্জারকে পর্যন্ত আগে যাবার অধিকার ছেড়ে দিয়ে লুপে গিয়ে শান্ট করছে। কখনো বা সেকশন ক্লিয়ার পায় না, পিছনের স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রাখে।
যদি স্টেশনে এসে দাঁড়ায় তবে দু-চারটে আলো বা গোটাকয় নিশ্বাসের না-হয় আভাস মেলে। তখন আভাস মেলে। তখন আসান লাগে কিছুটা। তাইতে যারা প্যাসেঞ্জারে কাজ করে তাদের তত হয়রানি নেই। কতক্ষণ পরে-পরেই তারা মানুষের হাঁক-ডাক শোনে, নিজের সমসুখদুঃখের সঙ্গী কেউ আছে তার পরিচয় পায়। কিন্তু এখানে এ-যাত্রায় কতক্ষণে স্টেশন পড়বে! আর স্টেশন পড়লেই বা কি! প্যাসেঞ্জার কই? কই সেই সুন্দর জনকোলাহল?
নিবারণ একেবারে একা। নিরবকাশ ভাবে নিঃসঙ্গ। পঞ্চান্নটা গাড়ির পরে কোথায় ড্রাইভার আর ফোরম্যান আর জ্যাক, হাত বাড়িয়ে নাগাল পায় না কিছুতেই। মনে হয়, গাড়ি যেন কেউ চালাচ্ছে না, গাড়ি আপনিই চলেছে। যেন কোথাও থামবে না কোনোদিন। শুধু কতগুলো রাশিভূত বস্তু আর সে একাকী এক প্রাণ, এছাড়া আর কেউ নেই এই গতির উন্মুক্তিতে।
ঠিক এমনি করেই ভাববে না নিবারণ। ভাবছে আজকের জার্নিতে থ্রিল কই? ইয়াসিন কি এ-যাত্রায় কোনো মার্চেন্টের সঙ্গে বন্দোবস্তু করেনি?
প্যাসেঞ্জারের কাজ করলে অনেক সুবিধা। লোডিং মানির বখরা পাওয়া যায়। ব্রেকে যে সব মাল যায় তাতে পয়সা দেয় মার্চেন্টরা। পার্সেল-ক্লার্করাই তা উসুল করে, ভাগের পয়সা লোডিংয়ের সময় দিয়ে দেয় গার্ডকে। ধরা পড়বার ভয় নেই। আর যদি টি-টি-ই হতে পারতে, তবে 'ঝাঁপসেই' ফেঁপে উঠতে নিটোল হয়ে। 'ঝাঁপস' শোনোনি বুঝি। ও একটা মুখ চলতি টার্ম_ঝাঁ করে আপস করতে হয় বলেই সন্ধি করে ঝাঁপস। হ্যাঁ বাবা, সন্ধি করো। তোমার অন্ধিসন্ধি আমি জানি, আমারটা তুমি জানো। তবে কেন মিছিমিছি খচখচ করছ?
সুখে কাজ করে বটে গুডস ক্লার্করা_স্থায়ী ডে-ডিউটি, ঘুমের কোনো ব্যাঘাত নেই, আর উপরিও স্বচ্ছন্দ।
আর তোমাদের?
আমাদের কথা আর বোলো না। বলতেই বলে এক পা রেলে এক পা জেলে। মারি তো গণ্ডার লুটি তো ভাণ্ডার। আর চোকা কড়ি রোখা মাল। হাতে-হাতে দে রে ভাই দাঁতে-দাঁতে খাই।
কিন্তু আজ হলো কী? কোনো বন্দোবস্তই কি করেনি আজ ইয়াসিন? আজ কি ডোল-ভরা আশা আর কুলো-ভরা ছাই?
কোনো স্টেশনের বাইরে কি আজ আর গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়বে না? আসবে নাকি কোনো মার্চেন্টের সাঙ্গোপাঙ্গরা। অফ-সাইডে সিল-রিভেট না থাকে তো ভালোই, আর থাকলেই বা খুলে ফেলতে কতক্ষণ? এই জঙ্গুলে অন্ধকারে কে তাঁর খোঁজ রাখছে? সেই সব সাঙ্গোপাঙ্গরা ঢেরা-দেওয়া গাড়ি থেকে মাল খালাস করে নেবে না_চিনি বা আস্ত গম বা কেরোসিন? সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার আর গার্ডের হাত আসবে না নোটের পাঁজা?
ট্রেন যে হঠাৎ থামিয়ে দিলে তার জবাবদিহি কী? ড্রাইভার মুখে-চোখে নিরীহ-নির্দোষের ভাব এনে বলবে, কী করব, এঞ্জিনে স্টিম পড়ে গিয়েছিল, স্টিম বানাতে হচ্ছিল, কিংবা কয়লা ঝামা হয়ে গিয়েছিল, আগ বানাতে হচ্ছিল_
পরের স্টেশনে হয়তো চেক করতে আসবে ওয়াচম্যান। হয়তো খোলা দেখবে গাড়ি। দেখুকগে, বয়ে গেল। ওয়াচম্যানের বইয়ে গার্ড রিমার্ক দিয়ে দেবে, গাড়ি খুলে দিয়েছে কে মাঝপথে, জিআরপিকে না হয় তারা করে দেবে, মেসেজ পাঠাবে ওয়াচম্যান ইন্সপেক্টরের কাছে। তারপরে তোমরা ইনকোয়ারি করো। আর যার মাল খোয়া গেছে সে উলটে ক্লেম দিয়ে বা কোর্ট করে তার ক্ষতি-খেসারত আদায় করে নিক।
ওয়াচম্যানও কম যায় না। গার্ডের থেকে অল করেক্ট সই নিয়ে পরে গাড়ি খুলে মাল বার করে নেয়। গাড়ি তখন হয়তো অন্য স্টেশনে চলে গিয়েছে, ওয়াচম্যানের আর ঝক্কি নেই। ফাঁসবে তো গার্ড ফাঁসবে। তখন সে ভাঙা গাড়ি সিল করিয়ে চেকিং-এর জন্যে কেটে রেখে মেসেজ পাঠিয়ে দাও। শুরু হোক ইনকোয়ারি। গার্ড বলবে, আমি জানি কি, মাঝপথে কে কেটেছে_আর ওয়াচম্যান বলবে আমি জানি কি, এই দেখ গার্ডের অল-করেক্ট দস্তখত। আর ড্রাইভার এমন একখানা মুখ করবে যেন তিলক না কাটলেও সে পরম বৈষ্ণব। সে যে কখন কার সঙ্গে সড় করবে কেউ জানে না। সর্বাঙ্গে ঘা, ওষুধ লাগাবে কোথা? সুতরাং লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন, খেসারত দিয়ে মরো রেল কোম্পানি।
এ রকম একটাও বড় দাঁও পড়েনি নিবারণের হাতে। একবার একটা হাতে আসতে আসতে ফসকে গেল। পরের মাল চুরি করে নেয় মার্চেন্টের চর-অনুচর, এতে হাঙ্গামা বেশি। সবচেয়ে সুবিধে নিজে মাল চুরি করা। গাড়ি চিনতে দেরি হয় না, আর মাল বার করবার কায়দাটাও রপ্ত-মুখস্থ থাকে। চক্ষের নিমেষে ঘটে যেতে পারে ঘটনা।
হলোও তাই। ব্রিজ রিপেয়ার হচ্ছে, গাড়ি দাঁড় করাল ড্রাইভার। কিছু বলতে পারো না ড্রাইভারকে। হুকুম টাঙ্গানো আছে। স্টপ ডেড ফর টু মিনিটস। যেই গাড়ি দাঁড়াল, অমনি বরজলাল মাড়োয়ারীর লোক এসে তাদের গাড়ি খুলল। বাইরের চেহারা থেকেই বুঝে নিলে কোন গাড়ি। কিভাবে সিল-রিভেট ভেঙে খুলে ফেলতে হবে দরজা জানা আছে তার কল-কৌশল। গম যাচ্ছিল বস্তা করে। চক্ষের পলকে প্রায় কুড়ি বস্তা ধুপধুপ করে ছুড়ে ফেললে মাটিতে। স্টার্ট দিল গাড়ি, একটা লোক বুঝি ফাইভ মাইলস পার আওয়ার। নেমে পড়ল লোকটা। ট্রাক তৈরি ছিল রাস্তায়। বোঝাই হয়ে গেল বস্তা। বেরিয়ে গেল এক ফুঁয়ে। যেখানকার গম সেখানে গিয়ে উঠল।
নিবারণ নিরিবিলিতে দেখা করেছিল ড্রাইভারের সঙ্গে। সে তো আকাশ থেকে পড়ল। ব্রিজের মুখে গাড়ি দাঁড় করাতে হবে এ তো সরকারের হুকুম। সে কাঁটায়-কাঁটায় হুকুম তামিল করেছে_সে কিছুই জানে না। এক আঙুলে দিব্যি তুড়ি বাজিয়ে গেল সে।
বরজলালের গদিতেও খোঁজ করেছিল নিবারণ। তারা স্পষ্ট মুখ মুছলে। কে-না কে ডাকাতি করে মাল বার করে নিয়েছে তারা তার জানে কি। তারা উলটে ক্লেম দিয়েছে অফিসে। ক্লেম না মানে মোটা টাকার মামলা ঠুকবে আদালতে।
একেই বলে খাবে আবার ছাঁদাও বাঁধবে।
এ তো সামান্য চুরি। কখনো কখনো আবার তেন্নাথের মেলা হয়। ড্রাইভার, গার্ড আর ক্যাবিনম্যান_ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর_ত্রিনাথের যোগাযোগ। সেসব পুকুরচুরি না বলে বলতে পারো গুদোম চুরি। ক্যাবিনম্যান আউটার সিগন্যাল খারাপ করিয়ে রাখে। সিগন্যাল যদি কাজ না করে তবে গাড়ি চলে কী করে? ড্রাইভারকে তাই আউটার সিগন্যালের কাছে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। জে-টি-আর-এ ভালো করে কৈফিয়ত লেখে গার্ড। ডিসট্যান্ট সিগন্যাল আউট অফ অ্যাকশন। সিগন্যাল সারিয়ে ফের চালু করতে কম-সে-কম দশ-পনেরো মিনিট লাগে। আর সেই দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই চিচিং ফাঁক_যাকে বলে গুদোম সাবাড়।
এসব বড় চুরি। রাজসূয় ব্যাপার। এসব ব্যাপারে অংশ নিতে পারাও ভাগ্যের কথা। নিবারণের অদৃষ্টে ঘটনাচক্র এমনভাবে কখনোই ঘুরবে না, যাতে সে তেন্নাথের মেলায় বসে এক ছিলিম গাঁজা টানতে পারে। সে ভীরু, সে খুঁতখুঁতে।
এমনি ড্রাইভার যা জোগাড় করে দিয়েছে মাঝে-মধ্যে। পথের মধ্যে যা দু-একটা ছককাটা ফন্দি-আঁটা রাহাজানি হয়েছে তারই লাভের বখরা। নিবারণ সাতেও নেই পাঁচেও নেই, হঠাৎ খ্যাচ করে বন্ধ হয়ে গিয়েছে গাড়ি। গাড়ি বন্ধ না হলে মাল খালাসি চলবে কী করে? আর, গাড়ি বন্ধ হলেই গার্ডের তাঁবেদারিতে চলে এলে। কেননা গার্ডের হাতে জি-টি-আর, টাইমিং-এর ফিরিস্তি। অতএব গার্ডের হাতেও কিছু গুঁজে দাও।
কিন্তু সব সময়েই ছক কেটে আসে না। এসে পড়ে গ্রাম্য ডাকাতের দল। লাইনের উপরে পাথর বা গাছ ফেলে রাখে। গাড়ি দাঁড় করিয়ে লুটতরাজ করে। দু-প্রান্তের দুই লোক, কোনো সংযোগের সুবিধে নেই_তাই চুপচাপ বসে থাকো যে যার এলেকায়। আর সংযোগ থাকলেই বা কী, লুটেরাদের বাধা দেবার তোমাদের রসদ কোথায়? আর যেখানে রস নেই সেখানে রসদ থাকলেই বা কী? নাকে তেল দিয়ে ঘুমোও, ডাকাতরা চলে গেলে হাতবাতি দেখিও, স্টার্টের সিটি দেবে ড্রাইভার।
ডাকাত যদি না থাকে, খুচরো চোর আছে অগণ্য। দিলি্ল থেকে হাওড়া পর্যন্ত চলেছে এই চোরের অক্ষৌহিণী। এরা গাড়ি থামায় না বটে কিন্তু যেখানে গাড়ি থামে, স্টেশনেই হোক বা স্টেশনের বাইরেই হোক, ঠিক এসে হাজির হয় কাতারে-কাতারে। প্রত্যেকের হাতে একটা করে সরু লোহার শলা আর গলায় একটা করে বেশ খানিকটা কাপড়ের টুকরো বাঁধা। প্রতিটি গ্রামের কামারশালায় তৈরি হচ্ছে এই লোহার শলা, কারুর বা চাই লিকলিকে তলোয়ার। মালগাড়ি দাঁড়ালেই প্রতিটি ওয়াগনের ফ্ল্যাপ-ডোরের ফাঁকের ভিতর দিয়ে এরা শলা ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে খোঁচা মারে। নেহাত যদি পাট বা তামাক হয়, তা হলে অবিশ্যি কোনো সুসার নেই, কিন্তু শুকনো আর দানা-ওয়ালা বা গুঁড়ো গুঁড়ো জিনিস হলেই খোঁচা খেয়ে ঝরঝর করে বেরুতে শুরু করবে। আর সেই বেরুনো, শর্ষে কি মুশুরি ডাল, আটা কি সুজি, চিনি কি চাল_বা নিতান্ত বিড়ির শুকো_গলার কাপড় তুলে ধরে ভরে নাও এক থলে। এমনি জনে জনে, যার যেমন ভাগ্য। আর যেই গাড়ি চলল অমনি সবাই এক দাপটে পগার পার।
কি হলো আজ? বরাকর_আস্তে আস্তে ধানবাদ পেরুল_এখনো কোনো থ্রিল নেই? ড্রাইভার কি আজ একেবারে বেকার হয়ে থাকবে?
কী মনে করে বাইরে একবার তাকাল নিবারণ। একি, জমাট মেঘ করেছে যে!
বৃষ্টি শুরু হলে কী অবস্থা যে হবে এ ব্রেক-ভ্যানের, ভাবতেও মন খারাপ হয়ে যায়। ফাটা দিয়ে পড়বে জল আর ফুটো দিয়ে ঢুকবে হাওয়া। কিন্তু কে জানে বৃষ্টি শুরু হলেই বোধ হয় পার্টিরা এসে দেখা দেবে। অন্ধকার যত বেশি ঘোরালো হয়, ততই যেন চুরির সুবিধে।
সুবিধে হলেই বা কী, না হলেই বা কী, নিবারণ কী জানে! নিজের থেকে তার কোনো তোড়জোড় নেই, যন্ত্রতন্ত্র নেই। ড্রাইভার যদি কোথাও কোনো ব্যবস্থা করে রাখে, আর তা যদি তার এলাকায় এসে পড়ে, তবেই সে আশা করতে পারে কিছু। নইলে তার কাঁচকলা।
ঘুষ না পেলেও ঘুষের স্বপ্ন দেখতে মন্দ লাগে না।
মাঝে মাঝে মালগাড়িতে ক্যাটল ওয়াগন থাকে। তার মানে গরু-মোষ যায় বোঝাই হয়ে। কিছু দুধ দুয়ে দে দেখি। সঙ্গে যে গয়লা থাকে সে দুয়ে দেয় গাড়িতে বসে। সঙ্গে দু-চারজন বেশি লোক নিতে যদি চাস, সিগারেট খাবার জন্য দু-চারটে টাকা দে, নিয়ে যা পাহারাদার। আর যদি কখনো তারা গাঁইগুঁই করে বলে, তোদের গাড়ি হট-অ্যাঙ্ল হয়েছে, মানে চাকা গরম হয়েছে_কেটে রাখতে হবে গাড়ি। কেটে না রাখলে আগুন লেগে যাবে, বেলাইন হয়ে যাবে গাড়ি, সর্বনাশ হয়ে যাবে। নে, নেমে পড়। তখন হাতজোড়। তখন দু-পাঁচ টাকা বেশি আসে।
সারাক্ষণ নিবারণ কি শুধু ঘুষের কথাই ভাববে?
তা ছাড়া আর কী আছে ভাববার?
কোনো একটা বই পড়ো না।
বই পড়বে। যা তোমার গাড়ির দুলুনি আর ঝাঁকুনি সাধ্য কি তুমি বইয়ের লাইনের উপর সোজা করে চোখ রাখো!
বেশ তো, বসে-বসে ঢোলো না। লোকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোয়, তুমি তো তবু বসবার জায়গা পেয়েছ।
হ্যাঁ, ঘুমুই, আর সেই ফাঁকে ড্রাইভার একাই ষোলআনা মেরে নিক। আমাকে না বলে ড্রাইভারকে ঘুমুতে বলো।
সেবার মধুপুর থেকে গাড়ি ছাড়ছে, হন্তদন্ত হয়ে এক যুবক আর যুবতী এসে হাজির। দয়া করে তাদের যদি তুলে নেয় নিবারণ। কী ব্যাপার? তারা মধুপুরে আউটিং করতে এসেছিল দেওঘর থেকে, ফিরে যাবার দুপুরের ট্রেনটি মিস করেছে, এখনও যদি এ মালগাড়িতে_তা হলে কেলেঙ্কারির একশেষ হবে। দেখুন, আপনি না দয়া করলে_আপনি যদি না মুখের দিকে তাকান_
মুখের দিকে তাকাবার অত গরজ নেই নিবারণের। সে মনি-ব্যাগের দিকে তাকাল। বললে, দশ টাকা।
তাই দেব, উঠে পড়ল যুবক-যুবতী।
কিন্তু উঠে পড়ে দেখে দুজনের কাছে মিলিয়েও দশ টাকা হয় না। যদি বা হয় জসিডি থেকে দেওঘরের ভাড়ায় কম পড়ে।
নিবারণ বললে, আমি তা জানি না। দশ টাকার এক আধলাও কম নয়। আর তা আগে চাই, এক্ষুনি এক্ষুনি। শেষে জসিডিতে এলে যে কলা দেখিয়ে সটকান দেবে তা হবে না।
দিয়ে দাও পুরোপুরি। মেয়েটি বললে দর্পিণীর মতো। জসিডিতে নেমে দেখা যাবে ধার পাই কি না। পুরোপুরি আদায় করল নিবারণ। দর্পই বলো আর প্রেমই বলো ওসবে চোখ পড়ে না, এখন চোখ শুধু বাঁধা মাইনের উপরে কিছু উপরি আয়ের দিকে। একে আর ঘুষ বোলো না, বোলো বকশিস, বোলো অনুগ্রহ।
কিন্তু আজকের দিনে একটু প্রেমের কথা ভাবলেই বা। স্ত্রীর হাতের অসমাপ্ত মালা নিয়ে চলে এসেছ তুমি। এখন স্নিগ্ধ মনে তার কথা একটু ভাবা উচিত।
স্নিগ্ধ মন-টন বড় কথা। ওসব বড় কথা বড় ভাব পাবে না ঘুণাক্ষরে। বরং ভাবা যাক, গাড়ি কখন থামবে কোন মাঠের মাঝখানে, আসবে কোন এক মার্চেন্টের লোকজন, মাল-খালাসির মিলবে কিছু নগদ মুনাফা। তা হলেই প্রেম পরিতৃপ্ত হবে। পেট পরিতৃপ্ত।
গয়া থেকে ফিরে গিয়ে নিবারণ যদি বলে, আর কিছু নয়, শুধু এই কেরোসিন তেলটুকু এনেছি, তখন কী বলবে লতিকা? বলবে কেরোসিন তেলটুকু গায়ে ঢেলে দেশলাই ধরিয়ে দাও। দিয়ে গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে এসো।
সংসার সর্বত্র এই উপরি-পাওনার জন্যেই ছটফটানি। মজুর থেকে হুজুর, কেরানি থেকে কর্ণধার_
গাড়ি থেমে গেল।
বসে বসেই লাট্টু পাকিয়ে ঘুমুচ্ছিল নিবারণ। হঠাৎ চমকে জেগে উঠল। ও মা, বৃষ্টি পড়ছে যে ঝুপঝুপ করে, গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে, বিদ্যুতের ঝলস দিচ্ছে থেকে থেকে। এ কোনখানে দাঁড়াল গাড়ি? কোন জায়গা? দুপাশে একটু দূরে দূরে কালো কালো কদাকার পাহাড়ের পাহারা। আর যখন বিদ্যুৎ নেই তখন কী নিরেট অন্ধকার। গাড়ি আর জায়গা পেল না দাঁড়াতে? এখানে মার্চেন্ট কোথায়?
ধৈর্য ধরো। ঘাবড়াও কেন? গাড়ি যখন থেমেছে তখন মজা একটা আছেই।
মজা বুঝতে দেরি হলো না নিবারণের। গাড়ি পার্টিং হয়ে গেছে। ভ্যাকম-গজ-মিটারের কাঁটা জিরোতে গিয়ে ঠেকেছে। কাপলিং ছিঁড়ে গেছে ওয়াগনের। হয়তো ভেঙে গেছে ড্র-বার।
এখন উপায়?
জায়গাটার দিকে ঠাহর করে একবার তাকাল। বিশালকায় পাহাড় আর বুনো ঝোপঝাড় দেখেই সে আন্দাজ করেছিল_তবু বিদ্যুতের আলোয় মাইল-পোস্ট দেখে সে নিঃসন্দেহে হলো পরেশনাথের কাছাকাছি। ঠিকঠাক বলতে গেলে পরেশনাথ পেরিয়ে এসে পরের স্টেশনে চৌধুরীবাঁধের মাইল দুয়েক দূরে এসে ঠেকেছে।
ধারে-পারে কোথাও জন-প্রাণী নেই। নেই ছিটে-ফোঁটা আলোর কণিকা। আকাশের একটি তারাও জেগে নেই। তাকিয়ে নেই বিশাল ভয়াল অন্ধকার। অজানার রাজ্য।
একটা সিগারেট ধরিয়ে মনে সাহস আনতে চাইল নিবারণ। দেশলাই জ্বলল অনেক ঘষাঘষি করে। ঘড়িতে দেখল রাত প্রায় দুটো। কিন্তু সিগারেট ধরানো গেল না। সিগারেট ভিজে জ্যাবজেবে হয়ে গিয়েছে।
যদিও শত ছিদ্র দিয়ে জল পড়ছে ব্রেকভ্যানে, গাড়ির চেহারা দেখতে তবু নেমে দাঁড়াল না নিবারণ। তার ভয় করতে লাগল। ভীষণ ভয় করতে লাগল। মনে হলো কে যেন তাকে হঠাৎ একটা বিরাট অনুভূতির মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যা বিরাট তা-ই ভয়ংকর।
খানিক পরে ঢিকোতে-ঢিকোতে ড্রাইভার এসে হাজির।
দু খণ্ড হয়ে গিয়েছে গাড়ি। ছিঁড়ে গিয়েছে গাঁটছড়া।
প্রথম খণ্ডের লাস্ট ওয়াগনের নম্বরটা দেখে এসেছ? ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল নিবারণ।
হ্যাঁ, ড্রাইভার নম্বর দিলে।
তবে আর কি, ঐ লাস্ট নম্বর দিয়ে মেমো লিখে দিই আগেই স্টেশনের এ-এস-এমকে। মেট আর জ্যাককে নিয়ে তুমি প্রথম খণ্ডটা নিয়ে বেরিয়ে যাও এঞ্জিন সমেত। এ-এস-এম কন্ট্রোলকে খবর দেবে। তারপর ইতিমধ্যে যদি বেঁচে থাকি, আসবে রিলিফ এঞ্জিন। মুণ্ডু চলে গিয়েছে আগে, পরে টেনে নিয়ে যাবে ধড়টাকে।
আগের আধখানা ট্রেন নিয়ে ড্রাইভার বেরিয়ে গেল। জীবনের সঙ্গে যে একটু ক্ষীণ সংস্পর্শ ছিল তাও গেল নিশ্চিহ্ন হয়ে।
আধখানা ট্রেনের শেষ চাকার শব্দ মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। কোথাও আর সম্পর্কের এতটুকু বন্ধন রইল না। সে একেবারে একা, নিঃশেষ রূপে নিঃসঙ্গ। তাকে ঘিরে প্রাচীন অরণ্য, মহামহিম পর্বত আর অগম্যরূপ অন্ধকার। এই বিশ্বসংসারে সে শুধু সঙ্গীহীন নয়, সে একেবারে দ্বিতীয়রহিত। পৃথিবীতে পরিত্যক্ত প্রথম প্রাণ।
কিন্তু ভয়ে কুঁকড়িসুকড়ি হয়ে ব্রেক-ভ্যানে বসে থাকলে চলবে না। তাকে তার শেষ আশ্রয়টুকু ছেড়ে নেমে পড়তে হবে ওই অপরিচিত অন্ধকারে। এই দুর্বোধ উপস্থিতির মুখোমুখি।
কিসের টানে নেমে পড়ল নিবারণ। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে একবার বুঝে নিতে চাইল চেহারাটা। চোখ বন্ধ হয়ে গেল। চারিদিকে শুধু বিশালস্তূপ পাহাড় আর দুর্ভেদ্য জঙ্গল। আর সমস্ত চরাচর আচ্ছন্ন করে দুর্জ্ঞেয় অন্ধকার। তার সংকীর্ণ সংসার থেকে ছিন্ন করে কে নিয়ে এল তাকে এই বিশাল অনুভূতির মাঝখানে। তার ছোট ঘর ছোট উঠোন থেকে অন্তহীন এই অঙ্গনের মুক্তিতে। তার প্রাণধারণের ছোট ছোট চেতনার বিন্দু থেকে মহিমময় মৃত্যুর মুখোমুখি।
খল-খল-খল-খল শব্দে কে যেন হঠাৎ উচ্চ রোলে হেসে উঠল। ভয়ে চমকে উঠে চোখ মেলল নিবারণ। না, ভূত-প্রেত নয়, কাছেই কোথায় একটা পাহাড়ি ঝরনা বৃষ্টির জল পেয়ে উল্লাস করে উঠেছে। কে জানে, তাকে দেখে যেন খল-খল-হাস্যে বিদ্রূপ করে উঠেছে। যে মহা স্তব্ধতা পুঞ্জিত হয়ে আছে পাহাড়ে-অরণ্যে তা যেন অমনি এক উপহাসেরই উচ্চসুর। সে যে এক ক্ষীণপ্রাণ হীনগতি প্রগলভ মানুষ তারই প্রতি উপহাস। তার যে একটা ছোট সংসার আছে, ভীরু আশা আর হীন হতাশা দিয়ে তৈরি_তারই প্রতি উদ্ধত ব্যঙ্গ। তার ক্ষুদ্র লোভ ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে ক্ষুদ্র ভবিষ্যৎ চেতনার উপরে কঠিন ভর্ৎসনা।
মাইল-পোস্ট লক্ষ্য করে স্লিপারের উপর দিয়ে পিছন থেকে এগিয়ে যেতে লাগল নিবারণ। কোয়ার্টার মাইল দূরে রেল লাইনের উপর ডিটোনেটর প্লেস করতে হবে। গায়ে বর্ষাতি হাতে হাত-বাতি নিয়ে চলেছে সে পাহাড়ের বেষ্টনীর মধ্যে। যেন প্রথম আবিষ্কারের পৃথিবীতে প্রথম মানুষ তার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ছিপ ছিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে, পা মেপে মেপে এগিয়ে চলেছে নিবারণ। কোয়ার্টার মাইলের মাথায় ডিটোনেটর ফিঙ্ করে দিল। আরো যেতে হবে কোয়ার্টার মাইল। সেখানে গিয়ে দশ গজ দূরে দূরে আরো তিনটে প্লেস করতে হবে। একেই বলে ফগ সিগন্যাল। আকস্মিক যদি কোন ট্রেন এসে পড়ে আপ-লাইনে তবে আধ মাইল দূরেই পরপর তিনটে ফটকা ফাটবে। তখনই কষে দেবে ব্রেক। আর যখন আরো খানিক এগিয়ে এসে একটা ফটকা ফাটবে তখনই করে দেবে ডেড স্টপ। দাঁড়িয়ে যাবে পিছুকার ট্রেন, বেঁচে যাবে দুটো গাড়িই।
কিন্তু পা চলে না আর নিবারণের। মনে হয় আরো কোয়ার্টার মাইল এগিয়ে যাবার আগেই যেন দুর্দান্ত বেগে ছুটে আসবে পিছনের ট্রেন। মুহূর্তে সর্বনাশ ঘটে যাবে। বিদীর্ণ হয়ে পড়বে অসহায় মানুষের করুণ আর্তধ্বনি_তাই তো জীবনধ্বনি।
সেই আর্তধ্বনি যেন স্তব্ধীভূত হয়ে আছে এই অন্ধকারে। পাষাণ হয়ে আছে এই পাহাড়ের রুক্ষতায়।
না, দূরের ডিটোনেটরও লাগিয়ে আসতে পেরেছে। বেঁচে যাবে গাড়ি_যদি না ড্রাইভার মাতাল হয়, যদি সে না ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু নিবারণ বাঁচবে না। কতক্ষণ পরেই জঙ্গল থেকে বাঘ বেরুবে, কিংবা শুনেছি ভালুক আছে এ অঞ্চলে। বাঘ-ভালুক না হোক, সাপ উঠবে না বেয়ে। যা হবে তা হবে, এখন ফিরে যেতে হবে ফের গাড়ির কাছাকাছি। হাত-বাতি লাল করে তাই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ব্রেক-ভ্যানের পিছনে। দু পাশে দুই সাইড ল্যাম্পের লালবাতি, টেইল-ল্যাম্পের লাল বাতি তার উপরে আবার এই হ্যান্ড সিগন্যালের লাল বাতি। যদি, ডিটোনেটর অগ্রাহ্য করলেও নজরে পড়ে এই সর্বনাশের নিশানা।
কে জানে পড়বে কি না। কিন্তু তার আগেই নিবারণ মরে যাবে। শুদ্ধ আতঙ্কে মরে যাবে। বাঘ-ভালুক চোর-ডাকাত ভূত-প্রেতের ভয় নয়। আরেক রকম ভয়। সংজ্ঞাহীন সীমাহীন শরীরহীন ভয়। একটা বিরাট চেতনা বিশাল উপস্থিতির ভয়। এই দুশ্ছেদ্য অন্ধকারে সে যে একেবারে একা, তার ঘর নেই, বাড়ি নেই, তার স্থির কোনো আশ্রয় নেই, দৃঢ় কোনো পরিচয় নেই তার ভয়। এই মুহূর্তে ক্ষুদ্র ঘুষ ক্ষুদ্র প্রমোশন ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির কথা যে মনে আসছে না_শুধু মৃত্যুর কথা মনে আসছে_তার ভয়।
মনে হচ্ছে সেই ভয় যেন মূর্তি গ্রহণ করছে। সমস্ত পাহাড় অরণ্য স্তব্ধতা-অন্ধকার মিলে এক বিরাট পুরুষের আকার নিচ্ছে তার চোখের সামনে। যেন প্রচণ্ড তাণ্ডব মূর্তি অথচ আদিমধ্যান্তশূন্য অশরীরী_
এই বোধহয় মৃত্যুর আবির্ভাব।
কিন্তু পিছনের সেই উদ্দাম ঊর্ধ্বগতি ট্রেন কই?
না, তার বদলে আকাশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে। পূর্ণিমার চাঁদ লাল হয়ে অস্ত যাচ্ছে পশ্চিমে। পুবে লাল হয়ে জাগছে সুগোল সূর্য। নিবারণের মনে হচ্ছে যেন সেই বিরাট পুরুষ দুই হাতে সোনার খঞ্জনি বাজাচ্ছেন, জন্ম-মৃত্যুর খঞ্জনি।
গাইছেন নব জীবনের কীর্তন।
সমস্ত মৃত্যুর পর এই নবজীবনের সংকেত সমস্ত ক্ষুদ্র অস্তিত্বের পর এই বিরাট এক সত্তার অনুভব_এইটিই আজকের উপরি পাওনা।
আজকের নয় অনন্তকালের।
'বাবু, কিতাব!'
সমস্ত সংসার-শান্তির উপরে উদ্ধত বজ্র।
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে লতিকা। সত্যি-সত্যি কল-পিওন। নিজের চুল ছিঁড়বে না কল-পিওনের কিতাবটা_বুঝে উঠতে পারে না।
'এ কি, আজ না তোমার রেস্ট বেশি হবে বলেছিলে?'
'হ্যাঁ, রোস্টার আজ ভালো ছিল। ভেবেছিলাম_' গলায় স্বর ফোটে না নিবারণের।
কিন্তু চোখ ফোটাও। পিওন কল-বুকটা চোখের সামনে মেলে ঘরে। হ্যাঁ, সই করো। দেখে নাও ঠিকঠাক। কোন ট্রেন, ইয়ার্ডে কোন লাইনে আছে, কোথায় যেতে হবে এ-যাত্রা। সব বিতং করে লেখা আছে বইয়ে। দেখে নাও। মনে মনে টুকে রাখো।
'তবে কী হবে!' লতিকা ককিয়ে ওঠে।
'আর কী হবে!' তক্তপোশ ছেড়ে উঠে পড়ে নিবারণ।
দশ বছর আগে এমন দিনে তাদের বিয়ে হয়েছিল। প্রথম পাঁচ বছর তারা ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়িয়েছে_নিবারণ মেসে, লতিকা বাপের বাড়ি, নয়তো বা শ্বশুরবাড়ির কোনো আত্মীয়ের আশ্রয়ে। ছ বছরের মাথায় তারা প্রথম কোয়ার্টার পায় ইনসাইড কোয়ার্টার। সেও দু-কুঠুরিরই আস্তানা_একটার মধ্যে আরেকটা ঘর। এবার, দশ বছরের বার, পাশাপাশি ঘরের কে-টাইপের কোয়ার্টার পেয়েছে। সামান্য একটু ভদ্রতা এসেছে বসবাসে। ইলেকট্রিক আলো হলে আরো একটু সুন্দর হতো। রেন্ট-সেকশানের বড়বাবুকে ধরেছিল নিবারণ_তিনি একটা আঙুল তুলে দেখিয়েছিলেন। তার মানে ঘুষ চাই এক শ টাকা।
বড় ছোট ঘরে, ছোট জীবনের মধ্যে আছে নিবারণ। স্ত্রীর সঙ্গে খুব একটা সংকীর্ণ সম্বন্ধের মধ্যে একটু অন্য রকম অর্থ দিতে চেয়েছিল আজ। আনতে চেয়েছিল একটু অন্য রকম লাবণ্য। ঠিক করেছিল, আজ, দশ বছর বাদে এই প্রথম, সে তার বিয়ের তারিখে একটু উৎসব করবে। উৎসব আর কি, কজন বন্ধুবান্ধবকে ডেকে একটু চা খাওয়ানো, চায়ের সঙ্গে কিছু না-হয় খাবার তৈরি করে দেবে লতিকা। বাইরে বসবার ঘরের মতো করতে পারা যাবে একটা ঘরকে। তাই যা সুবিধা। বন্ধুরা কিন্তু জানতেও পাবে না কেন কী হচ্ছে_শুধু জানবে তারা দুজনে, একটু বা নতুনতর অর্থে। কিছু ফুল জোগাড় করবে হয়তো। বিশেষ একটি অনুভবের লালিত্যে ফর্সা ও আস্ত একখানা শাড়ি পরবে লতিকা, বিকেলের দিকেই না-হয় দাড়ি কামাবে নিবারণ। মুহূর্তের জন্যে হোক, তবু সব আবার কেমন নতুন মনে হবে, মনে হবে আরম্ভের মতো, অজানার মতো_
রাত-ভোর ডিউটি করে সকাল চারটেয় আজ ফিরেছে নিবারণ। বাড়ি ফেরবার আগে রোস্টার দেখে এসেছে, অবস্থা বেশ ভালো_অনেক নম্বর গার্ড 'ইন' করেছে আজ। এমনিতে ডিউটির পর বারো ঘণ্টা মামুলি রেস্ট, তবে রোস্টারে বেশি গার্ড 'ইন' থাকলে আশা থাকে যে পালা আরো দূরে গিয়ে পড়বে। কিন্তু বিপদ এই, মামুলি রেস্টের পর সব সময়ে বাড়িতে তৈরি থাকো কখন 'কিতাব' এসে হাজির হয়। আজ নিবারণ আন্দাজ করেছিল, বারো ঘণ্টার কায়েমি বিশ্রামের পর আরো কয়েক ঘণ্টা ফাউ মিলবে বোধহয়। সেই ভরসায় করতে গিয়েছিল সে এই হাঙ্গামা। কিছু ফুল-পাতা কিনেছিল, কিনেছিল কিছু গন্ধওয়ালা চা, ছোট্ট এক শিশি দামি এসেন্স।
'বন্ধুদেরও তো বলেছ'_মনে করিয়ে দেয় লতিকা।
'তেমন করে কিছু বলিনি। বলেছিলাম রোস্টার ভালো আছে, দু-চার ঘণ্টা মিলে যেতে পারে একস্ট্রা। এক হাত তাস হবেুখন এসো। আর এলেই_এটা সর্বদা উহ্য_একটু চা-টা।'
তেমন করে কিছু বলিনি। একটু যেন বাজল লতিকাকে। বলতে লজ্জা হয়েছিল নিশ্চয়ই। নিমন্ত্রিত বন্ধুরা এসে ফিরে যাবে তার চেয়ে সে-লজ্জা অনেক বেশি।
'বা, লজ্জা কী! চাকরি যখন করছি তখন চাকরি তো করতেই হবে।'
'এ চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভিক্ষে করাও ভালো।'
এই কথাটা আরো একদিন বলেছিল লতিকা। তখন ছিল তারা ইনসাইড কোয়ার্টারে, এক ঘরের মধ্যে আরেক ঘরে। শীতের রাত, পাশাপাশি শুয়ে আছে দুজনে। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে তার ওপর। বেশ একটা ঘুম-না-আসা অথচ ঘুমেরই মতন মনোহর রাত। হঠাৎ রাত দুপুরে দরজায় কে ঘা দিলে। 'বাবু! বাবু! কিতাব!' চোর-ডাকাত নয়, কল-পিওন। মাথায় ছেঁড়া ছাতা, হাতে হাতবাতি। গাড়ি বুকিং হয়েছে তারই খবর দিতে এসেছে। এখন যদি রাত বারোটা হয়, গাড়ি নিয়ে নিবারণকে বেরুতে হবে দুটোয়। দু ঘণ্টা আগে নোটিশ আসে কিতাবের। কী গাড়ি জিজ্ঞেস করছ? রাগ কোরো না_মালগাড়ি। একে গার্ড, তায় মালগাড়ির গার্ড।
তবু, তবু সেই তপ্ত শয্যা ছেড়ে উঠে পড়তে হয়েছিল নিবারণকে। দু ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিতে হবে। লতিকাকে উঠে খাবার-দাবার করে ভরে দিতে হবে টিফিন-কেরিয়ার। ইউনিফর্ম পরে গায়ে বর্ষাতি চাপিয়ে এক হাতে টিফিন-কেরিয়ার, আরেক হাতে হ্যান্ড-সিগন্যাল ল্যাম্প নিয়ে কাদা-জলের মধ্যে ছপ ছপ করতে-করতে যেতে হবে ইস্টিশান।
বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে সেদিন বলেছিল লতিকা : 'এর চেয়ে ভিক্ষে করা ভালো ছিল।'
কিন্তু আজ যেন রাগ নয়, আজ দুঃখ। সেই ছোট ঘরে ছোট হয়ে থাকার হুকুম। একটা নতুন কিছু দেখবার নতুন কিছু বোঝবার থেকে বঞ্চনা।
কাছে এসে গলা নামাল লতিকা। 'সিক রিপোর্ট করে দিলে হয় না?'
নিবারণ হাসল। সে হাসির অর্থটা ভয়ের মতন স্পষ্ট।
সেবার মিথ্যেমিথ্যি সিক রিপোর্ট করেছিল নিবারণ। ফলে বড় ছেলে অন্তুর ডবল-নিউমোনিয়া হয়েছিল। আরেকবার হয়েছিল নিজের রক্ত-আমাশা। এমনিতে কত মিথ্যের মধ্যে তো আছে তারা, ছোট-বড় কত জুয়াচুরির মধ্যে_সেগুলি যেন গায়ে লাগে না, সেগুলির যেন বোধস্পর্শ নেই কিন্তু অসুখের ভয়টা যেন বুক চেপে-ধরা, দম-বন্ধ করার মতন। লতিকা কথা ফিরিয়ে নিল তাড়াতাড়ি। বললে, 'আর কোনো উপায় নেই?'
আরেক উপায় কেতাবে সই না করা। অর্থাৎ বাড়িতে না-থাকা। মামুলি রেস্টের পর পরোয়ানার প্রত্যাশায় তুমি বাড়িতে তটস্থ হয়ে থাকবে না, এ হতেই পারে না। নিজের কর্মদণ্ড নিজেকেই সই করতে হব। তা যদি না করো, তবে তোমার জরিমানা হবে, নামিয়ে দেবে নিচু মাইনেতে, পাশ-ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করে দেবে। চাকরি করতে বসে এ-সব গুনাগারে সাধ্য থাকতে কে রাজি হয় বলো?
তবু ওরই মধ্যে জিজ্ঞেস করে লতিকা : 'এবার কোথায় ট্রেন হলো?'
'গয়া'।
যেন কত উপেক্ষার সুর। মোকামায় না গিয়ে এবার যে নিবারণ গয়া যাচ্ছে আর লতিকা যে কোথাও যাচ্ছে না, থাকছে বাড়ির মধ্যে বন্ধ হয়ে_দুই-ই যেন একই কথা।
একজন যাচ্ছে আরেকজন যে বসে থাকছে দুই-ই যেন সমান নিরর্থক।
কিন্তু এখন আর বসে থাকা চলবে না লতিকার। খাবার-দাবার তৈরি করে দিতে হবে নিবারণকে। যে উনুন সে আজ জ্বালতে যাচ্ছিল, মাখতে যাচ্ছিল যে আটা, তাতে আজও সে কোনো নতুন অর্থ দিতে পারল না।
শুরু হয় সেই মামুলি কর্মচক্র।
সেজেগুজে বেরিয়ে পড়ে নিবারণ। যেন বাজারে যাচ্ছে বা বেড়াতে যাচ্ছে_তার যাওয়ার চেহারাটা যেন এমনি। লতিকা একটু দাঁড়িয়ে পর্যন্ত দেখে না। ছেলেমেয়েগুলো কে কোথায় ছিটকে রয়েছে তার কোনো খোঁজ-খবরের দরকার নেই। যাবার আগে লতিকাকে কোনো বিষয়ে কিছু বলতে বা সতর্ক করে দিতে হবে না। কবে ফিরবে, কাল না দু-তিন দিন পর সে প্রশ্নও অবান্তর। দিন-দিন কেরানি যেমন অফিস করতে যায় এও তেমনি। এদিকে হোক মোকামা বা গয়া, ওদিকে খিদিরপুর বা চিৎপুর সব একই চর্বিতচর্বণ। একই থোড়-বড়ি-খাড়া। এতটুকু রহস্য নেই কোথাও। নেই এতটুকু কোথাও নতুনতরো অনুভূতি!
'এ-এস-এম'-এর অফিসে গার্ডের হাজিরা বইয়ে সই করে নিবারণ। ঠিক কটার সময় গাড়ি সাজানো হবে জেনে নেয়। বঙ্-গোডাউনে গিয়ে বোতলে খাবার জল ভরে। জল আর টিফিন-কেরিয়ার বাঙ্ েভরে চলে যায় অয়েল গো-ডাউনে। ওখান থেকে টেইল-ল্যাম্প নিতে হবে সই করে। ট্রেনের পিছনে যে লাল বাতি জ্বলে সেইটেই টেইল-ল্যাম্প। আরো, নিতে হবে কেরোসিন তেল। সেই তেলে হাতবাতি জ্বালাবে, জ্বালাবে টেইল-ল্যাম্প আর সাইড-ল্যাম্প। আজ চারটের সময় বই হয়েছে যখন, ষোলো আউন্স তেল পাওয়া যাবে। একটু যেন আশ্বস্ত হলো নিবারণ। তেল কিছুটা সরানো যাবে আজকে।
তেলও ভরা হলো লাইন-বঙ্।ে কী না আছে এই বাঙ্টায়! টাইমটেবল, একটা লাল আরেকটা সবুজ নিশান, টেইল-ল্যাম্প, আর সাইড-ল্যাম্পের তিনটে বার্নার, দুটো লাল স্লাইড আর ডিটোনেটর। তা ছাড়া গার্ডস মেমো-বই_তাতে লেখা থাকবে ট্রেনের নম্বর, যাবে কোথা, কটার সময় অ্যারেঞ্জ, কটা ওয়াগন_তাদের টেয়ার-ওয়েট কত, কতই বা লোড-ওয়েট_স্টেশনের কোড, কোন স্টেশন কোন সময় পার হলো তার ফিরিস্তি। তারই এক পাশে টিফিন-কেরিয়ার, জলের বোতল, গ্লাস_সঙ্গে ছোট্ট ভাঁড়ার ঘর_চাল ডাল আটা নুন তেল মসলা আলু পেঁয়াজ চা আর চিনি। হ্যাঁ, মাথার তেল-সাবান, দাড়ি কামাবার সরঞ্জামও আছে।
বাঙ্-কুলির টিন্ডেল এসে ল্যাম্প টিন্ডেলের থেকে জেনে নেয় ইয়ার্ডে কোন লাইনে গাড়ি দাঁড়িয়ে। লাইন-নম্বর বলে দেয় সে বাঙ্-কুলিকে। বাঙ্-কুলি সেই নম্বরের ট্রেনের ব্রেক-ভ্যানে তুলে দিয়ে আসে বাঙ্।
বাঙ্ পাঠিয়ে দিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইয়ার্ড-মাস্টারের ক্যাবিনে যেতে হয় নিবারণকে। সেখানে নাম্বার-টেকাররা ট্রেনের ফর্দ বা 'গাইডেন্স' বানিয়ে রেখেছে। মানে, কতগুলো ওয়াগন আছে, কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাবে, টেয়ার-ওয়েট লোড-ওয়েট কত_তার হিসেব। ফর্দ মিলিয়ে একধার থেকে গাড়ি চেক করতে শুরু করো এবার। দেখ সিল আর রিভেট ঠিক আছে কিনা,_এধার দেখেছ তো ওধার পরখ করো। বয়ে গেছে অত মিলিয়ে দেখবার। একটা মাল-গাড়ির ফুল-লোড হলো ষাট ওয়াগন_এটার মধ্যে আছে বুঝি পঞ্চান্নটা। কোথায় কোনো ফ্ল্যাপ-ডোর আলগা থাকে তো থাক না_তার কি। যারা মাল বুক করে তারা দেখতে পারে না? কিন্তু গাড়িতে গাড়িতে কাপলিং ঠিক আছে কি না, অর্থাৎ শেকল দিয়ে গাঁটছড়া বাঁধা আছে তা আঁট হয়েছে কি না_তা তো দেখবে। বয়ে গেছে। তার জন্যে মাইনে দেয়া হয় না নিবারণকে।
ওয়াচম্যানের খাতায় তাড়াতাড়ি সই করে দেয় নিবারণ। হ্যাঁ, পঞ্চান্ন ওয়াগন সিল-রিভেট করেক্ট। ঠিক আছে। ও-কে।
তারপর ড্রাইভারের সঙ্গে দেখা করে। ঘড়ি মিলিয়ে নেয়। কোম্পানির থেকে ঘড়ি দিয়েছে দুজনকে। সে যেমনতরোই ঘড়ি হোক, মিল থাকলেই হলো। গাইয়ে-বাছুরে মিল থাকলে বনে গিয়েও দুধ দেবে।
ড্রাইভার জেটিআর ফর্ম আর ফুয়েল ফর্ম বের করে দেয় নিবারণকে। জেটিআর মানে জয়েন্ট ট্রেন রিপোর্ট_কটার সময় কোন স্টেশন পার হচ্ছে ট্রেন তার হিসাব দুজনকে রাখতে হবে আলাদা। শেষ স্টেশনে পেশ করতে হবে। মিল না থাকলেই মুশকিল। তা একযাত্রায় কি পৃথক ফল হয় কখনো? কী বলো হে ইয়াসিন?
এঞ্জিনের টেন্ডারে কটন কয়লা নিয়েছো নয় টন। দেখো এই ফুয়েল-ফর্ম।
সিগন্যাল ডাউন হলেই স্টার্ট কোরো। ইয়াসিনকে বলে দিয়ে নিবারণ তার ব্রেক-ভ্যানে গিয়ে ওঠে।
হ্যাঁ, এই ইয়ার্ডে সিগন্যাল আছে। যে ইয়ার্ডে সিগন্যাল নেই সেখানে ট্রেন অ্যারেঞ্জ করলেই ঝামেলা। ড্রাইভারকে গিয়ে স্টার্টিং অর্ডার নিয়ে আসতে হবে। তটস্থ হয়ে বসে থাকো ততক্ষণ। স্টার্টার সিগন্যাল আর অ্যাডভান্স স্টার্টার সিগন্যালের মধ্যে অল-রাইট সিগন্যাল দেখাও_রাত হলো শাদা আলো দেখিয়ে, দিন হলে হাত নেড়ে, তুমিও দেখাও ড্রাইভারও দেখাক। একটু ভুলচুক হলেই কেলেঙ্কারি। ভাগ্যিস এই ইয়ার্ডটা তেমনি কানা নয়_লাল-সবুজ চোখ আছে জ্বলজ্বলে। তাই ড্রাইভারের উপর ভার দিয়ে ব্রেক-ভ্যানে গিয়ে বসেছে চুপচাপ। যখন ছাড়তে হয় ছাড়বে।
একেবারে চুপচাপ। পঞ্চান্নখানা মালবোঝাই ওয়াগনের পিছনে একা-একা চুপ করে বসে থাকা। সেই কত দূরে এঞ্জিন, সেইখানে যা প্রাণস্পর্শ। তবু তো এঞ্জিনে ড্রাইভারের পাশে ফায়ারম্যান থাকে জ্যাক থাকে_গল্প করা যায়। কিন্তু গার্ডের কেউ নেই কিছু নেই। মাইলের পর মাইল চলেছে গাড়ি, সে একেবারে একা। চলেছে বন-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, অন্ধকার চিরে-চিরে, তাকে ঘিরে সমস্ত বিশ্ব-সংসার যেন অনন্ত শূন্যে ভরে রয়েছে। তার যেন কোনো আত্মীয় নেই, প্রতিবেশী নেই_কেউ এসে তাকে খুন করে গেলেও কেউ বাধা দেওয়া দূরে থাক অস্ফুট আপত্তিও করবে না। ইয়াসিনও বুঝতে পারবে না সে খুন হলো। যদি কারা গাড়ি থামিয়ে ওয়াগন লুট করে, মুখ বাড়িয়ে একবার দেখবেও না নিবারণ। ঘুম না এলেও ঘুমুবার ভান করবে। ডাকাতদের সঙ্গে সে লড়তে যাবে নাকি খালি-হাতে। এই একটানা একঘেয়েমির চেয়ে রাস্তার মাঝে দু-একটা রাহাজানি মন্দ নয়। অন্তত খানিক লোকজনের হৈ-চৈ কানে আসে।
দশ দিক আঁধার করে রাত নেমেছে। এটা থ্রু গুডস-ট্রেন, ওয়াটারিং স্টেশনে ছাড়া থামবে না। কিন্তু মেইল ও এঙ্প্রেস, এমনকি প্যাসেঞ্জারকে পর্যন্ত আগে যাবার অধিকার ছেড়ে দিয়ে লুপে গিয়ে শান্ট করছে। কখনো বা সেকশন ক্লিয়ার পায় না, পিছনের স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রাখে।
যদি স্টেশনে এসে দাঁড়ায় তবে দু-চারটে আলো বা গোটাকয় নিশ্বাসের না-হয় আভাস মেলে। তখন আভাস মেলে। তখন আসান লাগে কিছুটা। তাইতে যারা প্যাসেঞ্জারে কাজ করে তাদের তত হয়রানি নেই। কতক্ষণ পরে-পরেই তারা মানুষের হাঁক-ডাক শোনে, নিজের সমসুখদুঃখের সঙ্গী কেউ আছে তার পরিচয় পায়। কিন্তু এখানে এ-যাত্রায় কতক্ষণে স্টেশন পড়বে! আর স্টেশন পড়লেই বা কি! প্যাসেঞ্জার কই? কই সেই সুন্দর জনকোলাহল?
নিবারণ একেবারে একা। নিরবকাশ ভাবে নিঃসঙ্গ। পঞ্চান্নটা গাড়ির পরে কোথায় ড্রাইভার আর ফোরম্যান আর জ্যাক, হাত বাড়িয়ে নাগাল পায় না কিছুতেই। মনে হয়, গাড়ি যেন কেউ চালাচ্ছে না, গাড়ি আপনিই চলেছে। যেন কোথাও থামবে না কোনোদিন। শুধু কতগুলো রাশিভূত বস্তু আর সে একাকী এক প্রাণ, এছাড়া আর কেউ নেই এই গতির উন্মুক্তিতে।
ঠিক এমনি করেই ভাববে না নিবারণ। ভাবছে আজকের জার্নিতে থ্রিল কই? ইয়াসিন কি এ-যাত্রায় কোনো মার্চেন্টের সঙ্গে বন্দোবস্তু করেনি?
প্যাসেঞ্জারের কাজ করলে অনেক সুবিধা। লোডিং মানির বখরা পাওয়া যায়। ব্রেকে যে সব মাল যায় তাতে পয়সা দেয় মার্চেন্টরা। পার্সেল-ক্লার্করাই তা উসুল করে, ভাগের পয়সা লোডিংয়ের সময় দিয়ে দেয় গার্ডকে। ধরা পড়বার ভয় নেই। আর যদি টি-টি-ই হতে পারতে, তবে 'ঝাঁপসেই' ফেঁপে উঠতে নিটোল হয়ে। 'ঝাঁপস' শোনোনি বুঝি। ও একটা মুখ চলতি টার্ম_ঝাঁ করে আপস করতে হয় বলেই সন্ধি করে ঝাঁপস। হ্যাঁ বাবা, সন্ধি করো। তোমার অন্ধিসন্ধি আমি জানি, আমারটা তুমি জানো। তবে কেন মিছিমিছি খচখচ করছ?
সুখে কাজ করে বটে গুডস ক্লার্করা_স্থায়ী ডে-ডিউটি, ঘুমের কোনো ব্যাঘাত নেই, আর উপরিও স্বচ্ছন্দ।
আর তোমাদের?
আমাদের কথা আর বোলো না। বলতেই বলে এক পা রেলে এক পা জেলে। মারি তো গণ্ডার লুটি তো ভাণ্ডার। আর চোকা কড়ি রোখা মাল। হাতে-হাতে দে রে ভাই দাঁতে-দাঁতে খাই।
কিন্তু আজ হলো কী? কোনো বন্দোবস্তই কি করেনি আজ ইয়াসিন? আজ কি ডোল-ভরা আশা আর কুলো-ভরা ছাই?
কোনো স্টেশনের বাইরে কি আজ আর গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়বে না? আসবে নাকি কোনো মার্চেন্টের সাঙ্গোপাঙ্গরা। অফ-সাইডে সিল-রিভেট না থাকে তো ভালোই, আর থাকলেই বা খুলে ফেলতে কতক্ষণ? এই জঙ্গুলে অন্ধকারে কে তাঁর খোঁজ রাখছে? সেই সব সাঙ্গোপাঙ্গরা ঢেরা-দেওয়া গাড়ি থেকে মাল খালাস করে নেবে না_চিনি বা আস্ত গম বা কেরোসিন? সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার আর গার্ডের হাত আসবে না নোটের পাঁজা?
ট্রেন যে হঠাৎ থামিয়ে দিলে তার জবাবদিহি কী? ড্রাইভার মুখে-চোখে নিরীহ-নির্দোষের ভাব এনে বলবে, কী করব, এঞ্জিনে স্টিম পড়ে গিয়েছিল, স্টিম বানাতে হচ্ছিল, কিংবা কয়লা ঝামা হয়ে গিয়েছিল, আগ বানাতে হচ্ছিল_
পরের স্টেশনে হয়তো চেক করতে আসবে ওয়াচম্যান। হয়তো খোলা দেখবে গাড়ি। দেখুকগে, বয়ে গেল। ওয়াচম্যানের বইয়ে গার্ড রিমার্ক দিয়ে দেবে, গাড়ি খুলে দিয়েছে কে মাঝপথে, জিআরপিকে না হয় তারা করে দেবে, মেসেজ পাঠাবে ওয়াচম্যান ইন্সপেক্টরের কাছে। তারপরে তোমরা ইনকোয়ারি করো। আর যার মাল খোয়া গেছে সে উলটে ক্লেম দিয়ে বা কোর্ট করে তার ক্ষতি-খেসারত আদায় করে নিক।
ওয়াচম্যানও কম যায় না। গার্ডের থেকে অল করেক্ট সই নিয়ে পরে গাড়ি খুলে মাল বার করে নেয়। গাড়ি তখন হয়তো অন্য স্টেশনে চলে গিয়েছে, ওয়াচম্যানের আর ঝক্কি নেই। ফাঁসবে তো গার্ড ফাঁসবে। তখন সে ভাঙা গাড়ি সিল করিয়ে চেকিং-এর জন্যে কেটে রেখে মেসেজ পাঠিয়ে দাও। শুরু হোক ইনকোয়ারি। গার্ড বলবে, আমি জানি কি, মাঝপথে কে কেটেছে_আর ওয়াচম্যান বলবে আমি জানি কি, এই দেখ গার্ডের অল-করেক্ট দস্তখত। আর ড্রাইভার এমন একখানা মুখ করবে যেন তিলক না কাটলেও সে পরম বৈষ্ণব। সে যে কখন কার সঙ্গে সড় করবে কেউ জানে না। সর্বাঙ্গে ঘা, ওষুধ লাগাবে কোথা? সুতরাং লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন, খেসারত দিয়ে মরো রেল কোম্পানি।
এ রকম একটাও বড় দাঁও পড়েনি নিবারণের হাতে। একবার একটা হাতে আসতে আসতে ফসকে গেল। পরের মাল চুরি করে নেয় মার্চেন্টের চর-অনুচর, এতে হাঙ্গামা বেশি। সবচেয়ে সুবিধে নিজে মাল চুরি করা। গাড়ি চিনতে দেরি হয় না, আর মাল বার করবার কায়দাটাও রপ্ত-মুখস্থ থাকে। চক্ষের নিমেষে ঘটে যেতে পারে ঘটনা।
হলোও তাই। ব্রিজ রিপেয়ার হচ্ছে, গাড়ি দাঁড় করাল ড্রাইভার। কিছু বলতে পারো না ড্রাইভারকে। হুকুম টাঙ্গানো আছে। স্টপ ডেড ফর টু মিনিটস। যেই গাড়ি দাঁড়াল, অমনি বরজলাল মাড়োয়ারীর লোক এসে তাদের গাড়ি খুলল। বাইরের চেহারা থেকেই বুঝে নিলে কোন গাড়ি। কিভাবে সিল-রিভেট ভেঙে খুলে ফেলতে হবে দরজা জানা আছে তার কল-কৌশল। গম যাচ্ছিল বস্তা করে। চক্ষের পলকে প্রায় কুড়ি বস্তা ধুপধুপ করে ছুড়ে ফেললে মাটিতে। স্টার্ট দিল গাড়ি, একটা লোক বুঝি ফাইভ মাইলস পার আওয়ার। নেমে পড়ল লোকটা। ট্রাক তৈরি ছিল রাস্তায়। বোঝাই হয়ে গেল বস্তা। বেরিয়ে গেল এক ফুঁয়ে। যেখানকার গম সেখানে গিয়ে উঠল।
নিবারণ নিরিবিলিতে দেখা করেছিল ড্রাইভারের সঙ্গে। সে তো আকাশ থেকে পড়ল। ব্রিজের মুখে গাড়ি দাঁড় করাতে হবে এ তো সরকারের হুকুম। সে কাঁটায়-কাঁটায় হুকুম তামিল করেছে_সে কিছুই জানে না। এক আঙুলে দিব্যি তুড়ি বাজিয়ে গেল সে।
বরজলালের গদিতেও খোঁজ করেছিল নিবারণ। তারা স্পষ্ট মুখ মুছলে। কে-না কে ডাকাতি করে মাল বার করে নিয়েছে তারা তার জানে কি। তারা উলটে ক্লেম দিয়েছে অফিসে। ক্লেম না মানে মোটা টাকার মামলা ঠুকবে আদালতে।
একেই বলে খাবে আবার ছাঁদাও বাঁধবে।
এ তো সামান্য চুরি। কখনো কখনো আবার তেন্নাথের মেলা হয়। ড্রাইভার, গার্ড আর ক্যাবিনম্যান_ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর_ত্রিনাথের যোগাযোগ। সেসব পুকুরচুরি না বলে বলতে পারো গুদোম চুরি। ক্যাবিনম্যান আউটার সিগন্যাল খারাপ করিয়ে রাখে। সিগন্যাল যদি কাজ না করে তবে গাড়ি চলে কী করে? ড্রাইভারকে তাই আউটার সিগন্যালের কাছে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। জে-টি-আর-এ ভালো করে কৈফিয়ত লেখে গার্ড। ডিসট্যান্ট সিগন্যাল আউট অফ অ্যাকশন। সিগন্যাল সারিয়ে ফের চালু করতে কম-সে-কম দশ-পনেরো মিনিট লাগে। আর সেই দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই চিচিং ফাঁক_যাকে বলে গুদোম সাবাড়।
এসব বড় চুরি। রাজসূয় ব্যাপার। এসব ব্যাপারে অংশ নিতে পারাও ভাগ্যের কথা। নিবারণের অদৃষ্টে ঘটনাচক্র এমনভাবে কখনোই ঘুরবে না, যাতে সে তেন্নাথের মেলায় বসে এক ছিলিম গাঁজা টানতে পারে। সে ভীরু, সে খুঁতখুঁতে।
এমনি ড্রাইভার যা জোগাড় করে দিয়েছে মাঝে-মধ্যে। পথের মধ্যে যা দু-একটা ছককাটা ফন্দি-আঁটা রাহাজানি হয়েছে তারই লাভের বখরা। নিবারণ সাতেও নেই পাঁচেও নেই, হঠাৎ খ্যাচ করে বন্ধ হয়ে গিয়েছে গাড়ি। গাড়ি বন্ধ না হলে মাল খালাসি চলবে কী করে? আর, গাড়ি বন্ধ হলেই গার্ডের তাঁবেদারিতে চলে এলে। কেননা গার্ডের হাতে জি-টি-আর, টাইমিং-এর ফিরিস্তি। অতএব গার্ডের হাতেও কিছু গুঁজে দাও।
কিন্তু সব সময়েই ছক কেটে আসে না। এসে পড়ে গ্রাম্য ডাকাতের দল। লাইনের উপরে পাথর বা গাছ ফেলে রাখে। গাড়ি দাঁড় করিয়ে লুটতরাজ করে। দু-প্রান্তের দুই লোক, কোনো সংযোগের সুবিধে নেই_তাই চুপচাপ বসে থাকো যে যার এলেকায়। আর সংযোগ থাকলেই বা কী, লুটেরাদের বাধা দেবার তোমাদের রসদ কোথায়? আর যেখানে রস নেই সেখানে রসদ থাকলেই বা কী? নাকে তেল দিয়ে ঘুমোও, ডাকাতরা চলে গেলে হাতবাতি দেখিও, স্টার্টের সিটি দেবে ড্রাইভার।
ডাকাত যদি না থাকে, খুচরো চোর আছে অগণ্য। দিলি্ল থেকে হাওড়া পর্যন্ত চলেছে এই চোরের অক্ষৌহিণী। এরা গাড়ি থামায় না বটে কিন্তু যেখানে গাড়ি থামে, স্টেশনেই হোক বা স্টেশনের বাইরেই হোক, ঠিক এসে হাজির হয় কাতারে-কাতারে। প্রত্যেকের হাতে একটা করে সরু লোহার শলা আর গলায় একটা করে বেশ খানিকটা কাপড়ের টুকরো বাঁধা। প্রতিটি গ্রামের কামারশালায় তৈরি হচ্ছে এই লোহার শলা, কারুর বা চাই লিকলিকে তলোয়ার। মালগাড়ি দাঁড়ালেই প্রতিটি ওয়াগনের ফ্ল্যাপ-ডোরের ফাঁকের ভিতর দিয়ে এরা শলা ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে খোঁচা মারে। নেহাত যদি পাট বা তামাক হয়, তা হলে অবিশ্যি কোনো সুসার নেই, কিন্তু শুকনো আর দানা-ওয়ালা বা গুঁড়ো গুঁড়ো জিনিস হলেই খোঁচা খেয়ে ঝরঝর করে বেরুতে শুরু করবে। আর সেই বেরুনো, শর্ষে কি মুশুরি ডাল, আটা কি সুজি, চিনি কি চাল_বা নিতান্ত বিড়ির শুকো_গলার কাপড় তুলে ধরে ভরে নাও এক থলে। এমনি জনে জনে, যার যেমন ভাগ্য। আর যেই গাড়ি চলল অমনি সবাই এক দাপটে পগার পার।
কি হলো আজ? বরাকর_আস্তে আস্তে ধানবাদ পেরুল_এখনো কোনো থ্রিল নেই? ড্রাইভার কি আজ একেবারে বেকার হয়ে থাকবে?
কী মনে করে বাইরে একবার তাকাল নিবারণ। একি, জমাট মেঘ করেছে যে!
বৃষ্টি শুরু হলে কী অবস্থা যে হবে এ ব্রেক-ভ্যানের, ভাবতেও মন খারাপ হয়ে যায়। ফাটা দিয়ে পড়বে জল আর ফুটো দিয়ে ঢুকবে হাওয়া। কিন্তু কে জানে বৃষ্টি শুরু হলেই বোধ হয় পার্টিরা এসে দেখা দেবে। অন্ধকার যত বেশি ঘোরালো হয়, ততই যেন চুরির সুবিধে।
সুবিধে হলেই বা কী, না হলেই বা কী, নিবারণ কী জানে! নিজের থেকে তার কোনো তোড়জোড় নেই, যন্ত্রতন্ত্র নেই। ড্রাইভার যদি কোথাও কোনো ব্যবস্থা করে রাখে, আর তা যদি তার এলাকায় এসে পড়ে, তবেই সে আশা করতে পারে কিছু। নইলে তার কাঁচকলা।
ঘুষ না পেলেও ঘুষের স্বপ্ন দেখতে মন্দ লাগে না।
মাঝে মাঝে মালগাড়িতে ক্যাটল ওয়াগন থাকে। তার মানে গরু-মোষ যায় বোঝাই হয়ে। কিছু দুধ দুয়ে দে দেখি। সঙ্গে যে গয়লা থাকে সে দুয়ে দেয় গাড়িতে বসে। সঙ্গে দু-চারজন বেশি লোক নিতে যদি চাস, সিগারেট খাবার জন্য দু-চারটে টাকা দে, নিয়ে যা পাহারাদার। আর যদি কখনো তারা গাঁইগুঁই করে বলে, তোদের গাড়ি হট-অ্যাঙ্ল হয়েছে, মানে চাকা গরম হয়েছে_কেটে রাখতে হবে গাড়ি। কেটে না রাখলে আগুন লেগে যাবে, বেলাইন হয়ে যাবে গাড়ি, সর্বনাশ হয়ে যাবে। নে, নেমে পড়। তখন হাতজোড়। তখন দু-পাঁচ টাকা বেশি আসে।
সারাক্ষণ নিবারণ কি শুধু ঘুষের কথাই ভাববে?
তা ছাড়া আর কী আছে ভাববার?
কোনো একটা বই পড়ো না।
বই পড়বে। যা তোমার গাড়ির দুলুনি আর ঝাঁকুনি সাধ্য কি তুমি বইয়ের লাইনের উপর সোজা করে চোখ রাখো!
বেশ তো, বসে-বসে ঢোলো না। লোকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোয়, তুমি তো তবু বসবার জায়গা পেয়েছ।
হ্যাঁ, ঘুমুই, আর সেই ফাঁকে ড্রাইভার একাই ষোলআনা মেরে নিক। আমাকে না বলে ড্রাইভারকে ঘুমুতে বলো।
সেবার মধুপুর থেকে গাড়ি ছাড়ছে, হন্তদন্ত হয়ে এক যুবক আর যুবতী এসে হাজির। দয়া করে তাদের যদি তুলে নেয় নিবারণ। কী ব্যাপার? তারা মধুপুরে আউটিং করতে এসেছিল দেওঘর থেকে, ফিরে যাবার দুপুরের ট্রেনটি মিস করেছে, এখনও যদি এ মালগাড়িতে_তা হলে কেলেঙ্কারির একশেষ হবে। দেখুন, আপনি না দয়া করলে_আপনি যদি না মুখের দিকে তাকান_
মুখের দিকে তাকাবার অত গরজ নেই নিবারণের। সে মনি-ব্যাগের দিকে তাকাল। বললে, দশ টাকা।
তাই দেব, উঠে পড়ল যুবক-যুবতী।
কিন্তু উঠে পড়ে দেখে দুজনের কাছে মিলিয়েও দশ টাকা হয় না। যদি বা হয় জসিডি থেকে দেওঘরের ভাড়ায় কম পড়ে।
নিবারণ বললে, আমি তা জানি না। দশ টাকার এক আধলাও কম নয়। আর তা আগে চাই, এক্ষুনি এক্ষুনি। শেষে জসিডিতে এলে যে কলা দেখিয়ে সটকান দেবে তা হবে না।
দিয়ে দাও পুরোপুরি। মেয়েটি বললে দর্পিণীর মতো। জসিডিতে নেমে দেখা যাবে ধার পাই কি না। পুরোপুরি আদায় করল নিবারণ। দর্পই বলো আর প্রেমই বলো ওসবে চোখ পড়ে না, এখন চোখ শুধু বাঁধা মাইনের উপরে কিছু উপরি আয়ের দিকে। একে আর ঘুষ বোলো না, বোলো বকশিস, বোলো অনুগ্রহ।
কিন্তু আজকের দিনে একটু প্রেমের কথা ভাবলেই বা। স্ত্রীর হাতের অসমাপ্ত মালা নিয়ে চলে এসেছ তুমি। এখন স্নিগ্ধ মনে তার কথা একটু ভাবা উচিত।
স্নিগ্ধ মন-টন বড় কথা। ওসব বড় কথা বড় ভাব পাবে না ঘুণাক্ষরে। বরং ভাবা যাক, গাড়ি কখন থামবে কোন মাঠের মাঝখানে, আসবে কোন এক মার্চেন্টের লোকজন, মাল-খালাসির মিলবে কিছু নগদ মুনাফা। তা হলেই প্রেম পরিতৃপ্ত হবে। পেট পরিতৃপ্ত।
গয়া থেকে ফিরে গিয়ে নিবারণ যদি বলে, আর কিছু নয়, শুধু এই কেরোসিন তেলটুকু এনেছি, তখন কী বলবে লতিকা? বলবে কেরোসিন তেলটুকু গায়ে ঢেলে দেশলাই ধরিয়ে দাও। দিয়ে গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে এসো।
সংসার সর্বত্র এই উপরি-পাওনার জন্যেই ছটফটানি। মজুর থেকে হুজুর, কেরানি থেকে কর্ণধার_
গাড়ি থেমে গেল।
বসে বসেই লাট্টু পাকিয়ে ঘুমুচ্ছিল নিবারণ। হঠাৎ চমকে জেগে উঠল। ও মা, বৃষ্টি পড়ছে যে ঝুপঝুপ করে, গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে, বিদ্যুতের ঝলস দিচ্ছে থেকে থেকে। এ কোনখানে দাঁড়াল গাড়ি? কোন জায়গা? দুপাশে একটু দূরে দূরে কালো কালো কদাকার পাহাড়ের পাহারা। আর যখন বিদ্যুৎ নেই তখন কী নিরেট অন্ধকার। গাড়ি আর জায়গা পেল না দাঁড়াতে? এখানে মার্চেন্ট কোথায়?
ধৈর্য ধরো। ঘাবড়াও কেন? গাড়ি যখন থেমেছে তখন মজা একটা আছেই।
মজা বুঝতে দেরি হলো না নিবারণের। গাড়ি পার্টিং হয়ে গেছে। ভ্যাকম-গজ-মিটারের কাঁটা জিরোতে গিয়ে ঠেকেছে। কাপলিং ছিঁড়ে গেছে ওয়াগনের। হয়তো ভেঙে গেছে ড্র-বার।
এখন উপায়?
জায়গাটার দিকে ঠাহর করে একবার তাকাল। বিশালকায় পাহাড় আর বুনো ঝোপঝাড় দেখেই সে আন্দাজ করেছিল_তবু বিদ্যুতের আলোয় মাইল-পোস্ট দেখে সে নিঃসন্দেহে হলো পরেশনাথের কাছাকাছি। ঠিকঠাক বলতে গেলে পরেশনাথ পেরিয়ে এসে পরের স্টেশনে চৌধুরীবাঁধের মাইল দুয়েক দূরে এসে ঠেকেছে।
ধারে-পারে কোথাও জন-প্রাণী নেই। নেই ছিটে-ফোঁটা আলোর কণিকা। আকাশের একটি তারাও জেগে নেই। তাকিয়ে নেই বিশাল ভয়াল অন্ধকার। অজানার রাজ্য।
একটা সিগারেট ধরিয়ে মনে সাহস আনতে চাইল নিবারণ। দেশলাই জ্বলল অনেক ঘষাঘষি করে। ঘড়িতে দেখল রাত প্রায় দুটো। কিন্তু সিগারেট ধরানো গেল না। সিগারেট ভিজে জ্যাবজেবে হয়ে গিয়েছে।
যদিও শত ছিদ্র দিয়ে জল পড়ছে ব্রেকভ্যানে, গাড়ির চেহারা দেখতে তবু নেমে দাঁড়াল না নিবারণ। তার ভয় করতে লাগল। ভীষণ ভয় করতে লাগল। মনে হলো কে যেন তাকে হঠাৎ একটা বিরাট অনুভূতির মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যা বিরাট তা-ই ভয়ংকর।
খানিক পরে ঢিকোতে-ঢিকোতে ড্রাইভার এসে হাজির।
দু খণ্ড হয়ে গিয়েছে গাড়ি। ছিঁড়ে গিয়েছে গাঁটছড়া।
প্রথম খণ্ডের লাস্ট ওয়াগনের নম্বরটা দেখে এসেছ? ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল নিবারণ।
হ্যাঁ, ড্রাইভার নম্বর দিলে।
তবে আর কি, ঐ লাস্ট নম্বর দিয়ে মেমো লিখে দিই আগেই স্টেশনের এ-এস-এমকে। মেট আর জ্যাককে নিয়ে তুমি প্রথম খণ্ডটা নিয়ে বেরিয়ে যাও এঞ্জিন সমেত। এ-এস-এম কন্ট্রোলকে খবর দেবে। তারপর ইতিমধ্যে যদি বেঁচে থাকি, আসবে রিলিফ এঞ্জিন। মুণ্ডু চলে গিয়েছে আগে, পরে টেনে নিয়ে যাবে ধড়টাকে।
আগের আধখানা ট্রেন নিয়ে ড্রাইভার বেরিয়ে গেল। জীবনের সঙ্গে যে একটু ক্ষীণ সংস্পর্শ ছিল তাও গেল নিশ্চিহ্ন হয়ে।
আধখানা ট্রেনের শেষ চাকার শব্দ মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। কোথাও আর সম্পর্কের এতটুকু বন্ধন রইল না। সে একেবারে একা, নিঃশেষ রূপে নিঃসঙ্গ। তাকে ঘিরে প্রাচীন অরণ্য, মহামহিম পর্বত আর অগম্যরূপ অন্ধকার। এই বিশ্বসংসারে সে শুধু সঙ্গীহীন নয়, সে একেবারে দ্বিতীয়রহিত। পৃথিবীতে পরিত্যক্ত প্রথম প্রাণ।
কিন্তু ভয়ে কুঁকড়িসুকড়ি হয়ে ব্রেক-ভ্যানে বসে থাকলে চলবে না। তাকে তার শেষ আশ্রয়টুকু ছেড়ে নেমে পড়তে হবে ওই অপরিচিত অন্ধকারে। এই দুর্বোধ উপস্থিতির মুখোমুখি।
কিসের টানে নেমে পড়ল নিবারণ। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে একবার বুঝে নিতে চাইল চেহারাটা। চোখ বন্ধ হয়ে গেল। চারিদিকে শুধু বিশালস্তূপ পাহাড় আর দুর্ভেদ্য জঙ্গল। আর সমস্ত চরাচর আচ্ছন্ন করে দুর্জ্ঞেয় অন্ধকার। তার সংকীর্ণ সংসার থেকে ছিন্ন করে কে নিয়ে এল তাকে এই বিশাল অনুভূতির মাঝখানে। তার ছোট ঘর ছোট উঠোন থেকে অন্তহীন এই অঙ্গনের মুক্তিতে। তার প্রাণধারণের ছোট ছোট চেতনার বিন্দু থেকে মহিমময় মৃত্যুর মুখোমুখি।
খল-খল-খল-খল শব্দে কে যেন হঠাৎ উচ্চ রোলে হেসে উঠল। ভয়ে চমকে উঠে চোখ মেলল নিবারণ। না, ভূত-প্রেত নয়, কাছেই কোথায় একটা পাহাড়ি ঝরনা বৃষ্টির জল পেয়ে উল্লাস করে উঠেছে। কে জানে, তাকে দেখে যেন খল-খল-হাস্যে বিদ্রূপ করে উঠেছে। যে মহা স্তব্ধতা পুঞ্জিত হয়ে আছে পাহাড়ে-অরণ্যে তা যেন অমনি এক উপহাসেরই উচ্চসুর। সে যে এক ক্ষীণপ্রাণ হীনগতি প্রগলভ মানুষ তারই প্রতি উপহাস। তার যে একটা ছোট সংসার আছে, ভীরু আশা আর হীন হতাশা দিয়ে তৈরি_তারই প্রতি উদ্ধত ব্যঙ্গ। তার ক্ষুদ্র লোভ ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে ক্ষুদ্র ভবিষ্যৎ চেতনার উপরে কঠিন ভর্ৎসনা।
মাইল-পোস্ট লক্ষ্য করে স্লিপারের উপর দিয়ে পিছন থেকে এগিয়ে যেতে লাগল নিবারণ। কোয়ার্টার মাইল দূরে রেল লাইনের উপর ডিটোনেটর প্লেস করতে হবে। গায়ে বর্ষাতি হাতে হাত-বাতি নিয়ে চলেছে সে পাহাড়ের বেষ্টনীর মধ্যে। যেন প্রথম আবিষ্কারের পৃথিবীতে প্রথম মানুষ তার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ছিপ ছিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে, পা মেপে মেপে এগিয়ে চলেছে নিবারণ। কোয়ার্টার মাইলের মাথায় ডিটোনেটর ফিঙ্ করে দিল। আরো যেতে হবে কোয়ার্টার মাইল। সেখানে গিয়ে দশ গজ দূরে দূরে আরো তিনটে প্লেস করতে হবে। একেই বলে ফগ সিগন্যাল। আকস্মিক যদি কোন ট্রেন এসে পড়ে আপ-লাইনে তবে আধ মাইল দূরেই পরপর তিনটে ফটকা ফাটবে। তখনই কষে দেবে ব্রেক। আর যখন আরো খানিক এগিয়ে এসে একটা ফটকা ফাটবে তখনই করে দেবে ডেড স্টপ। দাঁড়িয়ে যাবে পিছুকার ট্রেন, বেঁচে যাবে দুটো গাড়িই।
কিন্তু পা চলে না আর নিবারণের। মনে হয় আরো কোয়ার্টার মাইল এগিয়ে যাবার আগেই যেন দুর্দান্ত বেগে ছুটে আসবে পিছনের ট্রেন। মুহূর্তে সর্বনাশ ঘটে যাবে। বিদীর্ণ হয়ে পড়বে অসহায় মানুষের করুণ আর্তধ্বনি_তাই তো জীবনধ্বনি।
সেই আর্তধ্বনি যেন স্তব্ধীভূত হয়ে আছে এই অন্ধকারে। পাষাণ হয়ে আছে এই পাহাড়ের রুক্ষতায়।
না, দূরের ডিটোনেটরও লাগিয়ে আসতে পেরেছে। বেঁচে যাবে গাড়ি_যদি না ড্রাইভার মাতাল হয়, যদি সে না ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু নিবারণ বাঁচবে না। কতক্ষণ পরেই জঙ্গল থেকে বাঘ বেরুবে, কিংবা শুনেছি ভালুক আছে এ অঞ্চলে। বাঘ-ভালুক না হোক, সাপ উঠবে না বেয়ে। যা হবে তা হবে, এখন ফিরে যেতে হবে ফের গাড়ির কাছাকাছি। হাত-বাতি লাল করে তাই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ব্রেক-ভ্যানের পিছনে। দু পাশে দুই সাইড ল্যাম্পের লালবাতি, টেইল-ল্যাম্পের লাল বাতি তার উপরে আবার এই হ্যান্ড সিগন্যালের লাল বাতি। যদি, ডিটোনেটর অগ্রাহ্য করলেও নজরে পড়ে এই সর্বনাশের নিশানা।
কে জানে পড়বে কি না। কিন্তু তার আগেই নিবারণ মরে যাবে। শুদ্ধ আতঙ্কে মরে যাবে। বাঘ-ভালুক চোর-ডাকাত ভূত-প্রেতের ভয় নয়। আরেক রকম ভয়। সংজ্ঞাহীন সীমাহীন শরীরহীন ভয়। একটা বিরাট চেতনা বিশাল উপস্থিতির ভয়। এই দুশ্ছেদ্য অন্ধকারে সে যে একেবারে একা, তার ঘর নেই, বাড়ি নেই, তার স্থির কোনো আশ্রয় নেই, দৃঢ় কোনো পরিচয় নেই তার ভয়। এই মুহূর্তে ক্ষুদ্র ঘুষ ক্ষুদ্র প্রমোশন ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির কথা যে মনে আসছে না_শুধু মৃত্যুর কথা মনে আসছে_তার ভয়।
মনে হচ্ছে সেই ভয় যেন মূর্তি গ্রহণ করছে। সমস্ত পাহাড় অরণ্য স্তব্ধতা-অন্ধকার মিলে এক বিরাট পুরুষের আকার নিচ্ছে তার চোখের সামনে। যেন প্রচণ্ড তাণ্ডব মূর্তি অথচ আদিমধ্যান্তশূন্য অশরীরী_
এই বোধহয় মৃত্যুর আবির্ভাব।
কিন্তু পিছনের সেই উদ্দাম ঊর্ধ্বগতি ট্রেন কই?
না, তার বদলে আকাশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে। পূর্ণিমার চাঁদ লাল হয়ে অস্ত যাচ্ছে পশ্চিমে। পুবে লাল হয়ে জাগছে সুগোল সূর্য। নিবারণের মনে হচ্ছে যেন সেই বিরাট পুরুষ দুই হাতে সোনার খঞ্জনি বাজাচ্ছেন, জন্ম-মৃত্যুর খঞ্জনি।
গাইছেন নব জীবনের কীর্তন।
সমস্ত মৃত্যুর পর এই নবজীবনের সংকেত সমস্ত ক্ষুদ্র অস্তিত্বের পর এই বিরাট এক সত্তার অনুভব_এইটিই আজকের উপরি পাওনা।
আজকের নয় অনন্তকালের।
No comments