বাঘা তেঁতুল-হরতালের আত্মকথা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
আগামীকাল আমার বয়স পূর্ণ হইবে ৯২ বছর। সর্বপ্রথম আমাকে যিনি আহ্বান করিয়াছিলেন তাঁহার নাম মহাত্মা গান্ধী। ৬ এপ্রিল ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে। গতকাল ১৪৩২ হিজরির ২৯ রবিউস সানি আমাকে সর্বশেষ ডাকিয়াছিলেন মুফতি আমিনী। মহাত্মা হইতে মুফতি।
তাঁহাদের স্বভাব ও চরিত্রে কী কী মিল ও গরমিল আছে তাহা পাঠক বলিতে পারিবেন, আমি দেখিতেছি চমৎকার অনুপ্রাণ রহিয়াছে।
কিছুকাল যাবৎ বাংলাভাষী কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিক, অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের মধ্যে আত্মকথা বা স্মৃতিকথা লিখিবার প্রবল প্রবণতা দেখা দিয়াছে। পুষ্করিণী ঘাটেরও যদি আত্মকথা হয় আমার আত্মস্মৃতি লিখিতে দোষ কি? আমার ৯২ বছরের জীবন এতই ঘটনাবহুল যে, শরৎবাবুর মতো সেরা নভেল লেখকও আমার সব কথা লিখিয়া শেষ করিতে পারিবেন না। বিমল মিত্র মহাশয়ের কড়ি দিয়ে কিনলাম-এর মতো ঢাউস দশ খণ্ডেও কুলাইবে না।
আমার জন্ম হইয়াছিল অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদের শান্তিপূর্ণ উপায় হিসাবে। ৯২ বছরে আসিয়া দেখিতেছি, অন্যায়-অবিচার করিবার অধিকার বলপূর্বক আদায় করিবার প্রয়োজনেও আমাকে আহ্বান করা হইতেছে।
আমি উপমহাদেশের দেশগুলির স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করিয়াছি। আমি জনগণের বহু অধিকার আদায়ে অতুলনীয় ভূমিকা রাখিয়াছি। ব্রিটিশ আমলে গুজরাতের পোরবন্দরের শান্তিবাদীসহ বহু জাতীয়তাবাদী নেতা আমাকে ব্যবহার করিয়াছেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা লাভ করিল। আমার প্রয়োজন ফুরাইল না। ভাসান চরের মওলানা সাহেব, গোপালগঞ্জের শেখ সাহেব, নীলক্ষেত ও রমনা এলাকার ছাত্রনেতারা আমাকে কাজে লাগাইলেন। বাংলাদেশের জন্মে আমার ভূমিকা রহিয়াছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আমার প্রয়োজন হইয়াছে। আমি না থাকিলে আশির দশকের কবি-শাসক বিংশ শতাব্দীর শেষ দিন পর্যন্ত যে ক্ষমতায় থাকিতেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। নব্বইয়ের ডিসেম্বরে গণ-অভ্যুত্থান আমার কারণেই সার্থক হইয়াছিল। আমি না হইলে ’৯৬-তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব হইত না। দেশের সবচাইতে বড় রাজনৈতিক দল বা জোট এবং শ্রমিক সংগঠনগুলিই আমাকে ব্যবহার করিবার স্পর্ধা রাখে। কিন্তু এখন দেখিতেছি আমাকে আহ্বান করিবার ক্ষমতা যেকোনো সংগঠন ও গোষ্ঠীই রাখে। এখন আমাকে আহ্বান করিতে পারে উৎপীড়ক ও ফতোয়াবাজ ঐক্য পরিষদ, বহুবিবাহ বাস্তবায়ন কমিটি, মধ্যযুগে প্রত্যাবর্তন প্রয়াসী মজলিসসহ এবংবিধ সংগঠনগুলিও।
কীভাবে আমার জন্ম হইয়াছিল তাহা নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণী শুধু নয়, তাহাদের জনক-জননীরাও অনেকে জানেন না। ভারতের জাতির জনক আমারও জনক। শুরুতেই বলিয়াছি, তাহা ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের কথা। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর সাহায্য-সহযোগিতা পাইতে ‘তোমাদের এইটা দিব’, ‘ওইটা দিব’ বলিয়া নানা রকম প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু যুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হইলে কলা দেখায়।
বাঘা বাঘা নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে ব্রিটিশরাজের টনক নড়িল না। দক্ষিণ আফ্রিকায় মানবাধিকার বিষয়ে কাজ করিয়া মোহনদাস গান্ধী সুখ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। তিনি অন্য রকম নেতা। বিহারের চম্পারণ জেলায় নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া সফল হইয়াছিলেন। তিনি এক বুদ্ধি আঁটিলেন। রাউলাট আইনের প্রতিবাদে ’১৯ সালের ৬ এপ্রিল টেকনাফ হইতে পেশোয়ার পর্যন্ত হরতাল পালনের আহ্বান জানাইলেন। সাহেবি ধরনের কংগ্রেস নেতারা মনে করিলেন: লোকটা করে কি? জনগণ ভাবল: তিনি ঠিক কাজই করেছেন। জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করিল। একজন পিকেটারও ছিল না। তখন জাপান হইতে আমদানি করা মোটরগাড়িও বিশেষ ছিল না। গাড়ির মধ্যে ঘোড়ার গাড়ি। সুতরাং পোড়াইবেটা কি?
প্রথম দিন সফল হওয়ায় ঘন ঘন আমাকে আহ্বান করা হইতে লাগিল। আমি আর শান্তিপূর্ণ থাকিলাম না। গত ৯০ বছরে আমার কারণে বহু মা তাঁহাদের সন্তানদের হারাইয়াছেন। বহু যুবতী নারী বিধবা হইয়াছেন। সীমাহীন সম্পদ পুড়িয়া কয়লা হইয়া গিয়াছে। চল্লিশ বৎসর আগে নেতারা আমাকে আহ্বান করিতেন এবং জনগণকে বলিতেন তোমরা উহাকে পালন করো। যাহার ইচ্ছা দোকানপাট বন্ধ করিয়া ঘরে বসিয়া থাকিত, যাহার ইচ্ছা দোকান খুলিত ও যানবাহন লইয়া রাস্তায় চলাচল করিত। এখন আমাকে প্রতিহত বা বানচাল করিবার জন্য সরকারের দিক হইতে নানা কৌশল আবিষ্কার করা হইয়াছে। আমার আহ্বানকারীরাও বসিয়া নাই। পেশাদার পিকেটার বাহিনী গড়িয়া উঠিয়াছে। আমার বদৌলতে অনেকে রিকশার হাওয়া ছাড়িতে ছাড়িতে অথবা গাড়িতে পেট্রল ঢালিয়া আগুন জ্বালাইতে জ্বালাইতে নেতা হইয়া গিয়াছেন।
আশির দশকে আমার জন্য এমন কিছু ঘটনা ঘটিয়াছে, যাহা মনে হইলে না হাসিয়া পারি না। তখন সকাল-সন্ধ্যা হরতালে কাজ হইত না। প্রমোশন পাইলাম। দুই দিন, তিন দিন, তারপর লাগাতার। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের অফিসে হাজিরা না দিলে চাকরি থাকে না। এক প্রতিমন্ত্রী গাড়ির সিটের নিচে শয়ন করিয়া চাদর মুড়ি দিয়া সচিবালয়ে যাইতেছিলেন। পিকেটারদের চোখে ধুলা দিলেও ফটোসাংবাদিকদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেন নাই। অনেক মন্ত্রী আগের রাত্রিতে বাড়ি হইতে টিফিন ক্যারিয়ারে গোটা কয়েক পরোটা ও ভুনা মাংস এবং মশারি বা মশার কয়েক লইয়া সচিবালয়ে রাত্রি যাপন করিতেন। মন্ত্রী তাঁর কক্ষে সোফায় বা কার্পেটে নাক ডাকিয়া ঘুমাইতেন। বাহিরে বারান্দায় পুলিশ চোখে ঘুম লইয়া ঢুলিয়া পড়িতেন।
অনেক কথা বলিবার আছে। শেষ কথা হইল, বাংলাদেশে যত দিন রাজনীতি আছে, তত দিন আমিও আছি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কিছুকাল যাবৎ বাংলাভাষী কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিক, অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের মধ্যে আত্মকথা বা স্মৃতিকথা লিখিবার প্রবল প্রবণতা দেখা দিয়াছে। পুষ্করিণী ঘাটেরও যদি আত্মকথা হয় আমার আত্মস্মৃতি লিখিতে দোষ কি? আমার ৯২ বছরের জীবন এতই ঘটনাবহুল যে, শরৎবাবুর মতো সেরা নভেল লেখকও আমার সব কথা লিখিয়া শেষ করিতে পারিবেন না। বিমল মিত্র মহাশয়ের কড়ি দিয়ে কিনলাম-এর মতো ঢাউস দশ খণ্ডেও কুলাইবে না।
আমার জন্ম হইয়াছিল অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদের শান্তিপূর্ণ উপায় হিসাবে। ৯২ বছরে আসিয়া দেখিতেছি, অন্যায়-অবিচার করিবার অধিকার বলপূর্বক আদায় করিবার প্রয়োজনেও আমাকে আহ্বান করা হইতেছে।
আমি উপমহাদেশের দেশগুলির স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করিয়াছি। আমি জনগণের বহু অধিকার আদায়ে অতুলনীয় ভূমিকা রাখিয়াছি। ব্রিটিশ আমলে গুজরাতের পোরবন্দরের শান্তিবাদীসহ বহু জাতীয়তাবাদী নেতা আমাকে ব্যবহার করিয়াছেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা লাভ করিল। আমার প্রয়োজন ফুরাইল না। ভাসান চরের মওলানা সাহেব, গোপালগঞ্জের শেখ সাহেব, নীলক্ষেত ও রমনা এলাকার ছাত্রনেতারা আমাকে কাজে লাগাইলেন। বাংলাদেশের জন্মে আমার ভূমিকা রহিয়াছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আমার প্রয়োজন হইয়াছে। আমি না থাকিলে আশির দশকের কবি-শাসক বিংশ শতাব্দীর শেষ দিন পর্যন্ত যে ক্ষমতায় থাকিতেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। নব্বইয়ের ডিসেম্বরে গণ-অভ্যুত্থান আমার কারণেই সার্থক হইয়াছিল। আমি না হইলে ’৯৬-তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব হইত না। দেশের সবচাইতে বড় রাজনৈতিক দল বা জোট এবং শ্রমিক সংগঠনগুলিই আমাকে ব্যবহার করিবার স্পর্ধা রাখে। কিন্তু এখন দেখিতেছি আমাকে আহ্বান করিবার ক্ষমতা যেকোনো সংগঠন ও গোষ্ঠীই রাখে। এখন আমাকে আহ্বান করিতে পারে উৎপীড়ক ও ফতোয়াবাজ ঐক্য পরিষদ, বহুবিবাহ বাস্তবায়ন কমিটি, মধ্যযুগে প্রত্যাবর্তন প্রয়াসী মজলিসসহ এবংবিধ সংগঠনগুলিও।
কীভাবে আমার জন্ম হইয়াছিল তাহা নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণী শুধু নয়, তাহাদের জনক-জননীরাও অনেকে জানেন না। ভারতের জাতির জনক আমারও জনক। শুরুতেই বলিয়াছি, তাহা ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের কথা। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর সাহায্য-সহযোগিতা পাইতে ‘তোমাদের এইটা দিব’, ‘ওইটা দিব’ বলিয়া নানা রকম প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু যুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হইলে কলা দেখায়।
বাঘা বাঘা নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে ব্রিটিশরাজের টনক নড়িল না। দক্ষিণ আফ্রিকায় মানবাধিকার বিষয়ে কাজ করিয়া মোহনদাস গান্ধী সুখ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। তিনি অন্য রকম নেতা। বিহারের চম্পারণ জেলায় নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া সফল হইয়াছিলেন। তিনি এক বুদ্ধি আঁটিলেন। রাউলাট আইনের প্রতিবাদে ’১৯ সালের ৬ এপ্রিল টেকনাফ হইতে পেশোয়ার পর্যন্ত হরতাল পালনের আহ্বান জানাইলেন। সাহেবি ধরনের কংগ্রেস নেতারা মনে করিলেন: লোকটা করে কি? জনগণ ভাবল: তিনি ঠিক কাজই করেছেন। জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করিল। একজন পিকেটারও ছিল না। তখন জাপান হইতে আমদানি করা মোটরগাড়িও বিশেষ ছিল না। গাড়ির মধ্যে ঘোড়ার গাড়ি। সুতরাং পোড়াইবেটা কি?
প্রথম দিন সফল হওয়ায় ঘন ঘন আমাকে আহ্বান করা হইতে লাগিল। আমি আর শান্তিপূর্ণ থাকিলাম না। গত ৯০ বছরে আমার কারণে বহু মা তাঁহাদের সন্তানদের হারাইয়াছেন। বহু যুবতী নারী বিধবা হইয়াছেন। সীমাহীন সম্পদ পুড়িয়া কয়লা হইয়া গিয়াছে। চল্লিশ বৎসর আগে নেতারা আমাকে আহ্বান করিতেন এবং জনগণকে বলিতেন তোমরা উহাকে পালন করো। যাহার ইচ্ছা দোকানপাট বন্ধ করিয়া ঘরে বসিয়া থাকিত, যাহার ইচ্ছা দোকান খুলিত ও যানবাহন লইয়া রাস্তায় চলাচল করিত। এখন আমাকে প্রতিহত বা বানচাল করিবার জন্য সরকারের দিক হইতে নানা কৌশল আবিষ্কার করা হইয়াছে। আমার আহ্বানকারীরাও বসিয়া নাই। পেশাদার পিকেটার বাহিনী গড়িয়া উঠিয়াছে। আমার বদৌলতে অনেকে রিকশার হাওয়া ছাড়িতে ছাড়িতে অথবা গাড়িতে পেট্রল ঢালিয়া আগুন জ্বালাইতে জ্বালাইতে নেতা হইয়া গিয়াছেন।
আশির দশকে আমার জন্য এমন কিছু ঘটনা ঘটিয়াছে, যাহা মনে হইলে না হাসিয়া পারি না। তখন সকাল-সন্ধ্যা হরতালে কাজ হইত না। প্রমোশন পাইলাম। দুই দিন, তিন দিন, তারপর লাগাতার। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের অফিসে হাজিরা না দিলে চাকরি থাকে না। এক প্রতিমন্ত্রী গাড়ির সিটের নিচে শয়ন করিয়া চাদর মুড়ি দিয়া সচিবালয়ে যাইতেছিলেন। পিকেটারদের চোখে ধুলা দিলেও ফটোসাংবাদিকদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেন নাই। অনেক মন্ত্রী আগের রাত্রিতে বাড়ি হইতে টিফিন ক্যারিয়ারে গোটা কয়েক পরোটা ও ভুনা মাংস এবং মশারি বা মশার কয়েক লইয়া সচিবালয়ে রাত্রি যাপন করিতেন। মন্ত্রী তাঁর কক্ষে সোফায় বা কার্পেটে নাক ডাকিয়া ঘুমাইতেন। বাহিরে বারান্দায় পুলিশ চোখে ঘুম লইয়া ঢুলিয়া পড়িতেন।
অনেক কথা বলিবার আছে। শেষ কথা হইল, বাংলাদেশে যত দিন রাজনীতি আছে, তত দিন আমিও আছি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments