সমকালীন প্রসঙ্গ-বাংলাদেশের জনগণই এ দেশের মাটি থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্র উচ্ছেদ করেছিল by বদরুদ্দীন উমর
বিষয়টি এভাবে দেখতে সক্ষম হলে এটা বোঝার কোনো অসুবিধা হবে না যে, পরবর্তীকালে স্বাধীনতা ঘোষণা কে করেছিল এই নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে কথা কাটাকাটি, ঝগড়া-বিবাদ, দাবি ও পাল্টা দাবি হতে থাকে তা এক অবাস্তব ও হাস্যকর ব্যাপার ছাড়া আর কী? স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে যে মিথ্যাচার বাংলাদেশে হয়েছে এবং হচ্ছে,
তার কোনো ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই। আসলে কোনো নেতার স্বাধীনতা ঘোষণার অপেক্ষা না করে এ দেশের জনগণ নিজেরাই পাকিস্তান সরকার ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করেছিল। জনগণের এই সংগ্রাম এবং যুদ্ধই এই ভূখণ্ডে পাকিস্তান রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠা করেছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র। এই পরিণতিতে আসার জন্য অন্য যা কিছু ঘটেছিল সেটা ছিল এই মূল প্রক্রিয়ারই অধীন
পাকিস্তান সরকার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর যে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করেছিল, তারপর পাকিস্তানের দুই অংশ একটি অখণ্ড রাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো প্রশ্ন আর ছিল না। ওইদিনই এ অঞ্চল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রকৃতপক্ষে উদ্ভূত হয়েছিল। তারপর নয় মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই সত্য বাস্তব রূপ লাভ করেছিল। এদিক দিয়ে ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করা যথার্থ।
ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় ও সে সঙ্গে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেসব দ্বন্দ্ব ছিল তার মধ্যে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সমগ্র জনগণের দ্বন্দ্ব এবং হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বই প্রাধান্যে আসে। প্রথম দ্বন্দ্বটির মীমাংসা হয়েছিল ব্রিটিশের ভারত ত্যাগ ও ব্রিটিশ ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় দ্বন্দ্বটির মীমাংসা হয়েছিল ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের মীমাংসা যেভাবে হয়েছিল তার মধ্যে কিছু পার্থক্য ছিল। স্বাধীনতার পরপরই পশ্চিম পাকিস্তান এবং উত্তর ভারতে হিন্দু শিখ ও মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিণতিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হিন্দু ও শিখদের প্রায় সমগ্র অংশ দেশ ত্যাগ করে ভারতে এসেছিল এবং পূর্ব পাঞ্জাবে মুসলমানদের প্রায় সমগ্র অংশ ভারত ত্যাগ করে পাকিস্তানে গিয়েছিল। উত্তর ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকেও বিপুলসংখ্যক মুসলমান পশ্চিম পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে বৃহত্তম আকারে জনগণের এই দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল তাতে লাখ লাখ নিরীহ নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ প্রাণ হারিয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়েছিল ১৯৫০ সালে। কিন্তু ১৯৪৭-এর আগস্টের আগে থেকেই হিন্দু মধ্যবিত্ত ও জমিদার শ্রেণীর লোকেরা বড় আকারে দেশত্যাগ করতে থাকে। মুসলমানশাসিত অঞ্চলকে তারা নিজেদের বাসযোগ্য মনে না করার কারণেই এটা ঘটে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কিছুসংখ্যক মধ্যবিত্ত মুসলমান ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে এলেও ১৯৫০-এর দাঙ্গার আগে খুব বড় আকারে তারা এদিকে আসেনি। তাছাড়া ১৯৫০ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা অনেক জায়গায় ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের দাঙ্গার মতো তা এত বিশাল আকারে ঘটেনি।
১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্টের পর যে কারণে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব গুরুত্বহীন হয়েছিল তার সঙ্গে অবশ্য দাঙ্গার কোনো সম্পর্ক ছিল না। দাঙ্গা না হলেও এটা হতো। কারণ ব্রিটিশ আমলে যেভাবে এ অঞ্চলে সমাজে এবং অর্থনীতি ক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল সে প্রাধান্য আগের অবস্থায় থাকার প্রশ্ন আর ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের শাসনে হিন্দু জমিদার, জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ী, সরকারি আমলাদের প্রাধান্য এ অঞ্চলে খর্ব হওয়ার শর্তই তৈরি হয়েছিল। ব্যাপক আকারে মধ্যবিত্ত হিন্দুদের দেশত্যাগ এই পরিবর্তন ত্বরান্বিত করেছিল।
সমাজে এবং অর্থনীতিতে হিন্দু প্রাধান্যের অবসান হওয়ার কারণে হিন্দু-মুসলমান সামাজিক দ্বন্দ্বের অবসান হয়ে এখানে তার স্থান দখল করেছিল অন্য এক দ্বন্দ্ব। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি এবং ভারত থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়া অবাঙালি মুসলমানদের প্রাধান্য। প্রাথমিকভাবে শাসনব্যবস্থায় এই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তা অন্য সব ক্ষেত্রেই বিস্তৃত হয়। এই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ হিসেবে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে তারা বাংলাভাষাকে অগ্রাহ্য করে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা প্রদান করে। এসব থেকে স্পষ্ট দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের পর এ অঞ্চলে বাঙালি-অবাঙালি দ্বন্দ্ব পূর্ববর্তী হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের পরিবর্তে রাজনীতির নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়। এ সঙ্গে তৈরি হয় দুই অংশের বিচ্ছিন্নতার শর্ত।
এই দ্বন্দ্বের বিকাশ হতে থাকার সময় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অসংখ্য কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন, মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক ও পেশাগত আন্দোলন, ছাত্র-যুব আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়। পাকিস্তানের দুই অংশ কৃত্রিমভাবে এক রাষ্ট্রের অন্তর্গত হওয়া সত্ত্বেও, ধর্মের ঐক্য সত্ত্বেও জাতিগত, ভাষাগত এবং আঞ্চলিক পার্থক্য এমন পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছিল, যার সমাধান পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রীয় ঐক্যের অন্য কোনো ভিত্তি না থাকায় শুধু ধর্মীয় ঐক্য যে জনগণকে দীর্ঘদিন এক রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে আটকে রাখতে পারে না, এটা পাকিস্তানের ইতিহাস নতুন করে প্রমাণ করেছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আক্রমণ এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছিল। কিন্তু যদি তা না হতো তা হলেও দুই অংশের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব যেভাবে বিকশিত এবং অগ্রসর হচ্ছিল তাতে পাকিস্তানের এ পরিণতি অনিবার্য ছিল।
এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার মধ্যে যাওয়ার কোনো সুযোগ এখানে নেই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর পরিস্থিতি যেভাবে পরিবর্তিত হচ্ছিল তাতে জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার তাগিদ বাড়ছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্টি হয় এক অভ্যুত্থান পরিস্থিতি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৬৮-৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর এটা ছিল তৃতীয় এক গণঅভ্যুত্থান এবং পূর্ববর্তী দুই অভ্যুত্থান থেকেও অনেক শক্তিশালী। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যখন ২৫ মার্চ জনগণের ওপর তাদের সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে, তখন এখানে একটা অভ্যুত্থান পরিস্থিতিই বিরাজ করছিল। শুধু ঢাকা শহরেই নয়, দেশজুড়ে তখন কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-যুবকসহ সব শ্রেণীর ও সর্বস্তরের জনগণ তখন 'অস্ত্র ধরো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো' এই আওয়াজ তুলে রাস্তায় নেমেছিল। সেই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী জনগণের ওপর যে আক্রমণ করেছিল তাতে উপরোক্ত অভ্যুত্থান পরিস্থিতি পরিণত হয়েছিল স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ পরিস্থিতিতে। এর জন্য জনগণ কারও স্বাধীনতা ঘোষণার অপেক্ষা করেনি। নেতাদের থেকে জনগণের অবস্থান ছিল অনেক অগ্রসর।
বিষয়টি এভাবে দেখতে সক্ষম হলে এটা বোঝার কোনো অসুবিধা হবে না যে, পরবর্তীকালে স্বাধীনতা ঘোষণা কে করেছিল এই নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে কথাকাটাকাটি, ঝগড়া-বিবাদ, দাবি ও পাল্টা দাবি হতে থাকে তা এক অবাস্তব ও হাস্যকর ব্যাপার ছাড়া আর কী? স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে যে মিথ্যাচার বাংলাদেশে হয়েছে এবং হচ্ছে, তার কোনো ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই। আসলে কোনো নেতার স্বাধীনতা ঘোষণার অপেক্ষা না করে এ দেশের জনগণ নিজেরাই পাকিস্তান সরকার ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করেছিল। জনগণের এই সংগ্রাম এবং যুদ্ধই এই ভূখণ্ডে পাকিস্তান রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠা করেছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র। এই পরিণতিতে আসার জন্য অন্য যা কিছু ঘটেছিল সেটা ছিল এই মূল প্রক্রিয়ারই অধীন।
২৫.৩.২০১২
পাকিস্তান সরকার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর যে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করেছিল, তারপর পাকিস্তানের দুই অংশ একটি অখণ্ড রাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো প্রশ্ন আর ছিল না। ওইদিনই এ অঞ্চল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রকৃতপক্ষে উদ্ভূত হয়েছিল। তারপর নয় মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই সত্য বাস্তব রূপ লাভ করেছিল। এদিক দিয়ে ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করা যথার্থ।
ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় ও সে সঙ্গে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেসব দ্বন্দ্ব ছিল তার মধ্যে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সমগ্র জনগণের দ্বন্দ্ব এবং হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বই প্রাধান্যে আসে। প্রথম দ্বন্দ্বটির মীমাংসা হয়েছিল ব্রিটিশের ভারত ত্যাগ ও ব্রিটিশ ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় দ্বন্দ্বটির মীমাংসা হয়েছিল ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের মীমাংসা যেভাবে হয়েছিল তার মধ্যে কিছু পার্থক্য ছিল। স্বাধীনতার পরপরই পশ্চিম পাকিস্তান এবং উত্তর ভারতে হিন্দু শিখ ও মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিণতিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হিন্দু ও শিখদের প্রায় সমগ্র অংশ দেশ ত্যাগ করে ভারতে এসেছিল এবং পূর্ব পাঞ্জাবে মুসলমানদের প্রায় সমগ্র অংশ ভারত ত্যাগ করে পাকিস্তানে গিয়েছিল। উত্তর ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকেও বিপুলসংখ্যক মুসলমান পশ্চিম পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে বৃহত্তম আকারে জনগণের এই দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল তাতে লাখ লাখ নিরীহ নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ প্রাণ হারিয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়েছিল ১৯৫০ সালে। কিন্তু ১৯৪৭-এর আগস্টের আগে থেকেই হিন্দু মধ্যবিত্ত ও জমিদার শ্রেণীর লোকেরা বড় আকারে দেশত্যাগ করতে থাকে। মুসলমানশাসিত অঞ্চলকে তারা নিজেদের বাসযোগ্য মনে না করার কারণেই এটা ঘটে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কিছুসংখ্যক মধ্যবিত্ত মুসলমান ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে এলেও ১৯৫০-এর দাঙ্গার আগে খুব বড় আকারে তারা এদিকে আসেনি। তাছাড়া ১৯৫০ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা অনেক জায়গায় ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের দাঙ্গার মতো তা এত বিশাল আকারে ঘটেনি।
১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্টের পর যে কারণে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব গুরুত্বহীন হয়েছিল তার সঙ্গে অবশ্য দাঙ্গার কোনো সম্পর্ক ছিল না। দাঙ্গা না হলেও এটা হতো। কারণ ব্রিটিশ আমলে যেভাবে এ অঞ্চলে সমাজে এবং অর্থনীতি ক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল সে প্রাধান্য আগের অবস্থায় থাকার প্রশ্ন আর ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের শাসনে হিন্দু জমিদার, জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ী, সরকারি আমলাদের প্রাধান্য এ অঞ্চলে খর্ব হওয়ার শর্তই তৈরি হয়েছিল। ব্যাপক আকারে মধ্যবিত্ত হিন্দুদের দেশত্যাগ এই পরিবর্তন ত্বরান্বিত করেছিল।
সমাজে এবং অর্থনীতিতে হিন্দু প্রাধান্যের অবসান হওয়ার কারণে হিন্দু-মুসলমান সামাজিক দ্বন্দ্বের অবসান হয়ে এখানে তার স্থান দখল করেছিল অন্য এক দ্বন্দ্ব। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি এবং ভারত থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়া অবাঙালি মুসলমানদের প্রাধান্য। প্রাথমিকভাবে শাসনব্যবস্থায় এই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তা অন্য সব ক্ষেত্রেই বিস্তৃত হয়। এই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ হিসেবে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে তারা বাংলাভাষাকে অগ্রাহ্য করে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা প্রদান করে। এসব থেকে স্পষ্ট দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের পর এ অঞ্চলে বাঙালি-অবাঙালি দ্বন্দ্ব পূর্ববর্তী হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের পরিবর্তে রাজনীতির নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়। এ সঙ্গে তৈরি হয় দুই অংশের বিচ্ছিন্নতার শর্ত।
এই দ্বন্দ্বের বিকাশ হতে থাকার সময় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অসংখ্য কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন, মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক ও পেশাগত আন্দোলন, ছাত্র-যুব আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়। পাকিস্তানের দুই অংশ কৃত্রিমভাবে এক রাষ্ট্রের অন্তর্গত হওয়া সত্ত্বেও, ধর্মের ঐক্য সত্ত্বেও জাতিগত, ভাষাগত এবং আঞ্চলিক পার্থক্য এমন পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছিল, যার সমাধান পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রীয় ঐক্যের অন্য কোনো ভিত্তি না থাকায় শুধু ধর্মীয় ঐক্য যে জনগণকে দীর্ঘদিন এক রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে আটকে রাখতে পারে না, এটা পাকিস্তানের ইতিহাস নতুন করে প্রমাণ করেছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আক্রমণ এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছিল। কিন্তু যদি তা না হতো তা হলেও দুই অংশের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব যেভাবে বিকশিত এবং অগ্রসর হচ্ছিল তাতে পাকিস্তানের এ পরিণতি অনিবার্য ছিল।
এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার মধ্যে যাওয়ার কোনো সুযোগ এখানে নেই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর পরিস্থিতি যেভাবে পরিবর্তিত হচ্ছিল তাতে জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার তাগিদ বাড়ছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্টি হয় এক অভ্যুত্থান পরিস্থিতি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৬৮-৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর এটা ছিল তৃতীয় এক গণঅভ্যুত্থান এবং পূর্ববর্তী দুই অভ্যুত্থান থেকেও অনেক শক্তিশালী। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যখন ২৫ মার্চ জনগণের ওপর তাদের সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে, তখন এখানে একটা অভ্যুত্থান পরিস্থিতিই বিরাজ করছিল। শুধু ঢাকা শহরেই নয়, দেশজুড়ে তখন কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-যুবকসহ সব শ্রেণীর ও সর্বস্তরের জনগণ তখন 'অস্ত্র ধরো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো' এই আওয়াজ তুলে রাস্তায় নেমেছিল। সেই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী জনগণের ওপর যে আক্রমণ করেছিল তাতে উপরোক্ত অভ্যুত্থান পরিস্থিতি পরিণত হয়েছিল স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ পরিস্থিতিতে। এর জন্য জনগণ কারও স্বাধীনতা ঘোষণার অপেক্ষা করেনি। নেতাদের থেকে জনগণের অবস্থান ছিল অনেক অগ্রসর।
বিষয়টি এভাবে দেখতে সক্ষম হলে এটা বোঝার কোনো অসুবিধা হবে না যে, পরবর্তীকালে স্বাধীনতা ঘোষণা কে করেছিল এই নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে কথাকাটাকাটি, ঝগড়া-বিবাদ, দাবি ও পাল্টা দাবি হতে থাকে তা এক অবাস্তব ও হাস্যকর ব্যাপার ছাড়া আর কী? স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে যে মিথ্যাচার বাংলাদেশে হয়েছে এবং হচ্ছে, তার কোনো ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই। আসলে কোনো নেতার স্বাধীনতা ঘোষণার অপেক্ষা না করে এ দেশের জনগণ নিজেরাই পাকিস্তান সরকার ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করেছিল। জনগণের এই সংগ্রাম এবং যুদ্ধই এই ভূখণ্ডে পাকিস্তান রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠা করেছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র। এই পরিণতিতে আসার জন্য অন্য যা কিছু ঘটেছিল সেটা ছিল এই মূল প্রক্রিয়ারই অধীন।
২৫.৩.২০১২
No comments