ট্রানজিট-ডব্লিউটিওর বিধানের অপব্যাখ্যা কেন? by আসজাদুল কিবরিয়া
প্রতিবেশী ভারতকে ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশে বরাবরই স্পর্শকাতর একটি বিষয়। অর্থনৈতিক সুবিধাসহ সার্বিক প্রাপ্তিযোগের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন ব্যতিরেকে প্রায় সব সময়ই ট্রানজিটকে রাজনৈতিকভাবে দেখা হয়েছে। তার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত সফর করেন, তখন ট্রানজিটের বিষয়টি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে যেসব প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন, গত এক বছরেও তার প্রায় কোনোটিই সম্পন্ন করা যায়নি। মন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকেরা শুধু বলেছেন যে ট্রানজিট দিলে কোটি কোটি ডলার আয় হবে। কিসের ভিত্তিতে তাঁরা এসব বলেছেন, তাঁরাই ভালো জানেন। তবে এক বছরেও ট্রানজিট-বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। মূলত গত বছরের একেবারে শেষভাগে এসে ট্রানজিট নীতিমালা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়। ট্যারিফ কমিশনের নেতৃত্বে সে কাজ এখনো চলছে।
এ রকম একটি অবস্থায় এসে ট্রানজিট-কেন্দ্রিক বিতর্ককে আবারও উসকে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সম্প্রতি তিনি এক সেমিনারে বলেছেন যে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে কোনো ট্রানজিট ফি বা মাশুল নেবে না। কেননা, এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধিবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাঁর ভাষায়: ‘যদি বাংলাদেশ একটি অসভ্য দেশ হতো এবং বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা যদি অসভ্য ও অশিক্ষিত হতো, তাহলে বলত, আমরা ডব্লিউটিও মানি না। তার নীতি মানি না। আমরা এখানে টাকা-পয়সা আদায় করব।’ (সমকাল, ১ এপ্রিল, ২০১১; পৃ.-২)। ত্রিপুরার পালটানায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করে সড়কপথে আখাউড়া হয়ে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে যাওয়া শুরু করেছে ভারত। এ জন্য কোনো মাশুল বা শুল্ক দিচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি এসব কথা বলেন।
স্বাভাবিকভাবেই তাহলে এখন প্রশ্ন আসে যে ডব্লিউটিওর বিধিবিধানে ট্রানজিট সম্পর্কে কী বলা আছে? জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট) দলিলের পঞ্চম ধারায় (আর্টিকেল-৫) ‘ট্রানজিটের স্বাধীনতা’ বিষয়টি সম্পর্কে নীতি-বিধান উল্লেখ করা হয়েছে, যা কিনা ডব্লিউটিওর সদস্য সব দেশের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এই ধারার তৃতীয় অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে এক দেশ অন্য দেশকে ট্রানজিট-সুবিধা দিলে কী কী শুল্ক ও মাশুল আরোপ করতে পারবে ও পারবে না, তার উল্লেখ আছে। এই ধারার সারকথাটি হলো এ রকম: কোনো দেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে আরেক দেশ ট্রানজিট-সুবিধা নিয়ে পণ্য পরিবহন করলে এ কাজে অপ্রয়োজনীয়ভাবে কোনো বাধা সৃষ্টি বা বিলম্ব করা যাবে না এবং এই পণ্য আনা-নেওয়ার শুল্ক বা ট্রানজিট শুল্ক বা ট্রানজিট-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মাশুলের আওতামুক্ত থাকবে, তবে পরিবহনসংশ্লিষ্ট মাশুল বা ট্রানজিটের জন্য প্রশাসনিক ব্যয় বা প্রদেয় সেবার জন্য মাশুল ব্যতিক্রম বিবেচিত হবে।
অর্থাৎ তৃতীয় অনুচ্ছেদে এটা স্পষ্ট, যেকোনো শুল্ক আদায় করা যাবে না, কিন্তু ট্রানজিট-সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে সেবামাশুল আদায় করা যাবে। আর তা হবে পরিবহনসংশ্লিষ্ট ও প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহকারী।
চতুর্থ অনুচ্ছেদে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে আরোপিত যাবতীয় মাশুল ও নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান যাতায়াত অবস্থা সাপেক্ষে যৌক্তিক হতে হবে। এর মানে হলো, ট্রানজিট-সুবিধা প্রদানকারী দেশ যখন সেবামাশুল আরোপ করবে, তখন তা যেন চড়া বা এমন না হয়, যা কিনা ট্রানজিট-সুবিধা গ্রহণের উদ্দেশ্যকে অর্থাৎ পণ্য পরিবহনে সময় ও ব্যয় সাশ্রয়কে ব্যাহত করে।
আবার পঞ্চম অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে তার সারকথা হলো, প্রথম দেশ দ্বিতীয় দেশকে যেভাবে ট্রানজিট-সুবিধা দেবে, সেই সুবিধা সমভাবে তৃতীয় যেকোনো দেশের জন্য প্রযোজ্য হবে। ডব্লিউটিওর পরিভাষায় এটি বৈষম্যহীন (নন-ডিসক্রিমিনিটরি) চর্চা হিসেবে পরিচিত।
সুতরাং গ্যাটের পঞ্চম ধারার তৃতীয় থেকে পঞ্চম অনুচ্ছেদেই এ-সংক্রান্ত সুস্পষ্ট নীতিনির্দেশনা দেওয়া আছে। এর মূল কথা হলো: ট্রানজিট-সুবিধা দিয়ে এটাকে রাজস্ব আয়ের কোনো উৎস বানানো যাবে না। সে কারণেই কোনো ধরনের শুল্কারোপে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। তবে ট্রানজিটের জন্য প্রশাসনিক ব্যয় ও প্রয়োজনীয় সেবামাশুল আরোপ ও আদায়ে কোনো আইনগত বাধা নেই। কাজেই যাঁরা বলছেন ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিপরীতে সেবামাশুল আদায় করা হলে তা ডব্লিউটিওর বিধি লঙ্ঘন বা অমান্য করা হবে, তাঁরা সঠিক কথা বলছেন না। বরং তাঁরা ডব্লিউটিওর বিধির বা নিয়মের অপব্যাখ্যা করছেন। আর এখানে সভ্য ও শিক্ষিত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে আনা নিতান্তই অযৌক্তিক।
বস্তুত, গত বছরের শেষভাগে এই ট্রানজিট মাশুল নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমানই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে ভারতীয় নৌযান চলাচলের জন্য কোনো ট্রানজিট শুল্ক বা মাশুল আদায় বন্ধ রাখার জন্য বলেছিলেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, যেহেতু ভারতকে বিনা শুল্কে বা বিনা মাশুলে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়টি সরকরের বিবেচনাধীন, সেহেতু এটা স্থগিত রাখতে হবে। তাঁর চিঠির সূত্র ধরেই ভারতীয় হাইকমিশন ট্রানজিট মাশুল না নেওয়ার জন্য দেনদরবার করে। শেষ পর্যন্ত কোনো মাশুল আদায় স্থগিত রাখা হয়। এরপর ট্রানজিট-বিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরির জন্য ট্যারিফ কমিশনের নেতৃত্বে কাজ শুরু হয়।
তাহলে এখন এ প্রশ্নও উঠতে পারে, ট্রানজিট নীতিমালা চূড়ান্ত করার আগেই উপদেষ্টা কেন ও কিসের ভিত্তিতে এ ঘোষণা দিচ্ছেন যে বাংলাদেশ কোনো ট্রানজিট ফি আদায় করবে না? সরকার কি এটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে? দেখা যাচ্ছে, ট্রানজিটকে ঘিরে সরকার আবারও এক ধরনের বিভ্রান্তি ও বিতর্ক সৃষ্টি করছে। এভাবে ডামাডোল তুলে মূল বিষয়টিকে দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বস্তুত, ডব্লিউটিওর নীতি-বিধি অনুসারে বাংলাদেশ একতরফাভাবে ভারতকে ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট-সুবিধা দিতে বাধ্য নয়। বরং বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই উভয়কে তৃতীয় দেশের জন্য ট্রানজিট-সুবিধা দিতে পারে। তা ছাড়া ট্রানজিট, করিডর ও ট্রানশিপমেন্ট নিয়ে ধারণাগত কিছুটা গোলমালও রয়ে গেছে।
উদাহরণসহ সহজ ভাষায় বললে, বাংলাদেশি পণ্যবাহী যান যখন ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল বা ভুটানে যায়, তখন তা হলো ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে ট্রানজিট-সুবিধা প্রদান। আর আন্তর্জাতিক ট্রানজিট পরিচালনার জন্য নীতি-বিধি অনুসৃত হয় বার্সেলোনা ট্রানজিট কনভেনশন-১৯২১ ও নিউইয়র্ক ট্রানজিট কনভেনশন-১৯৬৫ মেনে। আবার বাংলাদেশ যখন ভারতীয় পণ্যবাহী যানকে কলকাতা থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আগরতলায় যাওয়ার সুযোগ দেয়, তখন তা হয় করিডর-সুবিধা। অর্থাৎ এখানে তৃতীয় কোনো দেশের সম্পৃক্ততা নেই। বর্তমানে ভারতকে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি আসলে এই করিডর-সুবিধা দেওয়া। অন্যদিকে ট্রানশিপমেন্ট হলো এক যান থেকে আরেক যানে পণ্য স্থানান্তর। যেমন: ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশের বেনাপোল স্থলবন্দরে প্রবেশ করে পণ্য খালাস করল। এরপর খালাসকৃত ওই পণ্য আবার আরেকটি বাংলাদেশি ট্রাকে তুলে নিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তসংলগ্ন তামাবিল স্থলবন্দরে গিয়ে খালাস করা হলো। সেখান থেকে তা আবার ভারতীয় ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। এই তিনটি পদ্ধতির মধ্যে ট্রানশিপমেন্ট তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ বিবেচিত হয়।
আসলে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ভারতকে ট্রানজিট বা করিডর-সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অসুবিধা হওয়ার কোনো কথা নয়। তবে তা সুপরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদি বিবেচনাপ্রসূত হতে হবে। এ সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তিযোগ কতটা হবে, তা সঠিকভাবে প্রাক্কলন করতে হবে। এই প্রাপ্তিযোগ সেবামাশুল থেকে শুরু করে অন্যান্য বিষয়ও হতে পারে। তবে তা ভারতের সঙ্গে দক্ষতার সঙ্গে দরকষাকষির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। এটি ভারত-বিরোধিতা বা ভারত-বিদ্বেষের কোনো বিষয় নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থবহ লাভের বিষয়। আন্তর্জাতিক রীতি-বিধির আলোকেই এই লাভ নিশ্চিত করা যায়, অযাচিত কোনো ছাড় দিয়ে নয়।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক ও লেখক।
asjadulk@gmail.com
এ রকম একটি অবস্থায় এসে ট্রানজিট-কেন্দ্রিক বিতর্ককে আবারও উসকে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সম্প্রতি তিনি এক সেমিনারে বলেছেন যে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে কোনো ট্রানজিট ফি বা মাশুল নেবে না। কেননা, এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধিবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাঁর ভাষায়: ‘যদি বাংলাদেশ একটি অসভ্য দেশ হতো এবং বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা যদি অসভ্য ও অশিক্ষিত হতো, তাহলে বলত, আমরা ডব্লিউটিও মানি না। তার নীতি মানি না। আমরা এখানে টাকা-পয়সা আদায় করব।’ (সমকাল, ১ এপ্রিল, ২০১১; পৃ.-২)। ত্রিপুরার পালটানায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করে সড়কপথে আখাউড়া হয়ে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে যাওয়া শুরু করেছে ভারত। এ জন্য কোনো মাশুল বা শুল্ক দিচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি এসব কথা বলেন।
স্বাভাবিকভাবেই তাহলে এখন প্রশ্ন আসে যে ডব্লিউটিওর বিধিবিধানে ট্রানজিট সম্পর্কে কী বলা আছে? জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট) দলিলের পঞ্চম ধারায় (আর্টিকেল-৫) ‘ট্রানজিটের স্বাধীনতা’ বিষয়টি সম্পর্কে নীতি-বিধান উল্লেখ করা হয়েছে, যা কিনা ডব্লিউটিওর সদস্য সব দেশের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এই ধারার তৃতীয় অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে এক দেশ অন্য দেশকে ট্রানজিট-সুবিধা দিলে কী কী শুল্ক ও মাশুল আরোপ করতে পারবে ও পারবে না, তার উল্লেখ আছে। এই ধারার সারকথাটি হলো এ রকম: কোনো দেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে আরেক দেশ ট্রানজিট-সুবিধা নিয়ে পণ্য পরিবহন করলে এ কাজে অপ্রয়োজনীয়ভাবে কোনো বাধা সৃষ্টি বা বিলম্ব করা যাবে না এবং এই পণ্য আনা-নেওয়ার শুল্ক বা ট্রানজিট শুল্ক বা ট্রানজিট-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মাশুলের আওতামুক্ত থাকবে, তবে পরিবহনসংশ্লিষ্ট মাশুল বা ট্রানজিটের জন্য প্রশাসনিক ব্যয় বা প্রদেয় সেবার জন্য মাশুল ব্যতিক্রম বিবেচিত হবে।
অর্থাৎ তৃতীয় অনুচ্ছেদে এটা স্পষ্ট, যেকোনো শুল্ক আদায় করা যাবে না, কিন্তু ট্রানজিট-সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে সেবামাশুল আদায় করা যাবে। আর তা হবে পরিবহনসংশ্লিষ্ট ও প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহকারী।
চতুর্থ অনুচ্ছেদে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে আরোপিত যাবতীয় মাশুল ও নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান যাতায়াত অবস্থা সাপেক্ষে যৌক্তিক হতে হবে। এর মানে হলো, ট্রানজিট-সুবিধা প্রদানকারী দেশ যখন সেবামাশুল আরোপ করবে, তখন তা যেন চড়া বা এমন না হয়, যা কিনা ট্রানজিট-সুবিধা গ্রহণের উদ্দেশ্যকে অর্থাৎ পণ্য পরিবহনে সময় ও ব্যয় সাশ্রয়কে ব্যাহত করে।
আবার পঞ্চম অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে তার সারকথা হলো, প্রথম দেশ দ্বিতীয় দেশকে যেভাবে ট্রানজিট-সুবিধা দেবে, সেই সুবিধা সমভাবে তৃতীয় যেকোনো দেশের জন্য প্রযোজ্য হবে। ডব্লিউটিওর পরিভাষায় এটি বৈষম্যহীন (নন-ডিসক্রিমিনিটরি) চর্চা হিসেবে পরিচিত।
সুতরাং গ্যাটের পঞ্চম ধারার তৃতীয় থেকে পঞ্চম অনুচ্ছেদেই এ-সংক্রান্ত সুস্পষ্ট নীতিনির্দেশনা দেওয়া আছে। এর মূল কথা হলো: ট্রানজিট-সুবিধা দিয়ে এটাকে রাজস্ব আয়ের কোনো উৎস বানানো যাবে না। সে কারণেই কোনো ধরনের শুল্কারোপে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। তবে ট্রানজিটের জন্য প্রশাসনিক ব্যয় ও প্রয়োজনীয় সেবামাশুল আরোপ ও আদায়ে কোনো আইনগত বাধা নেই। কাজেই যাঁরা বলছেন ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিপরীতে সেবামাশুল আদায় করা হলে তা ডব্লিউটিওর বিধি লঙ্ঘন বা অমান্য করা হবে, তাঁরা সঠিক কথা বলছেন না। বরং তাঁরা ডব্লিউটিওর বিধির বা নিয়মের অপব্যাখ্যা করছেন। আর এখানে সভ্য ও শিক্ষিত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে আনা নিতান্তই অযৌক্তিক।
বস্তুত, গত বছরের শেষভাগে এই ট্রানজিট মাশুল নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমানই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে ভারতীয় নৌযান চলাচলের জন্য কোনো ট্রানজিট শুল্ক বা মাশুল আদায় বন্ধ রাখার জন্য বলেছিলেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, যেহেতু ভারতকে বিনা শুল্কে বা বিনা মাশুলে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়টি সরকরের বিবেচনাধীন, সেহেতু এটা স্থগিত রাখতে হবে। তাঁর চিঠির সূত্র ধরেই ভারতীয় হাইকমিশন ট্রানজিট মাশুল না নেওয়ার জন্য দেনদরবার করে। শেষ পর্যন্ত কোনো মাশুল আদায় স্থগিত রাখা হয়। এরপর ট্রানজিট-বিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরির জন্য ট্যারিফ কমিশনের নেতৃত্বে কাজ শুরু হয়।
তাহলে এখন এ প্রশ্নও উঠতে পারে, ট্রানজিট নীতিমালা চূড়ান্ত করার আগেই উপদেষ্টা কেন ও কিসের ভিত্তিতে এ ঘোষণা দিচ্ছেন যে বাংলাদেশ কোনো ট্রানজিট ফি আদায় করবে না? সরকার কি এটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে? দেখা যাচ্ছে, ট্রানজিটকে ঘিরে সরকার আবারও এক ধরনের বিভ্রান্তি ও বিতর্ক সৃষ্টি করছে। এভাবে ডামাডোল তুলে মূল বিষয়টিকে দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বস্তুত, ডব্লিউটিওর নীতি-বিধি অনুসারে বাংলাদেশ একতরফাভাবে ভারতকে ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট-সুবিধা দিতে বাধ্য নয়। বরং বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই উভয়কে তৃতীয় দেশের জন্য ট্রানজিট-সুবিধা দিতে পারে। তা ছাড়া ট্রানজিট, করিডর ও ট্রানশিপমেন্ট নিয়ে ধারণাগত কিছুটা গোলমালও রয়ে গেছে।
উদাহরণসহ সহজ ভাষায় বললে, বাংলাদেশি পণ্যবাহী যান যখন ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল বা ভুটানে যায়, তখন তা হলো ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে ট্রানজিট-সুবিধা প্রদান। আর আন্তর্জাতিক ট্রানজিট পরিচালনার জন্য নীতি-বিধি অনুসৃত হয় বার্সেলোনা ট্রানজিট কনভেনশন-১৯২১ ও নিউইয়র্ক ট্রানজিট কনভেনশন-১৯৬৫ মেনে। আবার বাংলাদেশ যখন ভারতীয় পণ্যবাহী যানকে কলকাতা থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আগরতলায় যাওয়ার সুযোগ দেয়, তখন তা হয় করিডর-সুবিধা। অর্থাৎ এখানে তৃতীয় কোনো দেশের সম্পৃক্ততা নেই। বর্তমানে ভারতকে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি আসলে এই করিডর-সুবিধা দেওয়া। অন্যদিকে ট্রানশিপমেন্ট হলো এক যান থেকে আরেক যানে পণ্য স্থানান্তর। যেমন: ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশের বেনাপোল স্থলবন্দরে প্রবেশ করে পণ্য খালাস করল। এরপর খালাসকৃত ওই পণ্য আবার আরেকটি বাংলাদেশি ট্রাকে তুলে নিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তসংলগ্ন তামাবিল স্থলবন্দরে গিয়ে খালাস করা হলো। সেখান থেকে তা আবার ভারতীয় ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। এই তিনটি পদ্ধতির মধ্যে ট্রানশিপমেন্ট তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ বিবেচিত হয়।
আসলে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ভারতকে ট্রানজিট বা করিডর-সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অসুবিধা হওয়ার কোনো কথা নয়। তবে তা সুপরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদি বিবেচনাপ্রসূত হতে হবে। এ সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তিযোগ কতটা হবে, তা সঠিকভাবে প্রাক্কলন করতে হবে। এই প্রাপ্তিযোগ সেবামাশুল থেকে শুরু করে অন্যান্য বিষয়ও হতে পারে। তবে তা ভারতের সঙ্গে দক্ষতার সঙ্গে দরকষাকষির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। এটি ভারত-বিরোধিতা বা ভারত-বিদ্বেষের কোনো বিষয় নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থবহ লাভের বিষয়। আন্তর্জাতিক রীতি-বিধির আলোকেই এই লাভ নিশ্চিত করা যায়, অযাচিত কোনো ছাড় দিয়ে নয়।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক ও লেখক।
asjadulk@gmail.com
No comments