দুর্নীতি দমন কমিশন বিল-আইন সংশোধনে বিলম্ব কেন?

শুধু বাংলাদেশ নয়, বিগত দুই দশকে উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গ দুর্নীতি। দুর্বল গণতন্ত্র, স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতি, শাসনকার্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি উপমহাদেশের দেশগুলোতে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছে। আর বছরের পর বছর এর মূল্য দিতে হচ্ছে দেশ ও জনগণকে।


দুর্নীতি দমনে উপযুক্ত আইন প্রণয়নের দাবিতে আন্না হাজারের নেতৃত্বে তীব্র নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে ভারতে। পাকিস্তানে দুর্নীতি ইস্যুতেই সরকার ও সর্বোচ্চ আদালত প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান মহাজোট সরকারের সময়ে বাংলাদেশে দুর্নীতি ইস্যুতে আদালত অঙ্গন বা নাগরিক সমাজে উত্তাপ ছড়ায়নি বটে, কিন্তু নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে দুর্নীতিই এখানকার রাজনীতির প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। তখন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক থেকে শুরু করে মাঝারি পর্যায়ের অনেক নেতার বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। অনেককে কারাবরণও করতে হয়েছিল। তখন রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, রাজনীতিকদের দুর্নীতি সম্বন্ধে জনমনে পুঞ্জীভূত ধারণা থেকে বিতর্কিত সে অভিযানও জনসমর্থন পেয়েছিল। বিগত কয়েকটি সরকারের সময়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের জরিপে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান একটি জোরদার সামাজিক আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বব্যাপ্ত প্রত্যাখ্যান ভাষা পেয়েছিল। এ সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই অকার্যকর দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ প্রণীত হয়েছিল। আইন প্রণীত হলেও তা কার্যকর ও কমিশন গঠন নিয়ে শ্লথগতির কারণে সে সময় সরকারকে ব্যাপক সমালোচিতও হতে হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিকদের মধ্যে কমিশনটি নিয়ে অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে আশা করা হয়েছিল, আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে কমিশনকে আবার সক্রিয় করে তোলা হবে। নির্বাচনী ইশতেহারেও আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান ব্যক্ত করে আইন প্রণয়নের কথা বলেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও সংশোধিত দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ও সক্রিয় দুর্নীতি দমন কমিশন কোনোটারই দেখা মিলছে না। নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক সংগঠন এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা পর্যন্ত কমিশনকে নখদন্তহীন করে তোলার অভিযোগ তুলেছেন। সরকারের জন্যই এ অভিযোগ সুখকর নয়। সুশাসন ও জবাবদিহিতার স্বার্থেই সরকারের উচিত শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করে একে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটছে বলেই অনেকে মনে করেন। আপত্তি আছে আইনের সংশোধনী নিয়েও। প্রস্তাবিত সংশোধনী গৃহীত হলে দুদক কতটা ক্রিয়াশীল থাকবে_ সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে। আইনগত বিতর্ক বাদ দিলেও আইনটি সংসদে উত্থাপন করার ক্ষেত্রে যে গড়িমসি চলছে তাও কম বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে না। ২০০৯ সালের মে মাসে দুদক আইন সংশোধনের প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন (সংশোধিত)-২০১০ মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। ২০১১ সালের জুনে বিলটি সংসদে ওঠে। এরপর বিলটি চূড়ান্ত করার জন্য আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। তারপর কেটে গেছে আরও নয় মাস। অনেক অজুহাত ও গড়িমসির পরও বিলটি সংসদে উত্থাপিত হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, খুব শিগগির সেটি উত্থাপিত হবেও না। জনগুরুত্বপূর্ণ এমন একটি আইনের এ করুণ পরিস্থিতি নিশ্চয় সুখকর নয়। দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষগুলোর কালক্ষেপণ ও গড়িমসির মধ্য দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্তরা কী মেসেজ পাচ্ছে_ তা ভাবা দরকার। আর আইন সংশোধনে বেলা চলে গেলে কমিশন কখন দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করবে?

No comments

Powered by Blogger.