তিস্তার পানি ১-বিপাকে তিস্তাপারের কৃষক by ইফতেখার মাহমুদ ও মীর মাহমুদুল হাসান

‘যখন পানি দরকার, তখন পাই না। আর যখন দরকার নাই, তখন পানিত ভাসি যাই।’ তিস্তার পানিপ্রবাহ নিয়ে অভিযোগ আর আক্ষেপের মিশেল পাওয়া গেল নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগলগাড়ি গ্রামের কৃষক আশরাফ আলীর কণ্ঠে। একই আক্ষেপ তিস্তা অববাহিকার বেশির ভাগ কৃষকেরও।


তিস্তাপারের কৃষকেরা জানান, এ মাসের শুরুতে হঠাৎ তিস্তায় পানি বেড়ে গেছে। এ সময় বোরোর চারা কিছুটা বাড়ন্ত অবস্থায় আছে। এখন সেচের দরকার নেই। কিন্তু না চাইতেই পানি এসে জমি ভাসিয়ে দিয়েছে। অথচ জানুয়ারিতে জমি প্রস্তুতের সময় প্রচুর পানির দরকার ছিল। কিন্তু কৃষক তখন সেচের জন্য পানি পাননি।
তিস্তার পানির এই অনিয়ন্ত্রিত আসা-যাওয়ার চিহ্ন উত্তরাঞ্চলের পথে পথে দেখা গেল। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় তিস্তা ব্যারাজের মূল ফটকের সামনে ও নীলফামারীর ডিমলায় তিস্তার শাখা খালগুলোর সামনে দেখা মিলল অর্ধমৃত অবস্থায়।
দরকারের সময় প্রয়োজনীয় পানি না পাওয়ার কথা স্বীকার করেন পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন। গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, উজান থেকে পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় প্রকল্পের অর্ধেক এলাকাতেও সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। পানির পরিমাণ বাড়াতে সরকার ভারতের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
হিমালয়ের পাদদেশে ভারতের উত্তর সিকিমে তিস্তার উৎপত্তি। এটি দার্জিলিং হয়ে মেকলিগঞ্জ দিয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ ও পাটগ্রামের দহগ্রামে ঢুকেছে। এ এলাকায় গিয়ে এক সময়কার প্রমত্তা তিস্তার প্রবাহকে বালুচরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝরনাধারার অবশেষ বলে মনে হলো। তিস্তা সেচ প্রকল্পের শাখা খালগুলো ছাড়া কোথাও পানির দেখা মিলল না।
তিস্তা সেচ প্রকল্পের প্রকৌশলীরা বলেছেন, উজান থেকে পানি কম আসায় ৯৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত তিস্তা সেচ প্রকল্প কৃষকের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। তিস্তা অববাহিকার প্রায় পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সরবরাহের কথা ছিল। এতে উত্তরাঞ্চলে অতিরিক্ত ৩০ লাখ টন ধান উৎপাদন হতে পারত বলে সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় তিস্তা কর্তৃপক্ষ মাত্র ৪০ থেকে ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের পানি দিতে পারছে। চার বছর ধরে উজান থেকে পানির প্রবাহ ধীরে ধীরে কমছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও পানি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে কৃষকদের পানি পাওয়া নিশ্চিত করতে হলে ভারত থেকে প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের কী পরিমাণ পানি শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজন, তার একটি পূর্ণাঙ্গ হিসাব থাকা প্রয়োজন।’ তিস্তা ব্যারাজের প্রথম পর্যায়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এক লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ নিশ্চিত করে তবেই দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজ শুরুর পরিকল্পনা করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। এ জন্য ভারতের সঙ্গে চুক্তি হওয়া প্রয়োজন।
তিস্তার একাল-সেকাল: পাউবো ও স্থানীয় সূত্র জানায়, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানিপ্রবাহ ২০০০ সাল থেকে ক্রমাগত কমছে। গত চার বছরে কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। শুষ্ক মৌসুমে এমনও দিন যায়, যখন পানির প্রবাহ এক হাজার কিউসেকের নিচে নেমে আসে, তখন পানির অভাবে ব্যারাজের সেচনালা শুকিয়ে যায়, ফসলের মাঠ ফেটে হয় চৌচির।
জলঢাকার বগলগাড়ি গ্রামের বড় কৃষক সেলিম চৌধুরীর মতে, ‘বেশির ভাগ সময় ব্যারাজের নালায় কোনোমতে পানি পাওয়া যায়। আর মাঝেমধ্যে মনে হয়, পানি পাগলা হইয়া গেছে। এই আসে, এই নাই। কোন সময় কী পরিমাণ পানি আসবে, তা আগে থেকে জানা থাকলে কৃষকের সুবিধা হতো।’
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের আওতাভুক্ত এলাকায় এক লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমি। এতে সেচ দিতে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কিউসেক পানি দরকার। কিন্তু তিন-চার বছর ধরে বাংলাদেশ পাচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার কিউসেক পানি।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, তিস্তার এ চেহারা এ রকম ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ১৯৮৭ সালে তিস্তার উজানে গজালডোবা সেচ প্রকল্পের আওতায় মোট চারটি ব্যারাজ নির্মাণ করে। এরপর নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই তিস্তা অববাহিকায় পানিপ্রবাহ কমতে থাকে। ’৮৯ সালে বাংলাদেশ ভাটিতে নির্মাণ করে তিস্তা ব্যারাজ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কাছে তিস্তা অববাহিকার ’৪৬ থেকে ’৬৮ সালের শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহের তথ্য পাওয়া গেছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিস্তায় চার থেকে ছয় হাজার কিউসেক পর্যন্ত পানির প্রবাহ থাকত। আর বর্ষায় তা লাখ কিউসেক ছাড়িতে যেত।
দেশের উত্তরাঞ্চলের মোট পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের পরিকল্পনা নিয়ে শুরু হয়েছিল তিস্তা প্রকল্প। ’৯৮ সালে মোট ৯৬২ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে এক লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ দেওয়া যায়নি।
তিস্তা প্রকল্পের বাইরে খরচ বেশি: নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কাজীরহাট ইউনিয়নের সর্দারহাট গ্রামের মূল সড়কের দুই পাশে দেখা গেল তিস্তা প্রকল্পের শুকনো সেচনালা। কৃষকেরা গভীর নলকূপ থেকে জমিতে পানি দেন। তাঁরা জানান, তিস্তা প্রকল্প থেকে পানি নিতে প্রতি বিঘা জমির জন্য দিতে হয় ১৬০ টাকা। আর নলকূপ থেকে পানি কিনতে লাগে তিন থেকে চার হাজার টাকা।
সরকারপাড়ার কাদিরখোল গ্রামের কৃষক সুজন চন্দ্র দাস তিস্তা প্রকল্পের শুকনো নালার দিকে আঙুল তুলে বলেন, ‘আট বছর হবার নাইগছে, নালা শুকি গেইছে। শুইকনা নালা ভাঙ্গি যাবার নাইগছে।’
তিস্তার পানি সবচেয়ে ভালোমতো পৌঁছায় এমন এলাকা নীলফামারীর জলঢাকা। সেখানে দেখা গেল অন্য চিত্র। কৃষক নালা ও জমির সংযোগস্থলে মাটি দিয়ে পানির প্রবাহ আটকাতে ব্যস্ত। জমিতে তখন সেচের দরকার নেই। কিন্তু পানি বেশি চলে আসায় কৃষক বিপদে পড়েছেন।
এ পরিস্থিতি কেন হয়, জানতে চাইলে তিস্তা কর্তৃপক্ষের একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এ প্রকল্পে পানি ধরে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রকল্পের আওতায় জমিতে কতটুকু পানি পাওয়া যাবে, তা নির্ভর করে ভারত কী পরিমাণ পানি দেবে তার ওপর। ফলে শুষ্ক মৌসুমে যে দুই থেকে আড়াই হাজার কিউসেক পানি আসে, তা কৃষকদের জমিতে দেওয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.