খাদ্য নিরাপত্তা-জল ও জীবনের সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না by ফারহাত জাহান
জল-জীবন-কৃষি-খাদ্য-পরিবেশের রয়েছে ঘনিষ্ঠ ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক। এ জলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্যের আন্তঃসম্পর্ক। খাদ্য নিরাপত্তার খাতিরে একটি স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের পথে
এগিয়ে যেতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সব আন্তঃসম্পর্ককে খতিয়ে দেখা দরকার
এগিয়ে যেতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সব আন্তঃসম্পর্ককে খতিয়ে দেখা দরকার
জলের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক অনিবার্য। আর এ জীবন জিইয়ে রাখার তাগিদে প্রয়োজনে যে নাম সবার আগে উচ্চারিত হয় তা হলো 'খাদ্য'। জল ও জীবনের এ যূথবদ্ধতাকে সামনে রেখে তাই এবারের 'বিশ্ব পানি দিবস'-এর স্লোগান ছিল_ 'ধিঃবৎ ধহফ ভড়ড়ফ ংবপঁৎরঃু' বা 'জল ও খাদ্য নিরাপত্তা'। আজকের বিশ্বে ৭ বিলিয়ন লোকের মধ্যে ১ বিলিয়ন লোক ক্ষুধায় ভুগছে। বর্তমান বিশ্ব জনসংখ্যার সঙ্গে ২০৩০ সালের মধ্যে আরও দুই বিলিয়ন যোগ হয়ে দাঁড়াবে নয় বিলিয়নে; যা পানি ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বিশেষ হুমকি তৈরি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খাদ্য ও জলের এ যূথবদ্ধতা খাদ্য নিরাপত্তার অভিযাত্রাকে জলের অনিবার্যতার সঙ্গে যুক্ত করে। কেননা খাদ্য উৎপাদনের একটি অন্যতম মৌলিক উপাদানই জল। খাদ্য নিরাপত্তার ধারণা, অধিক উৎপাদনের সরলকৃত সূত্র থেকে বহু আগেই বেরিয়ে এসেছে। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আজ একটি রাজনৈতিক ইস্যু, বৈশ্বিক বিভিন্ন রাজনৈতিক এজেন্ডার সঙ্গে এর বহুমাত্রিক সম্পর্ক বিদ্যমান। খাদ্যদ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সঙ্গেও খাদ্য নিরাপত্তার রয়েছে গভীর সম্পর্ক। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান নগরায়ন, অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন পানির উৎসগুলোকে কমিয়ে দিচ্ছে; যা প্রকারান্তরে পানি সংকট তৈরি করছে। যার সঙ্গে রয়েছে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র। কেবল পানীয় বা খাদ্যের জন্য নয়; শিল্পায়ন, নগরায়ন, কৃষির জন্যও জলের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য।
খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে জলের রয়েছে বহুমাত্রিক সম্পর্ক। এ জল হতে পারে ভূউপরিস্থ জল ও ভূগর্ভস্থ জল উভয়ই। তাই কম অথবা অধিক খাদ্য উৎপাদন পানির ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। গবেষণায় দেখা গেছে, যে অঞ্চলের মানুষের বিশুদ্ধ জল ব্যবহারের অধিক সুযোগ রয়েছে তাদের অপুষ্টিজনিত সমস্যা কম। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অধিক বৃষ্টিপাত বন্যা, খরা, খাদ্য সংকট তৈরি করে। বর্তমান বিশ্বে বৃষ্টিজনিত কৃষি নির্ভরশীলতা হলো শতকরা ৮০ ভাগ, যা বিশ্বের শতকরা ৬০ ভাগ খাদ্য সরবরাহের সঙ্গে জড়িত। এ তথ্য জলের সঙ্গে কৃষি, খাদ্য ও ক্ষুধার নিবিড়তাকে সামনে নিয়ে আসে। কেননা পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে বৃষ্টিজনিত জল, সেচ ব্যবস্থাপনা, নদীর জলের ব্যবহার, মৎস্য উৎপাদন সর্বোপরি কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। অর্থাৎ জল বা জলহীনতা খাদ্য উৎপাদন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্যদিকে যথোপযুক্ত জলের ব্যবহার খাদ্য উৎপাদনকে নিশ্চিত করে। ২৮ জুলাই ২০১০ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের প্রবেশাধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ীও নিরাপদ ও পর্যাপ্ত পানির অধিকার মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা (১৯৪৮) প্রতিটি মানুষের পর্যাপ্ত খাদ্যের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। খাদ্যে অধিকারের প্রশ্নটি পানির অধিকারের সঙ্গে আছে জড়িয়ে; যা বহুমাত্রিক উন্নয়ন ও অধিকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িতও বটে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাস্তবতায় তার সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রবেশাধিকার প্রশ্নটি ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত; যার আওতায় জলও পড়ে।
সব ধরনের খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদন যেমন শস্য, মৎস্য, গবাদিপশু, বনজ উদ্ভিদ এসবের জন্য প্রয়োজন জল। জাতিসংঘের ঁহ-ধিঃবৎ পধসঢ়ধরমহ-এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বের শতকরা ৪০ ভাগের অধিক লোক পানি সংকটে ভুগছে। আর এ পানি সংকটের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো, খাদ্য উৎপাদনে পানি মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। এক কেজি গম তৈরির জন্য ১ হাজার ৫০০ লিটার পানির প্রয়োজন এবং এর ১০ গুণ পানি বেশি প্রয়োজন ১ কেজি গরুর মাংস উৎপাদন করার জন্য। এদিকে ক্রমবর্ধমান নগরায়ন ও আয়ের কারণে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে মাংসের ব্যবহার চলেছে বেড়ে। ১৯৯৯-২০০০ সালে মাথাপিছু মাংস ভক্ষণের পরিমাণ ছিল ৩৭ কেজি; ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের কারণে ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০-এর মধ্যে তা দাঁড়াবে ৫২ কেজিতে। এ বর্ধিত মাংস উৎপাদনের প্রয়োজন পড়বে বর্ধিত শস্যদানার, চাপ বাড়বে কৃষি উৎপাদন ও পানির উৎসগুলোর ওপর। এ তথ্য ভাবতে বাধ্য করে যে, আমাদের ফিরে তাকানোর প্রয়োজন রয়েছে প্রস্তাবিত উন্নয়ন পরিকল্পনা, ক্রমবর্ধমান নগরায়ন ও বিকাশমান বিশ্বায়নের দিকে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় পানি ব্যবস্থাপনা একটি চ্যালেঞ্জ কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে। দেশের অপরিকল্পিত নগরায়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিকাশমান বিশ্বায়ন পানির উৎসগুলোকে সীমিত করেছে, যা কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন করছে ব্যাহত। বাংলাদেশে কৃষির আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় ভূগর্ভস্থ সেচনির্ভর কৃষির বিস্তার খাদ্য উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়েছে, বাড়িয়েছে পানির ব্যবহারও। অন্যদিকে অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও যৌথ নদীর অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে জলের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে ভারতের আধিপত্য বাংলদেশের ভূউপরিস্থ জলরাশি বিশেষত নদীগুলোকে নিয়ে গেছে মৃতপ্রায় অবস্থায়, যা বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থাকে করেছে ব্যাহত, পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে। ধারণা করা হয়, ক্রমাগত অপরিকল্পিত ভূউপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে আগামী দুই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ পড়বে প্রচণ্ড পানি সংকটে। উপরন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জলের অংশীদারিত্বের প্রশ্নে ঐকমত্যের রয়েছে অভাব। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত যৌথ নদী কমিশন চুক্তিতে (১৯৭২) মোট ৫৭টি সীমান্তবর্তী নদীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ৫৩টি ভারত এবং ৩টি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে একটি নদী। পরবর্তী সময়ে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি (১৯৮৩), গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি (১৯৯৬), পানি বণ্টন সমস্যার ন্যায্য সুরাহা করতে হয়েছে ব্যর্থ, বর্তমানে নির্মাণাধীন টিপাইমুখ বাঁধ এ সমস্যাকে করেছে আরও গভীর। ফলে বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশ হয় প্লাবিত আর শুষ্ক মৌসুমে হয় শুষ্কতা আর খরায় পতিত। দেশের কৃষি ব্যবস্থা, খাদ্য উৎপাদন তথা খাদ্য নিরাপত্তা হয় বিঘি্নত। অথচ নিম্নভূমির প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পানি বণ্টনের ন্যায্য হিস্যাদার। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মূলত পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় তার আওতাধীন বিভাগ ও প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, নদীভাঙন, নদী খনন ও নাব্যতা বৃদ্ধি, জলমহাল ব্যবস্থাপনা, উপকূলীয় বাঁধ ব্যবস্থাপনাসহ আন্তঃরাষ্ট্রিক নদীগুলোর পানি বণ্টন ইস্যুগুলো পরিচালনা করে। বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনার এ খণ্ডচিত্র সমগ্র দেশের কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে পানি ব্যবস্থাপনার অভিন্নতাকে তুলে ধরে। কিন্তু অব্যবস্থাপনা, দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতার অভাব বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনা প্রশ্নবিদ্ধ হয় প্রতি বছরই বন্যা ও শুষ্কতার মৌসুমে; ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি এবং কমে যায় খাদ্য উৎপাদন।
জল-জীবন-কৃষি-খাদ্য-পরিবেশের রয়েছে ঘনিষ্ঠ ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক। এ জলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্যের আন্তঃসম্পর্ক। খাদ্য নিরাপত্তার খাতিরে একটি স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সব আন্তঃসম্পর্ককে খতিয়ে দেখা দরকার। এ ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস পুনর্বিবেচনাসহ উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা, বৈশ্বিক উন্নয়ন চুক্তিমালার আলোকে মষড়নধষ মড়াবৎহধহপব-এর কার্যকরী হস্তক্ষেপের রয়েছে প্রয়োজন। প্রয়োজন রয়েছে উন্নয়ন নীতির বিন্যাস, যথাযথ বিনিযোগ, প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্বিন্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনার। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান খাদ্যে চাহিদা পূরণের জন্য কেবল অধিক খাদ্য উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করলে হবে না। কেননা ক্রমহ্রাসমান পানির উৎসগুলো খাদ্য নিরাপত্তার অভিযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। খাদ্য ও জলের এ আন্তঃসম্পর্কের গুরুত্বের কারণেই আজ বিশ্ব পানি দিবসের আহ্বান 'জল ও খাদ্য নিরাপত্তা'। মূলত জল ও খাদ্য সম্পর্ক হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একটিকে বাদ দিয়ে শুধু অপরটিকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যাবে না।
ফারহাত জাহান : গবেষক
খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে জলের রয়েছে বহুমাত্রিক সম্পর্ক। এ জল হতে পারে ভূউপরিস্থ জল ও ভূগর্ভস্থ জল উভয়ই। তাই কম অথবা অধিক খাদ্য উৎপাদন পানির ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। গবেষণায় দেখা গেছে, যে অঞ্চলের মানুষের বিশুদ্ধ জল ব্যবহারের অধিক সুযোগ রয়েছে তাদের অপুষ্টিজনিত সমস্যা কম। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অধিক বৃষ্টিপাত বন্যা, খরা, খাদ্য সংকট তৈরি করে। বর্তমান বিশ্বে বৃষ্টিজনিত কৃষি নির্ভরশীলতা হলো শতকরা ৮০ ভাগ, যা বিশ্বের শতকরা ৬০ ভাগ খাদ্য সরবরাহের সঙ্গে জড়িত। এ তথ্য জলের সঙ্গে কৃষি, খাদ্য ও ক্ষুধার নিবিড়তাকে সামনে নিয়ে আসে। কেননা পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে বৃষ্টিজনিত জল, সেচ ব্যবস্থাপনা, নদীর জলের ব্যবহার, মৎস্য উৎপাদন সর্বোপরি কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। অর্থাৎ জল বা জলহীনতা খাদ্য উৎপাদন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্যদিকে যথোপযুক্ত জলের ব্যবহার খাদ্য উৎপাদনকে নিশ্চিত করে। ২৮ জুলাই ২০১০ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের প্রবেশাধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ীও নিরাপদ ও পর্যাপ্ত পানির অধিকার মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা (১৯৪৮) প্রতিটি মানুষের পর্যাপ্ত খাদ্যের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। খাদ্যে অধিকারের প্রশ্নটি পানির অধিকারের সঙ্গে আছে জড়িয়ে; যা বহুমাত্রিক উন্নয়ন ও অধিকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িতও বটে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাস্তবতায় তার সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রবেশাধিকার প্রশ্নটি ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত; যার আওতায় জলও পড়ে।
সব ধরনের খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদন যেমন শস্য, মৎস্য, গবাদিপশু, বনজ উদ্ভিদ এসবের জন্য প্রয়োজন জল। জাতিসংঘের ঁহ-ধিঃবৎ পধসঢ়ধরমহ-এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বের শতকরা ৪০ ভাগের অধিক লোক পানি সংকটে ভুগছে। আর এ পানি সংকটের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো, খাদ্য উৎপাদনে পানি মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। এক কেজি গম তৈরির জন্য ১ হাজার ৫০০ লিটার পানির প্রয়োজন এবং এর ১০ গুণ পানি বেশি প্রয়োজন ১ কেজি গরুর মাংস উৎপাদন করার জন্য। এদিকে ক্রমবর্ধমান নগরায়ন ও আয়ের কারণে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে মাংসের ব্যবহার চলেছে বেড়ে। ১৯৯৯-২০০০ সালে মাথাপিছু মাংস ভক্ষণের পরিমাণ ছিল ৩৭ কেজি; ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের কারণে ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০-এর মধ্যে তা দাঁড়াবে ৫২ কেজিতে। এ বর্ধিত মাংস উৎপাদনের প্রয়োজন পড়বে বর্ধিত শস্যদানার, চাপ বাড়বে কৃষি উৎপাদন ও পানির উৎসগুলোর ওপর। এ তথ্য ভাবতে বাধ্য করে যে, আমাদের ফিরে তাকানোর প্রয়োজন রয়েছে প্রস্তাবিত উন্নয়ন পরিকল্পনা, ক্রমবর্ধমান নগরায়ন ও বিকাশমান বিশ্বায়নের দিকে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় পানি ব্যবস্থাপনা একটি চ্যালেঞ্জ কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে। দেশের অপরিকল্পিত নগরায়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিকাশমান বিশ্বায়ন পানির উৎসগুলোকে সীমিত করেছে, যা কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন করছে ব্যাহত। বাংলাদেশে কৃষির আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় ভূগর্ভস্থ সেচনির্ভর কৃষির বিস্তার খাদ্য উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়েছে, বাড়িয়েছে পানির ব্যবহারও। অন্যদিকে অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও যৌথ নদীর অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে জলের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে ভারতের আধিপত্য বাংলদেশের ভূউপরিস্থ জলরাশি বিশেষত নদীগুলোকে নিয়ে গেছে মৃতপ্রায় অবস্থায়, যা বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থাকে করেছে ব্যাহত, পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে। ধারণা করা হয়, ক্রমাগত অপরিকল্পিত ভূউপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে আগামী দুই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ পড়বে প্রচণ্ড পানি সংকটে। উপরন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জলের অংশীদারিত্বের প্রশ্নে ঐকমত্যের রয়েছে অভাব। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত যৌথ নদী কমিশন চুক্তিতে (১৯৭২) মোট ৫৭টি সীমান্তবর্তী নদীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ৫৩টি ভারত এবং ৩টি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে একটি নদী। পরবর্তী সময়ে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি (১৯৮৩), গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি (১৯৯৬), পানি বণ্টন সমস্যার ন্যায্য সুরাহা করতে হয়েছে ব্যর্থ, বর্তমানে নির্মাণাধীন টিপাইমুখ বাঁধ এ সমস্যাকে করেছে আরও গভীর। ফলে বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশ হয় প্লাবিত আর শুষ্ক মৌসুমে হয় শুষ্কতা আর খরায় পতিত। দেশের কৃষি ব্যবস্থা, খাদ্য উৎপাদন তথা খাদ্য নিরাপত্তা হয় বিঘি্নত। অথচ নিম্নভূমির প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পানি বণ্টনের ন্যায্য হিস্যাদার। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মূলত পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় তার আওতাধীন বিভাগ ও প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, নদীভাঙন, নদী খনন ও নাব্যতা বৃদ্ধি, জলমহাল ব্যবস্থাপনা, উপকূলীয় বাঁধ ব্যবস্থাপনাসহ আন্তঃরাষ্ট্রিক নদীগুলোর পানি বণ্টন ইস্যুগুলো পরিচালনা করে। বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনার এ খণ্ডচিত্র সমগ্র দেশের কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে পানি ব্যবস্থাপনার অভিন্নতাকে তুলে ধরে। কিন্তু অব্যবস্থাপনা, দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতার অভাব বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনা প্রশ্নবিদ্ধ হয় প্রতি বছরই বন্যা ও শুষ্কতার মৌসুমে; ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি এবং কমে যায় খাদ্য উৎপাদন।
জল-জীবন-কৃষি-খাদ্য-পরিবেশের রয়েছে ঘনিষ্ঠ ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক। এ জলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্যের আন্তঃসম্পর্ক। খাদ্য নিরাপত্তার খাতিরে একটি স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সব আন্তঃসম্পর্ককে খতিয়ে দেখা দরকার। এ ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস পুনর্বিবেচনাসহ উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা, বৈশ্বিক উন্নয়ন চুক্তিমালার আলোকে মষড়নধষ মড়াবৎহধহপব-এর কার্যকরী হস্তক্ষেপের রয়েছে প্রয়োজন। প্রয়োজন রয়েছে উন্নয়ন নীতির বিন্যাস, যথাযথ বিনিযোগ, প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্বিন্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনার। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান খাদ্যে চাহিদা পূরণের জন্য কেবল অধিক খাদ্য উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করলে হবে না। কেননা ক্রমহ্রাসমান পানির উৎসগুলো খাদ্য নিরাপত্তার অভিযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। খাদ্য ও জলের এ আন্তঃসম্পর্কের গুরুত্বের কারণেই আজ বিশ্ব পানি দিবসের আহ্বান 'জল ও খাদ্য নিরাপত্তা'। মূলত জল ও খাদ্য সম্পর্ক হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একটিকে বাদ দিয়ে শুধু অপরটিকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যাবে না।
ফারহাত জাহান : গবেষক
No comments