অতীত অনুসন্ধানের সহজ চেষ্টা by দীপংকর চন্দ
উজ্জ্বল
সূর্যকিরণ চারদিকে। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে বৈশাখের ছন্দময় গান।
রুক্ষ-শুষ্ক-জীর্ণ বেশ ছুড়ে ফেলে নতুন রঙে নিজেকে সাজিয়ে নিতে ব্যস্ত
প্রকৃতি। চেনা-অচেনা বৃক্ষরাজির শাখায় শাখায় নবীন পাতার উচ্ছলতা। অকৃত্রিম
সেই উচ্ছলতার জোয়ার স্পর্শ করেছে বাতাসকে। সমস্ত পিছুটান অগ্রাহ্য করে
বাতাস তাই ছুটে বেড়াচ্ছে বল্গাহীন ঘোড়ার মতো, কেশর ফুলিয়ে দিগন্ত দাপিয়ে।
অসাধারণ, উপভোগ্য মুহূর্তের কি নান্দনিক উপস্থাপন! স্বর্গীয় সময়ের কী
মনোমুগ্ধকর সংযোজন! আচ্ছা, অলৌকিক কোনো মন্ত্রবলে স্থির করে কি ধরে রাখা
যায় না এই স্বর্গীয় সময়কে? ধূসর অতীত হওয়ার হাত থেকে কি রক্ষা করা যায় না
বর্তমানের এই সুখচ্ছবিকে? না, যায় না। ভাবনার অতল থেকে নেতিবাচক উত্তর উঠে
আসে অবলীলায়। কারণ, নশ্বর মানুষের সাধ্য নেই সময়কে স্থির করে ধরে রাখার!
সাধ্য নেই বর্তমানের সুখচ্ছবিকে অতীত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার! মহাজাগতিক
নিয়মে ঘটমান বর্তমান বিলীন হবেই অতীতের গর্ভে। তবে চিত্রাঙ্কন কিংবা
আলোকচিত্র গ্রহণের মতো কিছু প্রতিষ্ঠিত কলাকৌশলে, স্মৃতিবিজড়িত স্মারক
সংগ্রহের মতো কিছু উদ্যোগ-আয়োজনের মাধ্যমে কালের বিস্মৃতিপ্রবণ অঞ্চল থেকে
স্মৃতিকে তুলে এনে অতীত অনুসন্ধানের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হতে পারে বর্তমান
সময়ে বসবাসকারী মানুষ। চিত্রে-আলোকচিত্রে চোখ বুলিয়ে, সংগৃহীত
স্মৃতিস্মারকে দৃষ্টি রেখে ইচ্ছে করলেই তারা হারিয়ে যেতে পারে পুরোনো দিনে,
অন্তর্দৃষ্টি একটু প্রসারিত করলেই তারা ফিরে যেতে পারে ফেলে আসা প্রাচীন
প্রহরে—আর এ কাজে মানুষের দিকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে দিতে প্রস্তুত
‘জাদুঘর’।
ময়মনসিংহ সদরে পৌঁছে তাই রিকশায় চেপে বসলাম প্রথমেই। গন্তব্য ‘ময়মনসিংহ জাদুঘর’। শহরের পৌর ভবনের কাছেই অমৃত বাবু সড়ক। অপ্রশস্ত এই সড়কের একপ্রান্তে দেয়ালঘেরা একটি স্থানের মধ্যবর্তী অংশে প্রবেশপথ। মোটা গ্রিলে তৈরি সেই প্রবেশপথের দুই কোনায় দুটো পাখি আকৃতির অমসৃণ দেয়াল মিশে গেছে সীমানা দেয়ালের সঙ্গে। দ্বাররক্ষীর বাড়াবাড়িহীন প্রবেশপথ নিশ্চিন্তে অতিক্রম করলাম আমরা। শান বাঁধানো সরু পথ আমাদের পায়ের নিচে। হাতের ডান দিকে প্রাণোচ্ছল কাঁঠালিচাপা গাছ। বাঁ দিকে গোলাপসমৃদ্ধ সাজানো বাগান এবং একটু সামনেই একটি বিবর্ণ হলুদ রঙের একতলা ভবন। আগে এই ভবনটি ছিল জমিদার মদনমোহন বাবুর বাগানবাড়ি। দেশভাগের পর বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে বেশ কিছুদিন। ১৯৬৯ সালের ১ আগস্ট মদনমোহন বাবুর এই বাগানবাড়িতে স্থাপন করা হয় ‘মোমেনশাহী জাদুঘর’। সে সময় জাদুঘরটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয় ময়মনসিংহ পৌরসভার ওপর। ১৯৮৯ সালে জাদুঘর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর।
পুরোনো এই জাদুঘর ভবনের সামনের দিকে প্রায় অর্ধবৃত্তাকার একটি কক্ষ। সুউচ্চ বহু জানালাবিশিষ্ট কক্ষটির কেন্দ্রভাগে মাঝারি আকৃতির প্রবেশদ্বার। আলোর প্রাচুর্যময় এ কক্ষটির অভ্যন্তরে দুটি হাতির মাথার কঙ্কাল সংরক্ষিত। অবিশ্বাস্য বিশালাকৃতির এই কঙ্কাল দুটো মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ি থেকে সংগৃহীত। কক্ষের দুই পাশের বর্ধিতাংশের চার কোনায় চারটি মূল্যবান কাঠের শোকেস এবং একপাশে সিমেন্ট ও ঝিনুক দিয়ে নির্মিত একটি রাজহাঁসের প্রতিকৃতি বিদ্যমান। ‘জাদুঘরের কক্ষসংখ্যা সর্বমোট ১১। অফিসের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি কক্ষ ব্যতীত অন্য কক্ষগুলো বর্তমানে ব্যবহূত হচ্ছে সংগৃহীত প্রত্নতাত্ত্বিকসামগ্রী প্রদর্শনের জন্য’—জানালেন জাদুঘরের পরিচালক মো. আসলাম উদ্দিন খান।
ময়মনসিংহ জাদুঘরের সংগৃহীত প্রত্নসামগ্রীর সুবিশাল অংশই বহন করছে মুক্তাগাছার বিখ্যাত জমিদারদের স্মৃতি। অফিসসংলগ্ন কক্ষটিতে বিভিন্ন আকৃতির দেবদেবীর মূর্তির পাশাপাশি নৃত্যরত মহাশ্রীধর বিগ্রহটির উপস্থিতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জাদুঘরের সবচেয়ে বড় কক্ষটিতে রয়েছে মহিষের শিংয়ের সুরা-পানপাত্র, হুক্কা, ধোবাউড়া থেকে সংগৃহীত শিবলিঙ্গ বেদি, আঠারবাড়ী জমিদারবাড়ি থেকে প্রাপ্ত মার্বেল পাথরের গোলটেবিল, গৌরীপুর জমিদারবাড়ি থেকে সংগৃহীত শ্বেতপাথরের টেবিল ছাড়াও সুখস্মৃতিপূর্ণ অতীতের নানা উপাদান। কিন্তু অতীত কি শুধুই সুখস্মৃতিপূর্ণ? না, অতীতের অধিকাংশ অধ্যায়ই ভীষণ বেদনাদায়ক। কিন্তু ইতিহাস সংরক্ষণের প্রচলিত নিয়মে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গুরুত্ব পায় শাসকশ্রেণীর ভোগবিলাসী জীবন ও তাঁদের জীবনোপকরণসামগ্রী। বিপরীতে সাধারণ প্রজাদের যাপিত জীবনের বেদনাদায়ক দিকগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে, অনুল্লেখ্য থাকে শাসক কর্তৃক প্রজা নিপীড়নের উপাত্ত-প্রমাণগুলো। বিষয়টি শুধু ময়মনসিংহ জাদুঘরের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য জাদুঘরের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। তবু ময়মনসিংহ জাদুঘরের প্রাচীন অস্ত্রে সজ্জিত তিনটি শোকেসের এককোনায় অবহেলায় পড়ে থাকা হাত কাটার যন্ত্রটি অতীতের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায়ের একটি নির্মম চিত্র ফুটিয়ে তোলে আমাদের সামনে। মুক্তাগাছা থেকে প্রাপ্ত এই যন্ত্রটি দিয়ে অবাধ্য প্রজাদের শরীর থেকে হাত বিচ্ছিন্ন করতেন জমিদাররা। ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখতে শাসকগোষ্ঠী আর কী ধরনের অত্যাচার চালাতেন প্রজাদের ওপর? সে ইতিহাস জানা কতটুকুই বা সম্ভব আজ? বিষণ্ন মনে ভাবতে থাকি আমরা। অতীত অনুসন্ধানের সহজ চেষ্টায় সহসাই ছেদ টেনে বেরিয়ে আসি জাদুঘরের বাইরে। মাথার অনেক ওপরে আকাশ দেখি, দেখি জলভরা মেঘ, হঠাৎ পাল্টে যাওয়া প্রকৃতি, বিবর্ণ সময়।
ময়মনসিংহ সদরে পৌঁছে তাই রিকশায় চেপে বসলাম প্রথমেই। গন্তব্য ‘ময়মনসিংহ জাদুঘর’। শহরের পৌর ভবনের কাছেই অমৃত বাবু সড়ক। অপ্রশস্ত এই সড়কের একপ্রান্তে দেয়ালঘেরা একটি স্থানের মধ্যবর্তী অংশে প্রবেশপথ। মোটা গ্রিলে তৈরি সেই প্রবেশপথের দুই কোনায় দুটো পাখি আকৃতির অমসৃণ দেয়াল মিশে গেছে সীমানা দেয়ালের সঙ্গে। দ্বাররক্ষীর বাড়াবাড়িহীন প্রবেশপথ নিশ্চিন্তে অতিক্রম করলাম আমরা। শান বাঁধানো সরু পথ আমাদের পায়ের নিচে। হাতের ডান দিকে প্রাণোচ্ছল কাঁঠালিচাপা গাছ। বাঁ দিকে গোলাপসমৃদ্ধ সাজানো বাগান এবং একটু সামনেই একটি বিবর্ণ হলুদ রঙের একতলা ভবন। আগে এই ভবনটি ছিল জমিদার মদনমোহন বাবুর বাগানবাড়ি। দেশভাগের পর বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে বেশ কিছুদিন। ১৯৬৯ সালের ১ আগস্ট মদনমোহন বাবুর এই বাগানবাড়িতে স্থাপন করা হয় ‘মোমেনশাহী জাদুঘর’। সে সময় জাদুঘরটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয় ময়মনসিংহ পৌরসভার ওপর। ১৯৮৯ সালে জাদুঘর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর।
পুরোনো এই জাদুঘর ভবনের সামনের দিকে প্রায় অর্ধবৃত্তাকার একটি কক্ষ। সুউচ্চ বহু জানালাবিশিষ্ট কক্ষটির কেন্দ্রভাগে মাঝারি আকৃতির প্রবেশদ্বার। আলোর প্রাচুর্যময় এ কক্ষটির অভ্যন্তরে দুটি হাতির মাথার কঙ্কাল সংরক্ষিত। অবিশ্বাস্য বিশালাকৃতির এই কঙ্কাল দুটো মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ি থেকে সংগৃহীত। কক্ষের দুই পাশের বর্ধিতাংশের চার কোনায় চারটি মূল্যবান কাঠের শোকেস এবং একপাশে সিমেন্ট ও ঝিনুক দিয়ে নির্মিত একটি রাজহাঁসের প্রতিকৃতি বিদ্যমান। ‘জাদুঘরের কক্ষসংখ্যা সর্বমোট ১১। অফিসের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি কক্ষ ব্যতীত অন্য কক্ষগুলো বর্তমানে ব্যবহূত হচ্ছে সংগৃহীত প্রত্নতাত্ত্বিকসামগ্রী প্রদর্শনের জন্য’—জানালেন জাদুঘরের পরিচালক মো. আসলাম উদ্দিন খান।
ময়মনসিংহ জাদুঘরের সংগৃহীত প্রত্নসামগ্রীর সুবিশাল অংশই বহন করছে মুক্তাগাছার বিখ্যাত জমিদারদের স্মৃতি। অফিসসংলগ্ন কক্ষটিতে বিভিন্ন আকৃতির দেবদেবীর মূর্তির পাশাপাশি নৃত্যরত মহাশ্রীধর বিগ্রহটির উপস্থিতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জাদুঘরের সবচেয়ে বড় কক্ষটিতে রয়েছে মহিষের শিংয়ের সুরা-পানপাত্র, হুক্কা, ধোবাউড়া থেকে সংগৃহীত শিবলিঙ্গ বেদি, আঠারবাড়ী জমিদারবাড়ি থেকে প্রাপ্ত মার্বেল পাথরের গোলটেবিল, গৌরীপুর জমিদারবাড়ি থেকে সংগৃহীত শ্বেতপাথরের টেবিল ছাড়াও সুখস্মৃতিপূর্ণ অতীতের নানা উপাদান। কিন্তু অতীত কি শুধুই সুখস্মৃতিপূর্ণ? না, অতীতের অধিকাংশ অধ্যায়ই ভীষণ বেদনাদায়ক। কিন্তু ইতিহাস সংরক্ষণের প্রচলিত নিয়মে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গুরুত্ব পায় শাসকশ্রেণীর ভোগবিলাসী জীবন ও তাঁদের জীবনোপকরণসামগ্রী। বিপরীতে সাধারণ প্রজাদের যাপিত জীবনের বেদনাদায়ক দিকগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে, অনুল্লেখ্য থাকে শাসক কর্তৃক প্রজা নিপীড়নের উপাত্ত-প্রমাণগুলো। বিষয়টি শুধু ময়মনসিংহ জাদুঘরের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য জাদুঘরের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। তবু ময়মনসিংহ জাদুঘরের প্রাচীন অস্ত্রে সজ্জিত তিনটি শোকেসের এককোনায় অবহেলায় পড়ে থাকা হাত কাটার যন্ত্রটি অতীতের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায়ের একটি নির্মম চিত্র ফুটিয়ে তোলে আমাদের সামনে। মুক্তাগাছা থেকে প্রাপ্ত এই যন্ত্রটি দিয়ে অবাধ্য প্রজাদের শরীর থেকে হাত বিচ্ছিন্ন করতেন জমিদাররা। ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখতে শাসকগোষ্ঠী আর কী ধরনের অত্যাচার চালাতেন প্রজাদের ওপর? সে ইতিহাস জানা কতটুকুই বা সম্ভব আজ? বিষণ্ন মনে ভাবতে থাকি আমরা। অতীত অনুসন্ধানের সহজ চেষ্টায় সহসাই ছেদ টেনে বেরিয়ে আসি জাদুঘরের বাইরে। মাথার অনেক ওপরে আকাশ দেখি, দেখি জলভরা মেঘ, হঠাৎ পাল্টে যাওয়া প্রকৃতি, বিবর্ণ সময়।
No comments