আসন্ন দুর্ভোগ আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব -জলবায়ুর পরিবর্তন by আসাদউল্লাহ খান
সম্প্রতি জেনেভায় অনুষ্ঠিত ১৫৫টি দেশের জলবায়ু সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন জলবায়ুর পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করে সম্মেলনে যোগদানকারী দেশসমূহকে কার্বন নির্গমণের একটা মাত্রা নির্ধারণের ব্যাপারে স্বল্পতম সময়ে চুক্তিতে পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষজ্ঞ মহলের উদ্ধৃতি দিয়ে বান কি মুন বলেছেন, এ ব্যাপারে ব্যাপক অগ্রগতি না হলে এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন না ঘটাতে পারলে বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্যোগ দেখা দিতে পারে।
বিশ্ব পানি ফোরামের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মার্টিন সমারকর্ন সুমেরু অঞ্চলে তাঁর পর্যবেক্ষণ অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন, সুমেরু অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রার দ্বিগুণ। ফলে অত্যধিক মাত্রায় বরফ গলে যাচ্ছে। মোদ্দা কথা, সুমেরু সাগরে ভাসমান বরফের তাক গলে যাওয়া এবং একই সঙ্গে গ্রিনল্যান্ড ও পশ্চিম আন্টার্কটিকায় বরফ গলার কারণে এ শতাব্দীর শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আধা মিটার থেকে দুই মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
উল্লিখিত অঞ্চলে এ রকম মাত্রাতিরিক্ত বরফ গলে যাওয়ার কারণে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠী বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়বে। এ ধরনের দুর্যোগের সবচেয়ে বড় শিকার হবে সাগরের উপকূলে অবস্থিত স্বল্পোন্নত বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল যথা মুম্বাই, গুজরাট, চেন্নাই, কেরালা প্রভৃতি অঞ্চল। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে কার্বন নির্গমণের মাত্রা কমিয়ে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানোর কথা খুবই জোরেশোরে বলা হচ্ছে। কিন্তু কাজটা কে শুরু করবে এবং কোন কোন দেশ এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে? উল্লেখ্য, প্রায় ২৮ কোটি জন-অধ্যুষিত বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এবং শিল্পোন্নত দেশ আমেরিকার অবদান বিশ্বে মোট কার্বন নির্গমণের প্রায় ২৫ শতাংশ হলেও এই নির্গমণ হ্রাস করার ব্যাপারে আমেরিকা বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে অনীহা দেখিয়ে আসছে।
জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কারণে সৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণের জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে এবং বিশ্বব্যাপী জনজীবন, বাসস্থান, খাদ্য উত্পাদন এবং কৃষিব্যবস্থার ওপর এই পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের মতে, ‘আমরা এক্সিলারেটরে পা চেপে বসে আছি’।
বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করলে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলো শুধু যে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছে তা-ই নয়, এসব দেশ বর্তমান মুহূর্তে অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশসমূহে কার্বন নির্গমণের এই ধারা অব্যাহত থাকলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে এবং কোনো রকম দায় ছাড়া বাংলাদেশের জন্য এটা হবে এক অশনি সংকেত। প্রতীয়মান হয়, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের দুই কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। আইপিসিসির পূর্বাভাস অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার থেকে দুই মিটার পর্যন্ত বেড়ে গেলে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ সাগরের নিচে তলিয়ে যাবে এবং এর ফলে নতুন আশ্রয় খোঁজার জন্য মানুষ ধেয়ে চলবে দেশের উত্তরাঞ্চলের দিকে। কিন্তু সেখানে কি এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে ঠাঁই করে দেওয়ার মতো জায়গা আছে? এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য সংস্থানের জন্য শস্য ফলানোর মতো প্রচুর জমি পাওয়া যাবে? পরিস্থিতি যেটা হবে সেটা হলো: অল্প জমি এবং সীমিত সম্পদের ওপর মারাত্ম্যক চাপ সৃষ্টি হবে। সৃষ্টি হবে রাষ্ট্রের জন্য এক দুর্লঙ্ঘ সংকট। কারণ, প্রায় চার কোটি লোক তাদের জীবিকা হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়বে।
উল্লেখ্য, পৃথিবীর শক্তিধর দেশ আমেরিকার বিগত সময়ের বুশ প্রশাসন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ব্যাপারটা গুরুত্বের সঙ্গে না নেওয়ায় অন্যান্য দেশও কার্বন নির্গমণ হ্রাসের ব্যাপারে তাদের প্রতিশ্রুতি থেকে অনেক পিছিয়ে গেছে। চীন এখন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ব্যাপারে শীর্ষে চলে এসেছে। স্বস্তির বিষয়, ওবামা প্রশাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু আগামী ডিসেম্বরে কোপেনহেগেন সম্মেলনে এই সদিচ্ছার কতটা প্রতিফলন ঘটবে সে বিষয়ে কেউ খুব বেশি আশাবাদী এখনো হতে পারেননি।
বাংলাদেশ এই বিপর্যয় কিংবা অনভিপ্রেত পরিস্থিতির জন্য দায়ী না হলেও বাংলাদেশকে এ সমস্যার পূর্ণ দায়ভার বহন করতে হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবল থেকে এ দেশের জনগোষ্ঠী তথা মাটি ও পানিসম্পদ রক্ষা করার জন্য সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ সরকার অনেক আইনি ব্যবস্থা, নীতি প্রণয়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নিয়েছে। বিপর্যয় ঠেকাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার নিজস্ব সংস্থান থেকে এক ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সম্প্রতি জেনেভা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুই ধরনের ড্রেজিং (ক্যাপিটাল এবং মেইনটেনান্স ড্রেজিং)-এর মাধ্যমে ভরাট হওয়া দেশের বড় নদীগুলোর তলদেশ উন্মুক্ত করতে পারলে নদীগুলোর প্রবাহ অব্যাহত থাকবে, পানি ধারণক্ষমতা বাড়বে এবং বন্যার ফলে সৃষ্ট দুর্ভোগ অনেকাংশে কমে আসবে। এই বিরাট কর্মকাণ্ডে সরকারের অর্থের সংস্থান নিয়ে প্রশ্ন আছে। অর্থের সংস্থান হলেও আগের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, মাঠ পর্যায়ে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের নিষ্ঠা, সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে একেবারে সংশয়মুক্ত হওয়া যায় না। শুধু তা-ই নয়, কাজ যাঁরা পর্যবেক্ষণ করবেন, যাঁরা দিকনির্দেশনা দেবেন, তাঁদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতাও প্রশ্নাতীত নয়। কারণ আশির দশক থেকে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে এ দেশের সরকার-সংশ্লিষ্ট প্রাজ্ঞজনেরা বক্তৃতায় যা বলেন, যেসব প্রতিশ্রুতি জনগণকে দেন তা কোনো সময় কাজে পরিণত করে দেখাতে পারেননি।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সংকট সৃষ্টিকারী ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সাহায্য-সহযোগিতা আশা করতে পারে। অবশ্য এ ধরনের আশ্বাসবাণী প্রতিটি দুর্যোগের পর শোনা গেছে। কিন্তু প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য সব সময় রয়ে গেছে এবং তা ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ দেশটা গরিব, তার ওপর ‘দুর্নীতি’ নামের একটি অপসংস্কৃতি দেশটাকে সবদিক থেকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। অন্যদিকে দেশের নেতা-নেত্রীদের বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকার কারণে বিশ্বসভায় আমাদের যুত্সই লবিংও নেই। বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থানরত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছ থেকে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে দুর্ভোগ ও ক্ষতি এড়ানোর জন্য অনেক আশ্বাস হয়তো পাবেন, কিন্তু সে সাহায্য এ দেশে পৌঁছানোর আগেই হয়তো আরেকটা দুর্যোগ আমাদের আঘাত করবে।
নদীভাঙন, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আগামী দিনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। সবচেয়ে বড় কথা, নিজেদের কর্মদক্ষতা, নিষ্ঠা ও সতততার মাধ্যমে দেশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে, কেউ আমাদের মূল্যায়ন করবে না। তাই বাংলাদেশকে তার নিজস্ব সম্পদ, মনোবল, প্রযুক্তিগত ধারণা ও কর্মদক্ষতা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মোতাবেক, উপকূলীয় অঞ্চলে সবুজ বলয় সৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর মতো সঠিক উচ্চতাসহ মজবুত করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বাঁধের দুই পাশে গাছ লাগানো, উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষ নিয়ন্ত্রণ, বিশেষভাবে বেড়িবাঁধের নিচে ছিদ্র করে চিংড়ির ঘেরে পানি ঢোকানোর উদ্যোগ প্রতিহত করা—এসব স্থানীয় প্রচেষ্টা সফল হতে হবে।
পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ পরিবেশের ওপর প্রশিক্ষিত একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। প্রতিমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, সরকারি উদ্যোগে দেশে সাত লাখ একরেরও বেশি জমিতে বন সৃষ্টি করা হবে। যত দূর বুঝতে পারা গেছে, এই বনজ সম্পদ থেকে প্রাপ্ত লাভ এলাকাভিত্তিক জনগোষ্ঠী পাবে। হিসাবটা বড় দূরের এবং জটিলও। বন যেখানে সৃজন করা হবে, সে এলাকার বিপুল জনগোষ্ঠী হতদরিদ্র। জীবন ধারণের ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা না করা গেলে, তাকে আগামীর প্রাপ্তির লোভ দেখিয়ে পরিবেশ রক্ষা কিংবা বনজ সম্পদ ধ্বংস করা থেকে নিবৃত্ত করা যাবে না। তাই এ বিষয়টি গভীরভাবে ভাবতে হবে।
আসাদউল্লাহ খান: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।
aukhanbd@gmail.com
বিশ্ব পানি ফোরামের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মার্টিন সমারকর্ন সুমেরু অঞ্চলে তাঁর পর্যবেক্ষণ অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন, সুমেরু অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রার দ্বিগুণ। ফলে অত্যধিক মাত্রায় বরফ গলে যাচ্ছে। মোদ্দা কথা, সুমেরু সাগরে ভাসমান বরফের তাক গলে যাওয়া এবং একই সঙ্গে গ্রিনল্যান্ড ও পশ্চিম আন্টার্কটিকায় বরফ গলার কারণে এ শতাব্দীর শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আধা মিটার থেকে দুই মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
উল্লিখিত অঞ্চলে এ রকম মাত্রাতিরিক্ত বরফ গলে যাওয়ার কারণে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠী বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়বে। এ ধরনের দুর্যোগের সবচেয়ে বড় শিকার হবে সাগরের উপকূলে অবস্থিত স্বল্পোন্নত বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল যথা মুম্বাই, গুজরাট, চেন্নাই, কেরালা প্রভৃতি অঞ্চল। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে কার্বন নির্গমণের মাত্রা কমিয়ে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানোর কথা খুবই জোরেশোরে বলা হচ্ছে। কিন্তু কাজটা কে শুরু করবে এবং কোন কোন দেশ এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে? উল্লেখ্য, প্রায় ২৮ কোটি জন-অধ্যুষিত বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এবং শিল্পোন্নত দেশ আমেরিকার অবদান বিশ্বে মোট কার্বন নির্গমণের প্রায় ২৫ শতাংশ হলেও এই নির্গমণ হ্রাস করার ব্যাপারে আমেরিকা বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে অনীহা দেখিয়ে আসছে।
জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কারণে সৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণের জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে এবং বিশ্বব্যাপী জনজীবন, বাসস্থান, খাদ্য উত্পাদন এবং কৃষিব্যবস্থার ওপর এই পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের মতে, ‘আমরা এক্সিলারেটরে পা চেপে বসে আছি’।
বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করলে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলো শুধু যে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছে তা-ই নয়, এসব দেশ বর্তমান মুহূর্তে অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশসমূহে কার্বন নির্গমণের এই ধারা অব্যাহত থাকলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে এবং কোনো রকম দায় ছাড়া বাংলাদেশের জন্য এটা হবে এক অশনি সংকেত। প্রতীয়মান হয়, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের দুই কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। আইপিসিসির পূর্বাভাস অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার থেকে দুই মিটার পর্যন্ত বেড়ে গেলে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ সাগরের নিচে তলিয়ে যাবে এবং এর ফলে নতুন আশ্রয় খোঁজার জন্য মানুষ ধেয়ে চলবে দেশের উত্তরাঞ্চলের দিকে। কিন্তু সেখানে কি এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে ঠাঁই করে দেওয়ার মতো জায়গা আছে? এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য সংস্থানের জন্য শস্য ফলানোর মতো প্রচুর জমি পাওয়া যাবে? পরিস্থিতি যেটা হবে সেটা হলো: অল্প জমি এবং সীমিত সম্পদের ওপর মারাত্ম্যক চাপ সৃষ্টি হবে। সৃষ্টি হবে রাষ্ট্রের জন্য এক দুর্লঙ্ঘ সংকট। কারণ, প্রায় চার কোটি লোক তাদের জীবিকা হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়বে।
উল্লেখ্য, পৃথিবীর শক্তিধর দেশ আমেরিকার বিগত সময়ের বুশ প্রশাসন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ব্যাপারটা গুরুত্বের সঙ্গে না নেওয়ায় অন্যান্য দেশও কার্বন নির্গমণ হ্রাসের ব্যাপারে তাদের প্রতিশ্রুতি থেকে অনেক পিছিয়ে গেছে। চীন এখন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ব্যাপারে শীর্ষে চলে এসেছে। স্বস্তির বিষয়, ওবামা প্রশাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু আগামী ডিসেম্বরে কোপেনহেগেন সম্মেলনে এই সদিচ্ছার কতটা প্রতিফলন ঘটবে সে বিষয়ে কেউ খুব বেশি আশাবাদী এখনো হতে পারেননি।
বাংলাদেশ এই বিপর্যয় কিংবা অনভিপ্রেত পরিস্থিতির জন্য দায়ী না হলেও বাংলাদেশকে এ সমস্যার পূর্ণ দায়ভার বহন করতে হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবল থেকে এ দেশের জনগোষ্ঠী তথা মাটি ও পানিসম্পদ রক্ষা করার জন্য সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ সরকার অনেক আইনি ব্যবস্থা, নীতি প্রণয়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নিয়েছে। বিপর্যয় ঠেকাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার নিজস্ব সংস্থান থেকে এক ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সম্প্রতি জেনেভা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুই ধরনের ড্রেজিং (ক্যাপিটাল এবং মেইনটেনান্স ড্রেজিং)-এর মাধ্যমে ভরাট হওয়া দেশের বড় নদীগুলোর তলদেশ উন্মুক্ত করতে পারলে নদীগুলোর প্রবাহ অব্যাহত থাকবে, পানি ধারণক্ষমতা বাড়বে এবং বন্যার ফলে সৃষ্ট দুর্ভোগ অনেকাংশে কমে আসবে। এই বিরাট কর্মকাণ্ডে সরকারের অর্থের সংস্থান নিয়ে প্রশ্ন আছে। অর্থের সংস্থান হলেও আগের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, মাঠ পর্যায়ে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের নিষ্ঠা, সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে একেবারে সংশয়মুক্ত হওয়া যায় না। শুধু তা-ই নয়, কাজ যাঁরা পর্যবেক্ষণ করবেন, যাঁরা দিকনির্দেশনা দেবেন, তাঁদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতাও প্রশ্নাতীত নয়। কারণ আশির দশক থেকে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে এ দেশের সরকার-সংশ্লিষ্ট প্রাজ্ঞজনেরা বক্তৃতায় যা বলেন, যেসব প্রতিশ্রুতি জনগণকে দেন তা কোনো সময় কাজে পরিণত করে দেখাতে পারেননি।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সংকট সৃষ্টিকারী ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সাহায্য-সহযোগিতা আশা করতে পারে। অবশ্য এ ধরনের আশ্বাসবাণী প্রতিটি দুর্যোগের পর শোনা গেছে। কিন্তু প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য সব সময় রয়ে গেছে এবং তা ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ দেশটা গরিব, তার ওপর ‘দুর্নীতি’ নামের একটি অপসংস্কৃতি দেশটাকে সবদিক থেকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। অন্যদিকে দেশের নেতা-নেত্রীদের বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকার কারণে বিশ্বসভায় আমাদের যুত্সই লবিংও নেই। বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থানরত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছ থেকে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে দুর্ভোগ ও ক্ষতি এড়ানোর জন্য অনেক আশ্বাস হয়তো পাবেন, কিন্তু সে সাহায্য এ দেশে পৌঁছানোর আগেই হয়তো আরেকটা দুর্যোগ আমাদের আঘাত করবে।
নদীভাঙন, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আগামী দিনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। সবচেয়ে বড় কথা, নিজেদের কর্মদক্ষতা, নিষ্ঠা ও সতততার মাধ্যমে দেশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে, কেউ আমাদের মূল্যায়ন করবে না। তাই বাংলাদেশকে তার নিজস্ব সম্পদ, মনোবল, প্রযুক্তিগত ধারণা ও কর্মদক্ষতা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মোতাবেক, উপকূলীয় অঞ্চলে সবুজ বলয় সৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর মতো সঠিক উচ্চতাসহ মজবুত করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বাঁধের দুই পাশে গাছ লাগানো, উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষ নিয়ন্ত্রণ, বিশেষভাবে বেড়িবাঁধের নিচে ছিদ্র করে চিংড়ির ঘেরে পানি ঢোকানোর উদ্যোগ প্রতিহত করা—এসব স্থানীয় প্রচেষ্টা সফল হতে হবে।
পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ পরিবেশের ওপর প্রশিক্ষিত একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। প্রতিমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, সরকারি উদ্যোগে দেশে সাত লাখ একরেরও বেশি জমিতে বন সৃষ্টি করা হবে। যত দূর বুঝতে পারা গেছে, এই বনজ সম্পদ থেকে প্রাপ্ত লাভ এলাকাভিত্তিক জনগোষ্ঠী পাবে। হিসাবটা বড় দূরের এবং জটিলও। বন যেখানে সৃজন করা হবে, সে এলাকার বিপুল জনগোষ্ঠী হতদরিদ্র। জীবন ধারণের ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা না করা গেলে, তাকে আগামীর প্রাপ্তির লোভ দেখিয়ে পরিবেশ রক্ষা কিংবা বনজ সম্পদ ধ্বংস করা থেকে নিবৃত্ত করা যাবে না। তাই এ বিষয়টি গভীরভাবে ভাবতে হবে।
আসাদউল্লাহ খান: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।
aukhanbd@gmail.com
No comments