সংযোজনের জন্য কিছু প্রস্তাব -শিক্ষানীতি by মুহাম্মদ ইব্রাহীম
প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অপরিহার্য কিছু সংস্কারের চেষ্টা রয়েছে। বিশেষ করে অর্থবহ ও কার্যকর শিক্ষার লক্ষ্যে সব ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সমানভাবে আবশ্যকীয় করা, পঠন-পাঠন ও পরীক্ষা পদ্ধতিতে সনাতনভাবে প্রচলিত মুখস্থনির্ভর পদ্ধতি থেকে বের হয়ে গিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রচলন এবং বিভিন্ন পছন্দ ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে থাকা ছাত্রছাত্রীদের সব পর্যায়েই উপযুক্ত মানের কারিগরি বিকল্পের দিকে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া—এগুলো এই শিক্ষানীতির খুবই যথার্থ ও বলিষ্ঠ দিক। একে তাই অভিনন্দন জানাচ্ছি ও এর দ্রুত সুষ্ঠু বাস্তবায়ন কামনা করছি। সেই সঙ্গে এই সংস্কারগুলোকে আরও কার্যকর ও সফল করে তুলতে শিক্ষানীতিতে সংযোজনের জন্য কিছু প্রস্তাব রাখছি।
অগ্রাধিকার
শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক ও দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মাধ্যমিক করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই ভিত্তিতেই বাকি নীতিগুলো প্রণীত হয়েছে। এটি বিশ্বজনীনভাবে স্বীকৃত ব্যবস্থা এবং এটিই হওয়া উচিত। তবে এ ক্ষেত্রে শিক্ষানীতির অগ্রাধিকার হওয়া উচিত শুরুতে এর জন্য ভৌত সুবিধাদি ও জনবল স্থানান্তরের বিশাল ব্যয়বহুল যজ্ঞে না গিয়ে এর অন্তর্নিহিত সংস্কার, অর্থাত্ এর পঠন-পাঠন-পরীক্ষাসহ প্রস্তাবিত কার্যক্রমকে, আপাতত যা যেখানে আছে সেখানে রেখেই বাস্তবায়িত করা। এতে প্রারম্ভিক গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ ও মনোযোগটি প্রকৃত শিক্ষা ও যথাযথ মানের দিকে যাবে, প্রশাসনিক পরিবর্তন ও ভৌত নির্মাণের দিকে যাবে না। যেসব ক্ষেত্রে সে রকম বড় পরিবর্তন, নির্মাণ ও আনুষঙ্গিক ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা কম হবে সেখান থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে এই স্থানান্তরের কাজটি দীর্ঘ মেয়াদে করা যাবে। আসলে অন্যান্য সব ক্ষেত্রেও শিক্ষানীতির অন্তর্নিহিত সংস্কারগুলোকে শুরু থেকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা শিক্ষানীতিতেই না থাকলে, পরিবর্তনগুলো বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতাগুলোতে গিয়েই ঠেকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
প্রাথমিক শিক্ষা
১। প্রাথমিক শিক্ষাতেও পঠন-পাঠন-পরীক্ষা পদ্ধতিকে সেই বয়সের উপযুক্ত সৃজনশীল, শিক্ষার্থীর নিজের প্রশ্ন উত্থাপন ও অনুশীলনভিত্তিক হবে। এ জন্য মাধ্যমিকের মতো এখানেও শিক্ষানীতির সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।
২। বিজ্ঞান শিক্ষার অনেকখানি নিজে করে দেখা ও নিজের পর্যবেক্ষণভিত্তিক হবে। এ জন্য পাঠ্যসূচি, পাঠ্যবই ও পঠন-পাঠন পদ্ধতিতে উপযুক্ত পরিবর্তন আনতে হবে। অতীতে এ রকম চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু যথাযথ নীতি ও সহযোগিতার অভাবে তা ধরে রাখা যায়নি। এর জন্য শিক্ষাসামগ্রী-সাপোর্ট হিসেবে অতি সাধারণ ও সহজলভ্য কিছু সরঞ্জামের একটি বিজ্ঞান কিট-বাক্স প্রত্যেক ক্লাসে থাকতে পারে।
৩। পঞ্চম শ্রেণীতে যে সমাপনী পরীক্ষা হবে তাতে বাংলা-ইংরেজি পঠন, লিখন, হিসাব এই রকম কয়েকটি মৌলিক দক্ষতার (কম্পিটেন্স) ওপর সরাসরি যাচাইটিকেই গুরুত্ব দিতে হবে। এ পর্যায়ে এগুলো অর্জন নিশ্চিত না করলে অন্যান্য অনেক কিছুই নিরর্থক হবে।
৪। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা একটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ উদ্যোগ। এটি যেন নেহাত প্রতীকী কিছুতে পরিণত না হয় সে জন্য এর উপায় সম্পর্কে একটি নির্দেশনা থাকা উচিত। আমার প্রস্তাব হলো এর জন্য মাত্র দু-একটি ট্রেডের জন্য স্থায়ী কারিগরি শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে বিভিন্ন উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া যারা সম্ভবমতো বিভিন্ন ট্রেডের কারিগরদের দিয়ে স্বল্পস্থায়ী কোর্সগুলো দেবে এবং ছাত্রের দক্ষতা প্রমাণিত হওয়ার ওপর তাদের নিয়োগের স্থায়িত্ব নির্ভর করবে।
৫। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে পদোন্নতির যোগসূত্র স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। আমার প্রস্তাব হলো প্রশিক্ষণ গ্রহণের সঙ্গে নয়, যথাযথ টেস্টের মাধ্যমে নির্ণিত শিক্ষকতা পারফরমেন্সের সঙ্গেই বরং এ যোগসূত্র স্থাপন করা উচিত। এটি অন্যান্য পর্যায়ের শিক্ষার পক্ষেও প্রযোজ্য।
মাধ্যমিক
১। মাধ্যমিকের শুরু থেকে বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য ইত্যাদি ধারায় বিভক্ত হয়ে গেলে আধুনিক যুগের সম্পূর্ণ নাগরিক গড়া বাধাগ্রস্ত হয়। এই বিভাজন একাদশ শ্রেণীতে হওয়া উচিত এবং তার আগে পর্যন্ত বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, কলার মৌলিক বিষয়গুলো সবার পড়া উচিত। এ ক্ষেত্রে শুধু সাধারণ গণিত আবশ্যকীয় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না। তা ছাড়া একেবারে অল্প বয়সে বিশেষায়ন শুরু না করলে ভবিষ্যতের বিশেষায়িত জ্ঞানে কুলাতে পারা যাবে না এমন ধারণা ঠিক নয়, অভিজ্ঞতায় সমর্থিতও নয়। যদি এভাবে দশম শ্রেণী পর্যন্ত একই ধারা প্রবর্তন করতে একান্তই অনীহা প্রকাশ করা হয়, তাহলে আমার বিকল্প প্রস্তাব হলো আপাতত বিজ্ঞান ধারার শিক্ষার্থীর জন্য ‘বিশ্ব সভ্যতা’ নামক এবং বিজ্ঞান ব্যতীত অন্যান্য ধারার জন্য ‘আধুনিক বিজ্ঞানে অগ্রগতি’ নামক একটি আবশ্যকীয় বিষয় নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত রাখা।
২। মাধ্যমিক শিক্ষার সৃজনশীলতা, কার্যকারিতা, মান ইত্যাদি যেহেতু অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও দরদি তত্ত্বাবধানের দাবি রাখে, তাই এর ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যকর নিয়ন্ত্রণ উপযুক্ত শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, অভিভাবকদের হাতে রাখার ব্যবস্থা নীতিতে থাকা উচিত, প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা নির্বাচনভিত্তিক প্রতিনিধির হাতে না রেখে।
উচ্চশিক্ষা
১। উচ্চশিক্ষার যাবতীয় সংস্কার একটি মাত্র জিনিসের ওপর বিপুলভাবে নির্ভর করে বলে মনে করি, তা হলো শিক্ষার পরিবেশ, পরিবেশ এবং পরিবেশ। শিক্ষা ছাড়া বাকি সবকিছুই প্রকৃত গুরুত্ব পেলে কোনো নীতিই কাজ করবে না। এ ব্যাপারে শিক্ষানীতিতে সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা ও কৌশল থাকতে হবে।
২। পঠন-পাঠন, পরীক্ষা সব কিছু সৃজনশীল ও বিশ্লেষণমূলক ব্যবস্থার ভিত্তিতে হতে হবে, যা শিক্ষার্থীকে পুরো কোর্সেই এই বিষয়ে নিবেদিত ও অনুসন্ধিত্সু রাখবে। সময় এলে মুখস্থ করে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা কাউকে শিক্ষিত করে না। এ জন্য সারা দুনিয়ায় প্রচলিত দৈনন্দিন অ্যাসাইনমেন্ট, সমস্যা সমাধানমূলক কাজ ইত্যাদিকেই পরীক্ষার বড় অংশ করতে হবে, মূল পরীক্ষাকেও সৃজনশীল করতে হবে।
৩। দুই-একটি ব্যতিক্রমী বিষয় ছাড়া অন্যগুলোর অন্তত আংশিক পরীক্ষা ইংরেজিতে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে আমাদের উচ্চশিক্ষা বিশ্ববাজারে আদৃত নাও হতে পারে।
৪। বিভিন্ন মানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নিশ্চিত করার চেষ্টায় একটি স্বাধীন এডুকেশন টেস্টিং সার্ভিসের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত ও কার্যকর গ্র্যাজুয়েট মান নির্ণয় পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এটি সারা দুনিয়ায় রয়েছে।
৫। উচ্চশিক্ষার সব বিষয়ে অন্তত ছয় মাস দীর্ঘ ইন্টার্ন ব্যবস্থা চালু করা উচিত। এ সময়ে শিক্ষার্থী বাস্তব কর্মস্থলে কাজ করে শিক্ষা নেবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত এসে এ সম্পর্কে অ্যাসাইনমেন্ট লিখবে। এ জন্য বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক কর্মস্থলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতার চুক্তি থাকবে।
বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা
১। বিভিন্ন পর্যায় থেকে কারিগরি বিকল্প ধারায় যাওয়ার যে অভিনন্দনযোগ্য ব্যবস্থা শিক্ষানীতিতে রাখা হয়েছে তাকে শুধু উপযুক্ত মানে নয়, উপযুক্ত সম্মানেও অভিষিক্ত করতে হবে। মূল ধারার সঙ্গে এর সমতা শুধু বাহ্যিকভাবে নয়, চাকরির মর্যাদা, প্রমোশন ইত্যাদির মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠিত করার ব্যবস্থা নীতিতে থাকা উচিত।
২। কারিগরি শিক্ষার এক একটি পর্যায় থেকে কোনো শিক্ষার্থী যদি মূল ধারায় ফিরে আসতে চায় তা হলে তাকে ক্ষেত্রবিশেষে এক বা দুই বছরের একটি অন্তবৃর্তীকালীন প্রস্তুতি কোর্স ও পরীক্ষা দিয়ে ফিরে আসার সুযোগ ‘কারিগরি শিক্ষার পথনির্দেশিকায়’ থাকতে হবে। এটি ডিপ্লোমা করার ও ডিপ্লোমা থেকে প্রফেশনাল ডিগ্রি করার ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য হবে, কারিগরি ধারা থেকে সাধারণ বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া উচিত।
৩। অংশত শিক্ষাকেন্দ্রে এবং অংশত বাস্তব কর্মস্থলে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে স্যান্ডউইচ বৃত্তিমূলক শিক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এরও মান ও সম্মান একই রকম হতে হবে।
৪। বৃত্তিমূলক শিক্ষা যাতে কেউ চাকরিতে অথবা ব্যবসায় রত থেকেই প্রয়োজনে দীর্ঘতর সময়ে লাভ করতে পারে তার জন্য আরও নমনীয়তা এতে থাকতে পারে।
৫। প্রাইভেট ব্যবস্থাগুলোকে তাদের নিজস্ব সৃষ্টিশীলতা বজায় রেখে প্রমিতকরণের এবং এ ক্ষেত্রে প্রাইভেট-পাবলিক সহযোগিতা সৃষ্টির কাজগুলো অধিদপ্তরে না করে সরকার ও প্রাইভেট প্রতিনিধিত্ব সম্পন্ন একটি মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠান এর জন্য সৃষ্টি করা উচিত।
বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা
বিভিন্নমুখী প্রয়োজনের এই ব্যাপক কর্মকাণ্ড নানা অভীষ্ট গোষ্ঠীর প্রয়োজনে নানা কৌশলে হতে হয়। বড় বড় সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে ঢালাও প্রক্রিয়ায় এর প্রকৃত বাস্তবায়ন কঠিন হবে। তাই এর মধ্যে বহুমুখিতা, নমনীয়তা এবং বহু রকম কৌশল ও সৃজনশীলতাকে যাতে স্থান করে দেওয়া যায়, এই উদ্দেশ্যে স্বতঃপ্রণোদিত যারা বেসরকারিভাবে কাজ করছে তাদের সহায়তা দেওয়ার নীতিই বেশি কাম্য। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বকীয়তার ও আত্মনিবেদিত যোগ্যতার মূল্য অনেক। সেটি উপযুক্তভাবে নির্ণয় করে তাদের সর্বতোভাবে সহায়তা দেওয়া ও প্রয়োজনে তাদের সফল কাজগুলোকে সম্প্রসারণ করার জন্য উদ্যোগ নেওয়ার ব্যবস্থা শিক্ষানীতিতে থাকা উচিত। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোকে একটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিত্বমূলক মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানে রূপ দিয়ে এ রকম উদ্যোগ নেওয়া যায়।
মুহাম্মদ ইব্রাহীম: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অগ্রাধিকার
শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক ও দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মাধ্যমিক করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই ভিত্তিতেই বাকি নীতিগুলো প্রণীত হয়েছে। এটি বিশ্বজনীনভাবে স্বীকৃত ব্যবস্থা এবং এটিই হওয়া উচিত। তবে এ ক্ষেত্রে শিক্ষানীতির অগ্রাধিকার হওয়া উচিত শুরুতে এর জন্য ভৌত সুবিধাদি ও জনবল স্থানান্তরের বিশাল ব্যয়বহুল যজ্ঞে না গিয়ে এর অন্তর্নিহিত সংস্কার, অর্থাত্ এর পঠন-পাঠন-পরীক্ষাসহ প্রস্তাবিত কার্যক্রমকে, আপাতত যা যেখানে আছে সেখানে রেখেই বাস্তবায়িত করা। এতে প্রারম্ভিক গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ ও মনোযোগটি প্রকৃত শিক্ষা ও যথাযথ মানের দিকে যাবে, প্রশাসনিক পরিবর্তন ও ভৌত নির্মাণের দিকে যাবে না। যেসব ক্ষেত্রে সে রকম বড় পরিবর্তন, নির্মাণ ও আনুষঙ্গিক ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা কম হবে সেখান থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে এই স্থানান্তরের কাজটি দীর্ঘ মেয়াদে করা যাবে। আসলে অন্যান্য সব ক্ষেত্রেও শিক্ষানীতির অন্তর্নিহিত সংস্কারগুলোকে শুরু থেকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা শিক্ষানীতিতেই না থাকলে, পরিবর্তনগুলো বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতাগুলোতে গিয়েই ঠেকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
প্রাথমিক শিক্ষা
১। প্রাথমিক শিক্ষাতেও পঠন-পাঠন-পরীক্ষা পদ্ধতিকে সেই বয়সের উপযুক্ত সৃজনশীল, শিক্ষার্থীর নিজের প্রশ্ন উত্থাপন ও অনুশীলনভিত্তিক হবে। এ জন্য মাধ্যমিকের মতো এখানেও শিক্ষানীতির সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।
২। বিজ্ঞান শিক্ষার অনেকখানি নিজে করে দেখা ও নিজের পর্যবেক্ষণভিত্তিক হবে। এ জন্য পাঠ্যসূচি, পাঠ্যবই ও পঠন-পাঠন পদ্ধতিতে উপযুক্ত পরিবর্তন আনতে হবে। অতীতে এ রকম চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু যথাযথ নীতি ও সহযোগিতার অভাবে তা ধরে রাখা যায়নি। এর জন্য শিক্ষাসামগ্রী-সাপোর্ট হিসেবে অতি সাধারণ ও সহজলভ্য কিছু সরঞ্জামের একটি বিজ্ঞান কিট-বাক্স প্রত্যেক ক্লাসে থাকতে পারে।
৩। পঞ্চম শ্রেণীতে যে সমাপনী পরীক্ষা হবে তাতে বাংলা-ইংরেজি পঠন, লিখন, হিসাব এই রকম কয়েকটি মৌলিক দক্ষতার (কম্পিটেন্স) ওপর সরাসরি যাচাইটিকেই গুরুত্ব দিতে হবে। এ পর্যায়ে এগুলো অর্জন নিশ্চিত না করলে অন্যান্য অনেক কিছুই নিরর্থক হবে।
৪। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা একটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ উদ্যোগ। এটি যেন নেহাত প্রতীকী কিছুতে পরিণত না হয় সে জন্য এর উপায় সম্পর্কে একটি নির্দেশনা থাকা উচিত। আমার প্রস্তাব হলো এর জন্য মাত্র দু-একটি ট্রেডের জন্য স্থায়ী কারিগরি শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে বিভিন্ন উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া যারা সম্ভবমতো বিভিন্ন ট্রেডের কারিগরদের দিয়ে স্বল্পস্থায়ী কোর্সগুলো দেবে এবং ছাত্রের দক্ষতা প্রমাণিত হওয়ার ওপর তাদের নিয়োগের স্থায়িত্ব নির্ভর করবে।
৫। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে পদোন্নতির যোগসূত্র স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। আমার প্রস্তাব হলো প্রশিক্ষণ গ্রহণের সঙ্গে নয়, যথাযথ টেস্টের মাধ্যমে নির্ণিত শিক্ষকতা পারফরমেন্সের সঙ্গেই বরং এ যোগসূত্র স্থাপন করা উচিত। এটি অন্যান্য পর্যায়ের শিক্ষার পক্ষেও প্রযোজ্য।
মাধ্যমিক
১। মাধ্যমিকের শুরু থেকে বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য ইত্যাদি ধারায় বিভক্ত হয়ে গেলে আধুনিক যুগের সম্পূর্ণ নাগরিক গড়া বাধাগ্রস্ত হয়। এই বিভাজন একাদশ শ্রেণীতে হওয়া উচিত এবং তার আগে পর্যন্ত বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, কলার মৌলিক বিষয়গুলো সবার পড়া উচিত। এ ক্ষেত্রে শুধু সাধারণ গণিত আবশ্যকীয় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না। তা ছাড়া একেবারে অল্প বয়সে বিশেষায়ন শুরু না করলে ভবিষ্যতের বিশেষায়িত জ্ঞানে কুলাতে পারা যাবে না এমন ধারণা ঠিক নয়, অভিজ্ঞতায় সমর্থিতও নয়। যদি এভাবে দশম শ্রেণী পর্যন্ত একই ধারা প্রবর্তন করতে একান্তই অনীহা প্রকাশ করা হয়, তাহলে আমার বিকল্প প্রস্তাব হলো আপাতত বিজ্ঞান ধারার শিক্ষার্থীর জন্য ‘বিশ্ব সভ্যতা’ নামক এবং বিজ্ঞান ব্যতীত অন্যান্য ধারার জন্য ‘আধুনিক বিজ্ঞানে অগ্রগতি’ নামক একটি আবশ্যকীয় বিষয় নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত রাখা।
২। মাধ্যমিক শিক্ষার সৃজনশীলতা, কার্যকারিতা, মান ইত্যাদি যেহেতু অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও দরদি তত্ত্বাবধানের দাবি রাখে, তাই এর ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যকর নিয়ন্ত্রণ উপযুক্ত শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, অভিভাবকদের হাতে রাখার ব্যবস্থা নীতিতে থাকা উচিত, প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা নির্বাচনভিত্তিক প্রতিনিধির হাতে না রেখে।
উচ্চশিক্ষা
১। উচ্চশিক্ষার যাবতীয় সংস্কার একটি মাত্র জিনিসের ওপর বিপুলভাবে নির্ভর করে বলে মনে করি, তা হলো শিক্ষার পরিবেশ, পরিবেশ এবং পরিবেশ। শিক্ষা ছাড়া বাকি সবকিছুই প্রকৃত গুরুত্ব পেলে কোনো নীতিই কাজ করবে না। এ ব্যাপারে শিক্ষানীতিতে সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা ও কৌশল থাকতে হবে।
২। পঠন-পাঠন, পরীক্ষা সব কিছু সৃজনশীল ও বিশ্লেষণমূলক ব্যবস্থার ভিত্তিতে হতে হবে, যা শিক্ষার্থীকে পুরো কোর্সেই এই বিষয়ে নিবেদিত ও অনুসন্ধিত্সু রাখবে। সময় এলে মুখস্থ করে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা কাউকে শিক্ষিত করে না। এ জন্য সারা দুনিয়ায় প্রচলিত দৈনন্দিন অ্যাসাইনমেন্ট, সমস্যা সমাধানমূলক কাজ ইত্যাদিকেই পরীক্ষার বড় অংশ করতে হবে, মূল পরীক্ষাকেও সৃজনশীল করতে হবে।
৩। দুই-একটি ব্যতিক্রমী বিষয় ছাড়া অন্যগুলোর অন্তত আংশিক পরীক্ষা ইংরেজিতে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে আমাদের উচ্চশিক্ষা বিশ্ববাজারে আদৃত নাও হতে পারে।
৪। বিভিন্ন মানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নিশ্চিত করার চেষ্টায় একটি স্বাধীন এডুকেশন টেস্টিং সার্ভিসের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত ও কার্যকর গ্র্যাজুয়েট মান নির্ণয় পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এটি সারা দুনিয়ায় রয়েছে।
৫। উচ্চশিক্ষার সব বিষয়ে অন্তত ছয় মাস দীর্ঘ ইন্টার্ন ব্যবস্থা চালু করা উচিত। এ সময়ে শিক্ষার্থী বাস্তব কর্মস্থলে কাজ করে শিক্ষা নেবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত এসে এ সম্পর্কে অ্যাসাইনমেন্ট লিখবে। এ জন্য বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক কর্মস্থলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতার চুক্তি থাকবে।
বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা
১। বিভিন্ন পর্যায় থেকে কারিগরি বিকল্প ধারায় যাওয়ার যে অভিনন্দনযোগ্য ব্যবস্থা শিক্ষানীতিতে রাখা হয়েছে তাকে শুধু উপযুক্ত মানে নয়, উপযুক্ত সম্মানেও অভিষিক্ত করতে হবে। মূল ধারার সঙ্গে এর সমতা শুধু বাহ্যিকভাবে নয়, চাকরির মর্যাদা, প্রমোশন ইত্যাদির মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠিত করার ব্যবস্থা নীতিতে থাকা উচিত।
২। কারিগরি শিক্ষার এক একটি পর্যায় থেকে কোনো শিক্ষার্থী যদি মূল ধারায় ফিরে আসতে চায় তা হলে তাকে ক্ষেত্রবিশেষে এক বা দুই বছরের একটি অন্তবৃর্তীকালীন প্রস্তুতি কোর্স ও পরীক্ষা দিয়ে ফিরে আসার সুযোগ ‘কারিগরি শিক্ষার পথনির্দেশিকায়’ থাকতে হবে। এটি ডিপ্লোমা করার ও ডিপ্লোমা থেকে প্রফেশনাল ডিগ্রি করার ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য হবে, কারিগরি ধারা থেকে সাধারণ বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া উচিত।
৩। অংশত শিক্ষাকেন্দ্রে এবং অংশত বাস্তব কর্মস্থলে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে স্যান্ডউইচ বৃত্তিমূলক শিক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এরও মান ও সম্মান একই রকম হতে হবে।
৪। বৃত্তিমূলক শিক্ষা যাতে কেউ চাকরিতে অথবা ব্যবসায় রত থেকেই প্রয়োজনে দীর্ঘতর সময়ে লাভ করতে পারে তার জন্য আরও নমনীয়তা এতে থাকতে পারে।
৫। প্রাইভেট ব্যবস্থাগুলোকে তাদের নিজস্ব সৃষ্টিশীলতা বজায় রেখে প্রমিতকরণের এবং এ ক্ষেত্রে প্রাইভেট-পাবলিক সহযোগিতা সৃষ্টির কাজগুলো অধিদপ্তরে না করে সরকার ও প্রাইভেট প্রতিনিধিত্ব সম্পন্ন একটি মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠান এর জন্য সৃষ্টি করা উচিত।
বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা
বিভিন্নমুখী প্রয়োজনের এই ব্যাপক কর্মকাণ্ড নানা অভীষ্ট গোষ্ঠীর প্রয়োজনে নানা কৌশলে হতে হয়। বড় বড় সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে ঢালাও প্রক্রিয়ায় এর প্রকৃত বাস্তবায়ন কঠিন হবে। তাই এর মধ্যে বহুমুখিতা, নমনীয়তা এবং বহু রকম কৌশল ও সৃজনশীলতাকে যাতে স্থান করে দেওয়া যায়, এই উদ্দেশ্যে স্বতঃপ্রণোদিত যারা বেসরকারিভাবে কাজ করছে তাদের সহায়তা দেওয়ার নীতিই বেশি কাম্য। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বকীয়তার ও আত্মনিবেদিত যোগ্যতার মূল্য অনেক। সেটি উপযুক্তভাবে নির্ণয় করে তাদের সর্বতোভাবে সহায়তা দেওয়া ও প্রয়োজনে তাদের সফল কাজগুলোকে সম্প্রসারণ করার জন্য উদ্যোগ নেওয়ার ব্যবস্থা শিক্ষানীতিতে থাকা উচিত। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোকে একটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিত্বমূলক মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানে রূপ দিয়ে এ রকম উদ্যোগ নেওয়া যায়।
মুহাম্মদ ইব্রাহীম: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments