কেন বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের দাপট by ফাহিমা আক্তার সুমি ও আফজাল হোসেন

ছিনতাই, জমি দখল, অপহরণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। দিন দিন বেড়েই চলছে এদের দৌরাত্ম্য। অপরাধ ঘটলেই উঠে আসছে কিশোর গ্যাংয়ের নাম। প্রকাশ্যে সংঘবদ্ধ হয়ে অস্ত্রশস্ত্র হাতে মহড়া দিচ্ছে অলিতে-গলিতে। বিভিন্ন চটকদার নামে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। এদের বেপরোয়া আচরণে পাড়া-মহল্লার মানুষ আতঙ্কে থাকে। সুযোগ পেলে উত্ত্যক্ত করছে নারীদের। এমনকি কিশোর গ্যাংয়ের হামলার শিকার হচ্ছেন পুলিশ সদস্যরাও।

পুলিশ বলছে, শুধু রাজধানীতেই নয় দেশের প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য বেড়েছে। মাদক, অর্থ লোভ, আইনের তোয়াক্কা না করা, হিরোইজম, বেকারত্ব ও অভিভাবকদের দায়িত্বহীনতাসহ বেশ কয়েকটি কারণে তারা দিন দিন বেপরোয়া ও বিপথগামী হয়ে উঠছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের ৪০ শতাংশই কিশোর। দেশে বর্তমানে দুইশ’র বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে। সদস্য রয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা যেন কমছে না। ১০-১৭ বছর বয়সীরা বেশি থাকলেও এসকল গ্যাং গ্রুপে রয়েছে ১৮ বছরের বেশি বয়সীরাও। সম্প্রতি কয়েকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, তাদের চুলের স্টাইল, পোশাক ও চালচলনে রয়েছে ভিন্নতা। দিনে-রাতে ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটাচ্ছে। এমনকি এ ঘটনায় মৃত্যুও হচ্ছে অনেকের। আবার কিশোর অপরাধীরা অস্ত্র হাতে অপরাধ কার্যক্রমের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে একে অপরকে। এমন অনেক ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছাড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রতিদিন ঘটছে ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ। গত ছয় মাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সন্দেহভাজন এসকল অপরাধীরা গ্রেপ্তার হলেও পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সম্প্রতি ঢাকার মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার বোর্ডঘাট এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযানে গিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের হামলার শিকার হয়েছে পুলিশ সদস্যরা। এতে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের তিন এসআই ও এক এএসআইসহ চার পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন। ওই এলাকার কিশোর গ্যাং ‘পাটালি গ্রুপ’ জড়িত বলে জানা গেছে। সূত্রমতে কয়েকদিন আগে একাধিক হত্যা মামলার আসামি ও বোর্ড ঘাট এলাকার কিশোর গ্যাং গ্রুপ পাটালি গ্রুপের মূলহোতা ফালানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ওই সময় পাটালি গ্রুপ ও বোর্ড ঘাটের মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশের হাত থেকে তাকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এ ঘটনায় ব্যর্থ হয়ে বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশের অভিযানের সময় তাদের ওপর দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা। হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছে পাটালি গ্রুপের ল্যাংড়া হাসান, ফরহাদ ও চিকু শাকিল। বাকি ৩০-৪০ জন সদস্য নিয়ে তারা এ হামলা চালায়।

আদাবর বালুর মাঠ এলাকায় মোবাইল ছিনতাইয়ের সময় বাধা দিলে ছিনতাইকারীরা মো. সুমন শেখ (২৬) নামের এক যুবকের বাম হাতের কব্জিসহ হাতে থাকা মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়। সুমন নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন।

পহেলা ফেব্রুয়ারি হাতিরঝিল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে জিলানী নামে এক পথচারী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তার তলপেটে গুলি লাগে। পুলিশ জানায়, হাতিরঝিল উলন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে। এতে একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। জিলানীর পরিবার জানায়, জিলানী একজন রিকশাচালক। উলন এলাকায় তাদের বাসা। গোলাগুলির সময় সে বাসার সামনে অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ তলপেটে গুলি লাগে তার।

বৃহস্পতিবার মোহাম্মদপুরে সেনাবাহিনীর অভিযান চালিয়ে উদ্যান এলাকা থেকে কিশোর গ্যাংয়ের ১৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই ‘গোল্ডেন গ্যাং গ্রুপের সদস্য’। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে দুটি সামুরাই, দুটি ছুরি, একটি দেশি ধারালো অস্ত্র, বাংলা মদ, আটটি পুলিশ বন্দুকের কার্তুজ উদ্ধার করা হয়। তারা এ সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে।

পহেলা ফেব্রুয়ারি বিশেষ অভিযানে কিশোর গ্যাংয়ের ৮ সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে আদাবর থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে অবৈধ মাদক ও বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। মোহাম্মদপুর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কোন্দল চলছিল কিশোর গ্যাং ডাইল্লা গ্রুপ ও এলেক্স গ্রুপের মধ্যে। গত বছরের ২০শে সেপ্টেম্বর রায়েরবাজারে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে দুজন নিহত হয়।

তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ইবনে মিজান মানবজমিনকে বলেন, আমরা এই পর্যন্ত এক মাসে শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছি। কিশোর গ্যাংয়ের কয়েকটি গ্রুপের তথ্য পেয়েছি এর মধ্যে নতুন একটি গ্রুপের নাম ‘ইমন গ্রুপ’। এ ছাড়া ‘কব্জি কাটা আনোয়ার গ্রুপ’ এবং ‘জনি গ্রুপ’ এর বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। মোহাম্মদপুরে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় আমরা পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে ‘পাটালি গ্রুপের’ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। মোহাম্মদপুরে অভিযান চালালে তারা আদাবরে বেড়িবাঁধ এলাকায় প্রবেশ করে, নিয়মিত অভিযান চালালে তারা তুরাগ নদ সংলগ্ন হাঁটার এরিয়ায় আত্মগোপনে চলে যায়। এ ছাড়াও তারা সাভার আশুলিয়া বেড়িবাঁধ এলাকায় অবস্থান করে।

গত দুই মাসে আদাবর থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় দুই শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ বিষয়ে আদাবর থানার ওসি এস এম জাকারিয়া মানবজমিনকে বলেন, এদের মধ্যে ১৭-২০ বছর বয়সী সদস্য বেশি। বৃহস্পতিবার সুমন শেখ নামে এক যুবকের কব্জি বিচ্ছিন্ন করার ঘটনায় আমরা ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। কিশোর গ্যাংয়ের ‘কব্জি কাটা আনোয়ার গ্রুপ’ এবং ‘জনি গ্রুপ’ ছাড়া আরেকটি গ্রুপ ‘ডিবি সুমন’ গ্রুপের তথ্য পেয়েছি আমরা। এই গ্রুপের মূলহোতা সুমনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি তাকে ইতিমধ্যে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১৪-১৬ বছর বয়সী কিশোররাও চুরি, ছিনতাই এবং মারামারিসহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। ১৭-২০ বছর বয়সী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বড় ভাইদের মদত পায় ১৪-১৬ বছর বয়সী সদস্যরা নিজেরা নিজেরাই ৪ থেকে ৫ জনের গ্রুপ খোলে। এদেরকে গ্রেপ্তার করার পর জামিনে বেরিয়ে এসে তারা আবার একই অপরাধ কার্যক্রমে জড়িত হয়। এজন্য আমরা আদালতকে বলি তাদের যেন খুব দ্রুত জামিন না দেয়।

মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান বলেন, শুধু জানুয়ারি মাসেই ৪২৮ জন কিশোর ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছি। বৃহসপতিবারেও ১৬ জনের মতো কিশোর ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ডেমরা থানার ওসি মাহমুদুর রহমান বলেন, জানুয়ারি মাসে আমরা যতজন আসামি গ্রেপ্তার করেছি তার মধ্যে তিনজন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ছিল। এ সকল কিশোররা মূলত ছিনতাই এবং মারামারিতে বেশি জড়িত থাকে। তিনি বলেন, জানুয়ারি মাসে যে সকল অভিযোগ এসেছিলো তা থেকে তদন্ত সাপেক্ষে ২২টি অভিযোগ মামলা হিসেবে রুজু হয়েছে। অপরাধ দমনে আমরা বিট পুলিশিং, কমিউনিটি পুলিশিং এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার জন্য এলাকায় এলাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে উঠান বৈঠক করছি।
যাত্রাবাড়ী থানার ওসি কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, আমরা অপরাধ দমনে প্রতিনিয়ত কাজ করছি। বুধবার আমরা দু’জন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছি। ছিনতাইকারীদের মধ্যে কিছু কিশোর রয়েছে যাত্রাবাড়ী থানার কর্মকর্তা হযরত আলী বলেন, এই থানায় আগে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত ছিল, তাদেরকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতারা প্রশ্রয় দিতো সরকার পতনের পর তারা পালিয়ে গেছে।

সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম কিশোর গ্যাংয়ের নতুন তালিকা করে অভিযান চালাতে সারা দেশে পুলিশের সব ইউনিট প্রধানকে নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তর গত পাঁচ মাসে দফায় দফায় বৈঠক করে তাদের নিয়ন্ত্রণের পথ খোঁজা হয়েছে। জেলা পুলিশ সুপারদের এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, দেশের বাস্তবতায় কোনো একটি রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখনকার অপরাধের পরিস্থিতি একরকম থাকে। অরাজনৈতিক কোনো সরকার থাকে তখনকার অপরাধ পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যেও একটা ভিন্নতা রয়েছে। বর্তমান সময়ে অপরাধ প্রবণতা, ছিনতাই, কিশোর গ্যাং, সহিংসতা, সংঘাত, খুন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ এই ধরনের অপরাধগুলো অনেক কমে আসার কথা, এটাই আমরা প্রত্যাশা করেছি কিন্তু বাস্তবতা তার বিপরীত। একটি রাজনৈতিক দলের সরকারের পতনের পর নতুন যে অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসেছেন তাদের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পরিপূর্ণভাবে স্বাভাবিক হয়নি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) জাহাঙ্গীর কবির মানবজমিনকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দেশীয় অস্ত্র, ছুরি-চাপাতি ব্যবহার করে। মোহাম্মদপুরে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছি আমরা। বিভিন্ন অপরাধ দমনসহ কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.