ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক: দ্বিতীয় পর্বে সরকার আলোচনায় চার্টার
বিকাল ৩টায় রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমির মিলনায়তনের ঐকমত্য কমিশনে এই বৈঠক হয়। চলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত। বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতসহ ২৬টি রাজনৈতিক দলের ১০০’র অধিক প্রতিনিধি অংশ নেন। এতে প্রারম্ভিক বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের যোদ্ধারা যে কারণে আত্মত্যাগ করেছিল, সেটা যেন পরবর্তী সব প্রজন্ম মনে রাখে, তাদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে, তাদের আত্মত্যাগ সার্থক করার জন্য আমরা সবাই মিলে সবরকম চেষ্টা করবো তাদের সে স্বপ্ন যেন বাস্তবায়ন করতে পারি।
বৈঠকে অংশ নিতে বেলা আড়াইটা থেকে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রবেশ করেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এর মধ্যে বিএনপি’র পক্ষে বৈঠকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। প্রতিনিধি দলের অন্যরা হলেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। প্রতিনিধি দলের অন্যরা হলেন- জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ, সাইফুল আলম খান মিলন, এডভোকেট মশিউল আলম। এ ছাড়া বৈঠকে মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), কর্নেল অলি আহমেদের নেতৃত্বে এলডিপি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে নাগরিক ঐক্য, এসএম আলতাফ হোসেন ও সুব্রত চৌধুরীর নেতৃত্বে গণফোরাম, জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বে গণসংহতি আন্দোলন, সাইফুল হকের নেতৃত্বে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীর নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন, মাওলানা আবদুল বাছিদ আজাদ ও আহমেদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বে খেলাফতে মজলিস, নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে গণঅধিকার পরিষদ, খন্দকার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে জাগপা, ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে এনপিপি, আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বে বিজেপি, নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন। এই বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের জাতীয় নাগরিক কমিটির চার সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশ নেন। তারা হলেন- নাসীরদ্দীন পাটোয়ারী, আখতার হোসেন, সামান্তা শারমিন ও সারজিস আলম।
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূস বলেন, প্রচণ্ড সুযোগ। সুযোগ এজন্যই যে আমরা এমন পর্যায়ে আছি এখন, আমাদের মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টি হলে সেগুলো কাজে লাগাতে পারি। এবার কাজে লাগালে সেটা বংশ, প্রজন্ম পরম্পরায় চলতে থাকবে। একটা সুন্দর দেশ আমরা পাবো। এই ভাবনা থেকেই আমরা এগুলো গ্রহণ করবো। তিনি বলেন, আলোচনাটা কতো সুন্দর হবে, কতো মসৃণ হবে সেটা আপনাদের ওপর নির্ভর করবে। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা সুপারিশগুলো উপস্থাপন করবো। কমিশনের সদস্যরা এখানে এগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য আছেন, চাপিয়ে দেয়ার জন্য না। চাপানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা শুধু আপনাদের বোঝানোর জন্য। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনাদের সহযোগিতা চাই, এটা আমি বলবো। কারণ এটা আপনাদের কাজ। এটা আমার কাজ না, একার কাজ না। যেহেতু আপনারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন, আপনাদের বলতে সমাজের কল্যাণে কোন কোন জিনিস করতে হবে, কীভাবে করতে হবে। যেটা এক্ষুনি করা যাবে বলবেন, এটা এক্ষুনি করা দরকার, সামান্য রদবদল থাকলে বলবেন সামান্য রদবদল করে দেন, সেটা আপনাদের ইচ্ছা। আমরা শুধু সাচিবিক কাজগুলো আপনাদের করে দিলাম। ড. ইউনূস বলেন, আমরা একটা লণ্ডভণ্ড অবস্থার মধ্যদিয়ে দায়িত্ব নিয়েছি। চেষ্টা করেছি এটাকে কোনোরকমে সফল করার। এই ৬ মাসের যে অভিজ্ঞতা, সেটা আমাদের সবাইকে প্রচণ্ড সাহস দেবে। এই ৬ মাসের অভিজ্ঞতা হলো আমাদের সবাইকে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সবাই সমর্থন দিয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে অনেক তর্কবিতর্ক করার, দূরত্ব সৃষ্টি করার মতো প্রবণতা আছে। কিন্তু এই একটি জায়গায় এক ছিলাম, এখনো এক আছি। আগামীতেও আমরা এক থাকবো। সে বিশ্বাস আমার আছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যেভাবে আমরা প্রথম অধ্যায় শেষ করলাম, দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা যদি সেটা ঠিক রাখতে পারি, তৃতীয় অধ্যায়ের জন্য আমাদের কোনো চিন্তা নেই। প্রথম অধ্যায়ে যে সমস্ত শক্তি আমাদের ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে, আমাদের ভণ্ডুল করার চেষ্টা করেছে, তাদেরকেও সুন্দরভাবে, সবাই মিলে মোকাবিলা করতে পেরেছি। ড. ইউনূস বলেন, হাঙ্গামা হবে, কারণ যাদেরকে বাংলাদেশের মানুষ তাড়িয়ে দিয়েছে, অস্বীকার করেছে, ত্যাগ করেছে, তারা ফিরে আসার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল, প্রতিটি দিন তাদের জন্য মূল্যবান, দেরি হলে তাদের জন্য অসুবিধা। সেজন্য আমাদের সবাইকে শক্ত থাকতে হবে, মজবুত থাকতে হবে, আমরা যেগুলো আলাপ করছি সেগুলোতে মতভেদ থাকবে কিন্তু এর অর্থ এই নয় আমরা একত্র নই। আমরা একত্র থাকবো। সরকারপ্রধান বলেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালালেও সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন থাকায় তা ব্যাহত হচ্ছে। সারা পৃথিবী জুড়ে আমাদের একটা বড় রকম সমর্থন গড়ে উঠেছে, যে কারণে অপরপক্ষ সুবিধা করতে পারছে না। পদে পদে ব্যাহত হচ্ছে যেখানে যায়। বহু গল্প করছে, গল্প ঠেকাতে পারছে না। শেষমেশ তো ট্রাম্পকে নিয়ে গল্প, সে অপপ্রচার চালাতে গিয়েও চালাতে পারলো না। ড. ইউনূস বলেন, যত ছোট রাষ্ট্র, বড় রাষ্ট্র, মাঝারি রাষ্ট্র, ধনী রাষ্ট্র, সবাই সমর্থন দিয়েছে, কারও কোনোরকম দ্বিধা নাই। তাদের ভাষা শুনলে আমি অবাক হই। আমরা যখন বসি, বিস্তারিত জানার আগে বলে, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। এ পর্যন্ত তারা সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং ক্রমাগতভাবে তাদের সমর্থন বাড়ছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের এই যে দুই সমর্থন, অভ্যন্তরীণ একটা সমর্থন, আন্তর্জাতিক একটা সমর্থন, এই দুই সমর্থনের ভেতর দিয়ে আমরা যদি নতুন বাংলাদেশ গড়তে না পারি। এটা আমাদের কর্মের দোষ ছাড়া আর কি বলবো। আমরা এ সুযোগ ছাড়তে চাই না। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মহলও আমাদের জিজ্ঞেস করে তোমাদের অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা সাহায্য করতে পারি কি না। সংস্কারের ব্যাপারেও আমরা সাহায্য করবো, তোমাদের কি দরকার। তোমাদের এ সংস্কারটা দরকার। তা না হলে এই যে পরিবর্তন, এটা টিকিয়ে রাখা যাবে না। আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন, সহযোগিতা এবং শুভেচ্ছা, এটা আমাদের জন্য একটা মস্তবড় সম্পদ বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। বলেন, আমরা তাদের বলি আমাদের এই স্বপ্ন, আমরা এই করতে চাই, ওই করতে চাই। তারা বলে তোমরা করতে পারো, আমাদের কোনো সমস্যা নাই। আমরা আছি তোমাদের সঙ্গে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই যে আইনকানুন, নীতিমালা বানিয়ে দেবো। একবার বানিয়ে দিলে তারপর থেকে চলতে থাকবে। একটা ট্রান্সপারেন্ট খেলা হবে। খেলায় জিতলে কেউ সন্দেহ করবে না যে কেউ জিতিয়ে দিয়েছে। এত ট্রান্সপারেন্ট, কেউ সন্দেহ করবে না। তিনি বলেন, এখন যে খেলা চলছে, ঠিকমতো জিতলেও সন্দেহ করে। বলে কিছু একটা কলকাঠি নেড়ে করেছে। এই কলকাঠি নাড়ার বিষয়টি আমাদের মনের ভেতর গেঁথে গেছে। কলকাঠি ছাড়া যে দেশ একটা নিয়মে চলতে পারে, সেটা আমরা ভুলে গেছি। ড. ইউনূস বলেন, আন্তর্জাতিক সমর্থনের কথা বলেন আর দেশীয় সমর্থনের কথা বলেন, এটা বলতে গেলে মনটা বড় হয়ে যায়। জাতিসংঘের সমর্থন, আপনারা চিন্তা করেছেন যে রিপোর্টটা প্রকাশিত হলো। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের একটি প্রতিবেদনে সারা পৃথিবী বদলে গেছে। আর কত সমর্থন চাই আমরা। একেবারে অক্ষরে অক্ষরে বলে দিয়েছে কোথায় কীভাবে মেরেছে, এর থেকে বের হওয়ার তো কারও উপায় নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে ঘিরে যে অপপ্রচার চলছিল, এই এক প্রতিবেদনে সব সমাপ্ত। বলতে পারবে কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হবে না। আরও অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাদের প্রতিবেদনে অত্যন্ত জোরালোভাবে তাদের (আওয়ামী লীগ) অপরাধের কথা উঠে এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা সেদিন আয়নাঘরে গেলাম, মানুষ কতো নির্মম হতে পারে, বীভৎস দৃশ্যের সৃষ্টি করতে পারে, নৃশংস হতে পারে, এর চেয়ে বড় নমুনা বোধ হয় পাওয়া যাবে না। আমাদের শুধু দেখতে কষ্ট লেগেছে, যারা বছরের পর বছর সেখানে থেকেছে তাদের কথা চিন্তা করুন। তাদের প্রতিটি বর্ণনা, তাদের অভিজ্ঞতা গুম-তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। ড. ইউনূস বলেন, পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিকভাবে মানুষ প্রথম বুঝতে পারলো আমরা কীসের কথা বলছি, আমরা কোথা থেকে এসেছি। কাজেই আমরা প্রথম পর্বের পর দ্বিতীয় পর্বে এলাম। দ্বিতীয় পর্ব যেন আমরা আনন্দের সঙ্গে, খুশি মনে সম্পন্ন করতে পারি। তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশে যে নতুন নির্বাচন, নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠন হবে সেটার ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। সেটার ব্যাপারে আইনকানুন সবার জানা থাকবে, এটা নড়চড় করার উপায় কারও থাকবে না। আইনকানুন বানানোর পর সেটা নড়চড় করার সুযোগ থাকবে না, সেজন্য এত বড় কমিশন করতে হয়েছে।
দ্রুত সংস্কার শেষ করে অতিদ্রুত নির্বাচন চায় বিএনপি: ওদিকে বৈঠকে শেষে সাংবাদিকদের বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজকের প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম সভায় মিলিত হয়েছিলেন, এই সভায় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন যে, সংস্কার কমিশনগুলো যে রিপোর্টগুলো প্রদান করেছে তার প্রত্যেকটার ওপরে আলাপ-আলোচনা হবে, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে কথা বলবে কমিশনের সঙ্গে এবং একটা ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে। সেটাই আজকের বৈঠকের মূল কথা। আমরা (বিএনপি) আশা করি যে, খুব দ্রুত এই সংস্কারের ন্যূনতম ঐকমত্য তৈরি হবে এবং সেটার ওপরে ভিত্তি করে অতিদ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
জাতীয় নির্বাচন না স্থানীয় সরকার নির্বাচন- এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা পরিষ্কার বলেছি যে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সবার আগে হতে হবে। তারপরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আজকে শুধুমাত্র প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে, বলতে পারেন আলোচনাটা ছিল পরিচিতিমূলক। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন কথা বলেছেন, সেটা ছিল তাদের নিজস্ব মতামত। একেবারে পজিটিভ কনস্ট্রাকটিভ কোনো আলোচনা আজকে হয়নি, কারণ সুযোগও ছিল না।
সংস্কারে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলেছে জামায়াত: জামায়াতের নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, কীভাবে এটা (সংস্কার) করবেন এবং বিভিন্ন দলের সঙ্গে, স্টেকহোল্ডালদের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করবেন, সেই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছি। প্রত্যেক ইতিবাচক সিদ্ধান্তে জামায়াতে ইসলামী সমর্থন জানাবে, আমরা এটা ঘোষণা করেছি। আমরা বলেছি, এই সংস্কার কমিশন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগুলো পৌঁছার পরে যথাশিগগিরই সম্ভব জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেই প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য।
নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা বলেছি, সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার করার ওপর আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। এরপর যথাশিগগিরই সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টা তো বলেছেন, ডিসেম্বরের ভেতরে তারা করবেন।
ওদিকে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বৈঠক শেষে বলেন, আমাদের সংস্কারটা করতে হবে ঐকমত্যের মধ্যদিয়ে। বৈঠকে সাধারণ পরিচয়ের সঙ্গে ভূমিকার মতো কথা হয়েছে। তখন অনেকগুলো কথাই বলা হয়েছে, যা সংস্কারের জন্য দরকার। অনেকে মতামত দিয়েছেন, ইসলামী বিধান আছে, আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের কথা আছে, রাষ্ট্রধর্ম- এগুলো থাকতে হবে। যতগুলো ইসলামী বিধান সংবিধানের মধ্যে আছে তা পরিবর্তন করা যাবে না। কিছু কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে, সেগুলোতে তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। প্রশ্ন এসেছে, আওয়ামী লীগকে কি আবার নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হচ্ছে? ছাত্রসহ নাগরিক কমিটি বলেছে, যদি জোর করে, কায়দা করে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাধ্যমে আবার এই প্রজন্মের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে সেই দায় শেষ পর্যন্ত সিনিয়রদের বহন করতে হবে। তারা মনে করে, আওয়ামী লীগ এখন অপ্রাসঙ্গিক। তারা পরাজিত।
বৈঠক শেষে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, আমরা বলেছি, একটা টেস্ট ম্যাচের মধ্যদিয়ে যেতে হবে আমাদেরকে। যেখানে ধৈর্য্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে আমাদের বাংলাদেশের ৫৩ বছরের যে অসমাপ্ত কাজগুলো রয়েছে সংস্কার কমিশনগুলোর ইফেক্টিভের মধ্যদিয়ে আমরা সেই কাজগুলো সমাপ্ত করতে পারবো।
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, আজকের বড় আলোচনার কিছু নাই। দলগুলো প্রত্যেকেই তাদের লিখিত প্রস্তাবনা দিয়েছেন, আমরাও দিয়েছি। রাজনৈতিক দলের সবাই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন যেন আমাদের জাতীয় ঐক্যটা ঠিক থাকে। গণতন্ত্রের পথে যেন অগ্রসর হতে পারি। প্রত্যেকেই সহযোগিতার কথা বলেছেন। আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে বলেছি, আমরাও সহযোগিতা করবো। আমরা খোলামেলা আলোচনা করেছি।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, অনেকগুলো কমিশন হয়েছে, কিন্তু বৈষম্য বিলোপের ব্যাপারে কোনো কমিশন হয়নি। দুর্বৃত্তের রাজনীতি এবং অর্থনীতি যদি বহাল থাকে তাহলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই নাও হতে পারে। আমরা বলেছি, এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি, বৈষম্যের ব্যাপারে যদি কোনো কমিশন করা যায় তাহলে ইতিবাচক ভাবে আমরা নিবো। আর কমিশনগুলোর যে বিশাল রিপোর্ট, সেগুলো যদি রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের কাছে পৌঁছাতে পারেন তাহলে সেটা গুরুত্বপূর্ণ হবে।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, আগামী ৬ মাস কীভাবে সবাই একসঙ্গে কাজ করবো, যে কমিশনগুলো কাজ হয়েছে, তারা কীভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে, আমাদের কী কী প্রস্তাব আছে- সেগুলো আর কীভাবে বিস্তর আলোচনা করবো, এই ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা কথা বলেছেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এ কাজে ব্যর্থ হলে জাতি আমাদের ক্ষমা করবেন না। দীর্ঘদিন সংগ্রাম ও অনেক প্রাণের বিনিময়ে আমরা এখানে এসেছি। ছয়টি কমিশনের প্রস্তাবে সেই পথরেখার কথা উল্লেখ আছে। এখন আমাদের কাজ সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি, বাস্তবায়নের পথ-পদ্ধতি তৈরি করা। আর রাষ্ট্রের সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। শুরু না করলে সেই প্রক্রিয়া অগ্রসর হবে না। প্রক্রিয়া অগ্রসরে সকলের ঐকমত্য জরুরি। এজন্য ঐকমত্য করতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দলগত ও জোটগত বৈঠক করবো। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আগে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ থাকা। বিভিন্ন সময়ে আমরা আবারো মিলিত হবো।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, এবি পার্টির পক্ষ থেকে আমরা বলেছি, প্রথম যেদিন আপনার (প্রধান উপদেষ্টা) সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল- তখন আমরা বলেছিলাম, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য ঐক্যের ভিত্তিতে টিম তৈরি করে দেন। কিন্তু আপনি সেটা করেননি, দেরি করে করেছেন। আমরা আরেকটা বিষয় বলেছি, এই সরকারের সঠিক কর্তৃত্ব এখনো প্রতিষ্ঠা হয়নি। ফলে এমন বন্ধুর অবস্থা নিয়ে কীভাবে নির্বাচন করবেন? আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি, জাতীয় নির্বাচন আগে করেন। কিন্তু আপনার প্রশাসনিক কর্তৃত্বটা লাগবেই। আর জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির জন্য আপনাদের উচিত ছিল ভূমিকা নেয়া। কিন্তু আপনারা সেটা নেননি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আজকে মহৎ একটা উদ্যোগ শুরু হলো। আমরা এই দ্বিতীয় যাত্রার মাধ্যমে আমরা কী রকম বাংলাদেশ চাই, সেটা নির্ধারিত হবে।
উল্লেখ্য যে, গত ১২ই ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ৭ সদস্যের ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করা হয়। এটি কমিশনের প্রথম বৈঠক।
No comments