লোডশেডিং বাড়ছে কয়লার অভাবে: পিডিবির লক্ষ্য আগামী গ্রীষ্ম মৌসুম
এদিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, শীতের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির চেয়েও বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি যাতে স্বাভাবিক থাকে। এজন্য শীত মৌসুমে সব কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে কয়লার পর্যাপ্ত মজুত করা হবে। যাতে গ্রীষ্মে কয়লাভিত্তিক সবকটি কেন্দ্র পূর্ণমাত্রায় চালানো যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়লার অভাবে গত ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। একই সংকটের কারণে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, এসএস পাওয়ার, আদানি পাওয়ার এবং বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি করে ইউনিট চালু করা যাচ্ছে না। কেন্দ্রগুলোর একটি করে ইউনিট চালু থাকলেও পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করতে পারছে না। এ ছাড়া পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি ইউনিট চালু থাকলেও আর এক সপ্তাহের কয়লা মজুত আছে।
পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ ক্রয়ের বিপরীতে দায় ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি। সরকারের ভর্তুকি আটকে আছে। যে কারণে আমরা বিল পরিশোধ করতে পারছি না। ফলে বর্তমানে বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়েছে। চলমান পরিস্থিতি আগামী মাসের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আশা করছি। তিনি বলেন, এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আগামী গ্রীষ্মকাল। ওই সময় যাতে লোডশেডিং না হয়, তার আগেই আমরা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য কয়লার মজুত গড়ে তুলতে চাই।
বকেয়া বিল নিয়ে প্রশ্ন করা হলে রেজাউল করিম বলেন, আদানির বকেয়া ৮ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্য কেন্দ্রগুলোর কোনোটি ৫ হাজার, কোনোটি ৪ হাজার আবার কোনোটি আরও কম টাকা বকেয়া রয়েছে। আমরা পরিশোধের চেষ্টা করছি এবং করাও হচ্ছে।
এ সময় পিডিবির চেয়ারম্যান আরও জানান, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আসছে। আগামী ১০ নভেম্বরের পর দুটি ইউনিট চালু হবে। মাতারবাড়ী কেন্দ্রের জন্য কয়লার দরপত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে কেন্দ্রটির উৎপাদন শুরু হবে। এসএস পাওয়ার আজ (গতকাল) রাত থেকে দুটি ইউনিট চালু করার কথা জানিয়েছে। এ ছাড়া ভারতের আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বকেয়া বিল নিয়ে আলোচনা চলছে।
পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, গত ২৮ অক্টোবর ভারতের ঝাড়খন্ডে স্থাপিত ১৬শ মেগাওয়াট ক্ষমতার আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে সরবরাহ বন্ধ করার কথা জানিয়েছে আদানি কর্তৃপক্ষ। প্রায় ১০ হাজার ৮৬ কোটি টাকার বকেয়া বিল বাকি। আদানি পাওয়ার (ঝাড়খন্ড) লিমিটেডের প্রতিনিধি ও যৌথ সমন্বয় কমিটির সভাপতি এমআর কৃষ্ণ রাও ওই চিঠিতে উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিসি) বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে ১৭০ দশমিক শূন্য ৩ মিলিয়ন ডলারের জন্য প্রয়োজনীয় এলসি প্রদান করেনি এবং ৮৪৬ মিলিয়ন ডলারের (১০ হাজার ৮৬ কোটি টাকা) বকেয়া পরিমাণও মেটায়নি। সময়মতো এলসি না দেওয়া এবং বকেয়া পরিমাণ পরিশোধ না করার ফলে পাওয়ার পচেজ অ্যাগ্রিমেন্টের আওতায় ‘মেটেরিয়াল ডিফল্ট’ ঘটেছে, যা আদানি পাওয়ারের সরবরাহ বজায় রাখতে বাধা দিচ্ছে।’
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘বহু বকেয়া পরিশোধ ও এলসির অভাবে আমরা কয়লা সরবরাহকারী এবং অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ কন্ট্রাক্টরদের জন্য কাজের মূলধন নিরাপদে রাখতে পারছি না। আমাদের ঋণদাতারাও সহায়তা প্রত্যাহার করছে।’
এদিকে গতকাল আদানি এই কেন্দ্র থেকে ৭৩১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। এস আলম গ্রুপের ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার বাঁশখালী এসএস পাওয়ার এদিন সরবরাহ করেছে ৪১৫ মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রের বিপরীতে বকেয়ার পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানির ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রটির একটি ইউনিট গত ৩১ অক্টোবর থেকে দুই মাসের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়ার পরে পিডিবির অনুরোধে তা পেছানো হয়েছে। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএম খোরশেদুল আলম জানিয়েছেন, এই কেন্দ্রের বিপরীতে পিডিবির কাছে ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বকেয়া। কয়লা সংকটের কারণে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে করা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট থেকে ৬২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এ ছাড়া পিডিবির মালিকানাধীন আড়াইশ মেগাওয়াট ক্ষমতার বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে গতকাল ৮৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে।
পিডিবি ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের চিত্র থেকে দেখা যায়, গতকাল দুপুর ১২টায় পর থেকে লোডশেডিং বাড়তে থাকে। পিজিসিবির তথ্যানুযায়ী, শনিবার দুপুর ১টায় ১১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে ১১ হাজার ৩৫৫ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল ৩২৯ মেগাওয়াট। দুপুর ২টায় ১১ হাজার ৮০০ বিপরীতে ১১ হাজার ৩২২ মেগাওয়াট সরবরাহ হয়েছে। ঘাটতি ৪৫৬ মেগাওয়াট। বিকেল ৩টায় ১১ হাজার ৮৫০ বিপরীতে ১১ হাজার ১২৪ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল ৬৯৩। বিকেল ৪টায় ১১ হাজার ৫০০-এর বিপরীতে সরবরাহ হয়েছে ১০ হাজার ৯০১ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল ৫৭২ এবং এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সর্বশেষ বিকেল ৫টায় ১১ হাজার ৯০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে সরবরাহ হয়েছে ১১ হাজার ২৫৬ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয়েছে ৬১৫ মেগাওয়াট। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিংও বাড়তে থাকে। এর আগের দিন শুক্রবার সারা দেশে ১৬ হাজার ৮৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার লোডশেডিং হয়েছে ১ হাজার ৫৭৬ মেগাওয়াট।
পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, গতকাল বিকেল ৫টা পর্যন্ত গ্যাস থেকে ৫ হাজার ৩৮ মেগাওয়াট, তেল থেকে ১ হাজার ৭৪৬, কয়লা থেকে ২ হাজার ১৩৩, জলবিদ্যুৎ থেকে ১৭৩ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১১১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। এ ছাড়া আদানি থেকে ৭৩১, ত্রিপুরা থেকে ৫০ এবং ভেড়ামারা এইচভিডিসি দিয়ে ভারত থেকে ৯১৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছে। গতকাল সারা দেশে চাহিদা ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট।
No comments