খুন হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর কাটাচ্ছেন আফগান নারী মেয়র
জারিফা
ঘাফারির পূর্ণ বিশ্বাস, যেকোনোদিন খুন হতে চলেছেন তিনি। তবে সে ভয় তাকে
দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখেনি। চুপচাপ ঘরে মুখ লুকিয়ে বসে থাকেননি তিনি।
২৬ বছর বয়সে আফগান শহর ময়দান শার এর প্রথম নারী মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন।
পুরো আফগানিস্তানের প্রথম নারী মেয়রদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন
নিজেকে। চলতি বছরের মার্চ মাসে মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এরপর থেকেই খুন
হওয়ার ভয় চেপে রয়েছে মাথার ওপর।
ময়দান শার’র মোট জনসংখ্যা ৩৫ হাজারের মতো। ওয়ারদাক প্রদেশের রাজধানী শহরটির বেশিরভাগ জনসংখ্যাই পাশতুন সম্প্রদায়ের।
ক্ষমতায় আসার পর নিজের নাম ও লাল হিজাব পরা ছবিসহ একটি বিশাল ব্যানার তৈরি করেছেন তিনি। ব্যানারে লেখা, চলুন আমাদের শহর পরিষ্কার রাখি। শহরের যত্রতত্র আবর্জনা ফেলার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তোলার প্রচারণার অংশ হিসেবেই এই ব্যানার তৈরি করা।
ঘাফারি বেশ ভালোভাবেই জানেন যে, আফগানিস্তানে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একেবারে সম্মুখভাগে রয়েছেন তিনি। তাও আবার এমন এক সময়ে সংগ্রাম করতে হচ্ছে তাকে, যখন পুরো দেশের বেশিরভাগ অংশের দখল চলে গেছে জঙ্গি দল তালেবানের হাতে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দলটির সম্ভাব্য শান্তি চুক্তি ভেস্তে যায়। কট্টর রক্ষণশীল তালেবানরা পুরো দেশের দখল নিয়ে নিলে সেখানে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নিমিষেই শেষ হয়ে যাওয়ার ঝুকি রয়েছে। এসব জানা সত্ত্বেও ঘাফারি নিজের অবস্থান পরিষ্কার রেখেছেন। সম্প্রতি টুইটারে লিখেছেন, আমার কাজ হচ্ছে জনগণকে নারীদের অধিকার ও নারী ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করানো ।
আফগানিস্তানের পুরুষশাসিত সমাজে প্রশাসনিক কাজগুলো সাধারণত পুরুষরাই সামলিয়ে থাকে। সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ বেশ কঠোরভাবে দমিয়ে রাখা হয়। তা সত্ত্বেও কয়েকজন সাহসী নারী সে প্রথা ভেঙে সামনে এগিয়ে আসার চেষ্টা চালিয়ে যায়। ঘাফারি তাদেরই একজন। পুরো দেশে তার মতো প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা নারী আরো আছে। তবে অন্যকোনো নারীকে তার মতো কঠিন, অকল্পনীয় পদে দেখা যাওয়াটা এক প্রকার অসম্ভবই বলা যায়। ময়দান শার ছাড়া দাইকুন্দি ও বামিয়ান প্রদেশেও নারী গভর্নর থাকার ইতিহাস রয়েছে। দাইকুন্দির নীল শহরে দুই বছরের জন্য একজন নারী গভর্নর দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। দাইকুন্দি ও বামিয়ানের তুলনায় ওয়ারদাক অপেক্ষাকৃত বেশি রক্ষণশীল অঞ্চল। সেখানে তালেবানের প্রতি সমর্থন ব্যাপক বিস্তৃত। তাদের প্রভাব এতটাই বেশি যে, অঞ্চলটির হাইওয়েগুলোও সাধারণ নাগরিকদের জন্য নিরাপদ নয়।
ময়দানে ‘গার্লস স্কুল’ এর সংখ্যা মাত্র একটি। গত বছর ওই স্কুল থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কেবল ১৩ জন। ঘাফারি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে পুরো শহরে গার্লস স্কুলের শিক্ষিকারা ছাড়া সরকারি চাকরিরত একমাত্র নারী ছিলেন নারী মন্ত্রণালয়ের প্রধান। কিন্তু তিনিও শহরটিতে বাস করার সাহস করেননি। নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি থাকেন রাজধানী কাবুলে।
প্রাথমিকভাবে গত বছরের জুলাইয়ে ঘাফারিকে মেয়র হিসেবে নিয়োগ করেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি। মেয়র হিসেবে তার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা ছিল বেশ তিক্ত। নানা ঝামেলায় প্রথম দিন পার করার পর তার নিয়োগ বেশ কয়েক মাস পিছিয়ে দেয়া হয়। তিনি বলেন, গত বছর মেয়র হিসেবে প্রথম দিন কাজে যোগদানের কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্ষোভান্বিত দুর্বৃত্তরা তার কার্যালয়ে হামলা চালায়। লাঠি ও পাথর দিয়ে ভাংচুর চালানো হয় পুরো কার্যালয়জুড়ে। সেখান থেকে তাকে বের করে আনতে জাতীয় নিরাপত্তা পরিচালকের কার্যালয় থেকে গোয়েন্দা মোতায়েন করতে হয়েছিল। সেদিন সম্পর্কে ঘাফারির মন্তব্য, সেটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে দিন।
তিনি যখন কার্যালয় থেকে গোয়েন্দাদের সহায়তায় বেরিয়ে আসার সময় একজন হুশিয়ারি দিয়ে বলেছিল, এখানে আর ফিরে এসো না। ঘাফারি জানান, ওইসব দুর্বৃত্তদের মধ্যে ওয়ারদাকের গভর্নর মোহাম্মদ আরিফ শাহ জাহানের সমর্থক ও সহযোগীরাও ছিল। আরিফ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে নারী নিয়োগের বিরোধী ছিলেন। এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। তবে আরিফ সাড়া দেননি।
ঘাফারি সেদিন কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পর শহর ছেড়ে যান। সোজা রাজধানী কাবুলস্থ প্রেসিডেন্ট ভবনে পৌছে যান। প্রেসিডেন্ট ভবনের কর্মকর্তাদের সাফ জানিয়ে দেন, তিনি অত সহজে হাল ছাড়বেন না। তিনি বলেন, আমি এত চিৎকার করেছিলাম যে, আমার গলা দিয়ে আর আওয়াজ বের হচ্ছিল না। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রয়োজনে ভবনের সামনে নিজের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে হলেও আমি আমার কার্যালয়ের অধিকার নিশ্চিত করে ছাড়বো। এটা কোনো ফাঁকা বুলি ছিল না।
ওই ঘটনার নয় মাস পর ওয়ারদাকের গভর্নর জাহান পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের পরপরই ফের মেয়রের দায়িত্ব পালনে ফিরে গেলেন ঘাফারি। দায়িত্বে যোগদানের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক হ্যাশট্যাগ বার্তায় লিখেন, আমি আমার অধিকারের জন্য লোড়ে যাবো। এর মানে এমন ছিল না যে, তার দুর্দিন শেষ হয়ে গেছে। বরং তা আরো বেশি পরিমাণে বেড়ে যায়। প্রতিদিনের নৈমিত্তিক কাজ করতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাকে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি টিম ঘাফারিকে সশরীরে দেখতে গিয়েছিলেন। তার কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছিল তাদের। ঘাফারির সঙ্গে সাক্ষাতের একটি বর্ণনা নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে তুলে ধরেন তারা। লিখেন, একটি রাস্তা উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যাপারে পৌরসভা কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক ডেকেছিলেন ঘাফারি। কর্মকর্তাদের সকলেই পুরুষ ছিলেন। বৈঠকে কয়েকজন আসেন দেরি করে। কেউ কেউ পুরো বৈঠকে তাদের মুঠোফোন নিয়েও মত্ত ছিলেন। মুঠোফোনের মনিটর থেকে চোখই তুলছিলেন না। আরো কয়েকজন নিজেদের মধ্যে খুশমনে আলাপ করছিলেন। ঘাফারির দিকে মনোযোগ দিচ্ছিলেন খুব কম সংখ্যক অংশগ্রহণকারী। এক পর্যায়ে চিৎকার করে ওঠেন ঘাফারি। বলেন, ‘এটা একটা আনুষ্ঠানিক বৈঠক। কারো যদি ব্যক্তিগত কাজ থাকে, তাহলে তারা চলে যেতে পারে।’ ঘাফারির ধমকে কিছুটা কাজ হয়। মিনিট কয়েকের জন্য চুপ হয়ে তার কথা শোনেন কর্মকর্তারা। ‘এখন যান ও নিজের কাজগুলো করুন’, বলে বৈঠক শেষ করেন ঘাফারি। তিনি চলে যাবার পরপরই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া কক্ষটি থেকে ভেসে আসে হাসির আওয়াজ।
মেয়র হওয়ার পর থেকে বেশকিছু প্রচারণা চালাচ্ছেন ঘাফারি। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘ক্লিন সিটি গ্রিন সিটি’ প্রকল্প। প্রকল্পের আওতায় পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও নিজের সহযোগীদের একটি দল নিয়ে শহরজুড়ে ময়লা ফেলার জন্য প্লাস্টিক ব্যাগ বিতরণ করে থাকেন। এই প্রচারণার কাজে সঙ্গে সাংবাদিক নিতে অনেকটা অনাগ্রহী ছিলেন তিনি। কারণটা সহজেই বোঝা গেল। বাজারের দিকে এগুতেই একদল পুরুষ হাজির হলো। তার পাশেপাশে বেশ কাছাকাছি থেকে হাঁটতে লাগলো। উদ্দেশ্য একটাই, তাকে ভয় দেখানো। ঘাফারি বলেন, ‘আমার কোনো দেহরক্ষী নেই। যদিও নিয়ম অনুসারে আমার সঙ্গে সবসময় দুজন দেহরক্ষী থাকার কথা। এই শহরটা নিরাপদ নয়।’
বেশিরভাগ মানুষই প্রথমে ব্যাগ নিতে চাননি। পুরো রাস্তাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আবর্জনার স্তুপ। কিন্তু ঘাফারি নিজের অবস্থানে অটল ছিলেন। কখনো কখনো নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আগ্রাসীভাবে বলছিলেন, ‘এটা আমাদের শহর। আমাদের উচিৎ এটা পরিষ্কার রাখা। আপনারা আমায় সাহায্য না করলে আমি একা এই কাজ করতে পারবো না।’ কেউ কেউ এসব কথায় হেসেছিল। তবে বাকিরা ব্যাগ নিতে এগিয়ে এলেন। পুরো বাজারে মাত্র একজন নারী উপস্থিত ছিলেন, বাকিরা সবাই পুরুষ, বালক। ওই নারীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা ছিল বোরখায়।
প্রচারণা কাজ শেষে সাংবাদিকদের কাছে আগ্রাসী আচরণের জন্য মাফ চেয়ে নেন। বলেন, ‘এরকম রক্ষণশীল সমাজে কাজ করতে গেলে একজন আরীকে তার সত্যিকারের সত্ত্বাকে লুকিয়ে রাখতে হয়। তাকে কঠোর হতে হয়, নইলে কেউ তার কথা কানে নেয় না। তাদের কাছে আমায় প্রমাণ করতে হবে যে, নারীরা দুর্বল নয়।
ওয়ারদাকের বেশিরভাগ জনসংখ্যাই পাশতুন সম্প্রদায়ের। ঘাফারিও সে সম্প্রদায়েরই একজন। তার মা একজন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বাবা আফগান স্পেশাল ফোর্সের একজন কর্নেল। তার বয়স ২৬। আফগান সমাজের প্রচলিত রীতি অনুসারে তার বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে বহু আগেই। কিন্তু এখনো বিয়ে করেননি ঘাফারি।
ময়দান শারের মেয়র জানান, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার তালেবান ও জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস’র কাছ থেকে মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন তিনি। কিন্তু আইএস, তালেবানের হাতে খুন হওয়ার ভয় অনেক আগেই পার করে এসেছেন এই নারী। তিনি বলেন, ‘আমি জানি আমাকে খুন করে ফেলা হবে, কিন্তু তাদের আমি ভয় পাই না। তাদের চেয়ে বেশি উদ্বেগ হয় সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করা অপরাধীদের সিন্ডিকেটগুলো নিয়ে। তারা উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি ও জমি লেনদেনের ব্যবসায় যুক্ত।’ তিনি বলেন, এখানকার ভূমি মাফিয়াদেরই আমি বেশি ভয় পাই। তাদের একজন একদিন আমায় বলেছিল, আমি এখান থেকে চলে না গেলে সে আমার মাথায় একটি বুলেট ঠুকে দেবে।’
ঘাফারি কখনো সরকারের হয়ে কাজ করার প্রত্যাশা করেননি। তিনি ভারতে স্নাতক শেষ করেন। এরপর অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পড়া অবস্থায় গত বছর ছুটিতে বাড়ি আসেন। তখন পরিবারের সদস্যদের চাপে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেন। ওই পরীক্ষার আয়োজন করেছিলেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। তার উদ্দেশ্য ছিল সরকারি পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য মেধাবীদের খুঁজে বের করা। পড়াশোনার পাশাপাশি একজন উদ্যোক্তাও ছিলেন ঘাফারি। ছুটিতে বেশ জনপ্রিয় একটি রেডিও স্টেশন চালু করেছিলেন ওয়ারদাকে। ছুটি শেষে পড়াশোনা শেষ করতে ভারত ফের যান ঘাফারি। সেসময় এক বন্ধুর ফোন দিয়ে তাকে জানান, গনির কার্যালয় ফেসবুকে দেয়া এক ঘোষণায় ঘাফারিকে ময়দান শার এর মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করেছেন।
সেসময়কার বর্ণনা দিয়ে ঘাফারি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, আমি কাজটা পেয়েছি। কারণ, আমার কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না, স্বর্ণও ছিল না। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমি কাজটা চাই। এই সমাজে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করতে চাই।’
ঘাফারির গোঁ ধরা স্বভাব অবজ্ঞগার পাশাপাশি তাকে সমাজে বেশ খানিকটা সম্মান এনে দিয়েছে। ওই পৌরসভা বৈঠকে অপমানিত হওয়ার পরও খুব একটা বিচলিত হননি।
তিনি বলেন, মাঝে মাঝে মনে হয় এখানে সবাই নারী বিরোধী। আর কোনো নারী যখন সমাজে সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন তারা সহজেই তাকে দুশ্চরিত্রা আখ্যা দিয়ে দেয়া হয়।
পরবর্তীতে রাস্তা উন্নয়ন প্রকল্পটি নিয়ে অপর এক বৈঠকে ঘাফারি আশার আলো দেখতে পান। তার পক্ষে অল্প হলেও সমর্থন দেখা যায়। বৈঠকটি ছিল একটি রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে। বৈঠকে একজন তার পক্ষ নিয়ে বলেন, তাকে কিছুটা কৃতিত্ব দাও। প্রকল্পটি ১২ বছর ধরে বন্ধ পড়ে ছিল। তিনি মেয়র হওয়ার এক মাসের মধ্যেই সেটি চালু করতে পেরেছেন। তিনি একজন নারী হতে পারেন, কিন্তু তার শক্তি আছে।
ময়দান শার’র মোট জনসংখ্যা ৩৫ হাজারের মতো। ওয়ারদাক প্রদেশের রাজধানী শহরটির বেশিরভাগ জনসংখ্যাই পাশতুন সম্প্রদায়ের।
ক্ষমতায় আসার পর নিজের নাম ও লাল হিজাব পরা ছবিসহ একটি বিশাল ব্যানার তৈরি করেছেন তিনি। ব্যানারে লেখা, চলুন আমাদের শহর পরিষ্কার রাখি। শহরের যত্রতত্র আবর্জনা ফেলার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তোলার প্রচারণার অংশ হিসেবেই এই ব্যানার তৈরি করা।
ঘাফারি বেশ ভালোভাবেই জানেন যে, আফগানিস্তানে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একেবারে সম্মুখভাগে রয়েছেন তিনি। তাও আবার এমন এক সময়ে সংগ্রাম করতে হচ্ছে তাকে, যখন পুরো দেশের বেশিরভাগ অংশের দখল চলে গেছে জঙ্গি দল তালেবানের হাতে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দলটির সম্ভাব্য শান্তি চুক্তি ভেস্তে যায়। কট্টর রক্ষণশীল তালেবানরা পুরো দেশের দখল নিয়ে নিলে সেখানে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নিমিষেই শেষ হয়ে যাওয়ার ঝুকি রয়েছে। এসব জানা সত্ত্বেও ঘাফারি নিজের অবস্থান পরিষ্কার রেখেছেন। সম্প্রতি টুইটারে লিখেছেন, আমার কাজ হচ্ছে জনগণকে নারীদের অধিকার ও নারী ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করানো ।
আফগানিস্তানের পুরুষশাসিত সমাজে প্রশাসনিক কাজগুলো সাধারণত পুরুষরাই সামলিয়ে থাকে। সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ বেশ কঠোরভাবে দমিয়ে রাখা হয়। তা সত্ত্বেও কয়েকজন সাহসী নারী সে প্রথা ভেঙে সামনে এগিয়ে আসার চেষ্টা চালিয়ে যায়। ঘাফারি তাদেরই একজন। পুরো দেশে তার মতো প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা নারী আরো আছে। তবে অন্যকোনো নারীকে তার মতো কঠিন, অকল্পনীয় পদে দেখা যাওয়াটা এক প্রকার অসম্ভবই বলা যায়। ময়দান শার ছাড়া দাইকুন্দি ও বামিয়ান প্রদেশেও নারী গভর্নর থাকার ইতিহাস রয়েছে। দাইকুন্দির নীল শহরে দুই বছরের জন্য একজন নারী গভর্নর দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। দাইকুন্দি ও বামিয়ানের তুলনায় ওয়ারদাক অপেক্ষাকৃত বেশি রক্ষণশীল অঞ্চল। সেখানে তালেবানের প্রতি সমর্থন ব্যাপক বিস্তৃত। তাদের প্রভাব এতটাই বেশি যে, অঞ্চলটির হাইওয়েগুলোও সাধারণ নাগরিকদের জন্য নিরাপদ নয়।
ময়দানে ‘গার্লস স্কুল’ এর সংখ্যা মাত্র একটি। গত বছর ওই স্কুল থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কেবল ১৩ জন। ঘাফারি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে পুরো শহরে গার্লস স্কুলের শিক্ষিকারা ছাড়া সরকারি চাকরিরত একমাত্র নারী ছিলেন নারী মন্ত্রণালয়ের প্রধান। কিন্তু তিনিও শহরটিতে বাস করার সাহস করেননি। নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি থাকেন রাজধানী কাবুলে।
প্রাথমিকভাবে গত বছরের জুলাইয়ে ঘাফারিকে মেয়র হিসেবে নিয়োগ করেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি। মেয়র হিসেবে তার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা ছিল বেশ তিক্ত। নানা ঝামেলায় প্রথম দিন পার করার পর তার নিয়োগ বেশ কয়েক মাস পিছিয়ে দেয়া হয়। তিনি বলেন, গত বছর মেয়র হিসেবে প্রথম দিন কাজে যোগদানের কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্ষোভান্বিত দুর্বৃত্তরা তার কার্যালয়ে হামলা চালায়। লাঠি ও পাথর দিয়ে ভাংচুর চালানো হয় পুরো কার্যালয়জুড়ে। সেখান থেকে তাকে বের করে আনতে জাতীয় নিরাপত্তা পরিচালকের কার্যালয় থেকে গোয়েন্দা মোতায়েন করতে হয়েছিল। সেদিন সম্পর্কে ঘাফারির মন্তব্য, সেটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে দিন।
তিনি যখন কার্যালয় থেকে গোয়েন্দাদের সহায়তায় বেরিয়ে আসার সময় একজন হুশিয়ারি দিয়ে বলেছিল, এখানে আর ফিরে এসো না। ঘাফারি জানান, ওইসব দুর্বৃত্তদের মধ্যে ওয়ারদাকের গভর্নর মোহাম্মদ আরিফ শাহ জাহানের সমর্থক ও সহযোগীরাও ছিল। আরিফ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে নারী নিয়োগের বিরোধী ছিলেন। এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। তবে আরিফ সাড়া দেননি।
ঘাফারি সেদিন কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পর শহর ছেড়ে যান। সোজা রাজধানী কাবুলস্থ প্রেসিডেন্ট ভবনে পৌছে যান। প্রেসিডেন্ট ভবনের কর্মকর্তাদের সাফ জানিয়ে দেন, তিনি অত সহজে হাল ছাড়বেন না। তিনি বলেন, আমি এত চিৎকার করেছিলাম যে, আমার গলা দিয়ে আর আওয়াজ বের হচ্ছিল না। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রয়োজনে ভবনের সামনে নিজের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে হলেও আমি আমার কার্যালয়ের অধিকার নিশ্চিত করে ছাড়বো। এটা কোনো ফাঁকা বুলি ছিল না।
ওই ঘটনার নয় মাস পর ওয়ারদাকের গভর্নর জাহান পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের পরপরই ফের মেয়রের দায়িত্ব পালনে ফিরে গেলেন ঘাফারি। দায়িত্বে যোগদানের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক হ্যাশট্যাগ বার্তায় লিখেন, আমি আমার অধিকারের জন্য লোড়ে যাবো। এর মানে এমন ছিল না যে, তার দুর্দিন শেষ হয়ে গেছে। বরং তা আরো বেশি পরিমাণে বেড়ে যায়। প্রতিদিনের নৈমিত্তিক কাজ করতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাকে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি টিম ঘাফারিকে সশরীরে দেখতে গিয়েছিলেন। তার কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছিল তাদের। ঘাফারির সঙ্গে সাক্ষাতের একটি বর্ণনা নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে তুলে ধরেন তারা। লিখেন, একটি রাস্তা উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যাপারে পৌরসভা কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক ডেকেছিলেন ঘাফারি। কর্মকর্তাদের সকলেই পুরুষ ছিলেন। বৈঠকে কয়েকজন আসেন দেরি করে। কেউ কেউ পুরো বৈঠকে তাদের মুঠোফোন নিয়েও মত্ত ছিলেন। মুঠোফোনের মনিটর থেকে চোখই তুলছিলেন না। আরো কয়েকজন নিজেদের মধ্যে খুশমনে আলাপ করছিলেন। ঘাফারির দিকে মনোযোগ দিচ্ছিলেন খুব কম সংখ্যক অংশগ্রহণকারী। এক পর্যায়ে চিৎকার করে ওঠেন ঘাফারি। বলেন, ‘এটা একটা আনুষ্ঠানিক বৈঠক। কারো যদি ব্যক্তিগত কাজ থাকে, তাহলে তারা চলে যেতে পারে।’ ঘাফারির ধমকে কিছুটা কাজ হয়। মিনিট কয়েকের জন্য চুপ হয়ে তার কথা শোনেন কর্মকর্তারা। ‘এখন যান ও নিজের কাজগুলো করুন’, বলে বৈঠক শেষ করেন ঘাফারি। তিনি চলে যাবার পরপরই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া কক্ষটি থেকে ভেসে আসে হাসির আওয়াজ।
মেয়র হওয়ার পর থেকে বেশকিছু প্রচারণা চালাচ্ছেন ঘাফারি। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘ক্লিন সিটি গ্রিন সিটি’ প্রকল্প। প্রকল্পের আওতায় পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও নিজের সহযোগীদের একটি দল নিয়ে শহরজুড়ে ময়লা ফেলার জন্য প্লাস্টিক ব্যাগ বিতরণ করে থাকেন। এই প্রচারণার কাজে সঙ্গে সাংবাদিক নিতে অনেকটা অনাগ্রহী ছিলেন তিনি। কারণটা সহজেই বোঝা গেল। বাজারের দিকে এগুতেই একদল পুরুষ হাজির হলো। তার পাশেপাশে বেশ কাছাকাছি থেকে হাঁটতে লাগলো। উদ্দেশ্য একটাই, তাকে ভয় দেখানো। ঘাফারি বলেন, ‘আমার কোনো দেহরক্ষী নেই। যদিও নিয়ম অনুসারে আমার সঙ্গে সবসময় দুজন দেহরক্ষী থাকার কথা। এই শহরটা নিরাপদ নয়।’
বেশিরভাগ মানুষই প্রথমে ব্যাগ নিতে চাননি। পুরো রাস্তাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আবর্জনার স্তুপ। কিন্তু ঘাফারি নিজের অবস্থানে অটল ছিলেন। কখনো কখনো নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আগ্রাসীভাবে বলছিলেন, ‘এটা আমাদের শহর। আমাদের উচিৎ এটা পরিষ্কার রাখা। আপনারা আমায় সাহায্য না করলে আমি একা এই কাজ করতে পারবো না।’ কেউ কেউ এসব কথায় হেসেছিল। তবে বাকিরা ব্যাগ নিতে এগিয়ে এলেন। পুরো বাজারে মাত্র একজন নারী উপস্থিত ছিলেন, বাকিরা সবাই পুরুষ, বালক। ওই নারীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা ছিল বোরখায়।
প্রচারণা কাজ শেষে সাংবাদিকদের কাছে আগ্রাসী আচরণের জন্য মাফ চেয়ে নেন। বলেন, ‘এরকম রক্ষণশীল সমাজে কাজ করতে গেলে একজন আরীকে তার সত্যিকারের সত্ত্বাকে লুকিয়ে রাখতে হয়। তাকে কঠোর হতে হয়, নইলে কেউ তার কথা কানে নেয় না। তাদের কাছে আমায় প্রমাণ করতে হবে যে, নারীরা দুর্বল নয়।
ওয়ারদাকের বেশিরভাগ জনসংখ্যাই পাশতুন সম্প্রদায়ের। ঘাফারিও সে সম্প্রদায়েরই একজন। তার মা একজন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বাবা আফগান স্পেশাল ফোর্সের একজন কর্নেল। তার বয়স ২৬। আফগান সমাজের প্রচলিত রীতি অনুসারে তার বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে বহু আগেই। কিন্তু এখনো বিয়ে করেননি ঘাফারি।
ময়দান শারের মেয়র জানান, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার তালেবান ও জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস’র কাছ থেকে মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন তিনি। কিন্তু আইএস, তালেবানের হাতে খুন হওয়ার ভয় অনেক আগেই পার করে এসেছেন এই নারী। তিনি বলেন, ‘আমি জানি আমাকে খুন করে ফেলা হবে, কিন্তু তাদের আমি ভয় পাই না। তাদের চেয়ে বেশি উদ্বেগ হয় সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করা অপরাধীদের সিন্ডিকেটগুলো নিয়ে। তারা উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি ও জমি লেনদেনের ব্যবসায় যুক্ত।’ তিনি বলেন, এখানকার ভূমি মাফিয়াদেরই আমি বেশি ভয় পাই। তাদের একজন একদিন আমায় বলেছিল, আমি এখান থেকে চলে না গেলে সে আমার মাথায় একটি বুলেট ঠুকে দেবে।’
ঘাফারি কখনো সরকারের হয়ে কাজ করার প্রত্যাশা করেননি। তিনি ভারতে স্নাতক শেষ করেন। এরপর অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পড়া অবস্থায় গত বছর ছুটিতে বাড়ি আসেন। তখন পরিবারের সদস্যদের চাপে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেন। ওই পরীক্ষার আয়োজন করেছিলেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। তার উদ্দেশ্য ছিল সরকারি পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য মেধাবীদের খুঁজে বের করা। পড়াশোনার পাশাপাশি একজন উদ্যোক্তাও ছিলেন ঘাফারি। ছুটিতে বেশ জনপ্রিয় একটি রেডিও স্টেশন চালু করেছিলেন ওয়ারদাকে। ছুটি শেষে পড়াশোনা শেষ করতে ভারত ফের যান ঘাফারি। সেসময় এক বন্ধুর ফোন দিয়ে তাকে জানান, গনির কার্যালয় ফেসবুকে দেয়া এক ঘোষণায় ঘাফারিকে ময়দান শার এর মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করেছেন।
সেসময়কার বর্ণনা দিয়ে ঘাফারি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, আমি কাজটা পেয়েছি। কারণ, আমার কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না, স্বর্ণও ছিল না। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমি কাজটা চাই। এই সমাজে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করতে চাই।’
ঘাফারির গোঁ ধরা স্বভাব অবজ্ঞগার পাশাপাশি তাকে সমাজে বেশ খানিকটা সম্মান এনে দিয়েছে। ওই পৌরসভা বৈঠকে অপমানিত হওয়ার পরও খুব একটা বিচলিত হননি।
তিনি বলেন, মাঝে মাঝে মনে হয় এখানে সবাই নারী বিরোধী। আর কোনো নারী যখন সমাজে সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন তারা সহজেই তাকে দুশ্চরিত্রা আখ্যা দিয়ে দেয়া হয়।
পরবর্তীতে রাস্তা উন্নয়ন প্রকল্পটি নিয়ে অপর এক বৈঠকে ঘাফারি আশার আলো দেখতে পান। তার পক্ষে অল্প হলেও সমর্থন দেখা যায়। বৈঠকটি ছিল একটি রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে। বৈঠকে একজন তার পক্ষ নিয়ে বলেন, তাকে কিছুটা কৃতিত্ব দাও। প্রকল্পটি ১২ বছর ধরে বন্ধ পড়ে ছিল। তিনি মেয়র হওয়ার এক মাসের মধ্যেই সেটি চালু করতে পেরেছেন। তিনি একজন নারী হতে পারেন, কিন্তু তার শক্তি আছে।
No comments