সেই অধ্যক্ষের যত কেলেঙ্কারি by জিয়া চৌধুরী ও নাজমুল হক শামীম
তিনি
মাদরাসার অধ্যক্ষ। নীতিবান মানুষ গড়া তার দায়িত্ব। কিন্তু এই মানুষটিই
নানা কেলেঙ্কারির হোতা। ছাত্রীদের যৌন হেনস্তা করা তার নিয়মিত অভ্যাস।
অভিযোগ রয়েছে বলাৎকারেরও। মাদরাসার আয়ার শ্লীলতাহানি, কোটি টাকা আত্মসাৎ,
চাচাতো ভাইকে হত্যা চেষ্টার মতো অভিযোগ এখন মানুষের মুখে মুখে। তিনি ফেনীর
সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। আলিম পরীক্ষার্থী
নুসরাত জাহান রাফিকে আগুন দিয়ে হত্যাচেষ্টা ও যৌন হয়রানির অভিযোগের পর
বেরিয়ে আসছে অধ্যক্ষের নানা অপকর্মের তথ্য।
সোনাগাজীর মাদরাসা ছাড়াও আরো দু’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির তথ্যও জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এসব ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবার ও ব্যক্তিদের সঙ্গে ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে গতকাল বিকালে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। রাফির সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার পাশাপাশি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার আগের নানা সময়ের এসব অভিযোগেরও ন্যায়বিচার দাবি করেন তারা। উম্মুল কোরা ডেভেলপার নামে একটি আবাসন ও ভূমি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকাকালে প্রতিষ্ঠানটির ১০৯ জন সদস্যের নামে থাকা প্রায় এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ফেনী মডেল থানায় সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে বাদী হয়ে একটি মামলা করেন আব্দুল কাইয়ুম নিশান। ২০১৭ সালে ফেনীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি করা হয়। মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. মনিরউদ্দিন মিনু জানান, অর্থ আত্মসাতের মামলায় বিবাদীর বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। মামলাটি এখন চার্জ গঠনের অপেক্ষায় রয়েছে।
মামলার বাদী আব্দুল কাইয়ুম নিশান মানবজমিনকে জানান, ২০১৭ সালের আগস্টে ১০৯জন সদস্যকে নিয়ে শুরু হয় উম্মুল কোরা ডেভেলপারের কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটির অধীনে থাকা উম্মুল কোরা মাদরাসা ভবনটি সে বছর রাজু, সোহাগ, নয়ন ও মতুর্জা নামে কয়েক সন্ত্রাসীর সহায়তায় সিরাজ উদ দৌলা দখল করে নেন। মাদরাসার শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের কাজে নিয়োজিত থাকা একটি মাইক্রোবাস বিক্রির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া, ফেনীর মহীপাল এলাকায় কোম্পানির নামে থাকা সাড়ে ১৬ শতাংশ জমিও নিজের নামে করে নেন সিরাজ।
একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ফেনীর পাঠান বাড়ির মোড় এলাকায় উসমান ফার্নিচার নামে জমির দখল নিয়ে নেন অধ্যক্ষ সিরাজ। এই কাজে তাকে ভ্যান নয়ন নামে একজন সহায়তা করে বলে অভিযোগ বাদীর। উম্মুল কোরা ডেভেলপারের অধীনে থাকা এসব সম্পত্তি বেহাত করে সব টাকা নিজের নামে ব্যাংকে জমা করেন সিরাজ-উদ দৌলা। আর কোম্পানির সাধারণ সদস্যদের টাকা আত্মসাৎ করে ফেনীর পাঠান বাড়ির মোড়ে গড়ে তোলেন আলিশান ছয় তলা বাড়ি ‘ ফেরদৌসী মঞ্জিল’। কিন্তু কিভাবে ১০৯ জনের নামে থাকা প্রতিষ্ঠানের প্রায় দেড় কোটি টাকার সম্পদ একা হাতিয়ে নিলেন সেসব বিষয়ে কথা হয় তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাওলানা আব্দুল মালেকের সঙ্গে।
তিনি মানবজমিনকে বলেন, কোম্পানির সম্পত্তি বিক্রির সুবিধায় সে সময় চেয়ারম্যান সিরাজ উদ দৌলাকে একক ক্ষমতার অধিকার দেয়া হয়। লেনদেন ও ব্যাংকের ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে এমন সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিষ্ঠানের ইসি কমিটির সদস্যরা। তবে, এমন সিদ্ধান্ত কাল হয়ে দাঁড়ায় ১০৯ জন সদস্যের জন্য। সিরাজ উদ দৌলা সাধারণ সদস্যদের সম্পদ একে একে নিজের নামে করে নেন। জমি ও অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমা দেয়ার কথা থাকলেও তা করেননি। পরে ২০১৭ সালে আমরা মামলা করতে বাধ্য হই। ২০১৭ সালের ৭ ও ১৩ই আগস্ট তার বিরুদ্ধে ফেনী সদর মডেল থানায় পৃথক দুটি অভিযোগ করা হয়। পরে কয়েক দফার বৈঠকে টাকা বুঝিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এক টাকাও হস্তান্তর করেননি। বরং আমাদের সন্ত্রাসী ও গুন্ডা দিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়েছেন।
মামলার বাদী আব্দুল কাইয়ুম নিশান জানান, ২০১৮ সালে এই মামলায় প্রায় ২১ দিন জেলও খাটেন সিরাজ উদ দৌলা। পরে স্ট্রোকের ভুয়া অজুহাত দেখিয়ে আদালত থেকে জামিন নেন। জামিনে বেরিয়ে বেশ কয়েকবার আমাকে হত্যার হুমকিও দেন তিনি। উম্মুল কোরা ডেভেলপারের প্রায় দেড় কোটি টাকার সম্পদ নিজের নামে হাতিয়ে নেয়া ছাড়াও ২০০৭ থেকে নানা সময়ে সিরাজ উদ দৌলা বিভিন্ন মাদরাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী, কর্মীদের যৌন হয়রানি, ছেলে শিক্ষার্থীকে বলাৎকার ও নিজের চাচাতো ভাই এবং গাড়ি চালককে হত্যাচেষ্টা করেন বলেও স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে। এছাড়া নাশকতা ও সরকারি গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে ২০১৫ সালে ফেনী মডেল থানার এফজিআর ৫১০/১৫ নম্বর মামলায়ও জেল খাটেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। ২০০৭ সালে ফেনীর দলিয়া এলাকার সালামতিয়া মাদরাসার এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে চাকরিচ্যুত হন তিনি। এছাড়া, আল জামিয়াতুল ফালাইয়া মাদরাসায় এক শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের অভিযোগেও তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের রংমালা মাদরাসায়ও নারী শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে চাকরি হারান সিরাজ। পরে জাল সনদ দিয়ে ফেনীর সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় উপাধ্যক্ষ পদে চাকরি নেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সেখানকার প্রভাবশালীদের নিয়ে গড়ে তোলেন নিজের বলয়। আর শুরু করেন ত্রাসের রাজত্ব। সোনাগাজীর ওই মাদরাসায় নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি ছাড়াও তহবিলের টাকা লুটপাট করেন। এছাড়া, ২০১৮ সালের ১০ই জুন নিজের গাড়িচালক মেফতাহুল ইসলামকে হত্যাচেষ্টা করেন সিরাজ। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেন রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টা মামলার দুই নম্বর আসমি শামীম। পরে শামীমের ভয়ে অভিযোগ তুলে নেন মেফতাহুল ইসলাম।
২০১৭ সালের ১২ই জুলাই ফেনীর ৮ নম্বর দরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে সিরাজের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনেন ইশরাফিল নামে একজন। অভিযোগের পর তাকেও হত্যার হুমকি দেয়া হয়। ২০১৭ সালের ১১ই নভেম্বর নিজের প্রবাসী চাচাতো ভাই নূরনবীকে হত্যার হুমকি দেন সিরাজ। পরে ফেনীর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এই বিষয়ে সমঝোতা হয়। একই বছরের ৬ই ফেব্রুয়ারি রফিকুল ইসলাম নামে একজন শিক্ষককে পরীক্ষা কক্ষে লাঞ্ছিত করারও অভিযোগ রয়েছে সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে। পরের বছর ২০১৮ সালে ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চেক জালিয়াতির অপরাধে তার বিরুদ্ধে ৩২৫/১৮ নম্বর মামলা করা হয়। ২০১১ সালে একবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাদরাসায় অনিয়মের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে। ক্ষমতার দাপটে সেই কমিটির রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়া ২০১৭ সালের ১২ই নভেম্বর ৩৮ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পি কে এনামুল করিম। কিন্তু সেবারও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বেঁচে যান সিরাজ উদ দৌলা। তবে নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টার পর অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আবারো মুখ খুলতে শুরু করেছেন স্থানীয় জনগণ। নানা অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গতকাল বুধবার ফেনী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধনও করেছেন ভুক্তভোগীরা।
৭ দিনের রিমান্ডে অধ্যক্ষ, মামলা পিবিআইতে: নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টা মামলায় এজহারভূক্ত প্রধান আসামি সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ (সদ্য বহিষ্কৃত) সিরাজ-উদ দৌলার ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বুধবার দুপুরে ফেনীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সরাফ উদ্দিন আহমেদের আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এসময় ওই মাদরাসার প্রভাষক নুরুল আবসার ও ছাত্র আরিফুল ইসলামের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সোনাগাজী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামাল হোসেন তিন আসামিকে আদালতে তুলে প্রত্যেকের ৭দিন করে রিমান্ড আবেদন করেন। এদিকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার এ মামলার এজহারভূক্ত আসামি জোবায়ের আহমেদ ও হামলায় জড়িত সন্দেহে আটক অধ্যক্ষের ভাগ্নি উন্মে সুলতানা পপিকে সকালে একই আদালতে তুলে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত শুনানির জন্য পরবর্তী দিন ধার্য্য করেছেন।
বাদি পক্ষের আইনজীবী এম শাহজাহান সাজু জানান, সিরাজ-উদ দৌলা কারাগারে বসে ষড়যন্ত্র করে তার সাঙ্গপাঙ্গরা নুসরাতের উপর এ জঘন্য হামলা করেছে। আমরা বিচারককে বিষয়টি বুঝিয়ে বলেছি। বিচারক আমাদের বক্তব্য শুনে ৭দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। আমরা আশা করি রিমান্ডে জিঙ্গাসাবাদে প্রধান আসামি হত্যার ষড়যন্তের বিষয়ে স্বীকার করবে।
নুসরাতের আবেগঘন চিঠি উদ্ধার: এদিকে অধ্যক্ষ সিরাজ উদৌলার হাতে যৌন হেনস্থার শিকার নুসরাত জাহান রাফির একটি আবেগঘন চিঠি উদ্ধার করেছে পুলিশ। দুই সহপাঠিকে লেখা এ চিঠি মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করেছে পুলিশ। রাফির খাতায় এটি নোট আকারে লেখা ছিল। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সোনাগাজী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামাল হোসেন জানান, নুসরাতের ঘরের পড়ার টেবিলের বই/খাতা দেখতে গিয়ে একটি খাতার পৃষ্ঠা উল্টালে এমন একটি লিখা পাই। এর কয়েক পাতা পর আরো একটি লিখা পাই। তাতক্ষণিক পুলিশ পাতাসহ খাতাটি জব্দ করে।
নিচে নুসরাতের চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
সাথি, তামান্না..
‘তামান্না, সাথি তোরা আমার বোনের মত, এবং বোনই। ওই দিন তামান্না আমায় বলেছিলো, আমি নাকি নাটক করতেছি। তোর সামনেই বললো, আরো কি কি বললো। আর তুই নাকি নিশাতকে বলেছিস, আমরা খারাপ মেয়ে। বোন প্রেম করলে কি সে খারাপ ???
তোরা সিরাজুদ্দৌলা সম্পর্কে সব জানার পরও কিভাবে তার মুক্তি চাইতেছিস, তোরা জানিস না ঐদিন ক্লাসে কি হইসে, উনি আমার কোন জায়গায় হাত দিয়েছে এবং আর কোন জায়গায় হাত দেয়ার চেষ্টা করছে। উনি আমাকে বলতেছে নুসরাত ডং করিও না। তুই প্রেম করিস না, ছেলেদের সাথে প্রেম করতে ভাল লাগে। ওরা তোরে কি দিতে পারবে, আমি তোকে পরীক্ষার সময় প্রশ্ন দেব। আমি শুধু আমার শরীর দিতাম ওরে। বোন এ জবাবে আমি উত্তর দিলাম, আমি একটা ছেলের না হাজারটা ছেলের...’’ (এই পত্রের বাকি অংশ পাওয়া যায়নি)
অন্য পাতায় নুসরাত লেখেন,
‘আমি লড়বো শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। আমি প্রথমে যে ভুলটা করেছি আত্নহত্যা করতে গিয়ে সে ভুলটা দ্বিতীয় বার করবো না। মরে যাওয়া মানে তো হেরে যাওয়া, আমি মরবো না। আমি বাঁচবো, আমি তাকে শাস্তি দেব। সে আমায় কষ্ট দিয়েছে। আমি তাকে এমন শাস্তি দেব যে তাকে দেখে অন্যরাও শিক্ষা নেবে। আমি তারে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দেব। ইনশাআল্লাহ।
ওসি প্রত্যাহার: এদিকে সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রত্যাহারের পর তাকে তাৎক্ষণিকভাবে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করা হয়েছে। গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ শাখার এআইজি সোহেল রানা এতথ্য জানিয়েছেন। ওসিকে এপিবিএনে বদলির খবর নিশ্চিত করেছেন ফেনীর পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার।
সোনাগাজীর মাদরাসা ছাড়াও আরো দু’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির তথ্যও জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এসব ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবার ও ব্যক্তিদের সঙ্গে ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে গতকাল বিকালে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। রাফির সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার পাশাপাশি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার আগের নানা সময়ের এসব অভিযোগেরও ন্যায়বিচার দাবি করেন তারা। উম্মুল কোরা ডেভেলপার নামে একটি আবাসন ও ভূমি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকাকালে প্রতিষ্ঠানটির ১০৯ জন সদস্যের নামে থাকা প্রায় এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ফেনী মডেল থানায় সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে বাদী হয়ে একটি মামলা করেন আব্দুল কাইয়ুম নিশান। ২০১৭ সালে ফেনীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি করা হয়। মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. মনিরউদ্দিন মিনু জানান, অর্থ আত্মসাতের মামলায় বিবাদীর বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। মামলাটি এখন চার্জ গঠনের অপেক্ষায় রয়েছে।
মামলার বাদী আব্দুল কাইয়ুম নিশান মানবজমিনকে জানান, ২০১৭ সালের আগস্টে ১০৯জন সদস্যকে নিয়ে শুরু হয় উম্মুল কোরা ডেভেলপারের কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটির অধীনে থাকা উম্মুল কোরা মাদরাসা ভবনটি সে বছর রাজু, সোহাগ, নয়ন ও মতুর্জা নামে কয়েক সন্ত্রাসীর সহায়তায় সিরাজ উদ দৌলা দখল করে নেন। মাদরাসার শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের কাজে নিয়োজিত থাকা একটি মাইক্রোবাস বিক্রির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া, ফেনীর মহীপাল এলাকায় কোম্পানির নামে থাকা সাড়ে ১৬ শতাংশ জমিও নিজের নামে করে নেন সিরাজ।
একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ফেনীর পাঠান বাড়ির মোড় এলাকায় উসমান ফার্নিচার নামে জমির দখল নিয়ে নেন অধ্যক্ষ সিরাজ। এই কাজে তাকে ভ্যান নয়ন নামে একজন সহায়তা করে বলে অভিযোগ বাদীর। উম্মুল কোরা ডেভেলপারের অধীনে থাকা এসব সম্পত্তি বেহাত করে সব টাকা নিজের নামে ব্যাংকে জমা করেন সিরাজ-উদ দৌলা। আর কোম্পানির সাধারণ সদস্যদের টাকা আত্মসাৎ করে ফেনীর পাঠান বাড়ির মোড়ে গড়ে তোলেন আলিশান ছয় তলা বাড়ি ‘ ফেরদৌসী মঞ্জিল’। কিন্তু কিভাবে ১০৯ জনের নামে থাকা প্রতিষ্ঠানের প্রায় দেড় কোটি টাকার সম্পদ একা হাতিয়ে নিলেন সেসব বিষয়ে কথা হয় তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাওলানা আব্দুল মালেকের সঙ্গে।
তিনি মানবজমিনকে বলেন, কোম্পানির সম্পত্তি বিক্রির সুবিধায় সে সময় চেয়ারম্যান সিরাজ উদ দৌলাকে একক ক্ষমতার অধিকার দেয়া হয়। লেনদেন ও ব্যাংকের ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে এমন সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিষ্ঠানের ইসি কমিটির সদস্যরা। তবে, এমন সিদ্ধান্ত কাল হয়ে দাঁড়ায় ১০৯ জন সদস্যের জন্য। সিরাজ উদ দৌলা সাধারণ সদস্যদের সম্পদ একে একে নিজের নামে করে নেন। জমি ও অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমা দেয়ার কথা থাকলেও তা করেননি। পরে ২০১৭ সালে আমরা মামলা করতে বাধ্য হই। ২০১৭ সালের ৭ ও ১৩ই আগস্ট তার বিরুদ্ধে ফেনী সদর মডেল থানায় পৃথক দুটি অভিযোগ করা হয়। পরে কয়েক দফার বৈঠকে টাকা বুঝিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এক টাকাও হস্তান্তর করেননি। বরং আমাদের সন্ত্রাসী ও গুন্ডা দিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়েছেন।
মামলার বাদী আব্দুল কাইয়ুম নিশান জানান, ২০১৮ সালে এই মামলায় প্রায় ২১ দিন জেলও খাটেন সিরাজ উদ দৌলা। পরে স্ট্রোকের ভুয়া অজুহাত দেখিয়ে আদালত থেকে জামিন নেন। জামিনে বেরিয়ে বেশ কয়েকবার আমাকে হত্যার হুমকিও দেন তিনি। উম্মুল কোরা ডেভেলপারের প্রায় দেড় কোটি টাকার সম্পদ নিজের নামে হাতিয়ে নেয়া ছাড়াও ২০০৭ থেকে নানা সময়ে সিরাজ উদ দৌলা বিভিন্ন মাদরাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী, কর্মীদের যৌন হয়রানি, ছেলে শিক্ষার্থীকে বলাৎকার ও নিজের চাচাতো ভাই এবং গাড়ি চালককে হত্যাচেষ্টা করেন বলেও স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে। এছাড়া নাশকতা ও সরকারি গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে ২০১৫ সালে ফেনী মডেল থানার এফজিআর ৫১০/১৫ নম্বর মামলায়ও জেল খাটেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। ২০০৭ সালে ফেনীর দলিয়া এলাকার সালামতিয়া মাদরাসার এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে চাকরিচ্যুত হন তিনি। এছাড়া, আল জামিয়াতুল ফালাইয়া মাদরাসায় এক শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের অভিযোগেও তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের রংমালা মাদরাসায়ও নারী শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে চাকরি হারান সিরাজ। পরে জাল সনদ দিয়ে ফেনীর সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় উপাধ্যক্ষ পদে চাকরি নেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সেখানকার প্রভাবশালীদের নিয়ে গড়ে তোলেন নিজের বলয়। আর শুরু করেন ত্রাসের রাজত্ব। সোনাগাজীর ওই মাদরাসায় নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি ছাড়াও তহবিলের টাকা লুটপাট করেন। এছাড়া, ২০১৮ সালের ১০ই জুন নিজের গাড়িচালক মেফতাহুল ইসলামকে হত্যাচেষ্টা করেন সিরাজ। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেন রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টা মামলার দুই নম্বর আসমি শামীম। পরে শামীমের ভয়ে অভিযোগ তুলে নেন মেফতাহুল ইসলাম।
২০১৭ সালের ১২ই জুলাই ফেনীর ৮ নম্বর দরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে সিরাজের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনেন ইশরাফিল নামে একজন। অভিযোগের পর তাকেও হত্যার হুমকি দেয়া হয়। ২০১৭ সালের ১১ই নভেম্বর নিজের প্রবাসী চাচাতো ভাই নূরনবীকে হত্যার হুমকি দেন সিরাজ। পরে ফেনীর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এই বিষয়ে সমঝোতা হয়। একই বছরের ৬ই ফেব্রুয়ারি রফিকুল ইসলাম নামে একজন শিক্ষককে পরীক্ষা কক্ষে লাঞ্ছিত করারও অভিযোগ রয়েছে সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে। পরের বছর ২০১৮ সালে ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চেক জালিয়াতির অপরাধে তার বিরুদ্ধে ৩২৫/১৮ নম্বর মামলা করা হয়। ২০১১ সালে একবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাদরাসায় অনিয়মের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে। ক্ষমতার দাপটে সেই কমিটির রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়া ২০১৭ সালের ১২ই নভেম্বর ৩৮ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পি কে এনামুল করিম। কিন্তু সেবারও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বেঁচে যান সিরাজ উদ দৌলা। তবে নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টার পর অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আবারো মুখ খুলতে শুরু করেছেন স্থানীয় জনগণ। নানা অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গতকাল বুধবার ফেনী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধনও করেছেন ভুক্তভোগীরা।
৭ দিনের রিমান্ডে অধ্যক্ষ, মামলা পিবিআইতে: নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টা মামলায় এজহারভূক্ত প্রধান আসামি সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ (সদ্য বহিষ্কৃত) সিরাজ-উদ দৌলার ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বুধবার দুপুরে ফেনীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সরাফ উদ্দিন আহমেদের আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এসময় ওই মাদরাসার প্রভাষক নুরুল আবসার ও ছাত্র আরিফুল ইসলামের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সোনাগাজী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামাল হোসেন তিন আসামিকে আদালতে তুলে প্রত্যেকের ৭দিন করে রিমান্ড আবেদন করেন। এদিকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার এ মামলার এজহারভূক্ত আসামি জোবায়ের আহমেদ ও হামলায় জড়িত সন্দেহে আটক অধ্যক্ষের ভাগ্নি উন্মে সুলতানা পপিকে সকালে একই আদালতে তুলে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত শুনানির জন্য পরবর্তী দিন ধার্য্য করেছেন।
বাদি পক্ষের আইনজীবী এম শাহজাহান সাজু জানান, সিরাজ-উদ দৌলা কারাগারে বসে ষড়যন্ত্র করে তার সাঙ্গপাঙ্গরা নুসরাতের উপর এ জঘন্য হামলা করেছে। আমরা বিচারককে বিষয়টি বুঝিয়ে বলেছি। বিচারক আমাদের বক্তব্য শুনে ৭দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। আমরা আশা করি রিমান্ডে জিঙ্গাসাবাদে প্রধান আসামি হত্যার ষড়যন্তের বিষয়ে স্বীকার করবে।
নুসরাতের আবেগঘন চিঠি উদ্ধার: এদিকে অধ্যক্ষ সিরাজ উদৌলার হাতে যৌন হেনস্থার শিকার নুসরাত জাহান রাফির একটি আবেগঘন চিঠি উদ্ধার করেছে পুলিশ। দুই সহপাঠিকে লেখা এ চিঠি মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করেছে পুলিশ। রাফির খাতায় এটি নোট আকারে লেখা ছিল। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সোনাগাজী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামাল হোসেন জানান, নুসরাতের ঘরের পড়ার টেবিলের বই/খাতা দেখতে গিয়ে একটি খাতার পৃষ্ঠা উল্টালে এমন একটি লিখা পাই। এর কয়েক পাতা পর আরো একটি লিখা পাই। তাতক্ষণিক পুলিশ পাতাসহ খাতাটি জব্দ করে।
নিচে নুসরাতের চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
সাথি, তামান্না..
‘তামান্না, সাথি তোরা আমার বোনের মত, এবং বোনই। ওই দিন তামান্না আমায় বলেছিলো, আমি নাকি নাটক করতেছি। তোর সামনেই বললো, আরো কি কি বললো। আর তুই নাকি নিশাতকে বলেছিস, আমরা খারাপ মেয়ে। বোন প্রেম করলে কি সে খারাপ ???
তোরা সিরাজুদ্দৌলা সম্পর্কে সব জানার পরও কিভাবে তার মুক্তি চাইতেছিস, তোরা জানিস না ঐদিন ক্লাসে কি হইসে, উনি আমার কোন জায়গায় হাত দিয়েছে এবং আর কোন জায়গায় হাত দেয়ার চেষ্টা করছে। উনি আমাকে বলতেছে নুসরাত ডং করিও না। তুই প্রেম করিস না, ছেলেদের সাথে প্রেম করতে ভাল লাগে। ওরা তোরে কি দিতে পারবে, আমি তোকে পরীক্ষার সময় প্রশ্ন দেব। আমি শুধু আমার শরীর দিতাম ওরে। বোন এ জবাবে আমি উত্তর দিলাম, আমি একটা ছেলের না হাজারটা ছেলের...’’ (এই পত্রের বাকি অংশ পাওয়া যায়নি)
অন্য পাতায় নুসরাত লেখেন,
‘আমি লড়বো শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। আমি প্রথমে যে ভুলটা করেছি আত্নহত্যা করতে গিয়ে সে ভুলটা দ্বিতীয় বার করবো না। মরে যাওয়া মানে তো হেরে যাওয়া, আমি মরবো না। আমি বাঁচবো, আমি তাকে শাস্তি দেব। সে আমায় কষ্ট দিয়েছে। আমি তাকে এমন শাস্তি দেব যে তাকে দেখে অন্যরাও শিক্ষা নেবে। আমি তারে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দেব। ইনশাআল্লাহ।
ওসি প্রত্যাহার: এদিকে সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রত্যাহারের পর তাকে তাৎক্ষণিকভাবে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করা হয়েছে। গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ শাখার এআইজি সোহেল রানা এতথ্য জানিয়েছেন। ওসিকে এপিবিএনে বদলির খবর নিশ্চিত করেছেন ফেনীর পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার।
No comments