লিডার অব দ্য ওয়ার্ল্ড by সাজেদুল হক ও অনিম আরাফাত
খবরটা
ততক্ষণে চাউর হয়ে গেছে। টিভি পর্দায় কোটি কোটি মানুষের চোখ। সংবাদ
সম্মেলনে এলেন এক ভদ্রমহিলা। সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে বিবিসি, আল জাজিরায়।
যারা চিনেন না তারা হয়তো বুঝতে পারেননি, তিনি নিউজিল্যান্ডের
প্রধানমন্ত্রী জাসিনদা আরডেন। পাশে কোনো চেলা, চামুণ্ডা নেই। একা একাই
দীর্ঘক্ষণ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেলেন। দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ
করলেন, আজকের দিনটি নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকার দিন।
আক্রান্ত মুসলিম সম্প্রদায়কে অভয় দিলেন, তোমরাই আমরা। জাসিনদা আরডেনের সাদাসিধে চলাফেরা সেদিনই অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পশ্চিমা দুনিয়ার শাসকদের জন্য এটা অবশ্য ব্যতিক্রম কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু গত এক সপ্তায় যা যা হলো তাতে নিউ ইয়র্ক টাইমস পর্যন্ত আফসোস করেছে, আমেরিকার যদি একজন আরডেন থাকতো।
পৃথিবীটা এমনিতেই খুব খারাপ একটা সময় অতিক্রম করছে। দেশে দেশে ডনাল্ড ট্রাম্প, নরেন্দ্র মোদিদের উত্থান। ভোটের বাজিতে উত্রাতে উস্কে দেয়া হচ্ছে ঘৃণা। আকাশে বোমারু বিমান। এ যেন সেই সময় যে সময়ের বয়ান দিতে গিয়ে আল মাহমুদ লিখেছেন, ‘ভাবো, ইতিহাসের গতিরুদ্ধ। মানুষের আর কোনো ইতিহাস থাকবে না। পুঁজি থাকবে, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ববিচরণশীল লুণ্ঠন থাকবে, কিন্তু না বলার মতো কোনো দেশ থাকবে না। কেবল মহাকাশব্যাপী ঈগলখচিত বোমারু বিমানগুলো উড়বে- কিন্তু মাটি, পাহাড় বা সাগর থাকবে না।’
সেই সময়ে দাঁড়িয়ে দুনিয়াতে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন আরডেন। ৩৮ বছর বয়সী এই প্রধানমন্ত্রী উত্রে গেলেন তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায়। এমন পরীক্ষার টেবিলে নিউজিল্যান্ডের আগের কোনো প্রধানমন্ত্রীকে বসতে হয়নি। এমনিতে নিউজিল্যান্ড শান্তির দেশ হিসেবে পরিচিত। খুন-খারাবি নেই বললেই চলে। সেখানে এক শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী চরম ঘৃণা নিয়ে হামলা চালালেন মসজিদে। হত্যা করলেন ৫০ মুসল্লিকে। এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে তোলপাড় তৈরি হয় সারা দুনিয়াতেই। তবে ঘটনাটি যে হঠাৎ করেই ঘটেনি তা বহু পর্যবেক্ষকই স্বীকার করেন। পশ্চিমা রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমের একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরে এ ঘৃণা ছড়িয়ে আসছে। ইসলামভীতি তৈরিতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে আসছেন তারা।
কিন্তু নিউজিল্যান্ডে মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা এটা আবার সামনে নিয়ে আসে যে সন্ত্রাসের কোনো ধর্ম নেই, জাত নেই। নিউজিল্যান্ড, এ দেশটির জনগণ ও প্রধানমন্ত্রী তামাম দুনিয়ার সামনে নজির হাজির করেন- কেবলমাত্র ভালোবাসা দিয়েই পরাজিত করা সম্ভব ঘৃণাকে। তারা একযোগে মুসলমানদের পাশে এসে দাঁড়ান। তাদের অভয় দেন। সংহতি প্রকাশ করেন। হিজাব পরে আরডেন এবং তার দেশের নারীরা বার্তা দেন মুসলিম নারীদের। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’- সেই চিরায়ত উচ্চারণ দীপ্তকণ্ঠে ফিরে আসে আরডেনের মুখে।
মুহূর্তেই সারা দুনিয়ার মানুষের মন জয় করে নেন তিনি। আক্রান্ত নূর মসজিদের ইমাম যখন বলেন, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে এই ঘটনার নিন্দা করেছেন, শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তা গোটা বিশ্বে একটি দৃষ্টান্ত। এটা শুধু নূর মসজিদের ইমামের কথাই নয়, এটা যেন এখন সারা পৃথিবীরই কথা। মুক্ত দুনিয়ার মানুষ, রাজনীতিবিদরা আকুণ্ঠ প্রশংসায় মেতেছেন আরডেনের। বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমও যোগ দিয়েছে এ দৌড়ে। নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, গার্ডিয়ান থেকে সারা পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যমে এক প্রশংসিত নাম আরডেন। সবারই প্রশ্ন এমনও হয় নাকি। আরডেনের প্রশংসা করে নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, আতঙ্ক কীভাবে সামাল দিতে হয় তা আরডেনের কাছ থেকে শেখা উচিত বিশ্বের। অন্যদিকে, গার্ডিয়ানে লেখা হয়েছে সত্যিকারের নেতা।
আরডেনকে নোবেল দেয়ার পিটিশন:
এই পরিস্থিতিতে জাসিনদা আরডেনকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেয়ার দাবি উঠেছে। এরই মধ্যে দুটি পিটিশন করা হয়েছে। একটি পিটিশন করা হয়েছে চেঞ্জ ডট অর্গ (ঈযধহমব.ড়ৎম)-এ। আরেকটি করা হয়েছে ফরাসি ওয়েবসাইট আভাজ ডট অর্গ (অঠঅঅত.ড়ৎম)-এ। অনলাইনে এ দুটি পিটিশনে এরই মধ্যে স্বাক্ষর করেছেন কয়েক হাজার মানুষ। এ খবর দিয়েছে অনলাইন নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড। ফরাসি সাইটে লেখা হয়েছে, ক্রাইস্টচার্চে বিয়োগান্তক ঘটনার পর উপযুক্ত, উন্মুক্ত ও শান্তিপূর্ণভাবে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিনদা আরডেন, আমরা আশা করি আগামীতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার তার হাতে তুলে দেয়া হবে। ধারণা করা হচ্ছে, ফরাসি সাইটে এই আবেদনটির উদ্যোক্তা ফরাসি কবি ড. খাল তোরাবুলি।
নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড লিখেছে, গত সপ্তাহের ওই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর দেশকে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তার জন্য সারা বিশ্ব তার প্রশংসা করেছে। তার এ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দুবাইয়ের বুর্জ খলিফায় তাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাতে একজন মুসলিম নারীকে তিনি আলিঙ্গন করছেন- এমন একটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। মুসলিমদের প্রতি তিনি যে আন্তরিক সহানুভূতি ও সমর্থন দেখিয়েছেন তার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ। বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের ১৫০ কোটি মুসলিমের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন জাসিনদা।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে আমিরাতের ‘সালাম’: বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন বুর্জ খলিফায় ফুটিয়ে তোলা হলো আরডেনকে। এতে দেখানো হয়েছে, তিনি ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত মুসলিমদের পরিবারের সদস্যদের জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। হামলার পর মুসলিমদের প্রতি তিনি যে সমর্থন, সম্মান দেখিয়েছেন তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে শুক্রবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অবস্থিত বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন বুর্জ খলিফায় তাকে এভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। সিডনি মর্নিং হেরাল্ডকে উদ্ধৃত করে এ খবর দিয়েছে অনলাইন দ্য স্ট্রেইটস টাইমস।
প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, ৮২৯ মিটার উঁচু বুর্জ খলিফার চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এই টাওয়ার। এর উপরেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আরডেনকে। তিনি মাথায় স্কার্ফ পরা। মসজিদে হামলায় নিহতদের এক নারী স্বজনকে জড়িয়ে ধরে আছেন তিনি। তার মাথার একটু উপরে আরবিতে লেখা ‘সালাম’ যার অর্থ শান্তি। বুর্জ খলিফার এমন ছবি টুইট করেছেন সংযুুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ।
শেখ মোহাম্মদ শুক্রবার টুইটে লিখেছেন, মসজিদে হামলায় শহীদদের সম্মানে নিউজিল্যান্ড নীরব আজ (শুক্রবার)। সন্ত্রাসী হামলার পর বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের মধ্যে এক হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। তারপর নিউজিল্যান্ড ও এ দেশের প্রধানমন্ত্রী জাসিনদা আরডেন যে আন্তরিক সহানুভূতি ও সমর্থন দিয়েছেন তাতে ১৫০ কোটি মুসলিমের শ্রদ্ধা পেয়েছেন তিনি।
কে এই আরডেন
নিউজিল্যান্ডের একদম প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসেছেন জাসিনদা আরডেন। ১৯৮০ সালের ২৬শে জুলাই নিউজিল্যান্ডের হ্যামিল্টনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। মা একটি স্কুলের খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে ছিলেন। জাসিনদা মরিন্সভিল্লে কলেজে পড়াশোনা করেছেন। ২০০১ সালে তিনি ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্কের অফিসে গবেষণা কাজে নিয়োজিত হন। এ ছাড়া তিনি বৃটেনে প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। রাজনীতির সঙ্গে এভাবেই যুক্ত হন তিনি। তবে তার ফুপি ম্যারি আরডেন লেবার পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় কিশোরী বয়সেই রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেন তিনি।
২০০৮ সালে সমাজতান্ত্রিক তরুণদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জাসিনদা আরডেন। সে বছরই তিনি প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডের বাম ঘরানার দল লেবার পার্টির একজন এমপি নির্বাচিত হন। এর ঠিক দশ বছরের মধ্যেই তিনি নিজেকে লেবার পার্টির সব থেকে যোগ্য নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। ২০১৭ সালের ১লা মার্চ তিনি লেবার পার্টির ডেপুটি প্রধান নির্বাচিত হন। ওই বছরের ১লা আগস্ট তিনি লেবার পার্টির প্রধান নেতা নির্বাচিত হন। সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে তিনি জোট গঠনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হন। জাসিন্দা আরডেন পার্টির প্রধান হওয়ার আগে আন্ড্রু লিটল ছিলেন এ পদে। তার সময়ে লেবার পার্টির জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধস নামে। ফলে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। দলের কঠিন সময়ে এর হাল ধরে তাকে পুনরায় জনপ্রিয় করে তোলেন জাসিনদা আরডেন।
রাজনৈতিক নানা সমীকরণ মিলিয়ে ২০১৭ সালের ২৬শে অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন তিনি। ক্ষমতায় বসেই তিনি ঘোষণা দেন, তার সরকার হবে শক্তিশালী ও সংবেদনশীল। ক্ষমতায় বসার কিছুদিন পরেই গর্ভবতী হন জাসিনদা। তবে এ জন্য তিনি দায়িত্বে গাফিলতি করেন নি। গর্ভবতী অবস্থায়ই তিনি ইউরোপ সফর করেছেন, রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্বও পালন করেছেন সফলভাবে। শেষদিকে মাত্র ৬ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছেন আরডেন। ২০১৮ সালে ‘ফোর্বসের পাওয়ার উইমেনের’ তালিকায় জায়গা করে নেন তিনি। আছেন টাইম ম্যাগাজিনে সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকাতেও। জলবায়ু পরিবর্তন, শিশু দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে কাজ করছেন তিনি। নিজ দেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একট সহানুভূতিশীল সরকার।
আক্রান্ত মুসলিম সম্প্রদায়কে অভয় দিলেন, তোমরাই আমরা। জাসিনদা আরডেনের সাদাসিধে চলাফেরা সেদিনই অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পশ্চিমা দুনিয়ার শাসকদের জন্য এটা অবশ্য ব্যতিক্রম কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু গত এক সপ্তায় যা যা হলো তাতে নিউ ইয়র্ক টাইমস পর্যন্ত আফসোস করেছে, আমেরিকার যদি একজন আরডেন থাকতো।
পৃথিবীটা এমনিতেই খুব খারাপ একটা সময় অতিক্রম করছে। দেশে দেশে ডনাল্ড ট্রাম্প, নরেন্দ্র মোদিদের উত্থান। ভোটের বাজিতে উত্রাতে উস্কে দেয়া হচ্ছে ঘৃণা। আকাশে বোমারু বিমান। এ যেন সেই সময় যে সময়ের বয়ান দিতে গিয়ে আল মাহমুদ লিখেছেন, ‘ভাবো, ইতিহাসের গতিরুদ্ধ। মানুষের আর কোনো ইতিহাস থাকবে না। পুঁজি থাকবে, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ববিচরণশীল লুণ্ঠন থাকবে, কিন্তু না বলার মতো কোনো দেশ থাকবে না। কেবল মহাকাশব্যাপী ঈগলখচিত বোমারু বিমানগুলো উড়বে- কিন্তু মাটি, পাহাড় বা সাগর থাকবে না।’
সেই সময়ে দাঁড়িয়ে দুনিয়াতে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন আরডেন। ৩৮ বছর বয়সী এই প্রধানমন্ত্রী উত্রে গেলেন তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায়। এমন পরীক্ষার টেবিলে নিউজিল্যান্ডের আগের কোনো প্রধানমন্ত্রীকে বসতে হয়নি। এমনিতে নিউজিল্যান্ড শান্তির দেশ হিসেবে পরিচিত। খুন-খারাবি নেই বললেই চলে। সেখানে এক শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী চরম ঘৃণা নিয়ে হামলা চালালেন মসজিদে। হত্যা করলেন ৫০ মুসল্লিকে। এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে তোলপাড় তৈরি হয় সারা দুনিয়াতেই। তবে ঘটনাটি যে হঠাৎ করেই ঘটেনি তা বহু পর্যবেক্ষকই স্বীকার করেন। পশ্চিমা রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমের একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরে এ ঘৃণা ছড়িয়ে আসছে। ইসলামভীতি তৈরিতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে আসছেন তারা।
কিন্তু নিউজিল্যান্ডে মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা এটা আবার সামনে নিয়ে আসে যে সন্ত্রাসের কোনো ধর্ম নেই, জাত নেই। নিউজিল্যান্ড, এ দেশটির জনগণ ও প্রধানমন্ত্রী তামাম দুনিয়ার সামনে নজির হাজির করেন- কেবলমাত্র ভালোবাসা দিয়েই পরাজিত করা সম্ভব ঘৃণাকে। তারা একযোগে মুসলমানদের পাশে এসে দাঁড়ান। তাদের অভয় দেন। সংহতি প্রকাশ করেন। হিজাব পরে আরডেন এবং তার দেশের নারীরা বার্তা দেন মুসলিম নারীদের। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’- সেই চিরায়ত উচ্চারণ দীপ্তকণ্ঠে ফিরে আসে আরডেনের মুখে।
মুহূর্তেই সারা দুনিয়ার মানুষের মন জয় করে নেন তিনি। আক্রান্ত নূর মসজিদের ইমাম যখন বলেন, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে এই ঘটনার নিন্দা করেছেন, শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তা গোটা বিশ্বে একটি দৃষ্টান্ত। এটা শুধু নূর মসজিদের ইমামের কথাই নয়, এটা যেন এখন সারা পৃথিবীরই কথা। মুক্ত দুনিয়ার মানুষ, রাজনীতিবিদরা আকুণ্ঠ প্রশংসায় মেতেছেন আরডেনের। বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমও যোগ দিয়েছে এ দৌড়ে। নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, গার্ডিয়ান থেকে সারা পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যমে এক প্রশংসিত নাম আরডেন। সবারই প্রশ্ন এমনও হয় নাকি। আরডেনের প্রশংসা করে নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, আতঙ্ক কীভাবে সামাল দিতে হয় তা আরডেনের কাছ থেকে শেখা উচিত বিশ্বের। অন্যদিকে, গার্ডিয়ানে লেখা হয়েছে সত্যিকারের নেতা।
আরডেনকে নোবেল দেয়ার পিটিশন:
এই পরিস্থিতিতে জাসিনদা আরডেনকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেয়ার দাবি উঠেছে। এরই মধ্যে দুটি পিটিশন করা হয়েছে। একটি পিটিশন করা হয়েছে চেঞ্জ ডট অর্গ (ঈযধহমব.ড়ৎম)-এ। আরেকটি করা হয়েছে ফরাসি ওয়েবসাইট আভাজ ডট অর্গ (অঠঅঅত.ড়ৎম)-এ। অনলাইনে এ দুটি পিটিশনে এরই মধ্যে স্বাক্ষর করেছেন কয়েক হাজার মানুষ। এ খবর দিয়েছে অনলাইন নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড। ফরাসি সাইটে লেখা হয়েছে, ক্রাইস্টচার্চে বিয়োগান্তক ঘটনার পর উপযুক্ত, উন্মুক্ত ও শান্তিপূর্ণভাবে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিনদা আরডেন, আমরা আশা করি আগামীতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার তার হাতে তুলে দেয়া হবে। ধারণা করা হচ্ছে, ফরাসি সাইটে এই আবেদনটির উদ্যোক্তা ফরাসি কবি ড. খাল তোরাবুলি।
নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড লিখেছে, গত সপ্তাহের ওই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর দেশকে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তার জন্য সারা বিশ্ব তার প্রশংসা করেছে। তার এ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দুবাইয়ের বুর্জ খলিফায় তাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাতে একজন মুসলিম নারীকে তিনি আলিঙ্গন করছেন- এমন একটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। মুসলিমদের প্রতি তিনি যে আন্তরিক সহানুভূতি ও সমর্থন দেখিয়েছেন তার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ। বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের ১৫০ কোটি মুসলিমের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন জাসিনদা।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে আমিরাতের ‘সালাম’: বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন বুর্জ খলিফায় ফুটিয়ে তোলা হলো আরডেনকে। এতে দেখানো হয়েছে, তিনি ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত মুসলিমদের পরিবারের সদস্যদের জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। হামলার পর মুসলিমদের প্রতি তিনি যে সমর্থন, সম্মান দেখিয়েছেন তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে শুক্রবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অবস্থিত বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন বুর্জ খলিফায় তাকে এভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। সিডনি মর্নিং হেরাল্ডকে উদ্ধৃত করে এ খবর দিয়েছে অনলাইন দ্য স্ট্রেইটস টাইমস।
প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, ৮২৯ মিটার উঁচু বুর্জ খলিফার চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এই টাওয়ার। এর উপরেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আরডেনকে। তিনি মাথায় স্কার্ফ পরা। মসজিদে হামলায় নিহতদের এক নারী স্বজনকে জড়িয়ে ধরে আছেন তিনি। তার মাথার একটু উপরে আরবিতে লেখা ‘সালাম’ যার অর্থ শান্তি। বুর্জ খলিফার এমন ছবি টুইট করেছেন সংযুুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ।
শেখ মোহাম্মদ শুক্রবার টুইটে লিখেছেন, মসজিদে হামলায় শহীদদের সম্মানে নিউজিল্যান্ড নীরব আজ (শুক্রবার)। সন্ত্রাসী হামলার পর বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের মধ্যে এক হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। তারপর নিউজিল্যান্ড ও এ দেশের প্রধানমন্ত্রী জাসিনদা আরডেন যে আন্তরিক সহানুভূতি ও সমর্থন দিয়েছেন তাতে ১৫০ কোটি মুসলিমের শ্রদ্ধা পেয়েছেন তিনি।
কে এই আরডেন
নিউজিল্যান্ডের একদম প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসেছেন জাসিনদা আরডেন। ১৯৮০ সালের ২৬শে জুলাই নিউজিল্যান্ডের হ্যামিল্টনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। মা একটি স্কুলের খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে ছিলেন। জাসিনদা মরিন্সভিল্লে কলেজে পড়াশোনা করেছেন। ২০০১ সালে তিনি ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্কের অফিসে গবেষণা কাজে নিয়োজিত হন। এ ছাড়া তিনি বৃটেনে প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। রাজনীতির সঙ্গে এভাবেই যুক্ত হন তিনি। তবে তার ফুপি ম্যারি আরডেন লেবার পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় কিশোরী বয়সেই রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেন তিনি।
২০০৮ সালে সমাজতান্ত্রিক তরুণদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জাসিনদা আরডেন। সে বছরই তিনি প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডের বাম ঘরানার দল লেবার পার্টির একজন এমপি নির্বাচিত হন। এর ঠিক দশ বছরের মধ্যেই তিনি নিজেকে লেবার পার্টির সব থেকে যোগ্য নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। ২০১৭ সালের ১লা মার্চ তিনি লেবার পার্টির ডেপুটি প্রধান নির্বাচিত হন। ওই বছরের ১লা আগস্ট তিনি লেবার পার্টির প্রধান নেতা নির্বাচিত হন। সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে তিনি জোট গঠনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হন। জাসিন্দা আরডেন পার্টির প্রধান হওয়ার আগে আন্ড্রু লিটল ছিলেন এ পদে। তার সময়ে লেবার পার্টির জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধস নামে। ফলে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। দলের কঠিন সময়ে এর হাল ধরে তাকে পুনরায় জনপ্রিয় করে তোলেন জাসিনদা আরডেন।
রাজনৈতিক নানা সমীকরণ মিলিয়ে ২০১৭ সালের ২৬শে অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন তিনি। ক্ষমতায় বসেই তিনি ঘোষণা দেন, তার সরকার হবে শক্তিশালী ও সংবেদনশীল। ক্ষমতায় বসার কিছুদিন পরেই গর্ভবতী হন জাসিনদা। তবে এ জন্য তিনি দায়িত্বে গাফিলতি করেন নি। গর্ভবতী অবস্থায়ই তিনি ইউরোপ সফর করেছেন, রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্বও পালন করেছেন সফলভাবে। শেষদিকে মাত্র ৬ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছেন আরডেন। ২০১৮ সালে ‘ফোর্বসের পাওয়ার উইমেনের’ তালিকায় জায়গা করে নেন তিনি। আছেন টাইম ম্যাগাজিনে সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকাতেও। জলবায়ু পরিবর্তন, শিশু দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে কাজ করছেন তিনি। নিজ দেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একট সহানুভূতিশীল সরকার।
No comments