মোবাইল টয়লেটের দরজায় তালা
হাফিজ
মুহাম্মদ: মিরপুর ১৪ নম্বর বাস স্ট্যান্ড। ফুটপাথের উপরে ঠাই দাঁড়িয়ে
দু’টি মোবাইল টয়লেট। দু’টি টয়লেটের দরজায়ই তালা। শেষ কবে এ টয়লেট ব্যবহার
হয়েছে আশপাশের কেউ মনে করতে পারছেন না। এ টয়লেটের তত্ত্বাবাধয়নে যার থাকার
কথা তাকেও আশেপাশে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিছুটা দূরে একটি চায়ের দোকান।
দোকানের সামনে মানুষের আনাগোনা থাকে সবসময়। আকবর নামের চায়ের দেকানি জানান,
দীর্ঘদিন থেকে টয়লেটে তালা। চা হাতে এক রিকশাচালক বলেন, বহু আগে টয়লেট
দু’টি ভালই ব্যবহার হতো। এখন রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টায়ই থাকে তালাবদ্ধ।
প্রথমদিকে আমরা যেতাম। ভালোই সাড়া ছিলো।
কিন্তু এখন আর ব্যবহার করছি না। তিনি বলেন, এগুলো ব্যবহারকারী মূলত বাস এবং রিকশা শ্রমিকরা। আমাদের কাছে প্রস্রাব ৫ টাকা এবং টয়লেট ১০ টাকা বেশি হয়ে যায়। এরপর টয়লেটের ভিতরের পরিবেশ নোংরা। অনেক সময় পানি থাকে না। সাবান টিস্যু তো দূরে থাক। অথচ এগুলো থাকার কথা ছিলো। তাই এসব মোবাইল টয়লেট ব্যবহারে আমরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। মিরপুর ১৪ নম্বরের এ দু’টি মোবাইল টয়লেট নয়। রাজধানীর অন্য যেসব পয়েন্টে মোবাইল টয়লেট রয়েছে। সেগুলোর অবস্থাও যেনতেন। অনেক টয়লেট ব্যবহারের অনুপযোগী। আর যেগুলো ভালো সেগুলোর দরজায় তালা দেয়া পান ব্যবহারে ইচ্ছুককারীরা। অনেক গুলোর তত্ত্ববাধয়কদের কখনো দেখাই মিলে না।
গতকাল সরজমিন দেখা যায়, রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বর বাস স্ট্যান্ডে দু’টি, মিরপুর আনসার ক্যাম্পে দু’টি, টেকনিক্যাল মোড়ে দু’টি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে একটি, মতিঝিল বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন তিনটি, নটর ডেম কলেজের বিপরীত পাশে দু’টি, প্রেস ক্লাবের পান্থকুঞ্জে দু’টি, বনানী পুলিশ ফাঁড়ির সামনে একটি, নতুন বাজার দু’টি, কমলাপুরে দু’টিসহ রাজধানীর অন্যান্য ১৯টি স্পটে মোট ৩৪টি মোবাইল টয়লেট রয়েছে। এরমধ্যে মিরপুর টেকনিক্যাল মোড়ে ডায়বেটিকস সমিতির সামনের ফুটপাথে যে দু’টি মোবাইল টয়লেট রয়েছে তার একটিতে প্রায় সময় তালাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। আর অন্যটি খোলা থাকে। এ টয়লেট দু’টির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে। তিনি একসময় ভিক্ষা করতেন, এখন এ দুটি পরিচালনা করে নিজের এবং সংসার বহন করেন।
ভ্রাম্যমাণ এ মোবাইল টয়লেটের প্রাথমিকভাবে যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে। আর পূর্ণাঙ্গভাবে ২০১২ সালে ঢাকার বিভিন্ন স্পটে এ টয়লেটগুলো বাসানো হয়। বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইডের আর্থিক সহায়তায় এসোসিয়েশন ফর রিয়েলাইজেশন অব বেসিক নিডস (আরবান)-এর উদ্যোগে সাড়ে চার বছর মেয়াদি এ প্রকল্পটি তখন চালু হয়। তখন প্রকল্পের আওতায় ৪৬টি মোবাইল টয়লেট তৈরি করা হয়। যারমধ্যে নগরীর বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয় ৩৬টি। বাকি ১০টি বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশে ব্যবহার করা হয়। যদিও বর্তামেন ৩৪টি বিভিন্ন স্পটে সচল রয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৭ সালের ৩০শে জুন। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও আরবান এগুলো সচল রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু অপারেটরদের কারণেই এগুলো বন্ধ থাকছে বলে মনে করছে ব্যবহারকারীরা।
আনসার ক্যাম্পে দু’টি মোবাইল টয়লেট রয়েছে। এ দু’টি ওপেন । লোকজনও আসছে বব্যহার করতে। তবে অনেকে সাবান টিস্যু না থাকার অভিযোগ তুলছেন। তবে এ টয়লেট দু’টির অপারেটর বলেন, ভিতরে সাবান টিস্যু দিলে দুই তিনজন ব্যবহারের পরেই আর পাওয়া যায় না। এ কারণে আমার রুমে এগুলো রেখে দিয়েছি যার দরকার হয় সে নিয়ে যায়।
টেকনিক্যাল ভ্রাম্যমাণ এ টয়লেটের পাশেই কথা হয় ব্যবসায়ী বাবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এসব টয়লেট পথচারী ও সাধারণ মানুষের কাছে খুব উপকারী হতে পারতো। এমনকি রাজধানীতে পাবলিক টয়লেটের যে অভাব রয়েছে সেটাও অনেকটা পূরণ হতো। কিন্তু কয়েকটিতে নোংরা পরিবেশ এবং দুর্গন্ধ হওয়ায় মানুষ টাকা দিয়ে এগুলোয় যেতে চায় না।
আনসার ক্যাম্পের এ মোবাইল টয়লেট দু’টি একজন উদ্যোক্তা নিয়ে অপারেটর দিয়ে চালাচ্ছেন। প্রতিদিন কতজন মানুষ এ টয়লেট দু’টি ব্যবহার করে তা জানতে চাইলে টয়লেটের অপারেটরের দায়িত্ব থাকা মো. রিয়াদ বলেন, যেদিন লোক কম আসে সেদিনও কমপক্ষে ৬০০ টাকা আয় হয়। আর কোনোদিন ১০০০/১২০০ টাকা আসে। এখান থেকে পানি, সাবান, টিস্যু অন্যান্য খরচ বাদে বাকি যে টাকা থাকে তা লাভ থাকে। আর মাসে ‘আরবান’কে কিস্তি হিসেবে ৭০০ টাকা করে পরিশোধ করতে হয়। রিয়াদ আরও জানান, হাসান নামে তার এক বড় ভাই রয়েছে এ টয়লেট দু’টির তত্ত্বাবধানে। যে আবার মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রিয়াদ প্রতিদিন ৩০০ টাকা বেতনের বিনিময়ে কাজ করেন। তার থাকার জন্য হাসান ফুটপাথে একটি ঘর তুলে দিয়েছেন। অন্যদিকে হাসান বলেন, আরবান থেকে এ মোবাইল টয়লেট দু’টি ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে নিয়েছি। প্রতি মাসে ৭০০ টাকা হারে তাদের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। প্রতিদিনের খরচ ছাড়া যে টাকা থাকে সেটা আমি পাই। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে যত্রতত্র স্থানে মল-মূত্র ত্যাগ করা থেকে টয়লেট ব্যবহারে অভ্যস্ত করা। এজন্য আমরা অনেক সময় কম টাকা নিয়ে থাকি।
আরবানের মোবাইল টয়লেট প্রকল্প বিভাগের কো-অর্ডিনেটর মো. শহীদুল্লাহ মজুমদার বলেন, ওয়াটার এইডের সহযোগিতায় আরবান নগরীর নিম্ন শ্রেণির মানুষদের এ টয়লেট ব্যবহারে অভ্যস্ত করার জন্য এ প্রকল্পটি চালু করেছিলো। আবার পাবলিক টয়লেটের বিকল্প হিসেবেও এ টয়লেটগুলো কাজ করছে। এ মোবাইল টয়লেটগুলো একেকজন তত্ত্ববাধায়কের কাছে ১০ হাজার ৮০০ টাকা চুক্তির মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়েছে। এটা একেবারে নয় প্রতিদিন ১০ টাকা হারে মাসে ৩০০ টাকা আরবানকে দিবে। আর পরিশোধ করার জন্য সময় দেয়া হয়েছিলো তিনবছর। তবে এ টয়লেটগুলা বানাতে আরবানের খরচ পড়েছে এক লাখ চল্লিশ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা।
তিনি আরও জানান, অন্যদিকে দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ প্রস্রাব ৩ টাকা এবং পায়খানা ৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। আর উত্তর সিটি করপোরেশন দিয়েছে প্রস্রাব ৫ টাকা এবং পায়খানার জন্য ১০ টাকা। কিন্তু এগুলোর ব্যবহারকারী শ্রমিক শ্রেণির মানুষ হওয়ায় এত টাকা দিতে চায় না।
এ মোবাইল টয়লেটগুলো তত্ত্বাবধায়নে কাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে শহীদুল্লাহ বলেন, এগুলো স্থাপন করতে আমাদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। যেসব জায়গায় এগুলো বসানো হয়েছে সেখানের লোকজনের বিভিন্ন অভিযোগ, পুলিশ এবং স্থানীয় লোকজনের চাঁদার দাবিসহ সমস্যার কারণে সবগুলা সরাসরি অপারেটরকে দেয়া যায়নি। কারণ এগুলো প্রথমে প্রতিবন্ধী ও ভিক্ষুকদের দেয়া হয়েছিলো। পরে স্থানীয়রা অনেকগুলা বন্ধ করে দেয়। পরে কয়েকজন উদ্যোক্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা অপারেটর দিয়ে এগুলো পরিচালনা করেন। যাতে সমস্যায় পড়তে না হয়। ভবিষ্যতে আরো টয়লেট দেয়া হলে এমন উদ্যোক্তদেরকেই দেবেন বলেও তিনি জানান।
এসব টয়লেট থেকে আরবান প্রতিদিন ১০ টাকা হারে মাসে যে ৩০০ টাকা নেন তা ইতিমধ্যে পরিশোধ হওয়ার কথা। কেননা ইতিমধ্যে এ প্রকল্পের ৬ বছর হয়ে গেছে। অন্যদিকে আবার আরবান বলছে তারা যে ১০ হাজার ৮০০ টাকা চুক্তিতে এ টয়লেটগুলো দিয়েছেন সে টাকাই এ কিস্তির মাধ্যমে দেয়ার কথা। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক বলছে তিনি প্রথমে ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে এগুলো এনেছেন। আর প্রতিমাসে আরবানকেও নাকি ৭০০ টাকা দেন। দুইজনের দুইরকমের তথ্যের কারণ সম্পর্কে নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক এক অপারেটর বলেন, আমাদের কাছ থেকে আরবানের যে লোক টাকা উঠান ওনাকেই বেশি টাকাটা দিতে হয়। তিনি এ টাকা আরবান অফিসে দেয় কিনা আমি জানি না।
এদিকে মোবাইল টয়লেটগুলো দুই সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপনে জন্য আরবান থেকে শুধু অনুমিত নিয়েই পরিচালনা করছে বলে জানান ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জনাব ড. তারিক বিন ইউসুফ।
তবে ২০১১ সালে পরিচালিত ‘নগর গবেষণা কেন্দ্র’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫৫ লাখ মানুষের পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের চাহিদা রয়েছে। অথচ দুই সিটি কর্পোরেশনের রয়েছে মাত্র ৬৯টি পাবলিক টয়লেট। তার মধ্যে আবার মাত্র ৪৭টি টয়লেট ব্যবহারের উপযোগী বলে ওই গবেষণায় বলা হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগই নারী, প্রতিবন্ধীদের ব্যবহারের উপযোগী নয়। এছাড়া নগরীতে প্রতিদিন চলাচলকারী সাধারণের ব্যবহার উপযোগী পাবলিক টয়লেটর সংখ্যাও অনেক কম। তবে সম্প্রতি রাজধানীত দুই সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসার সহতায় অত্যাধুনিক একাধিক পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করেছে ওয়াটার এইড। এগুলো একদিকে নারীবান্ধব আবার সকল ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
এগুলোর সঙ্গে একটি করে নামায ঘরের ব্যবস্থাও রয়েছে। বর্তমানে ৫০ টির অধিক এ টয়লেটগুলো উভয় সিটি করপোরেশনে ১০০ টি করে নির্মাণের কথা রয়েছে। পাবলিক টয়লেটের শূন্যতা থেকেই রাজধানীতে মোবাইল টয়লেট নামিয়েছিল ওয়াটার এইড ও আরবান। নগরীতে চলাচলকারী মানুষের মাঝে যাতে করে একটু স্বস্তি ফিরে আসে। মানুষের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমে যায়। প্রথমে সাড়াও মিলছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে অধিকাংশ মোবাইল টয়লেটের অবস্থান এবং পরিবেশ ভালো না হওয়ায় মানুষকে দিচ্ছে কষ্ট। মান এবং পরিবেশ ধরে রাখতে পারেনি তত্ত্বাবধায়নকারীরা। পানির অভাব, কখনো দুর্গন্ধ কিংবা দেখা যায় তালা বন্ধ অবস্থায়। রাজধানীতে প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ তাদের জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হন। কিন্তু প্রয়োজনে যখন মোবাইল টয়লেটগুলো ব্যবহার করতে যান তখনই পড়েন বিপাকে। অথচ টয়লেটগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ এবং সঠিক স্থানে বসালে এমন দুরবস্থা সৃষ্টি হতো না।
কিন্তু এখন আর ব্যবহার করছি না। তিনি বলেন, এগুলো ব্যবহারকারী মূলত বাস এবং রিকশা শ্রমিকরা। আমাদের কাছে প্রস্রাব ৫ টাকা এবং টয়লেট ১০ টাকা বেশি হয়ে যায়। এরপর টয়লেটের ভিতরের পরিবেশ নোংরা। অনেক সময় পানি থাকে না। সাবান টিস্যু তো দূরে থাক। অথচ এগুলো থাকার কথা ছিলো। তাই এসব মোবাইল টয়লেট ব্যবহারে আমরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। মিরপুর ১৪ নম্বরের এ দু’টি মোবাইল টয়লেট নয়। রাজধানীর অন্য যেসব পয়েন্টে মোবাইল টয়লেট রয়েছে। সেগুলোর অবস্থাও যেনতেন। অনেক টয়লেট ব্যবহারের অনুপযোগী। আর যেগুলো ভালো সেগুলোর দরজায় তালা দেয়া পান ব্যবহারে ইচ্ছুককারীরা। অনেক গুলোর তত্ত্ববাধয়কদের কখনো দেখাই মিলে না।
গতকাল সরজমিন দেখা যায়, রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বর বাস স্ট্যান্ডে দু’টি, মিরপুর আনসার ক্যাম্পে দু’টি, টেকনিক্যাল মোড়ে দু’টি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে একটি, মতিঝিল বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন তিনটি, নটর ডেম কলেজের বিপরীত পাশে দু’টি, প্রেস ক্লাবের পান্থকুঞ্জে দু’টি, বনানী পুলিশ ফাঁড়ির সামনে একটি, নতুন বাজার দু’টি, কমলাপুরে দু’টিসহ রাজধানীর অন্যান্য ১৯টি স্পটে মোট ৩৪টি মোবাইল টয়লেট রয়েছে। এরমধ্যে মিরপুর টেকনিক্যাল মোড়ে ডায়বেটিকস সমিতির সামনের ফুটপাথে যে দু’টি মোবাইল টয়লেট রয়েছে তার একটিতে প্রায় সময় তালাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। আর অন্যটি খোলা থাকে। এ টয়লেট দু’টির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে। তিনি একসময় ভিক্ষা করতেন, এখন এ দুটি পরিচালনা করে নিজের এবং সংসার বহন করেন।
ভ্রাম্যমাণ এ মোবাইল টয়লেটের প্রাথমিকভাবে যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে। আর পূর্ণাঙ্গভাবে ২০১২ সালে ঢাকার বিভিন্ন স্পটে এ টয়লেটগুলো বাসানো হয়। বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইডের আর্থিক সহায়তায় এসোসিয়েশন ফর রিয়েলাইজেশন অব বেসিক নিডস (আরবান)-এর উদ্যোগে সাড়ে চার বছর মেয়াদি এ প্রকল্পটি তখন চালু হয়। তখন প্রকল্পের আওতায় ৪৬টি মোবাইল টয়লেট তৈরি করা হয়। যারমধ্যে নগরীর বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয় ৩৬টি। বাকি ১০টি বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশে ব্যবহার করা হয়। যদিও বর্তামেন ৩৪টি বিভিন্ন স্পটে সচল রয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৭ সালের ৩০শে জুন। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও আরবান এগুলো সচল রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু অপারেটরদের কারণেই এগুলো বন্ধ থাকছে বলে মনে করছে ব্যবহারকারীরা।
আনসার ক্যাম্পে দু’টি মোবাইল টয়লেট রয়েছে। এ দু’টি ওপেন । লোকজনও আসছে বব্যহার করতে। তবে অনেকে সাবান টিস্যু না থাকার অভিযোগ তুলছেন। তবে এ টয়লেট দু’টির অপারেটর বলেন, ভিতরে সাবান টিস্যু দিলে দুই তিনজন ব্যবহারের পরেই আর পাওয়া যায় না। এ কারণে আমার রুমে এগুলো রেখে দিয়েছি যার দরকার হয় সে নিয়ে যায়।
টেকনিক্যাল ভ্রাম্যমাণ এ টয়লেটের পাশেই কথা হয় ব্যবসায়ী বাবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এসব টয়লেট পথচারী ও সাধারণ মানুষের কাছে খুব উপকারী হতে পারতো। এমনকি রাজধানীতে পাবলিক টয়লেটের যে অভাব রয়েছে সেটাও অনেকটা পূরণ হতো। কিন্তু কয়েকটিতে নোংরা পরিবেশ এবং দুর্গন্ধ হওয়ায় মানুষ টাকা দিয়ে এগুলোয় যেতে চায় না।
আনসার ক্যাম্পের এ মোবাইল টয়লেট দু’টি একজন উদ্যোক্তা নিয়ে অপারেটর দিয়ে চালাচ্ছেন। প্রতিদিন কতজন মানুষ এ টয়লেট দু’টি ব্যবহার করে তা জানতে চাইলে টয়লেটের অপারেটরের দায়িত্ব থাকা মো. রিয়াদ বলেন, যেদিন লোক কম আসে সেদিনও কমপক্ষে ৬০০ টাকা আয় হয়। আর কোনোদিন ১০০০/১২০০ টাকা আসে। এখান থেকে পানি, সাবান, টিস্যু অন্যান্য খরচ বাদে বাকি যে টাকা থাকে তা লাভ থাকে। আর মাসে ‘আরবান’কে কিস্তি হিসেবে ৭০০ টাকা করে পরিশোধ করতে হয়। রিয়াদ আরও জানান, হাসান নামে তার এক বড় ভাই রয়েছে এ টয়লেট দু’টির তত্ত্বাবধানে। যে আবার মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রিয়াদ প্রতিদিন ৩০০ টাকা বেতনের বিনিময়ে কাজ করেন। তার থাকার জন্য হাসান ফুটপাথে একটি ঘর তুলে দিয়েছেন। অন্যদিকে হাসান বলেন, আরবান থেকে এ মোবাইল টয়লেট দু’টি ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে নিয়েছি। প্রতি মাসে ৭০০ টাকা হারে তাদের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। প্রতিদিনের খরচ ছাড়া যে টাকা থাকে সেটা আমি পাই। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে যত্রতত্র স্থানে মল-মূত্র ত্যাগ করা থেকে টয়লেট ব্যবহারে অভ্যস্ত করা। এজন্য আমরা অনেক সময় কম টাকা নিয়ে থাকি।
আরবানের মোবাইল টয়লেট প্রকল্প বিভাগের কো-অর্ডিনেটর মো. শহীদুল্লাহ মজুমদার বলেন, ওয়াটার এইডের সহযোগিতায় আরবান নগরীর নিম্ন শ্রেণির মানুষদের এ টয়লেট ব্যবহারে অভ্যস্ত করার জন্য এ প্রকল্পটি চালু করেছিলো। আবার পাবলিক টয়লেটের বিকল্প হিসেবেও এ টয়লেটগুলো কাজ করছে। এ মোবাইল টয়লেটগুলো একেকজন তত্ত্ববাধায়কের কাছে ১০ হাজার ৮০০ টাকা চুক্তির মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়েছে। এটা একেবারে নয় প্রতিদিন ১০ টাকা হারে মাসে ৩০০ টাকা আরবানকে দিবে। আর পরিশোধ করার জন্য সময় দেয়া হয়েছিলো তিনবছর। তবে এ টয়লেটগুলা বানাতে আরবানের খরচ পড়েছে এক লাখ চল্লিশ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা।
তিনি আরও জানান, অন্যদিকে দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ প্রস্রাব ৩ টাকা এবং পায়খানা ৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। আর উত্তর সিটি করপোরেশন দিয়েছে প্রস্রাব ৫ টাকা এবং পায়খানার জন্য ১০ টাকা। কিন্তু এগুলোর ব্যবহারকারী শ্রমিক শ্রেণির মানুষ হওয়ায় এত টাকা দিতে চায় না।
এ মোবাইল টয়লেটগুলো তত্ত্বাবধায়নে কাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে শহীদুল্লাহ বলেন, এগুলো স্থাপন করতে আমাদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। যেসব জায়গায় এগুলো বসানো হয়েছে সেখানের লোকজনের বিভিন্ন অভিযোগ, পুলিশ এবং স্থানীয় লোকজনের চাঁদার দাবিসহ সমস্যার কারণে সবগুলা সরাসরি অপারেটরকে দেয়া যায়নি। কারণ এগুলো প্রথমে প্রতিবন্ধী ও ভিক্ষুকদের দেয়া হয়েছিলো। পরে স্থানীয়রা অনেকগুলা বন্ধ করে দেয়। পরে কয়েকজন উদ্যোক্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা অপারেটর দিয়ে এগুলো পরিচালনা করেন। যাতে সমস্যায় পড়তে না হয়। ভবিষ্যতে আরো টয়লেট দেয়া হলে এমন উদ্যোক্তদেরকেই দেবেন বলেও তিনি জানান।
এসব টয়লেট থেকে আরবান প্রতিদিন ১০ টাকা হারে মাসে যে ৩০০ টাকা নেন তা ইতিমধ্যে পরিশোধ হওয়ার কথা। কেননা ইতিমধ্যে এ প্রকল্পের ৬ বছর হয়ে গেছে। অন্যদিকে আবার আরবান বলছে তারা যে ১০ হাজার ৮০০ টাকা চুক্তিতে এ টয়লেটগুলো দিয়েছেন সে টাকাই এ কিস্তির মাধ্যমে দেয়ার কথা। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক বলছে তিনি প্রথমে ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে এগুলো এনেছেন। আর প্রতিমাসে আরবানকেও নাকি ৭০০ টাকা দেন। দুইজনের দুইরকমের তথ্যের কারণ সম্পর্কে নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক এক অপারেটর বলেন, আমাদের কাছ থেকে আরবানের যে লোক টাকা উঠান ওনাকেই বেশি টাকাটা দিতে হয়। তিনি এ টাকা আরবান অফিসে দেয় কিনা আমি জানি না।
এদিকে মোবাইল টয়লেটগুলো দুই সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপনে জন্য আরবান থেকে শুধু অনুমিত নিয়েই পরিচালনা করছে বলে জানান ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জনাব ড. তারিক বিন ইউসুফ।
তবে ২০১১ সালে পরিচালিত ‘নগর গবেষণা কেন্দ্র’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫৫ লাখ মানুষের পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের চাহিদা রয়েছে। অথচ দুই সিটি কর্পোরেশনের রয়েছে মাত্র ৬৯টি পাবলিক টয়লেট। তার মধ্যে আবার মাত্র ৪৭টি টয়লেট ব্যবহারের উপযোগী বলে ওই গবেষণায় বলা হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগই নারী, প্রতিবন্ধীদের ব্যবহারের উপযোগী নয়। এছাড়া নগরীতে প্রতিদিন চলাচলকারী সাধারণের ব্যবহার উপযোগী পাবলিক টয়লেটর সংখ্যাও অনেক কম। তবে সম্প্রতি রাজধানীত দুই সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসার সহতায় অত্যাধুনিক একাধিক পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করেছে ওয়াটার এইড। এগুলো একদিকে নারীবান্ধব আবার সকল ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
এগুলোর সঙ্গে একটি করে নামায ঘরের ব্যবস্থাও রয়েছে। বর্তমানে ৫০ টির অধিক এ টয়লেটগুলো উভয় সিটি করপোরেশনে ১০০ টি করে নির্মাণের কথা রয়েছে। পাবলিক টয়লেটের শূন্যতা থেকেই রাজধানীতে মোবাইল টয়লেট নামিয়েছিল ওয়াটার এইড ও আরবান। নগরীতে চলাচলকারী মানুষের মাঝে যাতে করে একটু স্বস্তি ফিরে আসে। মানুষের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমে যায়। প্রথমে সাড়াও মিলছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে অধিকাংশ মোবাইল টয়লেটের অবস্থান এবং পরিবেশ ভালো না হওয়ায় মানুষকে দিচ্ছে কষ্ট। মান এবং পরিবেশ ধরে রাখতে পারেনি তত্ত্বাবধায়নকারীরা। পানির অভাব, কখনো দুর্গন্ধ কিংবা দেখা যায় তালা বন্ধ অবস্থায়। রাজধানীতে প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ তাদের জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হন। কিন্তু প্রয়োজনে যখন মোবাইল টয়লেটগুলো ব্যবহার করতে যান তখনই পড়েন বিপাকে। অথচ টয়লেটগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ এবং সঠিক স্থানে বসালে এমন দুরবস্থা সৃষ্টি হতো না।
No comments