বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের জীবন ও কর্ম by সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম
স্বাধীনতার ঘোষণা। শব্দগুলো হুবহু এ রকম নয়; কিন্তু আমি সহজ করে উপস্থাপন করার জন্য এ রকম করে সাজিয়েছি উদ্বৃতি চিহ্নের মধ্যে। ‘আমি মেজর জিয়া; আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি মেজর জিয়া; আমি আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আপনাদেরকে আশ্বস্ত করতে চাই, দখলদার বাহিনীর হাত থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ ইতোমধ্যই শুরু হয়ে গেছে। স্বাধীনতাকামী দেশবাসী এবং মানবতাবাদী বিশ্ববাসীর প্রতি আমার আহ্বান, আমাদের এই যুদ্ধে আপনারা আমাদের পাশে দাঁড়ান; এই যুদ্ধে আমাদের সহায়তা করুন; আমাদের সরকার এবং রাষ্ট্রকে আপনারা স্বীকৃতি দিন।’ ২৭ মার্চ ১৯৭১, চট্টগ্রাম মহানগরের উপকণ্ঠের তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে, তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান এরূপ কথাগুলোই নিজের কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন। তার আগের দিন, ঘড়ির কাঁটা ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর আগমন ঘোষণা করেছিল, তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান পিএসসি, ব্যাটালিয়নের সৈনিকদের সামনে একটি শূন্য ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন অনেকটা এ রকম, ‘আমরা বিদ্রোহ করলাম; আমরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করলাম।’ ব্যাটালিয়নের সবাই উচ্চস্বরে সম্মতি দিয়েছিল।
বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম মহান ব্যক্তিত্ব শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মদিনে, সম্মানিত পাঠকের বরাবর আমার বিনীত নিবেদন এই কলাম। ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ায় তার জন্ম। তার বাবা মনসুর রহমান ছিলেন সরকারি দফতরে চাকরিরত একজন রসায়নবিদ। মায়ের নাম ছিল জাহানারা খাতুন (প্রকাশ রানী)। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়া ছিলেন দ্বিতীয়। তার শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতা শহরে কাটে। ভারত বিভাজনের পর তিনি প্রথমে পরিবারের সাথে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন অতঃপর তার বাবার সাথে করাচি চলে যান। সেখান থেকে তিনি পরবর্তী ধাপের লেখাপড়া শেষ করেন এবং ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি কাকুল-এ যোগ দেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে যেমন অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তারিখের মধ্যে, ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফা উপস্থাপনের দিনটি অথবা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের দিনটি, অধিকতর স্মরণীয় এবং অধিকতর উজ্জ্বল; তেমনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জীবনের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তারিখের মধ্যে ২৬ ও ২৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার দিনটি অথবা ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের দিনটি অধিকতর স্মরণীয় এবং অধিকতর উজ্জ্বল। জিয়াউর রহমান যেহেতু সেনাবাহিনীতে ছিলেন, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই শুরু। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি কাকুল থেকে কমিশন পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। তার সাথে আরো বাঙালি তরুণ ছিলেন, যারা একই দিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পেয়েছিলেন; এদের একজনকে অনেকেই সহজে চিনবেন যথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম সেনাবাহিনী প্রধান বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম। কমিশনের পরদিন থেকে জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একজন অফিসার হিসেবে চাকরি করেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় তিনি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন এবং বীরত্বের সাথে বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরের কাছে ভারতীয় সীমান্তে প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের পরে ১৯৭১-এর আগে, জিয়াউর রহমান চারটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বর্তমান পাকিস্তানের কোয়েটার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্টাফ কলেজে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করে পিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। দ্বিতীয়ত, তিনি পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি কাকুলে একজন প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তৃতীয়ত, সেনাবাহিনীর মনোনীত হয়ে তিনি ছয় মাসের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে জার্মানি যান। চতুর্থত, তিনি ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে (গাজীপুর) দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং চট্টগ্রাম মহানগরীর ষোলোশহরে নবপ্রতিষ্ঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৫-এর পরে ১৯৭১-এর আগে সময়টা ছিল উত্তাল। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবিনামা উপস্থাপন করেন। ১৯৬৮-এর শেষাংশ থেকে পুরো ১৯৬৯ ছিল গণ-আন্দোলনের বছর। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর ছিল তৎকালীন পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ নির্বাচন; যেই নির্বাচনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ ভূমিধস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। নির্বাচনের ফলাফলের তাৎপর্য ছিল এই যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছয় দফার ভিত্তিতে স্বাধিকার চান তথা পাকিস্তানের সংবিধানকে সংশোধন করে নতুন শাসনতান্ত্রিক কাঠামো চান। তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রায়কে উপেক্ষা করেন এবং মানতে অস্বীকার করেন। এই ষড়যন্ত্রমূলক আচরণের প্রথম আনুষ্ঠানিক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ১ মার্চ ১৯৭১ তারিখে, যেদিন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সরকার আসন্ন জাতীয় সংসদের অধিবেশনকে স্থগিত ঘোষণা করে। এরপর আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ।
ওপরের দু’টি অনুচ্ছেদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, তিনি ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠছিলেন। তিনি ক্রমেই জনগণের আকাক্সক্ষাকে নিজের হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন। নিজে সামরিক কর্মকর্তা হলেও শৃঙ্খলার কঠিন বেড়াজালে আবদ্ধ হলেও তিনি নিজেকে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য কী খেদমত করা যায় সে প্রসঙ্গে চিন্তাভাবনা শুরু করার সুযোগ ও পরিবেশ পেয়েছিলেন। আমার চাকরি জীবনে, ১৯৯৩ সালের মে থেকে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে ১০ মাইল উত্তরে ভাটিয়ারির বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে কমান্ড্যান্টের দায়িত্ব পালন করেছি। আমার দায়িত্ব মেয়াদের শেষ ছয় মাস আমি ব্যস্ত ছিলাম একটি অতিরিক্ত কাজে। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত ২৪ পদাতিক ডিভিশনের সদর দফতরের উল্টো দিকে একটি পুরনো একতলা দালানকে সংস্কার করে সেখানে স্থাপন করা হচ্ছিল এক মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পুরো চট্টগ্রাম জেলা ছিল ১ নম্বর সেক্টরের অধীন। সেই ১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে উদ্ভাসিত রাখার জন্য আমরা ওই মুক্তিযুদ্ধ-জাদুঘর স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মুক্তিযোদ্ধা লে. জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রম এবং তৎকালীন চট্টগ্রাম অঞ্চলের এরিয়া কমান্ডার ও ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান বীর উত্তমের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায়, আমার সার্বিক নেতৃত্বে ও পরিচালনায় ওই জাদুঘরটি স্থাপিত হয়। ওই জাদুঘরের নাম স্মৃতি অম্লান। সেই জাদুঘর স্থাপনের কাজ করতে গিয়ে আমরা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মেজর জিয়াউর রহমানের অনেক কিছু জানতে পারি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরু থেকেই মেজর জিয়া সন্ধ্যার পরে রাতের বেলা একটি টয়োটা কারে করে শহরের বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। উদ্দেশ্য পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীদের চোখ এড়িয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জনগণকে নিয়ে কী করা যায়, সে পরিকল্পনা করা। ওই টয়োটা কারের মালিক, ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসে, চট্টগ্রাম সেনানিবাসের কর্তৃপক্ষের কাছে, মিউজিয়ামে প্রদর্শনের নিমিত্তে, ওই কারটি অফেরতযোগ্য উপহারস্বরূপ দেন। সেনানিবাসের স্বাভাবিক বিধিনিষেধ মানা সাপেক্ষে, যে কেউ ইচ্ছা করলে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে প্রবেশের বায়েজিদ বোস্তামি গেট দিয়ে প্রবেশ করলেই, এক শ’ গজ মাত্র যাওয়ার পর ওই মিউজিয়ামের একতলা ভবনটি দেখতে পাবেন এবং তার সামনে কারটি দণ্ডায়মান দেখতে পাবেন।
১৯৭১-এর ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজারের বাসভবনে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অপারেশনাল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভাপতিত্ব ও নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন তৎকালীন কর্নেল এম এ জি ওসমানী। মেজর জিয়া সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭১-এর জুন-জুলাই মাসে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে প্রথম ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা করতে হলো, তখন লে. কর্নেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জেড ফোর্স গঠন করা হয়। জেড ফোর্স বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এবং উত্তর-পূর্ব এলাকায় যুদ্ধ করে। ঢাকা পতনের চার দিন আগেই জেড ফোর্স বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাংশ শত্রুমুক্ত করে। আরো অনেকের সাথে তিনি বীর উত্তম খেতাব পান। প্রথম তিন মাস তিনি জেড ফোর্স থেকে রূপান্তরিত হওয়া ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন, কুমিল্লা সেনানিবাসে। কুমিল্লা সেনানিবাসের তৎকালীন নাম ছিল ময়নামতি সেনানিবাস। এখনো সর্ব দক্ষিণের প্রবেশপথ দিয়ে সেনানিবাসে ঢুকতে গেলেই হাতের বাঁয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ দেখা যাবে, যেটি জিয়াউর রহমানের নির্দেশে তিন মাসের মধ্যেই স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৭২ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত হন। যদিও তিনি জিয়াউর রহমান থেকে কনিষ্ঠ ছিলেন, তথাপি সফিউল্লাহকেই তৎকালীন সরকার সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগ করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে বঙ্গবন্ধু হত্যা ঘটনার পর সমগ্র দেশে ও প্রশাসনে অনেক কিছু ওলট-পালট হয়। প্রায় তিন বছর চার মাস আট দিন চাকরির পর, তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে (বীর উত্তম) সরিয়ে তার জায়গায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে (বীর উত্তম) সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগ করা হয়। একই বছরের ৩ নভেম্বরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালী চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের নেতৃত্বে একটি কু অনুষ্ঠিত হয়। এই কু-এর নেতৃবৃন্দ ৩ নভেম্বর শুরু হওয়া মাত্রই জিয়াউর রহমানকে নিজ বাসভবনে বন্দী করেন। জিয়াউর রহমান কোনো প্রকার অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে চাননি; তিনি সেনাবাহিনী প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দেন; এই শূন্যস্থানে ৫ নভেম্বর তারিখে খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে যান। ইতোমধ্যে ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লব সাধিত হয়। স্বাধীনতাকামী, জাতীয়তাবাদী, মুক্তিযুদ্ধমুখী সাধারণ সৈনিকেরা তৎকালীন জাসদের ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করেই জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন এবং সেনাবাহিনী প্রধানের পদে তিনি আবার আসীন হন। ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুনরুজ্জীবনের দিন। বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর কাঠামো অস্তিত্ব এবং আনুগত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিন মাস আগে খন্দকার মোশতাকের জারি করা মার্শাল ল শাসন মোতাবেক, মোস্তাক ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ ছিলেন অন্যতম উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ৭ নভেম্বরের পর নতুন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম হলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং নতুন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম হলেন অন্যতম উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। কালক্রমে, দেশের প্রশাসন জিয়াউর রহমানের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। প্রথমে গণভোটের মাধ্যমে, পরে প্রকাশ্য নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে অতি প্রত্যুষে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে সরকারি সার্কিট হাউজে অবস্থানকালে একটি সেনাবিদ্রোহের ফলে জিয়াউর রহমান শহীদ হন। বীর উত্তম জিয়াউর রহমান, রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশে অনেকগুলো দূরদর্শী ও তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
এই সংক্ষিপ্ত কলামে অনেক কিছু লেখা যাবে না। তারপরও তারিখের ধারাবাহিতকা বজায় না রেখেই আমি এ রকম কিছু দূরদর্শী ও তাৎপর্যপূর্ণ কাজ বা কিছু সিদ্ধান্ত বা কিছু অর্জনের কথা বর্তমান প্রজন্মের উপকারার্থে তথা এই কলামের সম্মানিত পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করছি।
এক. ১৯৭২-এ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় রক্ষীবাহিনী জনগণের মানসপটে একটি ভীতিকর বাহিনী ছিল এবং তৎকালীন সেনাবাহিনীর মানসপটে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনী ছিল। সেনাবাহিনী প্রধান হওয়ার পরপরই জিয়াউর রহমানের তৎপরতায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, রক্ষীবাহিনীকে ভেঙে দেয়া হবে না বরং তাদেরকে দেশের সেবার জন্য নতুন সুযোগ দেয়া হবে। রক্ষীবাহিনীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে একীভূত বা আত্তীকরণ তথা ইন্টিগ্রেট করা হয়। পরিহাসের বিষয় যদিও এই মুহূর্তে (২০০৯ থেকে ২০১৬) জিয়াউর রহমানের একনিষ্ঠ সমালোচনাকারীদের মধ্যে, সাবেক রক্ষীবাহিনীর ও পরে সেনাবাহিনীর কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ অফিসার আছেন।
দুই. ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সাংগঠনিক পর্যায় ছিল ব্যাটালিয়ন, তার ওপরে ব্রিগেড এবং তার ওপরে সেনাবাহিনীর সদর দফতর। জিয়াউর রহমান ১৯৭৬-এর শুরুতেই নবম পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক স্তরকে এক ধাপ ওপরে নিয়ে যান।
তিন. জিয়াউর রহমান বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জন যেমন সেনাসদস্য ও জনগণের সম্মিলিত প্রয়াস ছিল, তেমনই দুর্যোগকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্বও যৌথভাবে সামরিক বাহিনী ও জনগণকে পালন করতে হবে। অতএব জনগণকে মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তার জন্য তিনি ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি বা ভিডিপি নামে একটি সংগঠন সৃষ্টি করেন এবং ১০ বছরের মধ্যে এক কোটি বাংলাদেশীকে ভিডিপিতে প্রশিক্ষণ দেবেন এই লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেন। ভিডিপি প্রশিক্ষণের মৌলিক অংশ ছিল একেবারেই প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ এবং দ্বিতীয় অংশ ছিল জীবিকা নির্বাহের উন্নতির জন্য একটি সেকেন্ডারি পেশা যথা হাঁস-মুরগি পালন যথা ক্ষেত-খামারকরণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ।
চার. জিয়াউর রহমান পর্যায়ক্রমে সামরিক আইন শাসনকে শিথিল করেন এবং আড়াই বছরের মাথায় এটি পূর্ণাঙ্গভাবে প্রত্যাহার করেন।
পাঁচ. ১৯৭৫ সালে আনীত বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যে বহুদলীয় গণতন্ত্র নিষিদ্ধ হয়েছিল, জিয়াউর রহমান পুনরায় সেই বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন এবং বাকশাল হওয়ার আগে যেসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে বিদ্যমান ও সক্রিয় ছিল, সবগুলোকে নতুনভাবে রাজনীতি করার সুযোগ দেন। তিনি নতুন রাজনৈতিক দল চালু করার অনুমতি দেন এবং উদ্যোগও নেন। বহুদলীয়, সংসদ নির্বাচন এবং সর্বজনীন ভোটের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বন্দোবস্ত করেন। সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন।
ছয়. বিদেশ সম্পর্কের অঙ্গনে, জিয়াউর রহমান সার্কের (বা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা) স্বপ্নদ্রষ্টা। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স, নন-অ্যালাইন মুভমেন্ট এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথ অব নেশনস- এই তিনটি সংগঠনেই বাংলাদেশের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেন। তিনি আল কুদস কমিটির সদস্য ছিলেন।
সাত. শিল্পাঙ্গনে, পূর্বে অনুসৃত জাতীয়করণ নীতি স্থগিত করেন। ব্যক্তি উদ্যোগে শিল্প প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বর্তমান ঢাকা মহানগরের মতিঝিলে অবস্থিত শিল্পভবন নামক বহুতল দালানটি জিয়াউর রহমানের আমলেই করা।
আট. সরকারি কর্মকাণ্ডের সম্প্রসার ঘটান। তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়, যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করেন। শিশু অ্যাকাডেমি জিয়াউর রহমানেরই উদ্যোগ।
নয়. তিনি পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শিশু হাসপাতল, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন।
দশ. মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার অন্যতম নির্দশনস্বরূপ তিনি রাষ্ট্রীয় সম্মান হিসেবে ‘একুশে পদক’ প্রদান প্রবর্তন করেন।
এগারো. বহুধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি সম্মানের নির্দশনস্বরূপ তিনি চীন থেকে, অতিশ দীপঙ্কর ও শ্রীজ্ঞানের দেহভস্ম বাংলাদেশে আনেন এবং একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করে রক্ষণাবেক্ষণ করেন।
১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ ঢাকা মহানগরের রামপুরায় অবস্থিত টেলিভিশন ভবনে, তৎকালীন বেতার ও তথ্য বিভাগের পদস্থ অফিসারদের এক সমাবেশে জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন (দৈনিক বাংলা ১৪ মার্চ ১৯৭৬): ‘আমরা সকলে বাংলাদেশী। আমরা প্রথমে বাংলাদেশী এবং শেষেও বাংলাদেশী। এই মাটি আমাদের, এই মাটি থেকে আমাদের অনুপ্রেরণা আহরণ করতে হবে। জাতিকে শক্তিশালী করাই আমাদের লক্ষ্য। ঐক্য, শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও কঠোর মেহনতের মাধ্যমেই তা সম্ভব।’ ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের সাংবাদিক ‘সুজান গ্রিন’, ঢাকা থেকে পাঠানো এক ডেসপাচে লিখেছিলেন, ‘সাম্যের প্রতীক ও সৎ লোকরূপে ব্যাপকভাবে গণ্য জিয়াউর রহমান, স্বনির্ভর সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশের ভিক্ষার ঝুলি ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন।’ মালয়েশিয়া দৈনিক ‘বিজনেস টাইমস’-এ প্রকাশিত ওই ডেসপাচে বলা হয় : ‘অতীতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত করেছিল যে মহাপ্লাবী সমস্যাগুলো, রাষ্ট্রপতি জিয়া কার্যত সেগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ নভেম্বর ১৯৭৯)।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরোক্ষ নেতৃত্বে, প্রবাসী সরকারের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে, রণাঙ্গনের লাখো মুক্তিযোদ্ধার জ্যেষ্ঠতম অধিনায়কদের অন্যতম ছিলেন সেক্টর কমান্ডার ও ফোর্স কমান্ডার মেজর, পরবর্তীকালে লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান। একান্ত শৃঙ্খলা অনুরাগী দেশপ্রেমিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলেই উপ-সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে আন্তরিক দায়িত্ব পালন করেন। পরিবেশ এবং জনআকাক্সক্ষা যখন তাকে জাতির চালকের আসনে বসায়, তখনো, বীর উত্তম জিয়াউর রহমান একান্তই আন্তরিক দেশপ্রেমিকতার সাথে দেশের সেবা করেন। তিনি ছিলেন সামরিক জেনারেল, রূপান্তরিত হয়েছিলেন একজন রাজনীতিবিদে এবং সঙ্গতভাবেই উন্নীত হয়েছিলেন একজন রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায়। এতদসত্ত্বেও চিরন্তন ঘোষণা হবে এরূপ : জিয়াউর রহমান একজন মানুষ ছিলেন; মানুষ হিসেবে তারও ভুলভ্রান্তি ছিল; ভুলভ্রান্তি থাকাই স্বাভাবিক; কিন্তু তার অর্জন ছিল অনেক বেশি, অনেক মহৎ ও অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯ জানুয়ারি বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের জন্মদিনে আমরা তার বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছি; তার রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:), চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম মহান ব্যক্তিত্ব শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মদিনে, সম্মানিত পাঠকের বরাবর আমার বিনীত নিবেদন এই কলাম। ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ায় তার জন্ম। তার বাবা মনসুর রহমান ছিলেন সরকারি দফতরে চাকরিরত একজন রসায়নবিদ। মায়ের নাম ছিল জাহানারা খাতুন (প্রকাশ রানী)। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়া ছিলেন দ্বিতীয়। তার শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতা শহরে কাটে। ভারত বিভাজনের পর তিনি প্রথমে পরিবারের সাথে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন অতঃপর তার বাবার সাথে করাচি চলে যান। সেখান থেকে তিনি পরবর্তী ধাপের লেখাপড়া শেষ করেন এবং ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি কাকুল-এ যোগ দেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে যেমন অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তারিখের মধ্যে, ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফা উপস্থাপনের দিনটি অথবা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের দিনটি, অধিকতর স্মরণীয় এবং অধিকতর উজ্জ্বল; তেমনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জীবনের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তারিখের মধ্যে ২৬ ও ২৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার দিনটি অথবা ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের দিনটি অধিকতর স্মরণীয় এবং অধিকতর উজ্জ্বল। জিয়াউর রহমান যেহেতু সেনাবাহিনীতে ছিলেন, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই শুরু। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি কাকুল থেকে কমিশন পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। তার সাথে আরো বাঙালি তরুণ ছিলেন, যারা একই দিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পেয়েছিলেন; এদের একজনকে অনেকেই সহজে চিনবেন যথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম সেনাবাহিনী প্রধান বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম। কমিশনের পরদিন থেকে জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একজন অফিসার হিসেবে চাকরি করেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় তিনি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন এবং বীরত্বের সাথে বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরের কাছে ভারতীয় সীমান্তে প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের পরে ১৯৭১-এর আগে, জিয়াউর রহমান চারটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বর্তমান পাকিস্তানের কোয়েটার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্টাফ কলেজে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করে পিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। দ্বিতীয়ত, তিনি পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি কাকুলে একজন প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তৃতীয়ত, সেনাবাহিনীর মনোনীত হয়ে তিনি ছয় মাসের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে জার্মানি যান। চতুর্থত, তিনি ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে (গাজীপুর) দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং চট্টগ্রাম মহানগরীর ষোলোশহরে নবপ্রতিষ্ঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৫-এর পরে ১৯৭১-এর আগে সময়টা ছিল উত্তাল। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবিনামা উপস্থাপন করেন। ১৯৬৮-এর শেষাংশ থেকে পুরো ১৯৬৯ ছিল গণ-আন্দোলনের বছর। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর ছিল তৎকালীন পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ নির্বাচন; যেই নির্বাচনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ ভূমিধস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। নির্বাচনের ফলাফলের তাৎপর্য ছিল এই যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছয় দফার ভিত্তিতে স্বাধিকার চান তথা পাকিস্তানের সংবিধানকে সংশোধন করে নতুন শাসনতান্ত্রিক কাঠামো চান। তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রায়কে উপেক্ষা করেন এবং মানতে অস্বীকার করেন। এই ষড়যন্ত্রমূলক আচরণের প্রথম আনুষ্ঠানিক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ১ মার্চ ১৯৭১ তারিখে, যেদিন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সরকার আসন্ন জাতীয় সংসদের অধিবেশনকে স্থগিত ঘোষণা করে। এরপর আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ।
ওপরের দু’টি অনুচ্ছেদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, তিনি ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠছিলেন। তিনি ক্রমেই জনগণের আকাক্সক্ষাকে নিজের হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন। নিজে সামরিক কর্মকর্তা হলেও শৃঙ্খলার কঠিন বেড়াজালে আবদ্ধ হলেও তিনি নিজেকে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য কী খেদমত করা যায় সে প্রসঙ্গে চিন্তাভাবনা শুরু করার সুযোগ ও পরিবেশ পেয়েছিলেন। আমার চাকরি জীবনে, ১৯৯৩ সালের মে থেকে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে ১০ মাইল উত্তরে ভাটিয়ারির বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে কমান্ড্যান্টের দায়িত্ব পালন করেছি। আমার দায়িত্ব মেয়াদের শেষ ছয় মাস আমি ব্যস্ত ছিলাম একটি অতিরিক্ত কাজে। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত ২৪ পদাতিক ডিভিশনের সদর দফতরের উল্টো দিকে একটি পুরনো একতলা দালানকে সংস্কার করে সেখানে স্থাপন করা হচ্ছিল এক মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পুরো চট্টগ্রাম জেলা ছিল ১ নম্বর সেক্টরের অধীন। সেই ১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে উদ্ভাসিত রাখার জন্য আমরা ওই মুক্তিযুদ্ধ-জাদুঘর স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মুক্তিযোদ্ধা লে. জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রম এবং তৎকালীন চট্টগ্রাম অঞ্চলের এরিয়া কমান্ডার ও ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান বীর উত্তমের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায়, আমার সার্বিক নেতৃত্বে ও পরিচালনায় ওই জাদুঘরটি স্থাপিত হয়। ওই জাদুঘরের নাম স্মৃতি অম্লান। সেই জাদুঘর স্থাপনের কাজ করতে গিয়ে আমরা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মেজর জিয়াউর রহমানের অনেক কিছু জানতে পারি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরু থেকেই মেজর জিয়া সন্ধ্যার পরে রাতের বেলা একটি টয়োটা কারে করে শহরের বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। উদ্দেশ্য পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীদের চোখ এড়িয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জনগণকে নিয়ে কী করা যায়, সে পরিকল্পনা করা। ওই টয়োটা কারের মালিক, ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসে, চট্টগ্রাম সেনানিবাসের কর্তৃপক্ষের কাছে, মিউজিয়ামে প্রদর্শনের নিমিত্তে, ওই কারটি অফেরতযোগ্য উপহারস্বরূপ দেন। সেনানিবাসের স্বাভাবিক বিধিনিষেধ মানা সাপেক্ষে, যে কেউ ইচ্ছা করলে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে প্রবেশের বায়েজিদ বোস্তামি গেট দিয়ে প্রবেশ করলেই, এক শ’ গজ মাত্র যাওয়ার পর ওই মিউজিয়ামের একতলা ভবনটি দেখতে পাবেন এবং তার সামনে কারটি দণ্ডায়মান দেখতে পাবেন।
১৯৭১-এর ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজারের বাসভবনে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অপারেশনাল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভাপতিত্ব ও নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন তৎকালীন কর্নেল এম এ জি ওসমানী। মেজর জিয়া সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭১-এর জুন-জুলাই মাসে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে প্রথম ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা করতে হলো, তখন লে. কর্নেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জেড ফোর্স গঠন করা হয়। জেড ফোর্স বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এবং উত্তর-পূর্ব এলাকায় যুদ্ধ করে। ঢাকা পতনের চার দিন আগেই জেড ফোর্স বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাংশ শত্রুমুক্ত করে। আরো অনেকের সাথে তিনি বীর উত্তম খেতাব পান। প্রথম তিন মাস তিনি জেড ফোর্স থেকে রূপান্তরিত হওয়া ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন, কুমিল্লা সেনানিবাসে। কুমিল্লা সেনানিবাসের তৎকালীন নাম ছিল ময়নামতি সেনানিবাস। এখনো সর্ব দক্ষিণের প্রবেশপথ দিয়ে সেনানিবাসে ঢুকতে গেলেই হাতের বাঁয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ দেখা যাবে, যেটি জিয়াউর রহমানের নির্দেশে তিন মাসের মধ্যেই স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৭২ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত হন। যদিও তিনি জিয়াউর রহমান থেকে কনিষ্ঠ ছিলেন, তথাপি সফিউল্লাহকেই তৎকালীন সরকার সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগ করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে বঙ্গবন্ধু হত্যা ঘটনার পর সমগ্র দেশে ও প্রশাসনে অনেক কিছু ওলট-পালট হয়। প্রায় তিন বছর চার মাস আট দিন চাকরির পর, তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে (বীর উত্তম) সরিয়ে তার জায়গায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে (বীর উত্তম) সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগ করা হয়। একই বছরের ৩ নভেম্বরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালী চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের নেতৃত্বে একটি কু অনুষ্ঠিত হয়। এই কু-এর নেতৃবৃন্দ ৩ নভেম্বর শুরু হওয়া মাত্রই জিয়াউর রহমানকে নিজ বাসভবনে বন্দী করেন। জিয়াউর রহমান কোনো প্রকার অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে চাননি; তিনি সেনাবাহিনী প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দেন; এই শূন্যস্থানে ৫ নভেম্বর তারিখে খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে যান। ইতোমধ্যে ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লব সাধিত হয়। স্বাধীনতাকামী, জাতীয়তাবাদী, মুক্তিযুদ্ধমুখী সাধারণ সৈনিকেরা তৎকালীন জাসদের ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করেই জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন এবং সেনাবাহিনী প্রধানের পদে তিনি আবার আসীন হন। ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুনরুজ্জীবনের দিন। বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর কাঠামো অস্তিত্ব এবং আনুগত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিন মাস আগে খন্দকার মোশতাকের জারি করা মার্শাল ল শাসন মোতাবেক, মোস্তাক ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ ছিলেন অন্যতম উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ৭ নভেম্বরের পর নতুন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম হলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং নতুন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম হলেন অন্যতম উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। কালক্রমে, দেশের প্রশাসন জিয়াউর রহমানের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। প্রথমে গণভোটের মাধ্যমে, পরে প্রকাশ্য নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে অতি প্রত্যুষে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে সরকারি সার্কিট হাউজে অবস্থানকালে একটি সেনাবিদ্রোহের ফলে জিয়াউর রহমান শহীদ হন। বীর উত্তম জিয়াউর রহমান, রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশে অনেকগুলো দূরদর্শী ও তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
এই সংক্ষিপ্ত কলামে অনেক কিছু লেখা যাবে না। তারপরও তারিখের ধারাবাহিতকা বজায় না রেখেই আমি এ রকম কিছু দূরদর্শী ও তাৎপর্যপূর্ণ কাজ বা কিছু সিদ্ধান্ত বা কিছু অর্জনের কথা বর্তমান প্রজন্মের উপকারার্থে তথা এই কলামের সম্মানিত পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করছি।
এক. ১৯৭২-এ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় রক্ষীবাহিনী জনগণের মানসপটে একটি ভীতিকর বাহিনী ছিল এবং তৎকালীন সেনাবাহিনীর মানসপটে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনী ছিল। সেনাবাহিনী প্রধান হওয়ার পরপরই জিয়াউর রহমানের তৎপরতায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, রক্ষীবাহিনীকে ভেঙে দেয়া হবে না বরং তাদেরকে দেশের সেবার জন্য নতুন সুযোগ দেয়া হবে। রক্ষীবাহিনীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে একীভূত বা আত্তীকরণ তথা ইন্টিগ্রেট করা হয়। পরিহাসের বিষয় যদিও এই মুহূর্তে (২০০৯ থেকে ২০১৬) জিয়াউর রহমানের একনিষ্ঠ সমালোচনাকারীদের মধ্যে, সাবেক রক্ষীবাহিনীর ও পরে সেনাবাহিনীর কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ অফিসার আছেন।
দুই. ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সাংগঠনিক পর্যায় ছিল ব্যাটালিয়ন, তার ওপরে ব্রিগেড এবং তার ওপরে সেনাবাহিনীর সদর দফতর। জিয়াউর রহমান ১৯৭৬-এর শুরুতেই নবম পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক স্তরকে এক ধাপ ওপরে নিয়ে যান।
তিন. জিয়াউর রহমান বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জন যেমন সেনাসদস্য ও জনগণের সম্মিলিত প্রয়াস ছিল, তেমনই দুর্যোগকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্বও যৌথভাবে সামরিক বাহিনী ও জনগণকে পালন করতে হবে। অতএব জনগণকে মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তার জন্য তিনি ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি বা ভিডিপি নামে একটি সংগঠন সৃষ্টি করেন এবং ১০ বছরের মধ্যে এক কোটি বাংলাদেশীকে ভিডিপিতে প্রশিক্ষণ দেবেন এই লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেন। ভিডিপি প্রশিক্ষণের মৌলিক অংশ ছিল একেবারেই প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ এবং দ্বিতীয় অংশ ছিল জীবিকা নির্বাহের উন্নতির জন্য একটি সেকেন্ডারি পেশা যথা হাঁস-মুরগি পালন যথা ক্ষেত-খামারকরণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ।
চার. জিয়াউর রহমান পর্যায়ক্রমে সামরিক আইন শাসনকে শিথিল করেন এবং আড়াই বছরের মাথায় এটি পূর্ণাঙ্গভাবে প্রত্যাহার করেন।
পাঁচ. ১৯৭৫ সালে আনীত বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যে বহুদলীয় গণতন্ত্র নিষিদ্ধ হয়েছিল, জিয়াউর রহমান পুনরায় সেই বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন এবং বাকশাল হওয়ার আগে যেসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে বিদ্যমান ও সক্রিয় ছিল, সবগুলোকে নতুনভাবে রাজনীতি করার সুযোগ দেন। তিনি নতুন রাজনৈতিক দল চালু করার অনুমতি দেন এবং উদ্যোগও নেন। বহুদলীয়, সংসদ নির্বাচন এবং সর্বজনীন ভোটের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বন্দোবস্ত করেন। সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন।
ছয়. বিদেশ সম্পর্কের অঙ্গনে, জিয়াউর রহমান সার্কের (বা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা) স্বপ্নদ্রষ্টা। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স, নন-অ্যালাইন মুভমেন্ট এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথ অব নেশনস- এই তিনটি সংগঠনেই বাংলাদেশের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেন। তিনি আল কুদস কমিটির সদস্য ছিলেন।
সাত. শিল্পাঙ্গনে, পূর্বে অনুসৃত জাতীয়করণ নীতি স্থগিত করেন। ব্যক্তি উদ্যোগে শিল্প প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বর্তমান ঢাকা মহানগরের মতিঝিলে অবস্থিত শিল্পভবন নামক বহুতল দালানটি জিয়াউর রহমানের আমলেই করা।
আট. সরকারি কর্মকাণ্ডের সম্প্রসার ঘটান। তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়, যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করেন। শিশু অ্যাকাডেমি জিয়াউর রহমানেরই উদ্যোগ।
নয়. তিনি পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শিশু হাসপাতল, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন।
দশ. মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার অন্যতম নির্দশনস্বরূপ তিনি রাষ্ট্রীয় সম্মান হিসেবে ‘একুশে পদক’ প্রদান প্রবর্তন করেন।
এগারো. বহুধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি সম্মানের নির্দশনস্বরূপ তিনি চীন থেকে, অতিশ দীপঙ্কর ও শ্রীজ্ঞানের দেহভস্ম বাংলাদেশে আনেন এবং একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করে রক্ষণাবেক্ষণ করেন।
১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ ঢাকা মহানগরের রামপুরায় অবস্থিত টেলিভিশন ভবনে, তৎকালীন বেতার ও তথ্য বিভাগের পদস্থ অফিসারদের এক সমাবেশে জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন (দৈনিক বাংলা ১৪ মার্চ ১৯৭৬): ‘আমরা সকলে বাংলাদেশী। আমরা প্রথমে বাংলাদেশী এবং শেষেও বাংলাদেশী। এই মাটি আমাদের, এই মাটি থেকে আমাদের অনুপ্রেরণা আহরণ করতে হবে। জাতিকে শক্তিশালী করাই আমাদের লক্ষ্য। ঐক্য, শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও কঠোর মেহনতের মাধ্যমেই তা সম্ভব।’ ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের সাংবাদিক ‘সুজান গ্রিন’, ঢাকা থেকে পাঠানো এক ডেসপাচে লিখেছিলেন, ‘সাম্যের প্রতীক ও সৎ লোকরূপে ব্যাপকভাবে গণ্য জিয়াউর রহমান, স্বনির্ভর সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশের ভিক্ষার ঝুলি ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন।’ মালয়েশিয়া দৈনিক ‘বিজনেস টাইমস’-এ প্রকাশিত ওই ডেসপাচে বলা হয় : ‘অতীতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত করেছিল যে মহাপ্লাবী সমস্যাগুলো, রাষ্ট্রপতি জিয়া কার্যত সেগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ নভেম্বর ১৯৭৯)।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরোক্ষ নেতৃত্বে, প্রবাসী সরকারের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে, রণাঙ্গনের লাখো মুক্তিযোদ্ধার জ্যেষ্ঠতম অধিনায়কদের অন্যতম ছিলেন সেক্টর কমান্ডার ও ফোর্স কমান্ডার মেজর, পরবর্তীকালে লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান। একান্ত শৃঙ্খলা অনুরাগী দেশপ্রেমিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলেই উপ-সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে আন্তরিক দায়িত্ব পালন করেন। পরিবেশ এবং জনআকাক্সক্ষা যখন তাকে জাতির চালকের আসনে বসায়, তখনো, বীর উত্তম জিয়াউর রহমান একান্তই আন্তরিক দেশপ্রেমিকতার সাথে দেশের সেবা করেন। তিনি ছিলেন সামরিক জেনারেল, রূপান্তরিত হয়েছিলেন একজন রাজনীতিবিদে এবং সঙ্গতভাবেই উন্নীত হয়েছিলেন একজন রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায়। এতদসত্ত্বেও চিরন্তন ঘোষণা হবে এরূপ : জিয়াউর রহমান একজন মানুষ ছিলেন; মানুষ হিসেবে তারও ভুলভ্রান্তি ছিল; ভুলভ্রান্তি থাকাই স্বাভাবিক; কিন্তু তার অর্জন ছিল অনেক বেশি, অনেক মহৎ ও অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯ জানুয়ারি বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের জন্মদিনে আমরা তার বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছি; তার রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:), চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
No comments