এক মত ও বহু মত by সৈয়দ আবুল মকসুদ
দ্বিতীয়
মহাযুদ্ধে হিটলারের পরাজয়ের পর জার্মানি ছিল আক্ষরিক অর্থেই একটি
ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ। ভৌগোলিকভাবে দুটুকরো হয়ে যায় জার্মানি। সোভিয়েত
সমাজতান্ত্রিক শিবিরে থাকে পূর্ব জার্মানি: জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক
বা জিডিআর। পশ্চিম জার্মানি—ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি থাকে পুঁজিবাদী
গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে। কিন্তু দেশটির আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক,
সাংস্কৃতিক অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। সেই বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে
সেখানে আবির্ভাব ঘটতে পারত একজন শক্তিশালী ডিকটেটরের। কিন্তু জার্মানির
নতুন নেতৃত্ব সে পথ গ্রহণ না করে উদার গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করেন।
রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, জার্মানিতে ‘এক মত’ চলবে না।
ভালো হোক মন্দ হোক, রাষ্ট্রে ও সমাজে নানা মতের সহ-অবস্থান থাকতে হবে।
বাস্তবিক পক্ষে শুধু রাষ্ট্রে নয়, জার্মান সমাজে, এমনকি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ও পরিবারে পর্যন্ত ‘এক মত’ পরিত্যাজ্য। আমি জার্মান পরিবারে দেখেছি, শিশুকাল থেকেই স্বাধীন চিন্তায় উৎসাহ দেওয়া হয়। যেকোনো প্রশ্নে ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সমান। জার্মান সংবিধান, যার নাম ‘বেসিক ল’ বা মৌলিক আইন, তাতে বাক্ ও ব্যক্তিস্বাধীনতার শতভাগ গ্যারান্টি দেওয়া আছে। শিল্পী-সাহিত্যিকদের স্বাধীনতা সীমাহীন। আমি সেকালের পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন নগরীর প্রেসক্লাবে এক কার্টুন প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম। তাতে প্রদর্শিত হয়েছিল একজন খ্যাতিমান কার্টুনশিল্পীর আঁকা ব্যঙ্গচিত্র। বিষয়বস্তু জার্মান রাজনীতিবিদ। জনা চল্লিশ বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতার কার্টুন। তাতে প্রেসিডেন্ট, চ্যান্সেলর থেকে শুরু করে মন্ত্রী ও পার্লামেন্ট মেম্বারদের ব্যঙ্গচিত্র ছিল। প্রত্যেক নেতার মুখটা মানুষের, তার শরীরটি পশুর। কোনো নেতা বিড়াল, কোনো নেতা কুকুর, কোনো নেতা বেজি, কোনো নেতা শুয়োর, কোনো নেতা সাপ, কোনো নেতা ষাঁড় প্রভৃতি। বাংলাদেশে ওই রকম কার্টুনের যদি কোনো শিল্পী প্রদর্শনী করতেন, তাহলে তা নিয়ে হতো নানা রকম মামলা—দেওয়ানি, ফৌজদারি ও রিট। সে মামলাও একটি নয়, বিভিন্ন জেলা শহরে। অনুভূতিতে আঘাতের কারণে মানহানির মামলা তো হতোই। ফৌজদারি মামলা হতো, কারণ ওই প্রদর্শনী ভাঙচুর করতে গিয়ে জনা বিশেক জখম হয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে থাকত চিকিৎসাধীন। হতো বহু প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন। সেখানেও মারামারিতে মাথা ফাটত কয়েকজনের। বিভিন্ন নিকৃষ্ট জানোয়ারের সঙ্গে রাজনীতিকদের তুলনা করায় কোনো আপত্তি উঠেছে কি না—জানতে চাইলে একজন জার্মান কর্মকর্তা বলেছিলেন, আর্ট ইজ ফ্রি। শিল্পী তাঁর শিল্পকর্মে স্বাধীন।
উনিশ শতক থেকে পৃথিবীর প্রায় সব প্রগতিশীল দার্শনিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বের উদ্ভব জার্মানিতে। উনিশ শতকেই পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে জার্মানিতে। সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সূচনাও জার্মানিতে। শিল্প-সাহিত্য, তত্ত্বজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার প্রভৃতি ক্ষেত্রেও জার্মানরাই ছিলেন অগ্রগামী। তারপরও কী কারণে জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে বর্বর ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে এবং তাঁর এক যুগের শাসনকালে অতীতের সব গৌরব ম্লান হয়ে যায়, তা বোঝার জন্য খুব বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। তার একমাত্র কারণ ‘এক মত’-এর প্রাধান্য এবং বহু মতের প্রকাশ ও সমন্বয় না থাকা। কোনো রাষ্ট্রেরই ভালোমন্দের সব দায়দায়িত্ব কোনো একটি গোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দিতে পারে না জনগণ। সেই গোষ্ঠী যদি অপার দেশপ্রেমিক ও অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন হয়, তা হলেও নয়। সেই জন্য হিটলারের পতনের পরপরই নতুন গণতান্ত্রিক জার্মানির যাত্রা শুরুর সময়ই ‘এক মত’-এর প্রাধান্য বর্জিত হয় এবং বহু মতের গুরুত্ব ঘোষিত হয়।
একটি রাষ্ট্র কোনো এক-দরজাবিশিষ্ট প্রায় অন্ধকার আলো-বাতাসহীন ঘর নয়। রাষ্ট্রকে হতে হয় বহু দরজা-জানালাবিশিষ্ট একটি আলোকিত ও উন্মুক্ত ভবন। এক-দরজাবিশিষ্ট রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত কিমের উত্তর কোরিয়া, সৌদি আরব, সিরিয়া প্রভৃতি। একটি মাত্র দরজা থাকাতে আলো-বাতাসহীন জায়গাতেই আইএস প্রভৃতির মতো জিনিসের জন্ম হতে পারে। তাতে শাসকদের যতটুকু ক্ষতি, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ক্ষতি দেশের জনগণের। মূল্যটা শেষ পর্যন্ত জনগণকেই দিতে হয়। কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ মিয়ানমারের শাসকেরা নন, খেসারত দিয়ে আসছে সে দেশের সাধারণ মানুষ। পাকিস্তানি শাসকদের দুর্বুদ্ধির মূল্য দিয়েছে এবং দিচ্ছে পাকিস্তানের জনগণ এবং আরও বহুকাল দেবে।
রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপক বা ম্যানেজার হলো সরকার, কিন্তু রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। রাষ্ট্রের নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে সরকার। সরকারের নিজস্ব নীতিনির্ধারক রয়েছেন। তাঁদের দুর্বলতা ও ভুলভ্রান্তি থাকা সম্ভব। সরকারের বাইরে নাগরিকদের যেসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের মতামতের মূল্য সামান্য নয়। কিছু কিছু প্রশ্নে বরং বেশি। কারণ সরকারের মেয়াদকাল নির্দিষ্ট, জনগণ চিরস্থায়ী; প্রজন্মের পর প্রজন্ম বংশানুক্রমে মানুষ বেঁচে থাকে। কোনো সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিবেচনাহীনতার কারণে যদি দেশের একটি অমূল্য বনভূমি ধ্বংস হয়ে যায়, সেই সরকারের তাতে কিছুই আসে-যায় না; কিন্তু সর্বনাশ দেশের জনগণের। এক প্রজন্মের ক্ষতি নয়, অনাগত সব প্রজন্মের। কোনো সরকারের গৃহীত কোনো প্রকল্পে যদি চেরনোবিলের মতো বিস্ফোরণ ঘটায় লাখ লাখ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়, তাতে সেই সরকারের লোকদের কী যায়-আসে। জনগণের ভবিষ্যৎ জনগণই ভালো বোঝে।
পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশে স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, থিংক ট্যাংক, বেসরকারি সংস্থা, পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার সংস্থা, সিভিল সোসাইটির সংগঠনগুলোকে সরকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। আর যদি নাও দেয়, অন্তত তাদের কাজের মূল্যায়ন করে। নাগরিক সমাজের মতামতের মূল্য দেয়। আর কিছুই যদি না করে, অন্তত অসম্মান করে না। ভিন্নমতাবলম্বীকে অপমানটা করে না। আমাদের সরকার তাদের নিজেদের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো মতামতকেই দাম দেয় না; বরং যেকোনো ভিন্নমত বিচার-বিবেচনা না করে তাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে।
সরকারি লোকেরা যেহেতু টাকাপয়সা বোঝেন ভালো, তাই কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে যখন সমালোচনামূলক মতামত আসে—তাঁরা প্রথমেই প্রশ্ন তোলেন, তারা গবেষণা যে করে, টাকা পায় কোথায়? শুধু টাকা কোথায় পায়, তা-ই নয়, বলেই দেন টাকাটা তারা পায় নির্ঘাত সরকারের শত্রুপক্ষ থেকে। এই ধরনের প্রশ্ন তোলা খুব নিম্নমানের গ্রাম্যতা। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার কাজটা যেহেতু সরকারের, সুতরাং তার কাজের প্রশংসা-সমালোচনা-নিন্দা হবেই। অন্যায্য ও বিদ্বেষমূলক সমালোচনায় মানুষ কানই দেয় না—নিন্দা নিন্দুকের মুখেই থাকে।
সব গণতান্ত্রিক সমাজেই গণমাধ্যম স্বাধীন এবং সমালোচনামূলক কর্তৃত্বের কাজ করে। মাঠপর্যায়ের মানুষের কণ্ঠস্বর রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। স্বাধীন নাগরিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন জাতীয় সমস্যা নিয়ে কাজ করে। তাদের গবেষণালব্ধ সমীক্ষার ফলাফল গণমাধ্যম সরকার ও দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দেয়। সেই সব বেসরকারি সমীক্ষা সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করতে পারে। নাগরিকদের সমীক্ষা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সহায়ক—উন্নয়নের শত্রু নয়। বিতর্ক হতেই পারে এবং হওয়াই বাঞ্ছনীয়। অমর্ত্য সেনের ভাষায় যাকে বলে তক্কাতক্কি। যে সমাজে বিতর্ক বা তক্কাতক্কির সুযোগ নেই, তা এক-দরজাবিশিষ্ট ঘর।
গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের সমাজে ব্যাপক রূপান্তর ঘটেছে। মানুষ পুরোনো বাংলাদেশে ফিরে যেতে চায় না; বরং চায় নতুন আরও ভালো এক বাংলাদেশ। যেখানে মানুষ তার পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারবে, যেখানে থাকবে সামাজিক ন্যায়বিচার। যেখানে মানুষ আছে, সেখানে সমস্যা থাকবে। সব সমস্যার সমাধান একা সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। বিশ্বায়নের যুগে কোনো দেশই এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। প্রাকৃতিক ও সামরিক সব সমস্যাই সম্মিলিত চেষ্টা ছাড়া সমাধান অসম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা লাগবেই। জঙ্গিবাদ মহামারির আকারে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা তুলনামূলকভাবে ভালো আছি। কিন্তু জঙ্গিবাদ কার প্ররোচনায়, কোথায়, কী আকার ধারণ করে, তা বলা সম্ভব নয়। কোন জঙ্গিবাদ দমনের ধরন কী রকম হবে, তা একা সরকারের পক্ষে নির্ধারণ করাও সম্ভব নয়। নাগরিক সমাজ, মানবাধিকারকর্মী, উন্নয়ন গবেষকদের বুদ্ধি-পরামর্শ দরকার। সবাইকে ঠেলা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলে বড় ক্ষতির আশঙ্কা।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন গত শুক্রবার সাধারণ পরিষদে বলেছেন, অপরিকল্পিত নীতি, ব্যর্থ নেতৃত্ব, কঠোর পন্থা, কেবল সামরিক বল প্রয়োগ করে জঙ্গিবাদ নির্মূলের চেষ্টা হয়েছে। উপেক্ষিত হয়েছে মানবাধিকার। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এসব পন্থা নেওয়ার ফলে জঙ্গিবাদ বেড়েই চলেছে। প্রতিটি রাষ্ট্রকে তিনি জঙ্গিবাদ নির্মূলে জাতীয় পরিকল্পনা তৈরির আহ্বান জানান।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি দাবি করে, প্রতিটি দেশের নেতৃত্বের সুবিবেচনাপ্রসূত সংযমী সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক পরিমিতিবোধ। সে জন্য এক মতের একরোখা নীতি নয়, চাই বহু মতের সমন্বয়ী সিদ্ধান্ত, পক্ষপাতহীনতা ও সহনশীলতা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হীন পন্থায় দুর্বল করতে চাইলে হিতে বিপরীত হয়। ভিন্নমতাবলম্বীকে তার অপ্রীতিকর কথার জন্য চপেটাঘাত না করে তা ধীরস্থিরভাবে বিচার করে প্রত্যাখ্যান করাই ভালো। নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে, যেন প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এই বোধ জন্মে: এই রাষ্ট্র আমার।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
বাস্তবিক পক্ষে শুধু রাষ্ট্রে নয়, জার্মান সমাজে, এমনকি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ও পরিবারে পর্যন্ত ‘এক মত’ পরিত্যাজ্য। আমি জার্মান পরিবারে দেখেছি, শিশুকাল থেকেই স্বাধীন চিন্তায় উৎসাহ দেওয়া হয়। যেকোনো প্রশ্নে ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সমান। জার্মান সংবিধান, যার নাম ‘বেসিক ল’ বা মৌলিক আইন, তাতে বাক্ ও ব্যক্তিস্বাধীনতার শতভাগ গ্যারান্টি দেওয়া আছে। শিল্পী-সাহিত্যিকদের স্বাধীনতা সীমাহীন। আমি সেকালের পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন নগরীর প্রেসক্লাবে এক কার্টুন প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম। তাতে প্রদর্শিত হয়েছিল একজন খ্যাতিমান কার্টুনশিল্পীর আঁকা ব্যঙ্গচিত্র। বিষয়বস্তু জার্মান রাজনীতিবিদ। জনা চল্লিশ বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতার কার্টুন। তাতে প্রেসিডেন্ট, চ্যান্সেলর থেকে শুরু করে মন্ত্রী ও পার্লামেন্ট মেম্বারদের ব্যঙ্গচিত্র ছিল। প্রত্যেক নেতার মুখটা মানুষের, তার শরীরটি পশুর। কোনো নেতা বিড়াল, কোনো নেতা কুকুর, কোনো নেতা বেজি, কোনো নেতা শুয়োর, কোনো নেতা সাপ, কোনো নেতা ষাঁড় প্রভৃতি। বাংলাদেশে ওই রকম কার্টুনের যদি কোনো শিল্পী প্রদর্শনী করতেন, তাহলে তা নিয়ে হতো নানা রকম মামলা—দেওয়ানি, ফৌজদারি ও রিট। সে মামলাও একটি নয়, বিভিন্ন জেলা শহরে। অনুভূতিতে আঘাতের কারণে মানহানির মামলা তো হতোই। ফৌজদারি মামলা হতো, কারণ ওই প্রদর্শনী ভাঙচুর করতে গিয়ে জনা বিশেক জখম হয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে থাকত চিকিৎসাধীন। হতো বহু প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন। সেখানেও মারামারিতে মাথা ফাটত কয়েকজনের। বিভিন্ন নিকৃষ্ট জানোয়ারের সঙ্গে রাজনীতিকদের তুলনা করায় কোনো আপত্তি উঠেছে কি না—জানতে চাইলে একজন জার্মান কর্মকর্তা বলেছিলেন, আর্ট ইজ ফ্রি। শিল্পী তাঁর শিল্পকর্মে স্বাধীন।
উনিশ শতক থেকে পৃথিবীর প্রায় সব প্রগতিশীল দার্শনিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বের উদ্ভব জার্মানিতে। উনিশ শতকেই পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে জার্মানিতে। সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সূচনাও জার্মানিতে। শিল্প-সাহিত্য, তত্ত্বজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার প্রভৃতি ক্ষেত্রেও জার্মানরাই ছিলেন অগ্রগামী। তারপরও কী কারণে জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে বর্বর ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে এবং তাঁর এক যুগের শাসনকালে অতীতের সব গৌরব ম্লান হয়ে যায়, তা বোঝার জন্য খুব বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। তার একমাত্র কারণ ‘এক মত’-এর প্রাধান্য এবং বহু মতের প্রকাশ ও সমন্বয় না থাকা। কোনো রাষ্ট্রেরই ভালোমন্দের সব দায়দায়িত্ব কোনো একটি গোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দিতে পারে না জনগণ। সেই গোষ্ঠী যদি অপার দেশপ্রেমিক ও অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন হয়, তা হলেও নয়। সেই জন্য হিটলারের পতনের পরপরই নতুন গণতান্ত্রিক জার্মানির যাত্রা শুরুর সময়ই ‘এক মত’-এর প্রাধান্য বর্জিত হয় এবং বহু মতের গুরুত্ব ঘোষিত হয়।
একটি রাষ্ট্র কোনো এক-দরজাবিশিষ্ট প্রায় অন্ধকার আলো-বাতাসহীন ঘর নয়। রাষ্ট্রকে হতে হয় বহু দরজা-জানালাবিশিষ্ট একটি আলোকিত ও উন্মুক্ত ভবন। এক-দরজাবিশিষ্ট রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত কিমের উত্তর কোরিয়া, সৌদি আরব, সিরিয়া প্রভৃতি। একটি মাত্র দরজা থাকাতে আলো-বাতাসহীন জায়গাতেই আইএস প্রভৃতির মতো জিনিসের জন্ম হতে পারে। তাতে শাসকদের যতটুকু ক্ষতি, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ক্ষতি দেশের জনগণের। মূল্যটা শেষ পর্যন্ত জনগণকেই দিতে হয়। কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ মিয়ানমারের শাসকেরা নন, খেসারত দিয়ে আসছে সে দেশের সাধারণ মানুষ। পাকিস্তানি শাসকদের দুর্বুদ্ধির মূল্য দিয়েছে এবং দিচ্ছে পাকিস্তানের জনগণ এবং আরও বহুকাল দেবে।
রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপক বা ম্যানেজার হলো সরকার, কিন্তু রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। রাষ্ট্রের নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে সরকার। সরকারের নিজস্ব নীতিনির্ধারক রয়েছেন। তাঁদের দুর্বলতা ও ভুলভ্রান্তি থাকা সম্ভব। সরকারের বাইরে নাগরিকদের যেসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের মতামতের মূল্য সামান্য নয়। কিছু কিছু প্রশ্নে বরং বেশি। কারণ সরকারের মেয়াদকাল নির্দিষ্ট, জনগণ চিরস্থায়ী; প্রজন্মের পর প্রজন্ম বংশানুক্রমে মানুষ বেঁচে থাকে। কোনো সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিবেচনাহীনতার কারণে যদি দেশের একটি অমূল্য বনভূমি ধ্বংস হয়ে যায়, সেই সরকারের তাতে কিছুই আসে-যায় না; কিন্তু সর্বনাশ দেশের জনগণের। এক প্রজন্মের ক্ষতি নয়, অনাগত সব প্রজন্মের। কোনো সরকারের গৃহীত কোনো প্রকল্পে যদি চেরনোবিলের মতো বিস্ফোরণ ঘটায় লাখ লাখ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়, তাতে সেই সরকারের লোকদের কী যায়-আসে। জনগণের ভবিষ্যৎ জনগণই ভালো বোঝে।
পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশে স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, থিংক ট্যাংক, বেসরকারি সংস্থা, পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার সংস্থা, সিভিল সোসাইটির সংগঠনগুলোকে সরকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। আর যদি নাও দেয়, অন্তত তাদের কাজের মূল্যায়ন করে। নাগরিক সমাজের মতামতের মূল্য দেয়। আর কিছুই যদি না করে, অন্তত অসম্মান করে না। ভিন্নমতাবলম্বীকে অপমানটা করে না। আমাদের সরকার তাদের নিজেদের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো মতামতকেই দাম দেয় না; বরং যেকোনো ভিন্নমত বিচার-বিবেচনা না করে তাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে।
সরকারি লোকেরা যেহেতু টাকাপয়সা বোঝেন ভালো, তাই কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে যখন সমালোচনামূলক মতামত আসে—তাঁরা প্রথমেই প্রশ্ন তোলেন, তারা গবেষণা যে করে, টাকা পায় কোথায়? শুধু টাকা কোথায় পায়, তা-ই নয়, বলেই দেন টাকাটা তারা পায় নির্ঘাত সরকারের শত্রুপক্ষ থেকে। এই ধরনের প্রশ্ন তোলা খুব নিম্নমানের গ্রাম্যতা। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার কাজটা যেহেতু সরকারের, সুতরাং তার কাজের প্রশংসা-সমালোচনা-নিন্দা হবেই। অন্যায্য ও বিদ্বেষমূলক সমালোচনায় মানুষ কানই দেয় না—নিন্দা নিন্দুকের মুখেই থাকে।
সব গণতান্ত্রিক সমাজেই গণমাধ্যম স্বাধীন এবং সমালোচনামূলক কর্তৃত্বের কাজ করে। মাঠপর্যায়ের মানুষের কণ্ঠস্বর রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। স্বাধীন নাগরিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন জাতীয় সমস্যা নিয়ে কাজ করে। তাদের গবেষণালব্ধ সমীক্ষার ফলাফল গণমাধ্যম সরকার ও দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দেয়। সেই সব বেসরকারি সমীক্ষা সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করতে পারে। নাগরিকদের সমীক্ষা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সহায়ক—উন্নয়নের শত্রু নয়। বিতর্ক হতেই পারে এবং হওয়াই বাঞ্ছনীয়। অমর্ত্য সেনের ভাষায় যাকে বলে তক্কাতক্কি। যে সমাজে বিতর্ক বা তক্কাতক্কির সুযোগ নেই, তা এক-দরজাবিশিষ্ট ঘর।
গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের সমাজে ব্যাপক রূপান্তর ঘটেছে। মানুষ পুরোনো বাংলাদেশে ফিরে যেতে চায় না; বরং চায় নতুন আরও ভালো এক বাংলাদেশ। যেখানে মানুষ তার পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারবে, যেখানে থাকবে সামাজিক ন্যায়বিচার। যেখানে মানুষ আছে, সেখানে সমস্যা থাকবে। সব সমস্যার সমাধান একা সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। বিশ্বায়নের যুগে কোনো দেশই এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। প্রাকৃতিক ও সামরিক সব সমস্যাই সম্মিলিত চেষ্টা ছাড়া সমাধান অসম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা লাগবেই। জঙ্গিবাদ মহামারির আকারে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা তুলনামূলকভাবে ভালো আছি। কিন্তু জঙ্গিবাদ কার প্ররোচনায়, কোথায়, কী আকার ধারণ করে, তা বলা সম্ভব নয়। কোন জঙ্গিবাদ দমনের ধরন কী রকম হবে, তা একা সরকারের পক্ষে নির্ধারণ করাও সম্ভব নয়। নাগরিক সমাজ, মানবাধিকারকর্মী, উন্নয়ন গবেষকদের বুদ্ধি-পরামর্শ দরকার। সবাইকে ঠেলা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলে বড় ক্ষতির আশঙ্কা।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন গত শুক্রবার সাধারণ পরিষদে বলেছেন, অপরিকল্পিত নীতি, ব্যর্থ নেতৃত্ব, কঠোর পন্থা, কেবল সামরিক বল প্রয়োগ করে জঙ্গিবাদ নির্মূলের চেষ্টা হয়েছে। উপেক্ষিত হয়েছে মানবাধিকার। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এসব পন্থা নেওয়ার ফলে জঙ্গিবাদ বেড়েই চলেছে। প্রতিটি রাষ্ট্রকে তিনি জঙ্গিবাদ নির্মূলে জাতীয় পরিকল্পনা তৈরির আহ্বান জানান।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি দাবি করে, প্রতিটি দেশের নেতৃত্বের সুবিবেচনাপ্রসূত সংযমী সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক পরিমিতিবোধ। সে জন্য এক মতের একরোখা নীতি নয়, চাই বহু মতের সমন্বয়ী সিদ্ধান্ত, পক্ষপাতহীনতা ও সহনশীলতা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হীন পন্থায় দুর্বল করতে চাইলে হিতে বিপরীত হয়। ভিন্নমতাবলম্বীকে তার অপ্রীতিকর কথার জন্য চপেটাঘাত না করে তা ধীরস্থিরভাবে বিচার করে প্রত্যাখ্যান করাই ভালো। নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে, যেন প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এই বোধ জন্মে: এই রাষ্ট্র আমার।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
No comments