শিক্ষক আন্দোলন ও পদ মানক্রম বিতর্ক by মিজানুর রহমান খান
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা সংগত প্রশ্ন তুলেছেন যে এত বেতন বাড়ানোর পরও কেন এই আন্দোলন?
এককথায় এর উত্তর হলো রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমে অধ্যাপকদের মর্যাদার
বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে ফয়সালা করলে তা সংকট উতরাতে সহজ হতে পারে। আওয়ামী
লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে সুপরিচিত একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে এ কথাটি বলতেই
তিনি তাৎক্ষণিক এর সঙ্গে একমত হলেন। বললেন, ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স
শোধরানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে মর্যাদার প্রশ্নটিই বড়।
সেখানেই ঘাটতি চলছে। যুগ্ম সচিবদের সঙ্গে অধ্যাপকদের এক কাতারে রাখা
হয়েছে।’ বাংলাপিডিয়া অনুযায়ী, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের বাংলা তরজমা হলো
‘পদ মানক্রম’। এটি বিদেশি কূটনীতিক কোরের সদস্যরাসহ রাষ্ট্রের নির্বাহী,
আইন ও বিচার বিভাগীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের পদের আপেক্ষিক মানক্রম। এটি
প্রধানত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ ও তাঁদের আসনবিন্যাসের কাজে লাগলেও
এটি আসলে মর্যাদা নির্ধারণী একটি সংবেদনশীল বিষয়। এর সঙ্গে জাতীয়
বেতনকাঠামোর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।
আমাদের দেশে বর্তমানে সামরিক শাসন আমলের ১৯৮৬ সালে হালনাগাদ করা পদ মানক্রম বহাল আছে। যদিও ১৯৯০ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এটি একাধিকবার সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে আলোচনা করে এটি হালনাগাদ করার কোনো উদ্যোগ কখনো চোখে পড়েনি।
মোগল আমলে বাংলায় মানক্রম নির্ধারিত হতো বংশগত ও জাতিগত অবস্থান বিবেচনায়। বাংলাপিডিয়া বলেছে, ‘স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য মর্যাদার অগ্রাধিকার ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত মহারাজা, রাজা, নওয়াব, স্যার, সুলতান, রায় বাহাদুর, খান বাহাদুর ইত্যাদি উপাধির গুরুত্বের ভিত্তিতে নির্ধারিত হতো। স্থানীয়দের মধ্যে জমিদার নন এমন উপাধিপ্রাপ্তরা ছিলেন পদসোপানের সর্বনিম্ন স্তরে।’ এরপর আমরা যখন গণতন্ত্র পেলাম, তখন গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে এটি প্রতিস্থাপন না করে ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তানি ধ্যানধারণা মনে–প্রাণে আঁকড়ে ধরে এটি নকল করেছি। ব্রিটিশ শাসনের গোড়ায় বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা নির্বাহী বিভাগের তুলনায় উচ্চতর মর্যাদা লাভ করতেন। ১৮৬১ সালে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ঊর্ধ্বে অবস্থান লাভ করে এবং ফলে এই অনুক্রম বদলে যায়। সেই ধারা আজও চলছে। উদাহরণ দিই, প্রশাসন ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ সচিব পদক্রমের ১৬তম স্তরে। আর বিচার ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ জেলা ও দায়রা জজকে অনুক্রমের ২৪–এ উপসচিব মর্যাদাসম্পন্ন ডিসিদের সঙ্গে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ বিচারকেরাও মর্যাদায় উপসচিব হয়েই আছেন।
আমরা আমলাদের প্রতি যথারীতি শ্রদ্ধাশীল। নাগরিকের জীবনে দৈনন্দিন প্রত্যক্ষ শাসনের কলকাঠি তাঁদের হাতেই। শিক্ষা যেভাবে জাতির মেরুদণ্ড, সেভাবে একটি দক্ষ আমলাতন্ত্র জাতীয় প্রশাসনের মেরুদণ্ড। বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর প্রতিটিরই পদ মানক্রম রয়েছে। তার সঙ্গে মিল রেখে এটা নির্ধারণ করতে হবে। সে কাজ করতে আমাদের সরকারকে একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারে পরিণত হতে হবে। তার এমন আচরণ করা উচিত নয়, যা বৈষম্যমূলক বা বিমাতাসুলভ। আর কোনো যুক্তিনিষ্ঠ আমলাতন্ত্র মানতে পারে না যে অন্যায্যভাবে হলেও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিচারক ও অধ্যাপকদের ওপরে তাদের ঠাঁই পেতেই হবে। এখন তেমনটাই প্রতীয়মান হচ্ছে।
এই রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে, তাহলে তাকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু পদ মানক্রম নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পদ মানক্রম এখন অনলাইনে সহজলভ্য, সুতরাং সেগুলো পর্যালোচনা করে আমরা সহজেই একটি গ্রহণযোগ্য পদ মানক্রম প্রস্তুত করতে পারি। পাকিস্তান সরকার ১৯৫০ সালে এক অস্থায়ী আদেশবলে প্রথম একটি পদ মানক্রম প্রস্তুত করেছিল। এই বিশেষ আদেশটি পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ থেকে জারি করা হয়েছিল। এ আদেশে সামরিক ও বেসামরিক আমলারা সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করেন। এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পদ মানক্রমকে মুক্ত করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে প্রধান বিচারপতি ছিলেন ৩ নম্বর স্তরে, স্পিকারের ওপরে। ১৯৮৬ সালে সামরিক শাসনে প্রধান বিচারপতিকে স্পিকারের নিচে ৪ নম্বরে নামানো হলো। ভারতে কিন্তু স্পিকারের ওপরেই প্রধান বিচারপতিকে রাখা হয়েছে। ভারতে উপাচার্য ও জাতীয় অধ্যাপক সচিব ও মেজর জেনারেলের ওপরে, বাংলাদেশে নিচে। সপ্তম গ্রেডে যখন সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের প্রথম গ্রেডে বেতন দেওয়া হলো, তখনো কিন্তু তাঁদের সচিবদের সমমর্যাদায় আনার দরকার মনে করেনি আমলাতন্ত্র। আর এখন সপ্তম গ্রেডের মতো সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের প্রথম গ্রেডে বেতন প্রদান অব্যাহত রাখতে আকস্মিক অস্বীকৃতি কেন, তা রহস্যজনক। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার নেতৃত্বাধীন পে–কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অর্থমন্ত্রীসহ আট মন্ত্রীকে নিয়ে ১২ জানুয়ারি নতুন কমিটি হয়েছে। এতে আশা ও শঙ্কা দুটোই আছে। কারণ, পদ মানক্রম নির্ধারণের সঙ্গে বিচারকদের বেতন–ভাতার আরও বেশি স্পর্শকাতরতা রয়েছে। আর এখানে একটি অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
ভারতে রাজ্য সরকারের সচিব ও কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্ম সচিবের সমান হলেন প্রিন্সিপাল জজ, যুগ্ম সচিবের সমান মর্যাদায় জেলা ও দায়রা জজ। একটি অঙ্গরাজ্যের যুগ্ম সচিবের সমান যদি জেলা জজ হন, তাহলে স্বাধীন রাষ্ট্রের জেলা জজ কেন উপসচিব হিসেবে থাকবেন? এবং যত দূর বুঝতে পারি, এ বিষয়ে সৃষ্ট অসন্তোষ অপনোদন না করেই বিচার বিভাগের জন্য নতুন পে–স্কেলের ঘোষণা আসবে। এবং সেখানে আবারও টাকার অঙ্কে হয়তো অনেক বেতন বাড়বে, কিন্তু অধস্তন আদালতের দেড় হাজার বিচারকের মনে অস্বস্তি থেকে যাবে। সরকার বৈষম্য দূর করতে টাস্কফোর্স গঠনের কথা ভাবছে। কিন্তু এই টাস্কফোর্সের সঙ্গে আরও একটি টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার, যারা বিবেচনায় নেবে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের যুগ্ম সচিব এবং জ্যেষ্ঠ জেলা জজদের উপসচিবের মর্যাদায় রাখা ঠিক নয়। সংখ্যা দিয়েই মানমর্যাদা নির্ধারণ হবে? কেউ বলছেন, এটাও বিবেচ্য যে সচিব ১২২ ও অধ্যাপক ৮২০, সচিব ও অধ্যাপক যথাক্রমে ৫৯ ও ৬৫ বছরে অবসরে যান। যুক্তি হিসেবে এটা সবল? সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা সংখ্যায় কত কম হয়েও তাঁরা মর্যাদায় মন্ত্রী। বহু দেশে বিচারকেরা আমৃত্যু কাজ করেন। সেসব দেশ সচিবদের সঙ্গে এর তুলনা করে না।
আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যখন মর্যাদার কথা বলছেন, সচিবের সমান মর্যাদা চাইছেন, তখন তাঁদের অধ্যাপনা ছেড়ে সচিব হতে বলা হচ্ছে। তাঁদের অনেকেরই দলাদলিতে যুক্ত হওয়া, দলবাজি করে নিয়োগ ও পদোন্নতি পাওয়া, ভর্তি-বাণিজ্য, অনিয়ন্ত্রিত খণ্ডকালীন চাকরি, দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি সামনে আনা হচ্ছে। কিন্তু মর্যাদার নীতিগত প্রশ্ন ও অভিযোগকে আলাদা করতে হবে। কারণ রাষ্ট্রের পদ মানক্রম ন্যায্যতার সঙ্গে নির্দিষ্ট হতে হবে। ব্যক্তি ও একশ্রেণির পেশাজীবীর অযথাযথ আচরণকে বিবেচনায় নিয়ে পদ মানক্রমের অসংগতি জিইয়ে রাখা সমীচীন নয়।
প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের কখনো চাকরির ক্ষেত্রে অন্তত শ্রেণি হিসেবে পদ মান সোপান বা বেতন–ভাতা বিতর্কে শামিল হতে হয়নি। এটা কী নির্দেশ করে? সিভিল সার্ভিসের অনেক আমলার জন্য আমরা গর্ববোধ করি। কিন্তু শ্রেণি হিসেবে জ্যেষ্ঠ জেলা জজ ও জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের ওপরে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব মানতে হবে? বিচার বিভাগ যখন জেলা জজকে সচিবের পদমর্যাদা দিল, তখন সংসদে মুহূর্তে জোরালো কণ্ঠে উচ্চারিত হলো—এই সিদ্ধান্ত ‘সম্পূর্ণ অনৈতিক।’ নির্বাহী বিভাগ ও সংসদকে কখনো তো অধ্যাপক ও জেলা জজদের অনৈতিকভাবে পিছিয়ে রাখায় বিব্রত হতে দেখিনি। তাহলে ওই বিশেষ শ্রেণির জন্য এতটা স্পর্শকাতরতা কেন? শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে যাঁরা শিক্ষাজীবনের সব স্তরে প্রথম শ্রেণি কিংবা প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন, তাঁরাই প্রধানত অধ্যাপনার জীবন বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে প্রশাসন ক্যাডারে যাঁরা গেছেন, তাঁদের সবার ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের পদ মানক্রম কী বলছে? শিক্ষকেরা সংগত প্রশ্ন তুলেছেন যে সচিবের নিচে জাতীয় অধ্যাপকদের রাখা হবে কেন?
পদ মানক্রমের ১৯ স্তরে সিলেকশন গ্রেডের অধ্যাপকদের রাখা হয়েছে সব থেকে নিচে। এমনকি তাদের দুদকের, কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের এমডির ওপরে তোলা যায়নি। সব থেকে পরিহাস হলো, ২২ স্তরের ক্রমিকের সবশেষ ধাপে রাখা হয়েছে মেডিকেল ও প্রকৌশল কলেজের অধ্যক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের নিচে আমরা কেন অধ্যাপকদের রাখব?
এসব যুক্তির আলোকেই বলি, অসন্তুষ্টির কারণ যদিও অনেক, তবে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তার অবসান করুন, তাহলে বেতন-বৈষম্য হ্রাস করতে তা সহায়ক হবে। প্রসঙ্গক্রমে এ কথা না বললেই নয় যে বিচারকেরা বেতন-ভাতার প্রশ্নেই ঐক্যবদ্ধভাবে রিট করেছিলেন। জন্ম নিয়েছিল মাসদার হোসেন মামলার। আজ দলাদলিতে করুণভাবে বিভক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ, যেখানে ৩৭ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, যারা তাঁদের গলদপূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়ার শুদ্ধতা নিয়ে তর্ক তুলতে নারাজ, শিক্ষার মানোন্নয়নে কোনো অভিন্ন কর্মসূচি দিতে অপারগ, সেখানে তাঁরা বেতন-ভাতা ও মর্যাদার প্রশ্নে একতাবদ্ধ হয়েছেন। বাঘ-মহিষ এক ঘাটে! বলা বাহুল্য, শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার ও তার মান বাড়াতে তাঁরা আন্দোলনে নামলে জনগণ তাঁদের প্রকৃত মর্যাদার আসনে বসাবে। সর্বস্তরে দায়িত্বশীলদের কাজে ক্ষয় দেখে আমজনতা মনঃকষ্টে আছেন। তাই শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এই আন্দোলন অসম্পূর্ণ এবং স্বতঃস্ফূর্ত জনসাড়া বঞ্চিত হতে বাধ্য।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক ৷
mrkhanbd@gmail.com
আমাদের দেশে বর্তমানে সামরিক শাসন আমলের ১৯৮৬ সালে হালনাগাদ করা পদ মানক্রম বহাল আছে। যদিও ১৯৯০ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এটি একাধিকবার সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে আলোচনা করে এটি হালনাগাদ করার কোনো উদ্যোগ কখনো চোখে পড়েনি।
মোগল আমলে বাংলায় মানক্রম নির্ধারিত হতো বংশগত ও জাতিগত অবস্থান বিবেচনায়। বাংলাপিডিয়া বলেছে, ‘স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য মর্যাদার অগ্রাধিকার ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত মহারাজা, রাজা, নওয়াব, স্যার, সুলতান, রায় বাহাদুর, খান বাহাদুর ইত্যাদি উপাধির গুরুত্বের ভিত্তিতে নির্ধারিত হতো। স্থানীয়দের মধ্যে জমিদার নন এমন উপাধিপ্রাপ্তরা ছিলেন পদসোপানের সর্বনিম্ন স্তরে।’ এরপর আমরা যখন গণতন্ত্র পেলাম, তখন গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে এটি প্রতিস্থাপন না করে ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তানি ধ্যানধারণা মনে–প্রাণে আঁকড়ে ধরে এটি নকল করেছি। ব্রিটিশ শাসনের গোড়ায় বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা নির্বাহী বিভাগের তুলনায় উচ্চতর মর্যাদা লাভ করতেন। ১৮৬১ সালে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ঊর্ধ্বে অবস্থান লাভ করে এবং ফলে এই অনুক্রম বদলে যায়। সেই ধারা আজও চলছে। উদাহরণ দিই, প্রশাসন ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ সচিব পদক্রমের ১৬তম স্তরে। আর বিচার ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ জেলা ও দায়রা জজকে অনুক্রমের ২৪–এ উপসচিব মর্যাদাসম্পন্ন ডিসিদের সঙ্গে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ বিচারকেরাও মর্যাদায় উপসচিব হয়েই আছেন।
আমরা আমলাদের প্রতি যথারীতি শ্রদ্ধাশীল। নাগরিকের জীবনে দৈনন্দিন প্রত্যক্ষ শাসনের কলকাঠি তাঁদের হাতেই। শিক্ষা যেভাবে জাতির মেরুদণ্ড, সেভাবে একটি দক্ষ আমলাতন্ত্র জাতীয় প্রশাসনের মেরুদণ্ড। বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর প্রতিটিরই পদ মানক্রম রয়েছে। তার সঙ্গে মিল রেখে এটা নির্ধারণ করতে হবে। সে কাজ করতে আমাদের সরকারকে একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারে পরিণত হতে হবে। তার এমন আচরণ করা উচিত নয়, যা বৈষম্যমূলক বা বিমাতাসুলভ। আর কোনো যুক্তিনিষ্ঠ আমলাতন্ত্র মানতে পারে না যে অন্যায্যভাবে হলেও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিচারক ও অধ্যাপকদের ওপরে তাদের ঠাঁই পেতেই হবে। এখন তেমনটাই প্রতীয়মান হচ্ছে।
এই রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে, তাহলে তাকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু পদ মানক্রম নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পদ মানক্রম এখন অনলাইনে সহজলভ্য, সুতরাং সেগুলো পর্যালোচনা করে আমরা সহজেই একটি গ্রহণযোগ্য পদ মানক্রম প্রস্তুত করতে পারি। পাকিস্তান সরকার ১৯৫০ সালে এক অস্থায়ী আদেশবলে প্রথম একটি পদ মানক্রম প্রস্তুত করেছিল। এই বিশেষ আদেশটি পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ থেকে জারি করা হয়েছিল। এ আদেশে সামরিক ও বেসামরিক আমলারা সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করেন। এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পদ মানক্রমকে মুক্ত করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে প্রধান বিচারপতি ছিলেন ৩ নম্বর স্তরে, স্পিকারের ওপরে। ১৯৮৬ সালে সামরিক শাসনে প্রধান বিচারপতিকে স্পিকারের নিচে ৪ নম্বরে নামানো হলো। ভারতে কিন্তু স্পিকারের ওপরেই প্রধান বিচারপতিকে রাখা হয়েছে। ভারতে উপাচার্য ও জাতীয় অধ্যাপক সচিব ও মেজর জেনারেলের ওপরে, বাংলাদেশে নিচে। সপ্তম গ্রেডে যখন সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের প্রথম গ্রেডে বেতন দেওয়া হলো, তখনো কিন্তু তাঁদের সচিবদের সমমর্যাদায় আনার দরকার মনে করেনি আমলাতন্ত্র। আর এখন সপ্তম গ্রেডের মতো সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের প্রথম গ্রেডে বেতন প্রদান অব্যাহত রাখতে আকস্মিক অস্বীকৃতি কেন, তা রহস্যজনক। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার নেতৃত্বাধীন পে–কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অর্থমন্ত্রীসহ আট মন্ত্রীকে নিয়ে ১২ জানুয়ারি নতুন কমিটি হয়েছে। এতে আশা ও শঙ্কা দুটোই আছে। কারণ, পদ মানক্রম নির্ধারণের সঙ্গে বিচারকদের বেতন–ভাতার আরও বেশি স্পর্শকাতরতা রয়েছে। আর এখানে একটি অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
ভারতে রাজ্য সরকারের সচিব ও কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্ম সচিবের সমান হলেন প্রিন্সিপাল জজ, যুগ্ম সচিবের সমান মর্যাদায় জেলা ও দায়রা জজ। একটি অঙ্গরাজ্যের যুগ্ম সচিবের সমান যদি জেলা জজ হন, তাহলে স্বাধীন রাষ্ট্রের জেলা জজ কেন উপসচিব হিসেবে থাকবেন? এবং যত দূর বুঝতে পারি, এ বিষয়ে সৃষ্ট অসন্তোষ অপনোদন না করেই বিচার বিভাগের জন্য নতুন পে–স্কেলের ঘোষণা আসবে। এবং সেখানে আবারও টাকার অঙ্কে হয়তো অনেক বেতন বাড়বে, কিন্তু অধস্তন আদালতের দেড় হাজার বিচারকের মনে অস্বস্তি থেকে যাবে। সরকার বৈষম্য দূর করতে টাস্কফোর্স গঠনের কথা ভাবছে। কিন্তু এই টাস্কফোর্সের সঙ্গে আরও একটি টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার, যারা বিবেচনায় নেবে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের যুগ্ম সচিব এবং জ্যেষ্ঠ জেলা জজদের উপসচিবের মর্যাদায় রাখা ঠিক নয়। সংখ্যা দিয়েই মানমর্যাদা নির্ধারণ হবে? কেউ বলছেন, এটাও বিবেচ্য যে সচিব ১২২ ও অধ্যাপক ৮২০, সচিব ও অধ্যাপক যথাক্রমে ৫৯ ও ৬৫ বছরে অবসরে যান। যুক্তি হিসেবে এটা সবল? সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা সংখ্যায় কত কম হয়েও তাঁরা মর্যাদায় মন্ত্রী। বহু দেশে বিচারকেরা আমৃত্যু কাজ করেন। সেসব দেশ সচিবদের সঙ্গে এর তুলনা করে না।
আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যখন মর্যাদার কথা বলছেন, সচিবের সমান মর্যাদা চাইছেন, তখন তাঁদের অধ্যাপনা ছেড়ে সচিব হতে বলা হচ্ছে। তাঁদের অনেকেরই দলাদলিতে যুক্ত হওয়া, দলবাজি করে নিয়োগ ও পদোন্নতি পাওয়া, ভর্তি-বাণিজ্য, অনিয়ন্ত্রিত খণ্ডকালীন চাকরি, দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি সামনে আনা হচ্ছে। কিন্তু মর্যাদার নীতিগত প্রশ্ন ও অভিযোগকে আলাদা করতে হবে। কারণ রাষ্ট্রের পদ মানক্রম ন্যায্যতার সঙ্গে নির্দিষ্ট হতে হবে। ব্যক্তি ও একশ্রেণির পেশাজীবীর অযথাযথ আচরণকে বিবেচনায় নিয়ে পদ মানক্রমের অসংগতি জিইয়ে রাখা সমীচীন নয়।
প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের কখনো চাকরির ক্ষেত্রে অন্তত শ্রেণি হিসেবে পদ মান সোপান বা বেতন–ভাতা বিতর্কে শামিল হতে হয়নি। এটা কী নির্দেশ করে? সিভিল সার্ভিসের অনেক আমলার জন্য আমরা গর্ববোধ করি। কিন্তু শ্রেণি হিসেবে জ্যেষ্ঠ জেলা জজ ও জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের ওপরে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব মানতে হবে? বিচার বিভাগ যখন জেলা জজকে সচিবের পদমর্যাদা দিল, তখন সংসদে মুহূর্তে জোরালো কণ্ঠে উচ্চারিত হলো—এই সিদ্ধান্ত ‘সম্পূর্ণ অনৈতিক।’ নির্বাহী বিভাগ ও সংসদকে কখনো তো অধ্যাপক ও জেলা জজদের অনৈতিকভাবে পিছিয়ে রাখায় বিব্রত হতে দেখিনি। তাহলে ওই বিশেষ শ্রেণির জন্য এতটা স্পর্শকাতরতা কেন? শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে যাঁরা শিক্ষাজীবনের সব স্তরে প্রথম শ্রেণি কিংবা প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন, তাঁরাই প্রধানত অধ্যাপনার জীবন বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে প্রশাসন ক্যাডারে যাঁরা গেছেন, তাঁদের সবার ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের পদ মানক্রম কী বলছে? শিক্ষকেরা সংগত প্রশ্ন তুলেছেন যে সচিবের নিচে জাতীয় অধ্যাপকদের রাখা হবে কেন?
পদ মানক্রমের ১৯ স্তরে সিলেকশন গ্রেডের অধ্যাপকদের রাখা হয়েছে সব থেকে নিচে। এমনকি তাদের দুদকের, কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের এমডির ওপরে তোলা যায়নি। সব থেকে পরিহাস হলো, ২২ স্তরের ক্রমিকের সবশেষ ধাপে রাখা হয়েছে মেডিকেল ও প্রকৌশল কলেজের অধ্যক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের নিচে আমরা কেন অধ্যাপকদের রাখব?
এসব যুক্তির আলোকেই বলি, অসন্তুষ্টির কারণ যদিও অনেক, তবে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তার অবসান করুন, তাহলে বেতন-বৈষম্য হ্রাস করতে তা সহায়ক হবে। প্রসঙ্গক্রমে এ কথা না বললেই নয় যে বিচারকেরা বেতন-ভাতার প্রশ্নেই ঐক্যবদ্ধভাবে রিট করেছিলেন। জন্ম নিয়েছিল মাসদার হোসেন মামলার। আজ দলাদলিতে করুণভাবে বিভক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ, যেখানে ৩৭ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, যারা তাঁদের গলদপূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়ার শুদ্ধতা নিয়ে তর্ক তুলতে নারাজ, শিক্ষার মানোন্নয়নে কোনো অভিন্ন কর্মসূচি দিতে অপারগ, সেখানে তাঁরা বেতন-ভাতা ও মর্যাদার প্রশ্নে একতাবদ্ধ হয়েছেন। বাঘ-মহিষ এক ঘাটে! বলা বাহুল্য, শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার ও তার মান বাড়াতে তাঁরা আন্দোলনে নামলে জনগণ তাঁদের প্রকৃত মর্যাদার আসনে বসাবে। সর্বস্তরে দায়িত্বশীলদের কাজে ক্ষয় দেখে আমজনতা মনঃকষ্টে আছেন। তাই শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এই আন্দোলন অসম্পূর্ণ এবং স্বতঃস্ফূর্ত জনসাড়া বঞ্চিত হতে বাধ্য।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক ৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments