যৌনকর্মীদের সিরিয়াল-সিনেমায় পুনর্বাসন দিতে মমতার প্রকল্প
যে
সব যৌনকর্মী পতিতাবৃত্তির পেশা ছাড়তে চান তাদেরকে অভিনয় দুনিয়ায় পুনর্বাসন
দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন কলকাতার মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। প্রকল্পের
নাম দেয়া হয়েছে ‘স্বাবলম্বন স্পেশাল’। প্রকল্পের ঘোষণা দেয়ার পর ইতিমধ্যে
দু’মাস পেরিয়ে গেছে। তবে এখন পর্যন্ত নাম লিখিয়েছেন মাত্র হাতে গোনা
কয়েকজন। আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে বলা বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে, অবসরে নিজে বাংলা সিরিয়ার দেখেন মূখ্যমন্ত্রী মমতা। বাংলা ছবি ও
সিরিয়ালের অনেক অভিনেতা-পরিচালক-প্রযোজকের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ
রয়েছে। তিনি এবার পেশা ছাড়তে আগ্রহী যৌনকর্মীদের অভিনয়ের দুনিয়ায়
পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করেছেন। তবে প্রকল্প ঘোষণার দু’মাস পেরিয়ে গেলেও নাম
লেখানো যৌনকর্মীদের সংখ্যা অনেক কম। মনে হচ্ছে, অভিনয় জগতের প্রতি তীব্র
আকর্ষণ থাকলেও পেশা ছাড়তে চাওয়া বেশিরভাগ যৌনকর্মী এখনই মুখ্যমন্ত্রীর
বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্পে পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছেন না। ফলে শুরুতেই
খানিকটা হোঁচট খেয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা সমাজকল্যাণ
দপ্তর। দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, পেশা ছাড়তে চাওয়া যৌনকর্মী মেয়েদের
জন্য আগে ‘স্বাবলম্বন’ নামে একটি প্রকল্প ছিল। সেখানে আচার-বড়ি তৈরি, সেলাই
কিংবা মশলা গুঁড়ো করার মতো পুরনো, একঘেয়ে কাজে তাঁদের মন নেই বলে
জানিয়েছিলেন অনেক মেয়ে। বরং সিনেমা-সিরিয়ালে অভিনয়ের কথা শুনে অনেকেই আগ্রহ
দেখান। রাজ্যের নারী ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজার কথায়,
‘মুখ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি জানানো হয়। তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত এই ‘স্বাবলম্বন
স্পেশ্যাল’ প্রকল্প। গত ডিসেম্বরে নির্মাণভবনে নারী উন্নয়ন নিগমে যৌনকর্মী
এবং যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠনের সঙ্গে দু’বার বৈঠক করে
প্রকল্পের কথা ও কাঠামো জানিয়ে দেওয়া হয়। মন্ত্রী জানান, স্বাবলম্বন
স্পেশ্যাল-এ দু’টি কাজ শেখানো হবে বলে ঠিক হয়েছে। এক, অভিনয়। এটি চার মাসের
কোর্স। অন্যটি কস্টিউম জুয়েলারি তৈরি। এটি তিন মাসের কোর্স। কিন্তু
সমাজকল্যাণ দপ্তর সূত্রেই জানা গেছে, পর্দায় অভিনয় করার জন্য প্রথম দিকে
উৎসাহ দেখা গেলেও এখন যেন সেখানে ভাটার টান। এখনও পর্যন্ত অভিনয় ও কস্টিউম
জুয়েলারি বানানোর কোর্স দু’টির জন্য মাত্র ১৫ জন যৌনকর্মী আবেদন করেছেন। এই
অনীহার কারণ কী? একাধিক সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা জানান, প্রথমে শুনে
গ্ল্যামারের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। শুনেছি, ওই পেশায় টাকাও মন্দ নয়।
কিন্তু তার পর কিছু সমস্যা সামনে আসে। যেমন, কোর্স চলাকালীন সরকার থেকে
মেয়েদের মাসে আড়াই হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হবে। এ ছাড়া যাতায়াত ও টিফিন
বাবদ প্রতিদিন দেওয়া হবে ১৫০ টাকা করে। অনেক মেয়েরই মাসিক রোজগার এর থেকে
অনেক বেশি বলে তাঁরা রাজি হচ্ছেন না। সরকার চাইছে, কোর্স শুরু করার পর
মেয়েরা যৌনপল্লিতে থাকলেও যৌনপেশায় আর থাকবেন না। পরে যৌনপল্লি ছেড়ে অন্য
জায়গায় ঘর ভাড়া নিতে হবে তাঁদের। এতেও মেয়েরা ধন্দে। নিজের পেশা ছেড়ে়
বিকল্প পেশায় যেতে আগ্রহী সোনাগাছির এক যৌনকর্মীর কথায়, ‘ধরা যাক, অভিনয়ের
কোর্সে নাম লেখালাম। তখন তো আমাকে এই পেশা বন্ধ করতে হবে। তার পর যদি দেখি
ঠিকঠাক অভিনয় করতে পারছি না তখন কী হবে?’ আর এক যৌনকর্মীর আশঙ্কা, ‘কোর্স
করার পরেও যে সিনেমা সিরিয়ালে সুযোগ পাব তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
সিরিয়ালে-সিনেমায় মুখ দেখে পেশার কারণে পুরনো কেউ যদি চিনে ফেলে? প্রশ্ন
তাঁদের। আরও একটি প্রশ্নও এই প্রসঙ্গে উঠছে। বাংলা ছবি ও সিরিয়াল পুরোটাই
বেসরকারি উদ্যোগে হয়। এটি সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। ফলে, সরকার কী ভাবে এই
ধরনের পুনর্বাসন প্রকল্প ঘোষণা করতে পারে? যৌনপল্লির যে মেয়েরা নিজেদের
পেশা ছেড়ে অভিনয়ের জগতে পা রাখতে চাইবেন, তাঁরা ঠিকমতো সুযোগ পাবেন কি? না
পেলে তখন তাঁরা কী করবেন? যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘দুর্বার
সমন্বয় সমিতি’র এক মুখপাত্র জানান, টেলিউড বা টলিউডে মানুষ ওঁদের কী ভাবে
নেবেন, ব্রাত্য করে রাখবেন কি না, অপমানজনক কথা বলবেন কি না; এ সব নিয়েও
মেয়েরা চিন্তিত। যদিও আমরা ওঁদের ভয় দূর করতে সোনাগাছি, খিদিরপুর, বৌবাজার,
কালীঘাট, চেতলার যৌনপল্লির বাড়ি-বাড়ি গিয়ে লাগাতার প্রচার চালাচ্ছি। তবু
সংশয়ে রয়েছেন মেয়েরা। সমাজকল্যাণ দপ্তরের অন্তর্গত ‘উওম্যান ডেভেলপমেন্ট
আন্ডারটেকিং’-এর চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য কোর্স-শেষে কাজ
পাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। তাঁর কথায়, প্রথম দিকে যাতে কাজ পেতে অসুবিধা
না-হয়, তা নিশ্চিত করতে কোর্সের পরে একাধিক নামী পরিচালক দিয়ে অভিনয়
ওয়ার্কশপ করানোর ব্যবস্থা হবে। সেই পর্ব মিটলে সরাসরি সিরিয়াল ও সিনেমায়
মেয়েদের অভিনয়ের সুযোগ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। লীনাদেবীর এই
আশ্বাসেও আপাতত চিঁড়ে ভিজছে না। তাই সাবলম্বন স্পেশাল-এর আকর্ষণ বাড়াতে
গ্ল্যামার দুনিয়ার হাতছানি সোনাগাছির নিশিজীবনে এখনও কোনও সাড়া ফেলতে
পারেনি।
No comments