ভালোবেসেছিলেন বাংলাদেশ by মিজানুর রহমান খান
জেনারেল
জ্যাকবকে প্রথম দেখি ২০০৮ সালের মার্চে, ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনে। প্রথম
দেখাতেই মুগ্ধ হলাম। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম
বই সারেন্ডার অ্যাট ঢাকার প্রচ্ছদে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের মুখচ্ছবি
ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সংস্করণের প্রচ্ছদে নিয়াজি-অরোরার আত্মসমর্পণ দলিল
স্বাক্ষরের আলোকচিত্রটি ঠাঁই পেয়েছে। এতে তিনি মোটেই সন্তুষ্ট নন। তাই
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের মুখচ্ছবিসংবলিত তাঁর বইয়ের
প্রথম সংস্করণের কপি ক্যামেরার সামনে তুলে ধরেছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে
বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকাই অগ্রণী ছিল।
দিল্লির আর কে পুরামের বাসায় দুই যাত্রায় পুরো দুই দিন অন্তরঙ্গ আলাপের সুযোগ হয়েছে আমার। জ্যাকব নিশ্চয় নানাভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর বীরত্বগাথার জন্য স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তিনি খুব তৃপ্ত ছিলেন না। ভারতের কোনো কোনো সরকারি মহলের প্রতি তাঁর চাপা ক্ষোভ ছিল। এর প্রধান কারণ সারেন্ডার অ্যাট ঢাকায় তিনি যেভাবে যুদ্ধের বিবরণ, বিশেষ করে ডিসেম্বরের ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন, তা তারা কবুল করেনি। ভারতীয় গণমাধ্যমে এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। এমনকি ভারতের হাইকমান্ডকে পাশ কাটিয়ে জ্যাকব তাঁর রণকৌশলে বাংলাদেশ বিজয় চূড়ান্ত করেছিলেন, সে বিষয়ে বাংলাদেশি যুদ্ধ গবেষকেরাও একমত হননি। যদিও তিনি ছিলেন ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ। অবশ্য যুদ্ধকালে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন যে অনেক সময় মাঠে থাকা জেনারেলদের ওপর নির্ভর করে, তার কিছু নজির আমাদের জানা আছে। চূড়ান্ত কোনো মত দেব না, বিষয়টি সমরবিদ ও ভাবীকালের যুদ্ধবিদ্যার্থীদের গবেষণার বিষয় হয়ে থাকবে। ভারত সরকারের প্রস্তুত করা অথচ অপ্রকাশিত যুদ্ধ-ইতিহাস ছাপা হলে হয়তো আমরা জ্যাকবের দাবি নতুন করে যাচাইয়ের সুযোগ পাব।
জ্যাকব ভারতের সেনাপ্রধান হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁকে সেনাপ্রধান করা হলে তিনি হতেন ভারতের সেনাবাহিনীর ইতিহাসে প্রথম ইহুদি সেনাপ্রধান। যদিও ধর্মের পরিচয় দিতে তিনি বড়ই কুণ্ঠিত। তাঁর কোনো জাত্যভিমান আমি দেখিনি। সেনাপ্রধান না হতে পারার একটা সূক্ষ্ম বেদনাবোধ ওঁর সুপ্ত ছিল। তিনি যে রকম উঁচু মাপের উদারনৈতিক ও অসাম্প্রদায়িক মানুষ, সেই হিসেবে বিজেপিতে যোগদান করা ছিল বিস্ময়কর। বিজেপি সরকারের আমলে তিনি গোয়া ও পাঞ্জাবের গভর্নর হয়েছিলেন, এটুকুই। বিজেপি-বন্দনা তিনি করেননি।
১৬ ডিসেম্বর তারিখটিতেই বিজয় অর্জন সম্পর্কে তাঁর একটি বিশেষ অনুভূতি ছিল। তিনি এই বিশ্বাসে আচ্ছন্ন ছিলেন যে, ডিসেম্বরে ঢাকায় তিনি এমন একটি কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, যার সিংহভাগ কৃতিত্ব ও প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য। তিনি ডিসেম্বরে ব্যক্তিগতভাবে এমনই এক কুশলী রণকৌশল অবলম্বন করেছিলেন, যার ফলে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দলিলে নিয়াজি সই দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। মুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের খসড়া মুসাবিদা তৈরিতে তাঁর হাতের ছোঁয়া ছিল। এসব বিবরণ দিতে দিতে তিনি আনন্দের আতিশয্যে আপ্লুত হয়েছেন। মনে হয়েছে, কোনো নিয়মে ফেলে জেনারেল অরোরার পরিবর্তে ওই দলিলখানায় যদি নিয়াজির প্রতিপক্ষ হিসেবে জ্যাকব সই দিতে পারতেন!
বিদেশি বন্ধু হিসেবে জ্যাকব সম্মাননা নিয়েছেন। তাঁকে কি আমরা একটা বিশেষ সংবর্ধনা দিতে পারতাম? আমাকে তিনি বলেছিলেন, বাহাত্তরে একবার তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতা থেকে বিমানে দিল্লি গিয়েছিলেন। সেই যাত্রাকালে তাজউদ্দীন তাঁকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সরকার তাঁকে একটি সংবর্ধনা দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে।
২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের ডেইলি টাইমস-এ পড়লাম, একাত্তরের যুদ্ধে নিখোঁজ ২ হাজার ২৩৮ ভারতীয় প্রতিরক্ষাকর্মী। সিমলা চুক্তির পরে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে ভারত ফেরত দিল। আর পাকিস্তান ফেরত দিল মাত্র ৬১৭ জনকে। ৫৪ ভারতীয় পরিবার আজও নিখোঁজ। এর বিস্তারিত জানতে জ্যাকবের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তিনি ১৬ জানুয়ারি আমাকে লিখেছিলেন, আমার ই-মেইলটি তিনি ভারতের সেনা সদরে পাঠিয়েছেন। আরেক বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতীয় শহীদ পরিবারের কতিপয় ঠিকানার খোঁজ জানতে লিখেছিলাম। ১৭ মে ২০১১ তিনি লিখলেন, ‘আমার মনে হয় না প্রতিরক্ষা বিভাগে এর কোনো রেকর্ড আছে।’
জীবনসায়াহ্নে তিনি ইন্টারনেটে সদা তৎপর ছিলেন। অনেক সময় দ্রুত উত্তর পেয়ে অবাক হয়েছি। ‘আই অ্যাম ফাইন।’ তাঁর সবশেষ ই-মেইল পেয়েছিলাম ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪।
তাঁর স্মৃতিকথন অ্যান অডিসি ইন ওয়ার অ্যান্ড পিস। ২০১১ সালে এটি বের করেছে দিল্লির লোটাস কালেকশন। এই বইয়ের একটি পরিচ্ছেদের দলিলপত্র আমি তাঁকে সরবরাহ করেছিলাম। এটি বইয়ের শেষ চ্যাপ্টার, জর্জ গ্রিফিন উপাখ্যান: ব্যর্থ গুপ্তচর। এই সেই গ্রিফিন, যিনি একাত্তরে কলকাতার মার্কিন মিশনে কাজী জহিরুল কাইয়ুমের মাধ্যমে ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে কিছু গোপন আলোচনা চালিয়েছিলেন। তখনকার ভারতীয় সরকারি মহলে গ্রিফিনকে সিআইএর এজেন্ট ভাবা হতো। ২৪ এপ্রিল তিনি আমাকে লিখেছিলেন, এতে তাঁর স্কুল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য, বার্মা, সুমাত্রা, সাতচল্লিশের আর্মি পোস্ট, নকশাল, নাগা, মিজো বিদ্রোহ-বাংলাদেশের স্বাধীনতা—গোয়া ও পাঞ্জাবের গভর্নর ও চণ্ডীগড়ের প্রশাসকজীবনের প্রতিফলন ঘটেছে। ৮ জুলাই জ্যাকব লিখলেন, ‘খবরের কাগজে পড়লাম, ইন্দিরার পক্ষে পদক নিতে সোনিয়া ঢাকায় যাচ্ছেন। ইন্দিরা সেরা প্রাপ্যের দাবিদার। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে তিনি সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। তিনি সমগ্র যুদ্ধজুড়ে সুমহান ব্যক্তিত্ব, সাহস ও দৃঢ়তা দেখিয়েছেন।’ সোনিয়ার সফরকালে তাঁর এই উদ্ধৃতি তিনি প্রথম আলোয় ছাপতে বলেছিলেন। সেটা হয়নি। তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় তিনি খুশি হননি। তাই তিনি মনমোহনের সফরের পরে ‘কিছু ফিডব্যাক’ জানতে চেয়েছিলেন।
জ্যাকব বিশ্বাস করেছেন, যুদ্ধ ডিসেম্বর ছাড়িয়ে আরও বহুদূর যেত। এ বিষয়ে ঢাকার জাতিসংঘ মিশনের চাল তিনিই বানচাল করেছিলেন। তিনিই বুদ্ধি করে বহু শহর শত্রুমুক্ত না করেই দ্রুত ‘ঢাকার পতন’ নিশ্চিত করেছিলেন। জ্যাকব দিলখোলা হাসিতে উদ্ভাসিত হতেন এটা বলতে যে, নিয়াজি নিজেই স্বীকার করেছেন, জ্যাকব আমাকে বোকা বানিয়েছে!
আমি এ-সংক্রান্ত তাঁর বিবরণে যে শিশুর সারল্য ও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখেছি, তাতে আমার এটা বিশ্বাস করতে ভালো লাগে যে, তিনি ডিসেম্বরের কোনো কৌশলগত লগ্নের উৎকর্ষে নিজেকে নায়ক থেকে মহানায়কে পরিণত করেছিলেন। সেই প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য। আমি তাঁকে মানবতাবাদী হিসেবে সব থেকে বেশি শ্রদ্ধা জানাই। জ্যাক জ্যাকবের বাড়িতে কিছুটা ইসলামি সংস্কৃতির ছাপ ছিল। পরিবারের অন্দরমহলে বিশ্বস্ত জন ছিলেন মুসলিম নরনারী। তাঁর আরবি জানা জননী হয়তো সে কারণেও তাঁকে আদর করে একটি আরবি উপনামে ‘ফারাজ’ (সুখ) ডাকতেন।
জ্যাক জ্যাকব অমর হোন। শঙ্খচিল শালিক হয়ে আপনি বারংবার ফিরে আসুন, আপনারই বড় প্রিয় এই বাংলায়। আপনাকে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য, অভিবাদন, প্রিয় জেনারেল।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
দিল্লির আর কে পুরামের বাসায় দুই যাত্রায় পুরো দুই দিন অন্তরঙ্গ আলাপের সুযোগ হয়েছে আমার। জ্যাকব নিশ্চয় নানাভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর বীরত্বগাথার জন্য স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তিনি খুব তৃপ্ত ছিলেন না। ভারতের কোনো কোনো সরকারি মহলের প্রতি তাঁর চাপা ক্ষোভ ছিল। এর প্রধান কারণ সারেন্ডার অ্যাট ঢাকায় তিনি যেভাবে যুদ্ধের বিবরণ, বিশেষ করে ডিসেম্বরের ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন, তা তারা কবুল করেনি। ভারতীয় গণমাধ্যমে এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। এমনকি ভারতের হাইকমান্ডকে পাশ কাটিয়ে জ্যাকব তাঁর রণকৌশলে বাংলাদেশ বিজয় চূড়ান্ত করেছিলেন, সে বিষয়ে বাংলাদেশি যুদ্ধ গবেষকেরাও একমত হননি। যদিও তিনি ছিলেন ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ। অবশ্য যুদ্ধকালে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন যে অনেক সময় মাঠে থাকা জেনারেলদের ওপর নির্ভর করে, তার কিছু নজির আমাদের জানা আছে। চূড়ান্ত কোনো মত দেব না, বিষয়টি সমরবিদ ও ভাবীকালের যুদ্ধবিদ্যার্থীদের গবেষণার বিষয় হয়ে থাকবে। ভারত সরকারের প্রস্তুত করা অথচ অপ্রকাশিত যুদ্ধ-ইতিহাস ছাপা হলে হয়তো আমরা জ্যাকবের দাবি নতুন করে যাচাইয়ের সুযোগ পাব।
জ্যাকব ভারতের সেনাপ্রধান হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁকে সেনাপ্রধান করা হলে তিনি হতেন ভারতের সেনাবাহিনীর ইতিহাসে প্রথম ইহুদি সেনাপ্রধান। যদিও ধর্মের পরিচয় দিতে তিনি বড়ই কুণ্ঠিত। তাঁর কোনো জাত্যভিমান আমি দেখিনি। সেনাপ্রধান না হতে পারার একটা সূক্ষ্ম বেদনাবোধ ওঁর সুপ্ত ছিল। তিনি যে রকম উঁচু মাপের উদারনৈতিক ও অসাম্প্রদায়িক মানুষ, সেই হিসেবে বিজেপিতে যোগদান করা ছিল বিস্ময়কর। বিজেপি সরকারের আমলে তিনি গোয়া ও পাঞ্জাবের গভর্নর হয়েছিলেন, এটুকুই। বিজেপি-বন্দনা তিনি করেননি।
১৬ ডিসেম্বর তারিখটিতেই বিজয় অর্জন সম্পর্কে তাঁর একটি বিশেষ অনুভূতি ছিল। তিনি এই বিশ্বাসে আচ্ছন্ন ছিলেন যে, ডিসেম্বরে ঢাকায় তিনি এমন একটি কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, যার সিংহভাগ কৃতিত্ব ও প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য। তিনি ডিসেম্বরে ব্যক্তিগতভাবে এমনই এক কুশলী রণকৌশল অবলম্বন করেছিলেন, যার ফলে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দলিলে নিয়াজি সই দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। মুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের খসড়া মুসাবিদা তৈরিতে তাঁর হাতের ছোঁয়া ছিল। এসব বিবরণ দিতে দিতে তিনি আনন্দের আতিশয্যে আপ্লুত হয়েছেন। মনে হয়েছে, কোনো নিয়মে ফেলে জেনারেল অরোরার পরিবর্তে ওই দলিলখানায় যদি নিয়াজির প্রতিপক্ষ হিসেবে জ্যাকব সই দিতে পারতেন!
বিদেশি বন্ধু হিসেবে জ্যাকব সম্মাননা নিয়েছেন। তাঁকে কি আমরা একটা বিশেষ সংবর্ধনা দিতে পারতাম? আমাকে তিনি বলেছিলেন, বাহাত্তরে একবার তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতা থেকে বিমানে দিল্লি গিয়েছিলেন। সেই যাত্রাকালে তাজউদ্দীন তাঁকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সরকার তাঁকে একটি সংবর্ধনা দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে।
২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের ডেইলি টাইমস-এ পড়লাম, একাত্তরের যুদ্ধে নিখোঁজ ২ হাজার ২৩৮ ভারতীয় প্রতিরক্ষাকর্মী। সিমলা চুক্তির পরে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে ভারত ফেরত দিল। আর পাকিস্তান ফেরত দিল মাত্র ৬১৭ জনকে। ৫৪ ভারতীয় পরিবার আজও নিখোঁজ। এর বিস্তারিত জানতে জ্যাকবের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তিনি ১৬ জানুয়ারি আমাকে লিখেছিলেন, আমার ই-মেইলটি তিনি ভারতের সেনা সদরে পাঠিয়েছেন। আরেক বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতীয় শহীদ পরিবারের কতিপয় ঠিকানার খোঁজ জানতে লিখেছিলাম। ১৭ মে ২০১১ তিনি লিখলেন, ‘আমার মনে হয় না প্রতিরক্ষা বিভাগে এর কোনো রেকর্ড আছে।’
জীবনসায়াহ্নে তিনি ইন্টারনেটে সদা তৎপর ছিলেন। অনেক সময় দ্রুত উত্তর পেয়ে অবাক হয়েছি। ‘আই অ্যাম ফাইন।’ তাঁর সবশেষ ই-মেইল পেয়েছিলাম ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪।
তাঁর স্মৃতিকথন অ্যান অডিসি ইন ওয়ার অ্যান্ড পিস। ২০১১ সালে এটি বের করেছে দিল্লির লোটাস কালেকশন। এই বইয়ের একটি পরিচ্ছেদের দলিলপত্র আমি তাঁকে সরবরাহ করেছিলাম। এটি বইয়ের শেষ চ্যাপ্টার, জর্জ গ্রিফিন উপাখ্যান: ব্যর্থ গুপ্তচর। এই সেই গ্রিফিন, যিনি একাত্তরে কলকাতার মার্কিন মিশনে কাজী জহিরুল কাইয়ুমের মাধ্যমে ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে কিছু গোপন আলোচনা চালিয়েছিলেন। তখনকার ভারতীয় সরকারি মহলে গ্রিফিনকে সিআইএর এজেন্ট ভাবা হতো। ২৪ এপ্রিল তিনি আমাকে লিখেছিলেন, এতে তাঁর স্কুল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য, বার্মা, সুমাত্রা, সাতচল্লিশের আর্মি পোস্ট, নকশাল, নাগা, মিজো বিদ্রোহ-বাংলাদেশের স্বাধীনতা—গোয়া ও পাঞ্জাবের গভর্নর ও চণ্ডীগড়ের প্রশাসকজীবনের প্রতিফলন ঘটেছে। ৮ জুলাই জ্যাকব লিখলেন, ‘খবরের কাগজে পড়লাম, ইন্দিরার পক্ষে পদক নিতে সোনিয়া ঢাকায় যাচ্ছেন। ইন্দিরা সেরা প্রাপ্যের দাবিদার। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে তিনি সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। তিনি সমগ্র যুদ্ধজুড়ে সুমহান ব্যক্তিত্ব, সাহস ও দৃঢ়তা দেখিয়েছেন।’ সোনিয়ার সফরকালে তাঁর এই উদ্ধৃতি তিনি প্রথম আলোয় ছাপতে বলেছিলেন। সেটা হয়নি। তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় তিনি খুশি হননি। তাই তিনি মনমোহনের সফরের পরে ‘কিছু ফিডব্যাক’ জানতে চেয়েছিলেন।
জ্যাকব বিশ্বাস করেছেন, যুদ্ধ ডিসেম্বর ছাড়িয়ে আরও বহুদূর যেত। এ বিষয়ে ঢাকার জাতিসংঘ মিশনের চাল তিনিই বানচাল করেছিলেন। তিনিই বুদ্ধি করে বহু শহর শত্রুমুক্ত না করেই দ্রুত ‘ঢাকার পতন’ নিশ্চিত করেছিলেন। জ্যাকব দিলখোলা হাসিতে উদ্ভাসিত হতেন এটা বলতে যে, নিয়াজি নিজেই স্বীকার করেছেন, জ্যাকব আমাকে বোকা বানিয়েছে!
আমি এ-সংক্রান্ত তাঁর বিবরণে যে শিশুর সারল্য ও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখেছি, তাতে আমার এটা বিশ্বাস করতে ভালো লাগে যে, তিনি ডিসেম্বরের কোনো কৌশলগত লগ্নের উৎকর্ষে নিজেকে নায়ক থেকে মহানায়কে পরিণত করেছিলেন। সেই প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য। আমি তাঁকে মানবতাবাদী হিসেবে সব থেকে বেশি শ্রদ্ধা জানাই। জ্যাক জ্যাকবের বাড়িতে কিছুটা ইসলামি সংস্কৃতির ছাপ ছিল। পরিবারের অন্দরমহলে বিশ্বস্ত জন ছিলেন মুসলিম নরনারী। তাঁর আরবি জানা জননী হয়তো সে কারণেও তাঁকে আদর করে একটি আরবি উপনামে ‘ফারাজ’ (সুখ) ডাকতেন।
জ্যাক জ্যাকব অমর হোন। শঙ্খচিল শালিক হয়ে আপনি বারংবার ফিরে আসুন, আপনারই বড় প্রিয় এই বাংলায়। আপনাকে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য, অভিবাদন, প্রিয় জেনারেল।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments