চৌহালির চর অথবা ছিন্নপত্রের ভুবন by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
ফিরোজের বাবা একটা কথা প্রায়ই বলতেন—এবং গভীর বিশ্বাস থেকেই বলতেন—এ দেশে যখন আকাল আসে, মড়কের চেহারা নিয়ে আসে। খুলনা জেলা আদালতের উকিল ছিলেন, অনেক আকাল পার করেছেন। তেতাল্লিশের মন্বন্তর দেখেছেন, সাতচল্লিশের দেশ বিভাগ দেখেছেন। কলকাতার বেক বাগানে বাপ-দাদার ভিটা ছিল। সাতচল্লিশে তাতে আগুন লেগেছিল। সেই আগুনে তাঁর অনেক বিশ্বাস পুড়ে গিয়েছিল। তার পরও বাপ-দাদার পোড়ো ভিটা আঁকড়ে ধরে পড়ে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আর পারেননি। ১৯৬৪-তে ঢাকা-কলকাতায় দাঙ্গা হলো—না বাপ-দাদার ভিটায় আর আগুন লাগেনি, কিন্তু কিছু কঠিন চেহারার লোক এসে পরিষ্কার বলে দিল, যদি যেতে চান, ব্যবস্থা হবে।
এরপর আর কি থাকা যায়?
খুলনায় এসে ওকালতি পেশাটা নতুন করে শুরু করতে তেমন সমস্যা হয়নি। ঘরও জুটেছিল একটা, সেটিও গুছিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু মনটা পড়ে থাকল বেক বাগানে। একদিন—এবং তত দিনে একাত্তর পার হয়ে গেছে—ভাঙা গলায় ফিরোজকে বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যদি বেঁচে থাকতেন, এই আগুন তাঁকেও পোড়াত।’ ফিরোজ মাথা নাড়ল। না, কথাটা ঠিক বললাম না। ফিরোজের ভেতরে একটা নকশাল-ফিরোজ ছিল। মাথাটা সে-ই নাড়ল। সে বলল, ‘রবীন্দ্রনাথের ঘোড়ার ডিম হতো। তিনি হয়তো ওই আগুনে একটু ওম পেতেন। এই যা।’ ফিরোজের বাবা তর্ক পছন্দ করতেন না। নিজের ছেলের সঙ্গে তো নয়ই। তিনি যুক্তিবাদী ছিলেন, দেখতেন, ছেলে যুক্তি মানে না, খালি আবেগ থেকে উঁচু গলায় কথা বলে। তিনি চুপ করে মনে মনে ঠাকুরের মালিনী থেকে সুপ্রিয়র কথাগুলো আওড়ালেন; ‘আপন বিশ্বাসে মত্ত। করিয়াছ স্থির শুধু দল বেঁধে সবে। সত্যের মীমাংসা হবে, শুধু উচ্চরবে?/ যুক্তি কিছু নাই?’ ফিরোজের বাবার অবসর বন্ধক দেওয়া ছিল ঠাকুরের হাতে। ফিরোজ যখন ছোট ছিল, এবং বাবার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, ঠাকুর তাকেও সঙ্গ দিতেন। তার ‘বীরপুরুষ’-এর আবৃত্তি শুনে পাশের বাসার সুজাতা ফিরোজের বাবাকে বলেছিল, ‘কাকা,
এরপর আর কি থাকা যায়?
খুলনায় এসে ওকালতি পেশাটা নতুন করে শুরু করতে তেমন সমস্যা হয়নি। ঘরও জুটেছিল একটা, সেটিও গুছিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু মনটা পড়ে থাকল বেক বাগানে। একদিন—এবং তত দিনে একাত্তর পার হয়ে গেছে—ভাঙা গলায় ফিরোজকে বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যদি বেঁচে থাকতেন, এই আগুন তাঁকেও পোড়াত।’ ফিরোজ মাথা নাড়ল। না, কথাটা ঠিক বললাম না। ফিরোজের ভেতরে একটা নকশাল-ফিরোজ ছিল। মাথাটা সে-ই নাড়ল। সে বলল, ‘রবীন্দ্রনাথের ঘোড়ার ডিম হতো। তিনি হয়তো ওই আগুনে একটু ওম পেতেন। এই যা।’ ফিরোজের বাবা তর্ক পছন্দ করতেন না। নিজের ছেলের সঙ্গে তো নয়ই। তিনি যুক্তিবাদী ছিলেন, দেখতেন, ছেলে যুক্তি মানে না, খালি আবেগ থেকে উঁচু গলায় কথা বলে। তিনি চুপ করে মনে মনে ঠাকুরের মালিনী থেকে সুপ্রিয়র কথাগুলো আওড়ালেন; ‘আপন বিশ্বাসে মত্ত। করিয়াছ স্থির শুধু দল বেঁধে সবে। সত্যের মীমাংসা হবে, শুধু উচ্চরবে?/ যুক্তি কিছু নাই?’ ফিরোজের বাবার অবসর বন্ধক দেওয়া ছিল ঠাকুরের হাতে। ফিরোজ যখন ছোট ছিল, এবং বাবার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, ঠাকুর তাকেও সঙ্গ দিতেন। তার ‘বীরপুরুষ’-এর আবৃত্তি শুনে পাশের বাসার সুজাতা ফিরোজের বাবাকে বলেছিল, ‘কাকা,
এ ছেলে একদিন কাজী সব্যসাচীকেও ছাড়িয়ে যাবে।’ সুজাতার দারুণ গানের গলা ছিল। মাঝে মাঝে বিকেলে আদালত থেকে ফিরে ফিরোজের বাবা সুজাতাকে ডেকে পাঠাতেন। বলতেন, ‘মা ওই গানটা গাইতে পারো? আজ সারা দিন মনে মনে গানটা বেজেছে। বড় শুনতে ইচ্ছে করছে।’ ফিরোজের মা বলতেন সুজাতা সম্পর্কে, ‘এ মেয়ের গলায় মালতী ঘোষাল বাজেন।’ সুজাতা ছিল সুদীপের বড় বোন। ফিরোজের ভেতর একটা যে নকশালী ছিল বলেছি, সে ছিল এক প্রক্সি-নকশালী, আসল নকশালী ছিল ওই সুদীপ। ১৯৬৪-তে যখন ফিরোজের বাবা দেশ ছাড়েন, সুদীপ তিন দিন ধরে কেঁদেছিল। চাপা স্বভাবের ছেলে, উদাসী মন। ফিরোজ ছিল তার একমাত্র বন্ধু। তারপর চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। ১৯৬৮-তে ফিরোজ খুলনা থেকে ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে যোগাযোগটা তরল হলো। ১৯৭১ সালে ছিন্নই হয়ে গেল যোগাযোগ। এর আগে বেশ কয়েক মাস থেকেই ফিরোজ বুঝতে পারছিল, সুদীপের ভেতরে একটা পরিবর্তন আসছে। চরম বামপন্থী হচ্ছে, ফিরোজকেও উৎসাহ দিচ্ছে তার রাস্তায় যেতে।
২. ১৯৭১ সালে আরেকবার ঘর ছাড়তে হলো ফিরোজের বাবাকে। স্ত্রী আর তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ফের কলকাতা, তবে এবার কলকাতা হয়ে মালদা, এক মামাতো ভাইয়ের আশ্রয়ে। মালদা গিয়ে ফিরোজ যোগাযোগের চেষ্টা করেছে সুদীপের সঙ্গে, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। তারপর সে নাম লিখেয়েছে মুক্তিবাহিনীতে। এক ফাঁকে বেক বাগান গিয়ে কড়া নেড়েছে সুদীপের দরজায়। দরজা খুলেছে সুজাতা। ফিরোজকে দেখে সে অবাক হলো, খুশি হলো, উচ্ছ্বাস দেখাল, আবার ভয়ও পেল। একটানে ঘরের ভেতর নিয়ে ফিরোজকে বলল, ‘সুদীপের খোঁজ করাটা বিপজ্জনক।’ কেন বিপজ্জনক, তাও ব্যাখ্যা করল। তারপর চোখের পানি মুছে ফিরোজের গালে হাত বুলিয়ে বলল, ‘সাবধানে থাকিস, বুম্বা।’ বুম্বা নামটা দুই বছর বয়সে ফিরোজ নিজেকেই দিয়েছিল। সেই নামে বরাবর সুজাতা তাকে ডাকত। যুদ্ধ শেষ হলে দেশে ফিরতে হলো ফিরোজকে, যদিও তার ইচ্ছা ছিল সুদীপের তালাশ করে তার সঙ্গে নকশালী যুদ্ধে শরিক হওয়ার। সুজাতা তাকে জানিয়েছিল, নকশালী চিন্তা কীভাবে মূল ধরে সুদীপকে টান দিয়েছিল, তাকে বদলে দিয়েছিল। ফিরোজ জিজ্ঞেস করেছিল সুজাতার পড়াশোনা, গান গাওয়া নিয়ে। সব ছেড়ে ঘরে ঠাঁই নিয়েছিল সুজাতা। সুদীপ চলে যাওয়ার আগে তাকে জানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিক্রিয়াশীলের গান সে গাইলে তার সঙ্গে সুদীপের ছাড়াছাড়ি হবে। ‘রবীন্দ্রনাথ কেন প্রতিক্রিয়াশীল হবেন?’ ফিরোজ জিজ্ঞেস করেছিল অনেকটা বিস্ময় নিয়ে। ফিরোজের কাঁধটা এক হাতে চেপে ধরে এরপর সুজাতা তাকে বুঝিয়েছিল কেন রবীন্দ্রনাথ প্রতিক্রিয়াশীল। সুজাতার চোখ জ্বলছিল, তার গলার আওয়াজ ফিরোজকে ভুলিয়ে দিয়েছিল একদিন এই গলায় মালতী ঘোষাল বাজতেন। ফিরোজের ভেতরের যে নকশালীর কথা বলেছিলাম, ফিরোজের হয়ে যে কথা বলত, সে বোধ হয় ছিল সুজাতাই। হ্যাঁ।
৩. সুজাতা এরপর একবারই যোগাযোগ করেছিল ফিরোজের সঙ্গে। একটা ছোট চিঠি লিখেছিল, বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে, তাতে জানিয়েছিল, ডিসেম্বরে সুদীপকে পুলিশ মেরে ফেলে। প্রথম খুব পিটুনি দিয়েছে, হাত-পায়ের হাড়গুলো সব ভেঙে দিয়েছে, পাঁজরেরও। তারপর তিনটি গুলি করেছে। গুলি তিনটিই বুকে লেগেছে। চিঠি পেয়ে স্তব্ধ বসে ছিল ফিরোজ। অনেকক্ষণ। তারপর উঠে গিয়ে বাবাকে বলতে গেছে—বাবা ছিন্নপত্র পড়ছিলেন। নিজে খুব ঘরকুনো মানুষ ছিলেন, সে জন্য ছিন্নপত্র পড়তে আলাদা আনন্দ পেতেন, যেন ঠাকুরের সঙ্গে তিনিও বিশ্বসংসারের ভেতর দিয়ে শুধু ভেসে যাচ্ছেন। তাঁর হাত থেকে ছিন্নপত্র নিয়ে রাস্তায় ফেলে এসেছিল ফিরোজ। যেন সুদীপকে পুলিশ মারেনি, মেরেছেন ঠাকুর।
৪. ফিরোজের মুখে লুম্পেন-বুর্জোয়া, মধ্যস্বত্বভোগী, প্রতিক্রিয়াশীল—এসব কথা খইয়ের মতো ফুটত। আমাদের মুখেও। কিন্তু ও যখন এসব বলত, অথবা বলত ‘একদিন সর্বহারারা জাগবে,’ কেন যেন একটা খুব প্রত্যয় তৈরি হতো; মনে হতো, দিনটা এই এল বলে। তবে যা আমাদের অবাক করত, প্রতিক্রিয়াশীলদের তালিকায় বিদ্যাসাগর আর রবীন্দ্রনাথের নাম শুনে, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের। মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের এ রকম একটা বিশ্বাস জেগেছিল যে দেশটা এবার সর্বহারাদের হাতে যাবে, তারা সংগঠিত হয়ে এটি চালাবে। আমাদের মানে ফিরোজ, মিজান, আমি আর সুমন। আমরা সবাই ছিলাম মার্ক্সে ও পরে মাওয়ে নিবেদিত ঘোরতর বাম। এতটাই যে পড়াশোনা প্রায় লাটে উঠেছিল। দিনে-রাতে একটাই চিন্তা, সমাজতন্ত্রের এবং কমরেড মাওয়ের মডেলের বিপ্লবের। আমাদের টেবিলে জমা হতে লাগল বিপ্লবের বইপত্র, আমাদের মগজে ভর করতে থাকল দিনবদলের চিন্তা। তার পরও কেন জানি সুমনটা গান গাইত। ফিরোজ সামনে না থাকলে রবীন্দ্রসংগীত। অপূর্ব গলায়। আর ফিরোজ থাকলে লোকগান। অপূর্ব গলায়। আর মিজান পকেটে রাখা নোটবইতে লিখত কবিতা। শ্রেণিসংগ্রামের। বিপ্লবের। এবং অবাক, প্রেমের।
২. ১৯৭১ সালে আরেকবার ঘর ছাড়তে হলো ফিরোজের বাবাকে। স্ত্রী আর তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ফের কলকাতা, তবে এবার কলকাতা হয়ে মালদা, এক মামাতো ভাইয়ের আশ্রয়ে। মালদা গিয়ে ফিরোজ যোগাযোগের চেষ্টা করেছে সুদীপের সঙ্গে, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। তারপর সে নাম লিখেয়েছে মুক্তিবাহিনীতে। এক ফাঁকে বেক বাগান গিয়ে কড়া নেড়েছে সুদীপের দরজায়। দরজা খুলেছে সুজাতা। ফিরোজকে দেখে সে অবাক হলো, খুশি হলো, উচ্ছ্বাস দেখাল, আবার ভয়ও পেল। একটানে ঘরের ভেতর নিয়ে ফিরোজকে বলল, ‘সুদীপের খোঁজ করাটা বিপজ্জনক।’ কেন বিপজ্জনক, তাও ব্যাখ্যা করল। তারপর চোখের পানি মুছে ফিরোজের গালে হাত বুলিয়ে বলল, ‘সাবধানে থাকিস, বুম্বা।’ বুম্বা নামটা দুই বছর বয়সে ফিরোজ নিজেকেই দিয়েছিল। সেই নামে বরাবর সুজাতা তাকে ডাকত। যুদ্ধ শেষ হলে দেশে ফিরতে হলো ফিরোজকে, যদিও তার ইচ্ছা ছিল সুদীপের তালাশ করে তার সঙ্গে নকশালী যুদ্ধে শরিক হওয়ার। সুজাতা তাকে জানিয়েছিল, নকশালী চিন্তা কীভাবে মূল ধরে সুদীপকে টান দিয়েছিল, তাকে বদলে দিয়েছিল। ফিরোজ জিজ্ঞেস করেছিল সুজাতার পড়াশোনা, গান গাওয়া নিয়ে। সব ছেড়ে ঘরে ঠাঁই নিয়েছিল সুজাতা। সুদীপ চলে যাওয়ার আগে তাকে জানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিক্রিয়াশীলের গান সে গাইলে তার সঙ্গে সুদীপের ছাড়াছাড়ি হবে। ‘রবীন্দ্রনাথ কেন প্রতিক্রিয়াশীল হবেন?’ ফিরোজ জিজ্ঞেস করেছিল অনেকটা বিস্ময় নিয়ে। ফিরোজের কাঁধটা এক হাতে চেপে ধরে এরপর সুজাতা তাকে বুঝিয়েছিল কেন রবীন্দ্রনাথ প্রতিক্রিয়াশীল। সুজাতার চোখ জ্বলছিল, তার গলার আওয়াজ ফিরোজকে ভুলিয়ে দিয়েছিল একদিন এই গলায় মালতী ঘোষাল বাজতেন। ফিরোজের ভেতরের যে নকশালীর কথা বলেছিলাম, ফিরোজের হয়ে যে কথা বলত, সে বোধ হয় ছিল সুজাতাই। হ্যাঁ।
৩. সুজাতা এরপর একবারই যোগাযোগ করেছিল ফিরোজের সঙ্গে। একটা ছোট চিঠি লিখেছিল, বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে, তাতে জানিয়েছিল, ডিসেম্বরে সুদীপকে পুলিশ মেরে ফেলে। প্রথম খুব পিটুনি দিয়েছে, হাত-পায়ের হাড়গুলো সব ভেঙে দিয়েছে, পাঁজরেরও। তারপর তিনটি গুলি করেছে। গুলি তিনটিই বুকে লেগেছে। চিঠি পেয়ে স্তব্ধ বসে ছিল ফিরোজ। অনেকক্ষণ। তারপর উঠে গিয়ে বাবাকে বলতে গেছে—বাবা ছিন্নপত্র পড়ছিলেন। নিজে খুব ঘরকুনো মানুষ ছিলেন, সে জন্য ছিন্নপত্র পড়তে আলাদা আনন্দ পেতেন, যেন ঠাকুরের সঙ্গে তিনিও বিশ্বসংসারের ভেতর দিয়ে শুধু ভেসে যাচ্ছেন। তাঁর হাত থেকে ছিন্নপত্র নিয়ে রাস্তায় ফেলে এসেছিল ফিরোজ। যেন সুদীপকে পুলিশ মারেনি, মেরেছেন ঠাকুর।
৪. ফিরোজের মুখে লুম্পেন-বুর্জোয়া, মধ্যস্বত্বভোগী, প্রতিক্রিয়াশীল—এসব কথা খইয়ের মতো ফুটত। আমাদের মুখেও। কিন্তু ও যখন এসব বলত, অথবা বলত ‘একদিন সর্বহারারা জাগবে,’ কেন যেন একটা খুব প্রত্যয় তৈরি হতো; মনে হতো, দিনটা এই এল বলে। তবে যা আমাদের অবাক করত, প্রতিক্রিয়াশীলদের তালিকায় বিদ্যাসাগর আর রবীন্দ্রনাথের নাম শুনে, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের। মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের এ রকম একটা বিশ্বাস জেগেছিল যে দেশটা এবার সর্বহারাদের হাতে যাবে, তারা সংগঠিত হয়ে এটি চালাবে। আমাদের মানে ফিরোজ, মিজান, আমি আর সুমন। আমরা সবাই ছিলাম মার্ক্সে ও পরে মাওয়ে নিবেদিত ঘোরতর বাম। এতটাই যে পড়াশোনা প্রায় লাটে উঠেছিল। দিনে-রাতে একটাই চিন্তা, সমাজতন্ত্রের এবং কমরেড মাওয়ের মডেলের বিপ্লবের। আমাদের টেবিলে জমা হতে লাগল বিপ্লবের বইপত্র, আমাদের মগজে ভর করতে থাকল দিনবদলের চিন্তা। তার পরও কেন জানি সুমনটা গান গাইত। ফিরোজ সামনে না থাকলে রবীন্দ্রসংগীত। অপূর্ব গলায়। আর ফিরোজ থাকলে লোকগান। অপূর্ব গলায়। আর মিজান পকেটে রাখা নোটবইতে লিখত কবিতা। শ্রেণিসংগ্রামের। বিপ্লবের। এবং অবাক, প্রেমের।
ফিরোজ বলত, বিপ্লব আর গান একসঙ্গে চলে না। বিপ্লব আর কবিতাতে ঠুকোঠুকি লাগে। ‘চ্যুজ ওয়ান,’ সে রেগে বলত, ‘লাভ ওর রিভল্যুশন।’ রাগলে নির্ভুল ইংরেজি বলত ফিরোজ। ফিরোজের বাবার চিঠি এল একদিন। চিঠি পেয়ে কথা হারিয়ে ফেলল ফিরোজ। চোখ দুটি হয়ে গেল মরা মার্বেলের মতো। কী লিখেছিলেন ফিরোজের বাবা? লিখেছিলেন, সুজাতা মারা গেছে। না গত দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে নয়, মারা গেছে বাহাত্তরের মার্চে। সেই পুলিশের হাতে। সুজাতা ভাইয়ের মৃত্যুর বদলা নিতে চেয়েছিল। কিন্তু বদলা নিতে গিয়ে সহায়তার জন্য নকশাল খুঁজে খুঁজে বেড়ালে তো পুলিশের নজরে আসবেই। এক টিকটিকি নকশাল সেজে তার হাতে একটা মরা বোমা তুলে দিয়েছিল এবং সেটি বুকে বেঁধে সুজাতা ঢুকে গিয়েছিল এক পুলিশ ফাঁড়িতে। সেই খবর ফিরোজের বাবার কানে পৌঁছায় নয় মাস পর। না, চিঠিতে এতসব কথা লেখা ছিল না। এসব আমরা পরে জেনেছি। ফিরোজের সেই মালদার চাচা এসব খবর নিয়ে খুলনা এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মেয়েটা যে এত বোকা, কেউ ভাবতে পারেনি। না, সুজাতা বোকা ছিল না। সে ছিল বেপরোয়া। মানুষের বুক থেকে ভালোবাসার ধন ছিনিয়ে নিলে মানুষ বোকা বনে যায় না, বরং পরোয়া করা ছেড়ে দেয়।
৫. একদিন শুনলাম, আমাদের পুলিশ খুঁজছে। শেষ পরীক্ষার চার মাসের মতো বাকি। এখন পুলিশ ধরলে পরীক্ষা শেষ। পালাতে হবে। তত দিনে আমাদের শ্রেণিসংগ্রাম মনে মনে সশস্ত্র হচ্ছে। কিন্তু হাতে অস্ত্র নেই। অস্ত্র কেন তাও জানি না। কী করা যায়? কুষ্টিয়াতে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন আমার দুলু মামা। আমার ছোটবেলার রোল মডেল। আমাদের জরুরি ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘এখন পনেরো-কুড়ি দিন নৌকায় থাকো। ঘুরে বেড়াও। নৌকাটা সবচেয়ে নিরাপদ। কোনো তল্লাশি নেই। এর মধ্যে আমি একটা বিহিত করব। তবে নৌকায় শুধু লুঙ্গি গেঞ্জি পরে থাকতে হবে। সর্বহারা যেহেতু, অসুবিধা হবে না, আশা করি,’ কিছুটা শ্লেষ নিয়ে বললেন দুলু মামা। ‘নৌকায়? পনেরো-কুড়ি দিন?’ ফিরোজ জিজ্ঞেস করল। ‘হ্যাঁ, এবং তৈরি হও,’ মামা বললেন। আমার মাথায় হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল। ‘মামা’ আমি বললাম, ‘যদি নৌকাতেই থাকতে হয়, ঘুরে বেড়াতে হয়, তাহলে শিলাইদহ থেকে শুরু কেন নয়।’ দুলু মামা হাসলেন। শিলাইদহ তাঁর অতি প্রিয়। কুঠিবাড়ির ছাদে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তিনি মামির গলায় শুনেছেন, ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে।’ মামি লাজলজ্জা ছাড়াই কথাটি আমাদের বলেছিলেন। ফিরোজ বেঁকে বসল। প্রতিক্রিয়াশীলতার তীর্থকেন্দ্র শিলাইদহ থেকে কিছুতেই নয়। শেষ পর্যন্ত রফা হলো, শিলাইদহ থেকে পাঁচ মাইল উজানে।
৫. একদিন শুনলাম, আমাদের পুলিশ খুঁজছে। শেষ পরীক্ষার চার মাসের মতো বাকি। এখন পুলিশ ধরলে পরীক্ষা শেষ। পালাতে হবে। তত দিনে আমাদের শ্রেণিসংগ্রাম মনে মনে সশস্ত্র হচ্ছে। কিন্তু হাতে অস্ত্র নেই। অস্ত্র কেন তাও জানি না। কী করা যায়? কুষ্টিয়াতে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন আমার দুলু মামা। আমার ছোটবেলার রোল মডেল। আমাদের জরুরি ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘এখন পনেরো-কুড়ি দিন নৌকায় থাকো। ঘুরে বেড়াও। নৌকাটা সবচেয়ে নিরাপদ। কোনো তল্লাশি নেই। এর মধ্যে আমি একটা বিহিত করব। তবে নৌকায় শুধু লুঙ্গি গেঞ্জি পরে থাকতে হবে। সর্বহারা যেহেতু, অসুবিধা হবে না, আশা করি,’ কিছুটা শ্লেষ নিয়ে বললেন দুলু মামা। ‘নৌকায়? পনেরো-কুড়ি দিন?’ ফিরোজ জিজ্ঞেস করল। ‘হ্যাঁ, এবং তৈরি হও,’ মামা বললেন। আমার মাথায় হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল। ‘মামা’ আমি বললাম, ‘যদি নৌকাতেই থাকতে হয়, ঘুরে বেড়াতে হয়, তাহলে শিলাইদহ থেকে শুরু কেন নয়।’ দুলু মামা হাসলেন। শিলাইদহ তাঁর অতি প্রিয়। কুঠিবাড়ির ছাদে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তিনি মামির গলায় শুনেছেন, ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে।’ মামি লাজলজ্জা ছাড়াই কথাটি আমাদের বলেছিলেন। ফিরোজ বেঁকে বসল। প্রতিক্রিয়াশীলতার তীর্থকেন্দ্র শিলাইদহ থেকে কিছুতেই নয়। শেষ পর্যন্ত রফা হলো, শিলাইদহ থেকে পাঁচ মাইল উজানে।
৬. আমরা নৌকায় শুয়ে বসে সময় কাটাই, শ্রেণিসংগ্রামের স্বপ্ন দেখি, সর্বহারাদের বিজয়ের ছবি আঁকি, কিন্তু একটা সময় (ফিরোজের বাবার দেওয়া) ছিন্নপত্র পড়ি। সুমন গান গায়। একদিন সে হঠাৎ গেয়ে উঠল ‘আজ কেমন করে গাইছে আকাশ...’ গানের মুখটা শেষও হয়নি, হঠাৎ যেন আকাশ ফেটে বাজ হানল। ‘খবরদার’ ফিরোজ বলল, ‘খবরদার।’ প্রথম খবরদার এ জন্য, গানটা ঠাকুরের; দ্বিতীয় খবরদার, ফিরোজ নিজেই রাগ নিয়ে বলল, এ গানটি সুজাতাদির বিশেষ প্রিয় ছিল। আমার হাত থেকে একদিন ছিন্নপত্র নিয়ে ফেলে দিতে গিয়েছিল ফিরোজ, কিন্তু দিল না। বরং বইটি হাতে বসে রইল চুপচাপ। খুব আস্তে করে বলল, ‘বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।’ অর্থাৎ তাঁর হাত থেকে ছিন্নপত্র নিয়ে ফেলে দেওয়ায়। এরপর একদিন দেখলাম গলুইতে হেলান দিয়ে বসে আছে ফিরোজ, তার হাতে ছিন্নপত্র। কিন্তু তার চোখ পদ্মার চরে।
৭. এক রাতে অপার্থিব জ্যোৎস্না উঠল, নৌকা তখন চৌহালির ধারে-কাছে। নদীর ওপর জ্যোৎস্নার একটা উদাস করা ভাব আছে; ঘোর ধরানো টান আছে, মানুষকে বদলে ফেলার, তার মাথার ভেতরে ভয়ানক ওলট-পালট করার কারসাজি আছে, যা শহরের মানুষ কস্মিনকালেও টের পাবে না। পদ্মার ওপর বিশাল চর। জ্যোৎস্নায় বালু চিকচিক করে। আমাদের নৌকার দুই মাঝির একজন মালিক ভাই বললেন, ‘নৌকাটা বান্ধি?’ ‘কেন?’ ফিরোজ জিজ্ঞেস করে। মালিক ভাই উত্তর দেন না। জ্যোৎস্না পাওয়া মানুষ কোনো প্রশ্নের ধার ধারে না। তিনি নৌকা বেঁধে চরে নেমে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, ‘রাইতটা এইখানে কাটাব।’
৮. অনেক রাতে, জ্যোৎস্না যখন আকন্দের রসের মতো সাদা আর চিতল মাছের পেটের মতো চিকচিক, ফিরোজও তখন চরে পা ফেলল। তার চোখ দূরে মেলা। আমরা নেশা পাওয়া মানুষের মতো পা ফেলে ফেলে হাঁটতে লাগলাম। এবং শুনলাম, কেউ একজন গাইছে, ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে...’ ফিরোজ দৌড় দিল, যতখানি দৌড় চরে দেওয়া সম্ভব। একসময় সে থেমেও গেল। ‘সুজাতাদি?’ ‘কেমন আছিসরে বুম্বা? আয়, বোস, গান, শোন,’ সুজাতাদি বললেন। বুম্বা মানে আমাদের ফিরোজ বালুতে বসে পড়ল। সুজাতাদি বললেন ‘তোরাও বোস।’ তারপর তিনি বললেন, ‘সুদীপ, তুইও।’ সুদীপও বসল আমাদের সঙ্গে। সুদীপকে দেখে আমাদের হতবাক হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কেউ অবাক হলো না, ফিরোজ তো মোটেও না। ‘এই চরের বালুর মধ্যে গানের রেখা আঁকা আছে,’ সুজাতাদি বললেন, ‘এই রেখা কোথা থেকে শুরু, কোথায় এদের শেষ, কেউ জানে না। এগুলোকে বলে সঙ লাইনস। আমাদের আদি যাযাবর পুরুষেরা এইসব গানরেখা এঁকে দিতেন যেখানে যেখানে তাঁরা যেতেন—যাতে একটু কান পেতে রাখলেই সেগুলো ধরা দেয়, আর তাঁদের দেখানো পথচলা সহজ হয় তাঁদের পরে আসা সকলের জন্য’, তারপর তিনি গাইলেন ‘আমি কান পেতে রই।’ গান গাওয়া হয়ে গেলে তাকালেন দূরে। আলখাল্লা পরা একজন সাদা দাড়ির মানুষ চর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁর পায়ের আঘাতে উড়তে থাকা ধূলিতে জ্যোৎস্না সুর তুলছে। ‘ওই গানগুলোর কোনোটা তোরা পারিস?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন। ‘সুমন সবগুলো পারে,’ ফিরোজ বলল। তারপর সুমন গাইল ‘সার্থক জনম আমার...
৭. এক রাতে অপার্থিব জ্যোৎস্না উঠল, নৌকা তখন চৌহালির ধারে-কাছে। নদীর ওপর জ্যোৎস্নার একটা উদাস করা ভাব আছে; ঘোর ধরানো টান আছে, মানুষকে বদলে ফেলার, তার মাথার ভেতরে ভয়ানক ওলট-পালট করার কারসাজি আছে, যা শহরের মানুষ কস্মিনকালেও টের পাবে না। পদ্মার ওপর বিশাল চর। জ্যোৎস্নায় বালু চিকচিক করে। আমাদের নৌকার দুই মাঝির একজন মালিক ভাই বললেন, ‘নৌকাটা বান্ধি?’ ‘কেন?’ ফিরোজ জিজ্ঞেস করে। মালিক ভাই উত্তর দেন না। জ্যোৎস্না পাওয়া মানুষ কোনো প্রশ্নের ধার ধারে না। তিনি নৌকা বেঁধে চরে নেমে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, ‘রাইতটা এইখানে কাটাব।’
৮. অনেক রাতে, জ্যোৎস্না যখন আকন্দের রসের মতো সাদা আর চিতল মাছের পেটের মতো চিকচিক, ফিরোজও তখন চরে পা ফেলল। তার চোখ দূরে মেলা। আমরা নেশা পাওয়া মানুষের মতো পা ফেলে ফেলে হাঁটতে লাগলাম। এবং শুনলাম, কেউ একজন গাইছে, ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে...’ ফিরোজ দৌড় দিল, যতখানি দৌড় চরে দেওয়া সম্ভব। একসময় সে থেমেও গেল। ‘সুজাতাদি?’ ‘কেমন আছিসরে বুম্বা? আয়, বোস, গান, শোন,’ সুজাতাদি বললেন। বুম্বা মানে আমাদের ফিরোজ বালুতে বসে পড়ল। সুজাতাদি বললেন ‘তোরাও বোস।’ তারপর তিনি বললেন, ‘সুদীপ, তুইও।’ সুদীপও বসল আমাদের সঙ্গে। সুদীপকে দেখে আমাদের হতবাক হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কেউ অবাক হলো না, ফিরোজ তো মোটেও না। ‘এই চরের বালুর মধ্যে গানের রেখা আঁকা আছে,’ সুজাতাদি বললেন, ‘এই রেখা কোথা থেকে শুরু, কোথায় এদের শেষ, কেউ জানে না। এগুলোকে বলে সঙ লাইনস। আমাদের আদি যাযাবর পুরুষেরা এইসব গানরেখা এঁকে দিতেন যেখানে যেখানে তাঁরা যেতেন—যাতে একটু কান পেতে রাখলেই সেগুলো ধরা দেয়, আর তাঁদের দেখানো পথচলা সহজ হয় তাঁদের পরে আসা সকলের জন্য’, তারপর তিনি গাইলেন ‘আমি কান পেতে রই।’ গান গাওয়া হয়ে গেলে তাকালেন দূরে। আলখাল্লা পরা একজন সাদা দাড়ির মানুষ চর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁর পায়ের আঘাতে উড়তে থাকা ধূলিতে জ্যোৎস্না সুর তুলছে। ‘ওই গানগুলোর কোনোটা তোরা পারিস?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন। ‘সুমন সবগুলো পারে,’ ফিরোজ বলল। তারপর সুমন গাইল ‘সার্থক জনম আমার...
৯. আরও অনেক রাতে মনে হলো, চরটা খুব সুনসান, যেন কোনো দিন এর বালুতে কারও পা পড়েনি। কেউ লিখে রাখেনি এর কোনো বিবরণ। তা তো বটেই, পদ্মা-যমুনার কোনো চরই তো দীর্ঘজীবী নয়। তার পরও কেন আমাদের মনে হলো, রাত আরও গাঢ় হলে, রুপালি আলখাল্লা পরে কেউ একজন চাষির মতো বুনে চলেছে গানের পর গান, এর বালুতে যখন অবাক করা জ্যোৎস্না প্রেমিকার চোখের মতো বুজে আসে, আবেশে?
১০. সকালে মালিক ভাই বললেন, ‘রাতে কী অইছিল আপনাদের? জ্বরটর, নাকি নেশাটেশা করেছিলেন?’ হাহ্।
১০. সকালে মালিক ভাই বললেন, ‘রাতে কী অইছিল আপনাদের? জ্বরটর, নাকি নেশাটেশা করেছিলেন?’ হাহ্।
No comments