খেলাপি বনাম সদাচারী ঋণগ্রহীতা by ফারুক মঈনউদ্দীন
অবশেষে
বাংলাদেশ ব্যাংক সদাচারী ঋণগ্রহীতাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনামূলক নীতিমালা
প্রবর্তন করে তাঁদের পুরস্কৃত করার উদ্যোগ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
সাম্প্রতিকতম এক সার্কুলারে সদাচারী বা ভালো ঋণগ্রহীতাদের সংজ্ঞায়িত করে
তাঁদের জন্য সুদের হারে বিশেষ ছাড়ের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। এ কথা সত্যি, আমাদের দেশে কারণে-অকারণে খেলাপি
ঋণগ্রহীতাদের পুনঃতফসিলীকরণ, সুদ মওকুফসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়ার
ব্যবস্থা ও নজির থাকলেও নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারী গ্রহীতাদের জন্য কোনো
সুবিধা বা ছাড়ের ব্যবস্থা নেই। বরং কোনো গ্রহীতা যদি দীর্ঘমেয়াদি ঋণ
মেয়াদপূর্তির আগে সমন্বয় করে দিতে চান, এর জন্য উল্টো আর্লি সেটেলমেন্ট ফি
নামে জরিমানা আদায় করার বিধান রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী—চলমান, তলবি ও মেয়াদি—সব ধরনের ঋণ হিসাব বিগত তিন বছরের জন্য নিয়মিত বা স্ট্যান্ডার্ড থাকলে সেই ঋণ হিসাবধারীকে ভালো ঋণগ্রহীতা বলে বিবেচনা করা যাবে। তবে আগের তিন বছরের কোনো এক সময়ে গ্রহীতাদের কেউ বা তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যদি কোনো ব্যাংকে বিরূপ মানে শ্রেণীকৃত হয়, তাহলে তাঁরা ভালো ঋণগ্রহীতা হিসেবে বিবেচিত হবেন না।
সদাচারী ঋণগ্রহীতাদের জন্য যে প্রণোদনা দিতে হবে, তার সুনির্দিষ্ট বিধিমালাও প্রণয়ন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলমান ঋণ, তলবি ঋণ কিংবা মেয়াদি ঋণ—সব ক্ষেত্রেই পর পর তিন বছর ঋণ অনুমোদনের শর্ত অনুযায়ী ঋণ পরিশোধ করলে তৃতীয় বছরের আদায়কৃত মোট সুদের ওপর কমপক্ষে ১০ শতাংশ ছাড় দিতে হবে। পরবর্তী বছর শেষে ভালো ঋণগ্রহীতা হিসেবে চিহ্নিত থাকলে কিংবা মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করলে পরের বছরও ছাড়ের এই বিশেষ সুবিধা বহাল থাকবে। এ ছাড়া গ্রহীতার ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তাঁরা বর্ধিত ঋণসুবিধা পাওয়ার যোগ্য বলেও বিবেচিত হবেন।
দেশের চলমান ঋণ সংস্কৃতিতে সদাচারী গ্রহীতারা বরাবরই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যান, বরং খেলাপি ও বড় গ্রহীতারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিভিন্ন উপায়ে প্রচারণা পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এই নতুন নীতিমালায় সদাচারী ঋণগ্রহীতাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বীকৃতি বা পুরস্কার দিয়ে তাঁদের সামাজিকভাবে উচ্চাসনে তুলে ধরার জন্যও ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিয়েছে। এই বিশেষ উদ্যোগটি পল্লি, উপজেলা ও ছোট জেলা সদরের ব্যাংক শাখার গ্রাহকদের মধ্যে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, এ রকম পাদপ্রদীপের আলোয় আসার সুযোগ তাঁদের কমই ঘটে। তবে ব্যাংকিং খাতের অনেকেই বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছেন না। তাঁদের বক্তব্য, ভালো ঋণগ্রহীতাদের ব্যাংক প্রথম থেকেই সুদের হারে সুবিধা দিয়ে থাকে। তার ওপর যদি আবার তিন বছর সদাচারী থাকার জন্য আদায়কৃত সুদের অংশ ফেরত দিতে হয়, সেটি ব্যাংকের আয়ের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
এই প্রণোদনা প্রবর্তনের মাস দুয়েক আগে সুবৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের ঋণ হিসাবগুলোকে সহজ শর্তে পুনর্গঠিত করার নতুন যে নীতিমালা ঘোষিত হয়, সেটির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার জন্যই হয়তো সদাচারী ঋণগ্রহীতাদের পুরস্কৃত করা ও স্বীকৃতি দেওয়ার এই উদ্যোগ। কারণ, নতুন নীতিমালায় ৫০০ কোটি টাকার চেয়ে বেশি ঋণ পুনর্গঠনের জন্য যেসব শিথিল শর্ত প্রণয়ন করা হয়, সেগুলো এই অঙ্কের নিচের গ্রহীতাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। আবার ঋণের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি হলে এসব শর্তের অন্তত একটি (ডাউন পেমেন্ট) আরও কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ঋণ পুনর্গঠনের এই সুযোগ যে কেবল সুবৃহৎ খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে তা নয়, মেয়াদোত্তীর্ণ নয় এমন ঋণও এই নীতিমালার অধীনে সর্বোচ্চ ১২ বছরের জন্য পুনর্গঠন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব বিশাল ঋণ হিসাবের ওপর সুদের হারও নির্ধারণ করা যাবে বিশেষ ছাড়ে, তবে ব্যাংকের তহবিল ব্যয়ের সঙ্গে ১ শতাংশ যোগ করলে যা হয় তার চেয়ে কম নয়। অবশ্য ব্যাংকের তহবিল ব্যয়ের সঙ্গে ১ শতাংশ যোগ করলেও পুনর্গঠিত ঋণের ওপর ধার্য করা এই সুদের হার ব্যাংকের জন্য কোনোভাবেই লাভজনক হবে না।
এই নীতিমালা প্রণয়নের যৌক্তিকতা হিসেবে বলা হয়েছে যে আর্থসামাজিক ও কর্মসংস্থানের নিরিখে বৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বিধায় ঋণ আদায়ের স্বার্থে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশের মোট কর্মসংস্থানে ও জিডিপিতে ৫০০ কোটি টাকার ওপর ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট কী পরিমাণ অবদান আছে, কিংবা তাঁদের অবদান ৫০০ কোটি টাকার কম ঋণগ্রহীতাদের চেয়ে বেশি কি না, সে বিষয়ে একটা সংগত প্রশ্ন থেকেই যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোর অস্থিরতার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়াও যদি হয় এই নতুন নীতিমালার উদ্দেশ্য, তাহলেও ৫০০ কোটি টাকার নিচের গ্রহীতারা এই সুবিধা থেকে কেন বঞ্চিত হবেন, সে প্রশ্নেরও কোনো জবাব আমরা দিতে পারছি না। যদি বহির্দেশীয় কিংবা অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সুবৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো এই ঋণ পুনর্গঠন–সুবিধা পায়, তাহলে সেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল কিংবা নির্ভরশীল নয় এমন অপেক্ষাকৃত ছোট বা মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোও কেন একই কারণে এই সুবিধা পাবে না, তার কোনো সদুত্তরও ব্যাংকাররা দিতে পারছেন না।
মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা যখন আমাদের তারকা খেলাপিসহ সুবৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের এ রকম ঢালাও ছাড় দিচ্ছি, ঠিক তখনই ভারতে খেলাপি ঋণের প্রবণতা রোধে আরেক প্রস্থ কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘অসহযোগী’ (নন-কো-অপারেটিভ) ঋণগ্রহীতা নাম দিয়ে একটা নতুন শ্রেণি চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। পাঁচ কোটি রুপির বেশি সব ধরনের ঋণ এই শ্রেণির আওতাভুক্ত। কয়েক বছর আগে ইচ্ছাকৃত (উইলফুল) খেলাপি নামে যে নতুন শ্রেণীকরণ করা হয়েছিল, এটি তার পরের ধাপ। ‘অসহযোগী’ ঋণগ্রহীতা বলতে তাঁদের বোঝানো হচ্ছে, যাঁরা সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করেন না, বরং ব্যাংকের ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য গোপন করেন, নিজেদের আর্থিক সংগতি বা জামানত সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহে বাধা দিয়ে কিংবা সহায়ক জামানত বিক্রি করে ঋণ আদায়ের জন্য ঋণদাতা ব্যাংকের সব তৎপরতাকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংজ্ঞানুযায়ী, এই শ্রেণির ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের টাকা তো ফেরত দেনই না, বরং ঋণের টাকা সরিয়ে ফেলে ভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেন কিংবা বন্ধকীকৃত অস্থাবর সম্পদ ব্যাংকের অগোচরে বিক্রি করে দেন। বস্তুত, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তহবিল সরিয়ে ফেলার (ফান্ড ডাইভারশন) বিষয়টি প্রমাণসাপেক্ষ বলে ব্যাংকগুলোকে এই শ্রেণীকরণ করতে গিয়ে নানা আইনি জটিলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছিল। এই বাধা এড়ানোর জন্য নতুন শ্রেণীকরণের এই উদ্যোগ। কারণ, অসহযোগী ঋণগ্রহীতাদের বিষয়ে এ রকম কোনো প্রমাণের আবশ্যকতা নেই।
উল্লেখ্য, গত বছরের শেষে ভারতের কিংফিশার এয়ারলাইনসের প্রায় সাত হাজার কোটি রুপি খেলাপি ঋণ আদায়ের উদ্দেশ্যে কলকাতার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কিংফিশার বিয়ার খ্যাত বিজয় মালিহাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঘোষণা করার পর সে দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রকদের টনক নড়ে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য কলকাতা হাইকোর্ট এই ঘোষণাকে স্থগিত করে দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দরিদ্র ও কৃষকবান্ধব ব্যাংকিং, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথক সেল গঠন, গ্রিন ব্যাংকিংসহ মানবিক ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন প্রশংসনীয় ও অনন্য উদ্যোগের পাশাপাশি ৫০০ কোটি টাকা এবং তদূর্ধ্ব ঋণ পুনর্গঠনের একপেশে ছাড়ের বিধানটি আদৌ বাংলাদেশ ব্যাংক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করেছে কি না, সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে বিজ্ঞ সমাজের। কারণ, কয়েক বছর আগে সরকার যখন খোলামেলা স্বীকার করেই রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রয়োজনহীনভাবে কিছু নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই প্রভাবকে বাধা দিতে পারেনি।
অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, আমাদের দেশের খেলাপি ঋণ সংস্কৃতিতে বড় গ্রহীতারা সব সময়ই সুদ মওকুফ, হ্রাসকৃত সুদ, দীর্ঘমেয়াদি কিস্তি–সুবিধাসহ নানা ধরনের ছাড় পেয়ে আসছেন, অথচ এই তারকা খেলাপিরা ঋণ পরিশোধের জন্য তাঁদের জীবনযাপনের কোনো স্বাচ্ছন্দ্য কখনো উৎসর্গ করেছেন, এমন কোনো নজির নেই। এমনকি তাঁদের খেলাপি ঘোষণার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থায় আদালতের স্থগিতাদেশের মতো রক্ষাকবচ ব্যবহার করেও তাঁরা আরও ব্যাংকঋণ গ্রহণের পথ সুগম রাখার প্রয়াস পান। এসব সুবৃহৎ খেলাপির অনেককেই বিভিন্ন সময়ে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বিদেশে সফরসঙ্গী হতেও দেখা যায়।
তবে ভরসার কথা, সুবৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠনের এই সুযোগটি দেওয়া হয়েছে সীমিত সময়ের জন্য, চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে এ ধরনের ঋণ পুনর্গঠনের প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের জন্য পেশ করতে হবে। এই ব্যবস্থার পরও কোনো গ্রহীতা আবার খেলাপি হলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা এবং শেষাবধি দেউলিয়া আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকবে ব্যাংকগুলোর। এ রকম কঠোর শর্তের পর সুযোগটি নিতে কয়টা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ, এই সুবিধা গ্রহণ করার পর খেলাপি হলে দেউলিয়া আইনের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠনের পর পরবর্তী ১২ বছরের মধ্যে আবার খেলাপি হয়ে পড়লে সুবৃহৎ এসব গ্রহীতার বিষয়ে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail.com
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী—চলমান, তলবি ও মেয়াদি—সব ধরনের ঋণ হিসাব বিগত তিন বছরের জন্য নিয়মিত বা স্ট্যান্ডার্ড থাকলে সেই ঋণ হিসাবধারীকে ভালো ঋণগ্রহীতা বলে বিবেচনা করা যাবে। তবে আগের তিন বছরের কোনো এক সময়ে গ্রহীতাদের কেউ বা তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যদি কোনো ব্যাংকে বিরূপ মানে শ্রেণীকৃত হয়, তাহলে তাঁরা ভালো ঋণগ্রহীতা হিসেবে বিবেচিত হবেন না।
সদাচারী ঋণগ্রহীতাদের জন্য যে প্রণোদনা দিতে হবে, তার সুনির্দিষ্ট বিধিমালাও প্রণয়ন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলমান ঋণ, তলবি ঋণ কিংবা মেয়াদি ঋণ—সব ক্ষেত্রেই পর পর তিন বছর ঋণ অনুমোদনের শর্ত অনুযায়ী ঋণ পরিশোধ করলে তৃতীয় বছরের আদায়কৃত মোট সুদের ওপর কমপক্ষে ১০ শতাংশ ছাড় দিতে হবে। পরবর্তী বছর শেষে ভালো ঋণগ্রহীতা হিসেবে চিহ্নিত থাকলে কিংবা মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করলে পরের বছরও ছাড়ের এই বিশেষ সুবিধা বহাল থাকবে। এ ছাড়া গ্রহীতার ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তাঁরা বর্ধিত ঋণসুবিধা পাওয়ার যোগ্য বলেও বিবেচিত হবেন।
দেশের চলমান ঋণ সংস্কৃতিতে সদাচারী গ্রহীতারা বরাবরই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যান, বরং খেলাপি ও বড় গ্রহীতারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিভিন্ন উপায়ে প্রচারণা পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এই নতুন নীতিমালায় সদাচারী ঋণগ্রহীতাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বীকৃতি বা পুরস্কার দিয়ে তাঁদের সামাজিকভাবে উচ্চাসনে তুলে ধরার জন্যও ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিয়েছে। এই বিশেষ উদ্যোগটি পল্লি, উপজেলা ও ছোট জেলা সদরের ব্যাংক শাখার গ্রাহকদের মধ্যে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, এ রকম পাদপ্রদীপের আলোয় আসার সুযোগ তাঁদের কমই ঘটে। তবে ব্যাংকিং খাতের অনেকেই বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছেন না। তাঁদের বক্তব্য, ভালো ঋণগ্রহীতাদের ব্যাংক প্রথম থেকেই সুদের হারে সুবিধা দিয়ে থাকে। তার ওপর যদি আবার তিন বছর সদাচারী থাকার জন্য আদায়কৃত সুদের অংশ ফেরত দিতে হয়, সেটি ব্যাংকের আয়ের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
এই প্রণোদনা প্রবর্তনের মাস দুয়েক আগে সুবৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের ঋণ হিসাবগুলোকে সহজ শর্তে পুনর্গঠিত করার নতুন যে নীতিমালা ঘোষিত হয়, সেটির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার জন্যই হয়তো সদাচারী ঋণগ্রহীতাদের পুরস্কৃত করা ও স্বীকৃতি দেওয়ার এই উদ্যোগ। কারণ, নতুন নীতিমালায় ৫০০ কোটি টাকার চেয়ে বেশি ঋণ পুনর্গঠনের জন্য যেসব শিথিল শর্ত প্রণয়ন করা হয়, সেগুলো এই অঙ্কের নিচের গ্রহীতাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। আবার ঋণের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি হলে এসব শর্তের অন্তত একটি (ডাউন পেমেন্ট) আরও কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ঋণ পুনর্গঠনের এই সুযোগ যে কেবল সুবৃহৎ খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে তা নয়, মেয়াদোত্তীর্ণ নয় এমন ঋণও এই নীতিমালার অধীনে সর্বোচ্চ ১২ বছরের জন্য পুনর্গঠন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব বিশাল ঋণ হিসাবের ওপর সুদের হারও নির্ধারণ করা যাবে বিশেষ ছাড়ে, তবে ব্যাংকের তহবিল ব্যয়ের সঙ্গে ১ শতাংশ যোগ করলে যা হয় তার চেয়ে কম নয়। অবশ্য ব্যাংকের তহবিল ব্যয়ের সঙ্গে ১ শতাংশ যোগ করলেও পুনর্গঠিত ঋণের ওপর ধার্য করা এই সুদের হার ব্যাংকের জন্য কোনোভাবেই লাভজনক হবে না।
এই নীতিমালা প্রণয়নের যৌক্তিকতা হিসেবে বলা হয়েছে যে আর্থসামাজিক ও কর্মসংস্থানের নিরিখে বৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বিধায় ঋণ আদায়ের স্বার্থে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশের মোট কর্মসংস্থানে ও জিডিপিতে ৫০০ কোটি টাকার ওপর ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট কী পরিমাণ অবদান আছে, কিংবা তাঁদের অবদান ৫০০ কোটি টাকার কম ঋণগ্রহীতাদের চেয়ে বেশি কি না, সে বিষয়ে একটা সংগত প্রশ্ন থেকেই যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোর অস্থিরতার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়াও যদি হয় এই নতুন নীতিমালার উদ্দেশ্য, তাহলেও ৫০০ কোটি টাকার নিচের গ্রহীতারা এই সুবিধা থেকে কেন বঞ্চিত হবেন, সে প্রশ্নেরও কোনো জবাব আমরা দিতে পারছি না। যদি বহির্দেশীয় কিংবা অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সুবৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো এই ঋণ পুনর্গঠন–সুবিধা পায়, তাহলে সেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল কিংবা নির্ভরশীল নয় এমন অপেক্ষাকৃত ছোট বা মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোও কেন একই কারণে এই সুবিধা পাবে না, তার কোনো সদুত্তরও ব্যাংকাররা দিতে পারছেন না।
মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা যখন আমাদের তারকা খেলাপিসহ সুবৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের এ রকম ঢালাও ছাড় দিচ্ছি, ঠিক তখনই ভারতে খেলাপি ঋণের প্রবণতা রোধে আরেক প্রস্থ কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘অসহযোগী’ (নন-কো-অপারেটিভ) ঋণগ্রহীতা নাম দিয়ে একটা নতুন শ্রেণি চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। পাঁচ কোটি রুপির বেশি সব ধরনের ঋণ এই শ্রেণির আওতাভুক্ত। কয়েক বছর আগে ইচ্ছাকৃত (উইলফুল) খেলাপি নামে যে নতুন শ্রেণীকরণ করা হয়েছিল, এটি তার পরের ধাপ। ‘অসহযোগী’ ঋণগ্রহীতা বলতে তাঁদের বোঝানো হচ্ছে, যাঁরা সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করেন না, বরং ব্যাংকের ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য গোপন করেন, নিজেদের আর্থিক সংগতি বা জামানত সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহে বাধা দিয়ে কিংবা সহায়ক জামানত বিক্রি করে ঋণ আদায়ের জন্য ঋণদাতা ব্যাংকের সব তৎপরতাকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংজ্ঞানুযায়ী, এই শ্রেণির ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের টাকা তো ফেরত দেনই না, বরং ঋণের টাকা সরিয়ে ফেলে ভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেন কিংবা বন্ধকীকৃত অস্থাবর সম্পদ ব্যাংকের অগোচরে বিক্রি করে দেন। বস্তুত, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তহবিল সরিয়ে ফেলার (ফান্ড ডাইভারশন) বিষয়টি প্রমাণসাপেক্ষ বলে ব্যাংকগুলোকে এই শ্রেণীকরণ করতে গিয়ে নানা আইনি জটিলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছিল। এই বাধা এড়ানোর জন্য নতুন শ্রেণীকরণের এই উদ্যোগ। কারণ, অসহযোগী ঋণগ্রহীতাদের বিষয়ে এ রকম কোনো প্রমাণের আবশ্যকতা নেই।
উল্লেখ্য, গত বছরের শেষে ভারতের কিংফিশার এয়ারলাইনসের প্রায় সাত হাজার কোটি রুপি খেলাপি ঋণ আদায়ের উদ্দেশ্যে কলকাতার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কিংফিশার বিয়ার খ্যাত বিজয় মালিহাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঘোষণা করার পর সে দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রকদের টনক নড়ে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য কলকাতা হাইকোর্ট এই ঘোষণাকে স্থগিত করে দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দরিদ্র ও কৃষকবান্ধব ব্যাংকিং, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথক সেল গঠন, গ্রিন ব্যাংকিংসহ মানবিক ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন প্রশংসনীয় ও অনন্য উদ্যোগের পাশাপাশি ৫০০ কোটি টাকা এবং তদূর্ধ্ব ঋণ পুনর্গঠনের একপেশে ছাড়ের বিধানটি আদৌ বাংলাদেশ ব্যাংক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করেছে কি না, সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে বিজ্ঞ সমাজের। কারণ, কয়েক বছর আগে সরকার যখন খোলামেলা স্বীকার করেই রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রয়োজনহীনভাবে কিছু নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই প্রভাবকে বাধা দিতে পারেনি।
অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, আমাদের দেশের খেলাপি ঋণ সংস্কৃতিতে বড় গ্রহীতারা সব সময়ই সুদ মওকুফ, হ্রাসকৃত সুদ, দীর্ঘমেয়াদি কিস্তি–সুবিধাসহ নানা ধরনের ছাড় পেয়ে আসছেন, অথচ এই তারকা খেলাপিরা ঋণ পরিশোধের জন্য তাঁদের জীবনযাপনের কোনো স্বাচ্ছন্দ্য কখনো উৎসর্গ করেছেন, এমন কোনো নজির নেই। এমনকি তাঁদের খেলাপি ঘোষণার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থায় আদালতের স্থগিতাদেশের মতো রক্ষাকবচ ব্যবহার করেও তাঁরা আরও ব্যাংকঋণ গ্রহণের পথ সুগম রাখার প্রয়াস পান। এসব সুবৃহৎ খেলাপির অনেককেই বিভিন্ন সময়ে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বিদেশে সফরসঙ্গী হতেও দেখা যায়।
তবে ভরসার কথা, সুবৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠনের এই সুযোগটি দেওয়া হয়েছে সীমিত সময়ের জন্য, চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে এ ধরনের ঋণ পুনর্গঠনের প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের জন্য পেশ করতে হবে। এই ব্যবস্থার পরও কোনো গ্রহীতা আবার খেলাপি হলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা এবং শেষাবধি দেউলিয়া আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকবে ব্যাংকগুলোর। এ রকম কঠোর শর্তের পর সুযোগটি নিতে কয়টা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ, এই সুবিধা গ্রহণ করার পর খেলাপি হলে দেউলিয়া আইনের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠনের পর পরবর্তী ১২ বছরের মধ্যে আবার খেলাপি হয়ে পড়লে সুবৃহৎ এসব গ্রহীতার বিষয়ে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail.com
No comments