মায়ার পাখিরা মরে গেল! by ফারুক ওয়াসিফ
কালবৈশাখী ঝড়ের আঘাতে ভেঙে গেছে গাছের ডাল, মারা পড়েছে শালিক, কাকসহ বেশ কিছু পাখি। ছবি: সোয়েল রানা, প্রথম আলো, বগুড়া |
এই
দেশে পাখি নামের পোশাকের জন্য মেয়েরা আত্মহত্যা করে; কিন্তু লাখো পাখির
মৃত্যুতে শোক জাগে কি? কালবৈশাখী এসেছে আবার চলেও গেছে। সঙ্গে নিয়ে গেছে
ত্রিশের অধিক মানুষের প্রাণ। হাজার হাজার পাখিও তাদের সঙ্গে সহমরণ নিয়েছিল
সেই রাতে। কুষ্টিয়ার এক গ্রামেই পাওয়া গেছে ২৫ হাজার পাখির লাশ।
চুয়াডাঙ্গার গ্রামের বন-জঙ্গলের মাটিতে স্তূপের মতো পড়ে ছিল মৃত পাখিরা।
লেবানিজ কবি কাহলিল জিবরান বলেন, ‘বিদায়ের সময়ই মানুষ বুঝতে পারে তার
প্রকৃত ভালোবাসা।’ এত পাখির মৃত্যু দেখে মনে কি জাগে না এই কথা যে ওরা
আমাদের কে ছিল?
পাখি হলো প্রকৃতির শিশু। আমাদের শিশুদের দেখলে মনে যেমন মায়া উথলে ওঠে, মানুষের শিশুরা যেমন নিষ্পাপ সারল্যের অনুভূতি জাগায়, অনেকেরই প্রায় সেরকমই অনুভূতি হয় পাখিদের দেখে। মানুষ কাছে গেলে নাকি প্রকৃত সারস উড়ে যায়, কিন্তু প্রকৃত সরল-শুদ্ধ মানুষের কাছে উড়ে আসে পাখি—লোকমুখে শোনা যায় সেই গল্প। একসময় মানুষ ও পশুপাখি অনেক কাছাকাছি ছিল। এখনো গেরস্থ কৃষকের সংসারে পশুপাখি ও শিশুরা একসঙ্গে খেলা করে। শিশুদের সঙ্গে পাখিদের এই সম্পর্ক, পাখির প্রতি শিশুদের যে উচ্ছল আদর, তা জানায় যে শিশুরা আমাদের পাখি আর পাখিরা প্রকৃতির শিশু! ওরা আমাদের এমন কিছু দেয়, যা আমরা শৈশবে রেখে এসেছি। বড় হওয়া মানে সারল্য হারাতে থাকা, মানে পাখি-স্বভাব ভুলতে বসা, জীবন-জগতের প্রতি মুগ্ধতা হারানো।
প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের অংশ আমরা। অদৃশ্য বন্ধনে পৃথিবীর সব প্রাণ এক সুতায় গাঁথা। প্রকৃতিতে কোনো প্রাণের বড় রকমের ক্ষতি হলে তার প্রভাব অন্য সব প্রাণীর ওপরও পড়ে। একসঙ্গে এত পাখির মৃত্যুতে তাই আমরা এমন কিছু হারালাম, যা আমাদের প্রয়োজন ছিল। ফুলবাড়ীর এক কৃষক কয়লাখনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে বুঝিয়েছিলেন, ‘শুধুই কি মানুষ? এই যে আঠারো হাজার মখলুকাত, পশু-পাখি-পোকা-মাকড়-সাপ-ব্যাঙ—এরা কই যাবে খনি হইলে? ’
পাখির ডাকে যাদের ঘুম ভাঙে, রোদেলা উঠানে যে শালিকের নাচানাচি দেখে, বরইগাছে চড়ুইদের দুষ্টুমিতে যার মন ভরে, ভরদুপুরে যে ঘুঘুর ডাক শোনে, সন্ধ্যায় যে টিয়া পাখির দলের উড়ে যেতে দেখে; তার মনে কি পাখোয়ালি সুখ জাগে না? মনে হয় না জীবন সুন্দর? শরীরের যেমন পুষ্টি প্রয়োজন, মনের মহল্লায় পাখির ছায়া তো তেমনই এক পুষ্টি, তাই না?
এ কারণেই হয়তো কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার মানুষেরা দুঃখ পেয়েছে। এসব মানুষের অনেকেরই পাখির মতো সংসার। সম্পত্তি নেই, নেই কোনো সঞ্চয়, দিন এনে দিন খেতে হয় পাখিদের মতো করেই। পাখিরা যেমন লতাপাতা-খড়কুটোয় ঘর বানায়, এদের অনেককেও তেমনি প্রকৃতির দান দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকতে হয়। গাছের ওপর পাখির মামুলি বাসা আর মাটির ওপর বেড়ার ঘর সে রাতে একসঙ্গেই তছনছ হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাই সামাজিকও বটে। সমাজে যারা গরিব ও বঞ্চিত, যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে তারাই বেশি অরক্ষিত। এবারের কালবৈশাখীতে নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই বিত্তহীন। পাখিরা যেমন প্রকৃতির মধ্যে দুর্বলতম প্রাণের অংশ; সমাজের মধ্যে এসব মানুষও তেমনি। পাখির জন্য শোকে তাই সেসব বঞ্চিত মানুষের প্রতি বেদনাও মিশে থাকে। থাকা উচিত।
পাখি মুক্তি ও শান্তির প্রতীক। আমাদের দেশটা সুখে নেই, মানুষ কতটা মুক্ত তাও সত্য করে বলতে গেলে সাহস লাগে। এ রকম সময়ে হাজার হাজার পাখির মৃত্যু মুক্তি ও শান্তির বিপন্নতারও প্রতীক। লাতিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়ের বিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানোর বলা ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি। গল্পটা অনুবাদ করে দিচ্ছি:
উরুগুয়ের রাজনৈতিক বন্দীদের অনুমতি ছাড়া কথা বলা, শিস দেওয়া, হাসা, তাড়াতাড়ি হাঁটা অথবা একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানানো বারণ। এমনকি প্রসূতি নারী, প্রেমিক জুটি, প্রজাপতি, তারা ও পাখি আঁকা কিংবা সেসবের ছবি উপহার পাওয়াও ছিল নিষিদ্ধ। এক রোববার, ‘আদর্শবাদী হওয়ার’ দায়ে বন্দী ও নির্যাতিত স্কুলশিক্ষক দিদাসকো পেরেজের কাছে তাঁর পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে মাইলা দেখা করতে এল। ও বাবার জন্য পাখির ছবি এঁকে এনেছিল। জেলের দরজাতেই রক্ষীরা সেসব ধ্বংস করে।
পরের রোববার মেয়েটি আবারও আসে। এবার মাইলা এনেছে তার আঁকা গাছের ছবি। তো গাছ যেহেতু নিষিদ্ধ না, সেহেতু ছবিগুলো কারাগারে ঢুকতে পারল। দিদাসকো মেয়ের আঁকার খুবই তারিফ করে জানতে চাইল, ‘তোমার গাছের পাতার ভেতর থেকে উঁকিঝুঁকি দেওয়া ছোট ছোট রঙিন গোল্লাগুলো কী, মা? এগুলো কি কমলালেবু? কী ফল এগুলো?’ মেয়ে তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে ‘হিশশশশ! ’ তারপর বাপের কানে ফিসফিস করে বলে: বোকা তুমি! দেখছ না এগুলো হলো চোখ? ওগুলো তোমার কাছে লুকিয়ে পাঠানো আমার পাখিদের চোখ।’ (Eduardo Galeano, Memory of Fire III, The Century of the Wind, 1988)
ছোটবেলায় আমারও একটি পাখির ছানা মরে গিয়েছিল ঝড়ে। ভাইবোনেরা মিলে তাকে কবর দিয়ে ফুল ছিটাতে ছিটাতে কেঁদেছিলাম। সেই ছোট পাখিটা আমাকে বলে গেছে, ‘মানুষ শুধু রক্ত-মাংস দিয়েই তৈরি নয়, মানুষ মায়া দিয়েও তৈরি।’
ঝড়ে, নদীতে ডুবে, বাস উল্টে আর আগুন ও গুলিতে যে মানুষগুলো মরে গেল, তাদের ভেতরেও মায়া ছিল!
এত এত মৃত্যুতে আমাদের পৃথিবীতে মায়া কমে গেল আরও! মানুষ নিপাখি হয়ে গেল বড়!
পাখি হলো প্রকৃতির শিশু। আমাদের শিশুদের দেখলে মনে যেমন মায়া উথলে ওঠে, মানুষের শিশুরা যেমন নিষ্পাপ সারল্যের অনুভূতি জাগায়, অনেকেরই প্রায় সেরকমই অনুভূতি হয় পাখিদের দেখে। মানুষ কাছে গেলে নাকি প্রকৃত সারস উড়ে যায়, কিন্তু প্রকৃত সরল-শুদ্ধ মানুষের কাছে উড়ে আসে পাখি—লোকমুখে শোনা যায় সেই গল্প। একসময় মানুষ ও পশুপাখি অনেক কাছাকাছি ছিল। এখনো গেরস্থ কৃষকের সংসারে পশুপাখি ও শিশুরা একসঙ্গে খেলা করে। শিশুদের সঙ্গে পাখিদের এই সম্পর্ক, পাখির প্রতি শিশুদের যে উচ্ছল আদর, তা জানায় যে শিশুরা আমাদের পাখি আর পাখিরা প্রকৃতির শিশু! ওরা আমাদের এমন কিছু দেয়, যা আমরা শৈশবে রেখে এসেছি। বড় হওয়া মানে সারল্য হারাতে থাকা, মানে পাখি-স্বভাব ভুলতে বসা, জীবন-জগতের প্রতি মুগ্ধতা হারানো।
প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের অংশ আমরা। অদৃশ্য বন্ধনে পৃথিবীর সব প্রাণ এক সুতায় গাঁথা। প্রকৃতিতে কোনো প্রাণের বড় রকমের ক্ষতি হলে তার প্রভাব অন্য সব প্রাণীর ওপরও পড়ে। একসঙ্গে এত পাখির মৃত্যুতে তাই আমরা এমন কিছু হারালাম, যা আমাদের প্রয়োজন ছিল। ফুলবাড়ীর এক কৃষক কয়লাখনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে বুঝিয়েছিলেন, ‘শুধুই কি মানুষ? এই যে আঠারো হাজার মখলুকাত, পশু-পাখি-পোকা-মাকড়-সাপ-ব্যাঙ—এরা কই যাবে খনি হইলে? ’
পাখির ডাকে যাদের ঘুম ভাঙে, রোদেলা উঠানে যে শালিকের নাচানাচি দেখে, বরইগাছে চড়ুইদের দুষ্টুমিতে যার মন ভরে, ভরদুপুরে যে ঘুঘুর ডাক শোনে, সন্ধ্যায় যে টিয়া পাখির দলের উড়ে যেতে দেখে; তার মনে কি পাখোয়ালি সুখ জাগে না? মনে হয় না জীবন সুন্দর? শরীরের যেমন পুষ্টি প্রয়োজন, মনের মহল্লায় পাখির ছায়া তো তেমনই এক পুষ্টি, তাই না?
এ কারণেই হয়তো কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার মানুষেরা দুঃখ পেয়েছে। এসব মানুষের অনেকেরই পাখির মতো সংসার। সম্পত্তি নেই, নেই কোনো সঞ্চয়, দিন এনে দিন খেতে হয় পাখিদের মতো করেই। পাখিরা যেমন লতাপাতা-খড়কুটোয় ঘর বানায়, এদের অনেককেও তেমনি প্রকৃতির দান দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকতে হয়। গাছের ওপর পাখির মামুলি বাসা আর মাটির ওপর বেড়ার ঘর সে রাতে একসঙ্গেই তছনছ হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাই সামাজিকও বটে। সমাজে যারা গরিব ও বঞ্চিত, যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে তারাই বেশি অরক্ষিত। এবারের কালবৈশাখীতে নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই বিত্তহীন। পাখিরা যেমন প্রকৃতির মধ্যে দুর্বলতম প্রাণের অংশ; সমাজের মধ্যে এসব মানুষও তেমনি। পাখির জন্য শোকে তাই সেসব বঞ্চিত মানুষের প্রতি বেদনাও মিশে থাকে। থাকা উচিত।
পাখি মুক্তি ও শান্তির প্রতীক। আমাদের দেশটা সুখে নেই, মানুষ কতটা মুক্ত তাও সত্য করে বলতে গেলে সাহস লাগে। এ রকম সময়ে হাজার হাজার পাখির মৃত্যু মুক্তি ও শান্তির বিপন্নতারও প্রতীক। লাতিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়ের বিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানোর বলা ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি। গল্পটা অনুবাদ করে দিচ্ছি:
উরুগুয়ের রাজনৈতিক বন্দীদের অনুমতি ছাড়া কথা বলা, শিস দেওয়া, হাসা, তাড়াতাড়ি হাঁটা অথবা একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানানো বারণ। এমনকি প্রসূতি নারী, প্রেমিক জুটি, প্রজাপতি, তারা ও পাখি আঁকা কিংবা সেসবের ছবি উপহার পাওয়াও ছিল নিষিদ্ধ। এক রোববার, ‘আদর্শবাদী হওয়ার’ দায়ে বন্দী ও নির্যাতিত স্কুলশিক্ষক দিদাসকো পেরেজের কাছে তাঁর পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে মাইলা দেখা করতে এল। ও বাবার জন্য পাখির ছবি এঁকে এনেছিল। জেলের দরজাতেই রক্ষীরা সেসব ধ্বংস করে।
পরের রোববার মেয়েটি আবারও আসে। এবার মাইলা এনেছে তার আঁকা গাছের ছবি। তো গাছ যেহেতু নিষিদ্ধ না, সেহেতু ছবিগুলো কারাগারে ঢুকতে পারল। দিদাসকো মেয়ের আঁকার খুবই তারিফ করে জানতে চাইল, ‘তোমার গাছের পাতার ভেতর থেকে উঁকিঝুঁকি দেওয়া ছোট ছোট রঙিন গোল্লাগুলো কী, মা? এগুলো কি কমলালেবু? কী ফল এগুলো?’ মেয়ে তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে ‘হিশশশশ! ’ তারপর বাপের কানে ফিসফিস করে বলে: বোকা তুমি! দেখছ না এগুলো হলো চোখ? ওগুলো তোমার কাছে লুকিয়ে পাঠানো আমার পাখিদের চোখ।’ (Eduardo Galeano, Memory of Fire III, The Century of the Wind, 1988)
ছোটবেলায় আমারও একটি পাখির ছানা মরে গিয়েছিল ঝড়ে। ভাইবোনেরা মিলে তাকে কবর দিয়ে ফুল ছিটাতে ছিটাতে কেঁদেছিলাম। সেই ছোট পাখিটা আমাকে বলে গেছে, ‘মানুষ শুধু রক্ত-মাংস দিয়েই তৈরি নয়, মানুষ মায়া দিয়েও তৈরি।’
ঝড়ে, নদীতে ডুবে, বাস উল্টে আর আগুন ও গুলিতে যে মানুষগুলো মরে গেল, তাদের ভেতরেও মায়া ছিল!
এত এত মৃত্যুতে আমাদের পৃথিবীতে মায়া কমে গেল আরও! মানুষ নিপাখি হয়ে গেল বড়!
No comments