একটি গরুবিষয়ক রচনা by আনিসুল হক
ভারতের
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বিএসএফের জওয়ানদের বলেছেন, বাংলাদেশে গরু
পাচার বন্ধ করতে হবে। তাঁর কাছে খবর আছে, ভারতের সীমান্তে কড়াকড়ি বাড়ানোয়
বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। গরু পাচার সম্পূর্ণ বন্ধ
করা হলে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম আরও ৭০ শতাংশ বেড়ে যাবে। তখন ওখানকার
মানুষ গরু খাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেবে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবর (২ এপ্রিল ২০১৫)। কাজেই এটাকে বেখবর বলে উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। বাংলাদেশের পত্রিকা ডেইলি স্টার এই উক্তিটাকে দিনের উদ্ধৃতি হিসেবে ছেপেছেও।
আমি মিলান কুন্ডেরা নামের এক কথাসাহিত্যিকের ভক্ত। তিনি বলেছেন, সবকিছুরই হালকা দিক আছে, এমনকি সেক্স এবং মৃত্যুরও একটা রসিকতার দিক রয়েছে। কাজেই প্রথমে এই উক্তির হালকা দিকটা নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলে নেওয়া ভালো। গরুর মাংসই হোক আর ইলিশ মাছই হোক, দামের কারণে খাদ্যাভ্যাস বদলানোর পাত্র যে বাংলাদেশিরা নয়, সেটা রাজনাথ সিংকে মনে করিয়ে দেওয়াটা কর্তব্য বলে মনে করি। বাংলাদেশে যে ইলিশ মাছ আর ১৫ দিন পরে ৩০০ টাকায় পাওয়া যাবে, তা এখন বাজারে তিন হাজার টাকায় বিকোচ্ছে। দাম বেড়েছে ১০ গুণ। তাতেও বাংলাদেশি ও বাঙালিরা ইলিশ মাছ কেনা বা খাওয়া ছাড়েনি। দিব্যি বাজারে ইলিশ মাছ কেনা হচ্ছে, একটা ইলিশের দাম তো হাঁকা হয়েছে ১৬ হাজার টাকা! মাননীয় রাজনাথকে কি কেউ বলবেন, বাঙালিকে দামের ভয় দেখাবেন না! ৭০ শতাংশ কেন, দাম ১ হাজার শতাংশ বাড়লেও ওরা কোনো কিছু কেনা বা খাওয়া থেকে বিরত থাকে না।
দ্বিতীয় কথাটা অবশ্য টাইমস অব ইন্ডিয়াই বলে দিয়েছে। বাংলাদেশকে গরুর মাংস খাওয়ানো বন্ধ করার দাম ভারতকে দিতে হবে বছরে ৩১ হাজার কোটি টাকা (ইকোনমিক টাইমস, ৩ এপ্রিল ২০১৫)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে প্রতিবছর ১ কোটি ২৫ লাখ গরু উৎপাদিত হয়, ২৫ লাখ পাচার হয় বাংলাদেশে, কিন্তু বাকিটা কই যায়? টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, ওই মন্ত্রীকে কেউ কি বলেনি, গরুর মাংসের বেশির ভাগটাই চলে যায় উপসাগরীয় দেশসমূহে? আর যে ৩১ হাজার কোটি রুপি ভারত আয় করে বাংলাদেশে আসা গরু থেকে, সেটা ভারতে পুষ্টিহীনতার শিকার শিশুদের রক্ষার রাষ্ট্রীয় প্রকল্প ব্যয়ের চার গুণ।
আরেকটা কথাও বলে নেওয়া দরকার। বাংলাদেশ অলৌকিক সব উন্নতির নজির দেখিয়ে পৃথিবীকে নানা দিক থেকে অবাক করছে। ‘বাংলাদেশ মিরাকল’ নামে সেসব প্রচলিত ও প্রশংসিত। এত চাহিদা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে। মাছ উৎপাদনে তো রীতিমতো রুপালি বিপ্লব ঘটে গেছে। জ্যান্ত পাঙাশ মাছ লাফাচ্ছে, খাওয়ার লোক নেই। ডিম, দুধ, কলা থেকে শুরু করে বাউকুল—সর্বত্র বিপ্লব ঘটে গেছে। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীর চার নম্বরে। বাংলাদেশের সৃজনশীল ও পরিশ্রমী মানুষ যদি একবার বোঝে গরু উৎপাদনটা লাভজনক, তাহলে আগামী চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশে গরু-বিপ্লব সম্পন্ন হয়ে যাবে। আমরা সেই বিপ্লবকে ‘শিং বিপ্লব’ নাম দিতে পারি। দেখবেন, আমাদের ঘরে ঘরে, উঠোনে, মাঠে-ঘাটে, খামারে গরু আর গরু, কত জাতের গরুই না চাষ করা হবে। তার ফলটা আমরা জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হতে দেখব, ৩১ হাজার কোটি টাকা বাঁচবে নগদে, তারপর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় রপ্তানি করব গরুর মাংস। শুধু কি মাংস, আমাদের খেতে-খামারে রাসায়নিক সার দরকার হবে না—গোবর বড় উৎকৃষ্ট সার—কৃষিতে উৎপাদন বাড়বে, পরিবেশ বাঁচবে, সার খাত থেকে বেঁচে যাবে বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের চামড়া উৎপাদন আর রপ্তানি বাড়বে, চামড়াশিল্পে উন্নতি ঘটবে। আমরা সস্তায় জুতা পরব আর গরুর লেজের রোম দিয়ে বুরুশ বানিয়ে সেই জুতা পালিশ করব!
তবে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই উক্তিতে সাম্প্রদায়িকতার ভাবটা ঠিক প্রচ্ছন্নও নেই, একটু বেশি প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়ে গেছে। বিজেপি ক্ষমতায় এলে কী হবে, ভারতসহ পৃথিবীর সম্প্রীতিকামী মানুষ এই বিষয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং আছেন। ভারত যদি গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে বিচ্যুত হয়, সেটা ভারতের জন্য সুসংবাদ নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও দুঃসংবাদ। একটা সমীক্ষায় দেখা গেল, ২০২০-এর দশকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মুসলমানের দেশ হবে ভারত। ভারতকে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতে হবে, তা ভারতের শান্তি ও উন্নতির জন্য দরকার। তা দরকার পৃথিবীর অন্য অংশগুলোর শান্তি ও উন্নতির জন্যও। ১৯৪৭-এর আগস্টে জওহরলাল নেহরু তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই, সে যে-ধর্মেরই হই না কেন, ভারতের সমান সন্তান, সবার অধিকার, সুযোগ আর দায়িত্ব সমান। আমরা সাম্প্রদায়িকতা কিংবা সংকীর্ণ মানসিকতা উৎসাহিত করতে পারি না, কোনো জাতিই বড় হতে পারে না, যার মানুষ চিন্তায় কিংবা কাজে সংকীর্ণ।’ ওই আগস্টেই পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘তোমরা মুক্ত। তোমরা মুক্তভাবে মন্দিরে যেতে পারো, তোমরা মসজিদে যেতে পারো বা অন্য যেকোনো প্রার্থনাগৃহে যেতে পারো।’ ‘তোমরা যেকোনো ধর্ম, গোত্র বা বর্ণের হতে পারো, তার সঙ্গে রাষ্ট্রের কাজকর্মের কোনো সংস্রব নেই।’ যেকোনো সুবিবেচক রাষ্ট্রনায়ক এই রকমটাই কেবল বলতে পারেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে বলেছিলেন, বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এর একটা মানে আছে। মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। কিন্তু ধর্ম নিয়ে কেউ ব্যবসা করতে পারবে না। সেই আদর্শবাদিতা থেকে ভারত বাস্তবে অনেক জায়গায় বিচ্যুত হয়েছে, বাংলাদেশ হয়েছে, পাকিস্তান বিচ্যুত হয়েছে ব্যাপকভাবে, তার দাম দেশগুলোকে দিতে হয়েছে, দিতে হচ্ছে এবং হবে। তবু ভারত তার গণতন্ত্রকে রক্ষা করেই এসেছে। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের গৌরব ভারতের প্রাপ্য, কিন্তু রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য সেই ঐতিহ্য ও আদর্শবাদিতার সঙ্গে মানানসই নয়।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি। বড় ভালো লেখেন। আমি তাঁর ভক্ত, তাঁর সাংবাদিকসুলভ লেখার জন্য আর তাঁর অপরূপ গদ্যভঙ্গির জন্য। সৌম্যদা কিছুদিন আগে আমাকে পাঠিয়েছিলেন ছোট ছোট ডায়েরির মতো লেখার নমুনা। সেখান থেকে একটা হুবহু উদ্ধৃত করি, ভালো লেখার উদাহরণ হিসেবে আমরা যারা সাংবাদিকতার ছাত্র, তারা তা পড়তে পারি:
‘মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান ফিলিপ হিউজ বাউন্সারের মোকাবিলা ঠিকঠাক করতে না পেরে যেদিন মারা গেলেন, সেদিনই হর্ষবর্ধনের সঙ্গে আমার কথোপকথনটা আবার মনে পড়ে গেল। এবং কী আশ্চর্য, ওই দিনেই বিজেপি শ্রীনগরে তাদের কাশ্মীর নির্বাচনের ইশতেহার প্রকাশ করল, যাতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ও সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ নিয়ে একটা শব্দও স্থান পায়নি!
‘হর্ষবর্ধন বিজেপির প্রথম সারির নেতা হলেও তিনি দিল্লির একজন নামকরা ডাক্তার। সৎ ও ভালো মানুষ বলে তাঁর সুনাম আছে। গুন্ডা-বদমাশদের নিয়ে রাজনীতি করেন না বলে অন্য দলের নেতারাও তাঁকে পছন্দ করেন। ভদ্রলোককে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী করা হবে ঠিক করে বিজেপি রাজ্যের গত ভোটটা লড়েছিল। কিন্তু বিজেপির তরি তীরে ভিড়তে ভিড়তেও ভিড়ল না। কংগ্রেসের সাহায্য নিয়ে সরকার গড়ল আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ৪৯ দিনের মাথায় তার পদত্যাগ। হঠকারিতার একশেষ। এসব গল্প এখন সবার জানা।
‘হর্ষবর্ধন অতঃপর লোকসভায় জিতে কেন্দ্রে মন্ত্রী হলেন এবং বিধানসভার পদ ছেড়ে দিলেন। দিল্লিতে রাষ্ট্রপতির শাসন চলছে। বিজেপি ঠিক করল, দিল্লিতে টু হুইলার চালানোর যে নীতি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন শীলা দীক্ষিত চালু করেছিলেন, তাতে সামান্য পরিবর্তন আনবে। আগের নীতিতে মহিলা আরোহীদের হেলমেট পরা জরুরি ছিল না। নতুন নীতিতে তা বাধ্যতামূলক করা হলো। শুরু হলো হইচই। শিখ সম্প্রদায়ের আপত্তি মেনে শিখ মহিলাদের হেলমেট পরায় ছাড় দিল সরকার। অর্থাৎ, শিখ পুরুষদের হেলমেট পরতে হয় না। শিখ মহিলারাও পেছনে বসলে তাঁদের ছাড়।
‘সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনে পার্লামেন্ট হাউসে ওই সময় একদিন হর্ষবর্ধনের মুখোমুখি। তারপর তাঁর সঙ্গে আমার এই ধরনের কথাবার্তা হয়।
“আপনারাও তাহলে সবার জন্য প্রযোজ্য টু হুইলার নীতি চালু করতে পারলেন না! নীতিটা ধর্মভিত্তিক হলো। শিখদের বাদ দিলেন!”
“কী করা যাবে বলুন। শিখদের এমন চাপ। পাগড়ির ওপর হেলমেট পরা যায় না। ওদের ধর্মের ব্যাপার। তাই...।”
“তাই ওদের ছাড়। কিন্তু শিখ ক্রিকেটাররা তো দিব্যি হেলমেট পরে ব্যাট করতে নামে। সিলিতে হেলমেট পরে ফিল্ডিং দেয়। তখন ধর্মে আটকায় না? কিংবা খনিতে যখন শিখ শ্রমিক নামে, ফ্রন্ট লাইনে যখন শিখ জওয়ানদের যুদ্ধ করতে হয়, অথবা শিখ কনস্ট্রাকশন লেবাররা যখন সাইটে কাজ করে, তখনো তো নিরাপত্তার জন্যই হেলমেট মাস্ট? ধর্মের যুক্তি তখন পাত্তা পায় না কেন?”
‘হর্ষবর্ধন কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, “আইনটা হওয়া উচিত টু হুইলার স্পেসিফিক। যারাই স্কুটার বা বাইক চালাবে ও চড়বে, তাদের সব্বাইকেই তাদেরই নিরাপত্তার জন্য হেলমেট পরতে হবে। কারও ধর্মে আঘাত করলে সে চালাবে না। এটাই সহজ শর্ত। শিখ পুরুষ-নারীদের ছাড় আর অন্যদের জন্য বজ্র আঁটুনি, এটা স্যার বাজে আইন। এটাই অন্য অর্থে ভোটব্যাংক রাজনীতি।”
‘হর্ষবর্ধন আমতা-আমতা করে বলেছিলেন, “আপনার যুক্তি অকাট্য সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদেরও অনেক কিছু ভাবতে হয়।” কথাটা বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার আগে ওকে বলেছিলাম, “যারা সারা দেশের জন্য অভিন্ন স্কুটার বা বাইক আইন করতে পারে না, তারা করবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি? কস্মিনকালেও হবে না। বাজি ধরবেন?”’
রাজনীতি জিনিসটা কঠিন, রাষ্ট্র ব্যাপারটা আরও কঠিন। তবু মনে হয়, ভারতকে, পাকিস্তানকে তাদের প্রতিষ্ঠাতা-পুরুষদের ১৯৪৭-এর আগস্ট বক্তৃতাগুলোই বারবার পড়তে হবে, সেই দিকেই যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবর (২ এপ্রিল ২০১৫)। কাজেই এটাকে বেখবর বলে উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। বাংলাদেশের পত্রিকা ডেইলি স্টার এই উক্তিটাকে দিনের উদ্ধৃতি হিসেবে ছেপেছেও।
আমি মিলান কুন্ডেরা নামের এক কথাসাহিত্যিকের ভক্ত। তিনি বলেছেন, সবকিছুরই হালকা দিক আছে, এমনকি সেক্স এবং মৃত্যুরও একটা রসিকতার দিক রয়েছে। কাজেই প্রথমে এই উক্তির হালকা দিকটা নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলে নেওয়া ভালো। গরুর মাংসই হোক আর ইলিশ মাছই হোক, দামের কারণে খাদ্যাভ্যাস বদলানোর পাত্র যে বাংলাদেশিরা নয়, সেটা রাজনাথ সিংকে মনে করিয়ে দেওয়াটা কর্তব্য বলে মনে করি। বাংলাদেশে যে ইলিশ মাছ আর ১৫ দিন পরে ৩০০ টাকায় পাওয়া যাবে, তা এখন বাজারে তিন হাজার টাকায় বিকোচ্ছে। দাম বেড়েছে ১০ গুণ। তাতেও বাংলাদেশি ও বাঙালিরা ইলিশ মাছ কেনা বা খাওয়া ছাড়েনি। দিব্যি বাজারে ইলিশ মাছ কেনা হচ্ছে, একটা ইলিশের দাম তো হাঁকা হয়েছে ১৬ হাজার টাকা! মাননীয় রাজনাথকে কি কেউ বলবেন, বাঙালিকে দামের ভয় দেখাবেন না! ৭০ শতাংশ কেন, দাম ১ হাজার শতাংশ বাড়লেও ওরা কোনো কিছু কেনা বা খাওয়া থেকে বিরত থাকে না।
দ্বিতীয় কথাটা অবশ্য টাইমস অব ইন্ডিয়াই বলে দিয়েছে। বাংলাদেশকে গরুর মাংস খাওয়ানো বন্ধ করার দাম ভারতকে দিতে হবে বছরে ৩১ হাজার কোটি টাকা (ইকোনমিক টাইমস, ৩ এপ্রিল ২০১৫)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে প্রতিবছর ১ কোটি ২৫ লাখ গরু উৎপাদিত হয়, ২৫ লাখ পাচার হয় বাংলাদেশে, কিন্তু বাকিটা কই যায়? টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, ওই মন্ত্রীকে কেউ কি বলেনি, গরুর মাংসের বেশির ভাগটাই চলে যায় উপসাগরীয় দেশসমূহে? আর যে ৩১ হাজার কোটি রুপি ভারত আয় করে বাংলাদেশে আসা গরু থেকে, সেটা ভারতে পুষ্টিহীনতার শিকার শিশুদের রক্ষার রাষ্ট্রীয় প্রকল্প ব্যয়ের চার গুণ।
আরেকটা কথাও বলে নেওয়া দরকার। বাংলাদেশ অলৌকিক সব উন্নতির নজির দেখিয়ে পৃথিবীকে নানা দিক থেকে অবাক করছে। ‘বাংলাদেশ মিরাকল’ নামে সেসব প্রচলিত ও প্রশংসিত। এত চাহিদা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে। মাছ উৎপাদনে তো রীতিমতো রুপালি বিপ্লব ঘটে গেছে। জ্যান্ত পাঙাশ মাছ লাফাচ্ছে, খাওয়ার লোক নেই। ডিম, দুধ, কলা থেকে শুরু করে বাউকুল—সর্বত্র বিপ্লব ঘটে গেছে। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীর চার নম্বরে। বাংলাদেশের সৃজনশীল ও পরিশ্রমী মানুষ যদি একবার বোঝে গরু উৎপাদনটা লাভজনক, তাহলে আগামী চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশে গরু-বিপ্লব সম্পন্ন হয়ে যাবে। আমরা সেই বিপ্লবকে ‘শিং বিপ্লব’ নাম দিতে পারি। দেখবেন, আমাদের ঘরে ঘরে, উঠোনে, মাঠে-ঘাটে, খামারে গরু আর গরু, কত জাতের গরুই না চাষ করা হবে। তার ফলটা আমরা জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হতে দেখব, ৩১ হাজার কোটি টাকা বাঁচবে নগদে, তারপর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় রপ্তানি করব গরুর মাংস। শুধু কি মাংস, আমাদের খেতে-খামারে রাসায়নিক সার দরকার হবে না—গোবর বড় উৎকৃষ্ট সার—কৃষিতে উৎপাদন বাড়বে, পরিবেশ বাঁচবে, সার খাত থেকে বেঁচে যাবে বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের চামড়া উৎপাদন আর রপ্তানি বাড়বে, চামড়াশিল্পে উন্নতি ঘটবে। আমরা সস্তায় জুতা পরব আর গরুর লেজের রোম দিয়ে বুরুশ বানিয়ে সেই জুতা পালিশ করব!
তবে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই উক্তিতে সাম্প্রদায়িকতার ভাবটা ঠিক প্রচ্ছন্নও নেই, একটু বেশি প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়ে গেছে। বিজেপি ক্ষমতায় এলে কী হবে, ভারতসহ পৃথিবীর সম্প্রীতিকামী মানুষ এই বিষয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং আছেন। ভারত যদি গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে বিচ্যুত হয়, সেটা ভারতের জন্য সুসংবাদ নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও দুঃসংবাদ। একটা সমীক্ষায় দেখা গেল, ২০২০-এর দশকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মুসলমানের দেশ হবে ভারত। ভারতকে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতে হবে, তা ভারতের শান্তি ও উন্নতির জন্য দরকার। তা দরকার পৃথিবীর অন্য অংশগুলোর শান্তি ও উন্নতির জন্যও। ১৯৪৭-এর আগস্টে জওহরলাল নেহরু তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই, সে যে-ধর্মেরই হই না কেন, ভারতের সমান সন্তান, সবার অধিকার, সুযোগ আর দায়িত্ব সমান। আমরা সাম্প্রদায়িকতা কিংবা সংকীর্ণ মানসিকতা উৎসাহিত করতে পারি না, কোনো জাতিই বড় হতে পারে না, যার মানুষ চিন্তায় কিংবা কাজে সংকীর্ণ।’ ওই আগস্টেই পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘তোমরা মুক্ত। তোমরা মুক্তভাবে মন্দিরে যেতে পারো, তোমরা মসজিদে যেতে পারো বা অন্য যেকোনো প্রার্থনাগৃহে যেতে পারো।’ ‘তোমরা যেকোনো ধর্ম, গোত্র বা বর্ণের হতে পারো, তার সঙ্গে রাষ্ট্রের কাজকর্মের কোনো সংস্রব নেই।’ যেকোনো সুবিবেচক রাষ্ট্রনায়ক এই রকমটাই কেবল বলতে পারেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে বলেছিলেন, বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এর একটা মানে আছে। মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। কিন্তু ধর্ম নিয়ে কেউ ব্যবসা করতে পারবে না। সেই আদর্শবাদিতা থেকে ভারত বাস্তবে অনেক জায়গায় বিচ্যুত হয়েছে, বাংলাদেশ হয়েছে, পাকিস্তান বিচ্যুত হয়েছে ব্যাপকভাবে, তার দাম দেশগুলোকে দিতে হয়েছে, দিতে হচ্ছে এবং হবে। তবু ভারত তার গণতন্ত্রকে রক্ষা করেই এসেছে। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের গৌরব ভারতের প্রাপ্য, কিন্তু রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য সেই ঐতিহ্য ও আদর্শবাদিতার সঙ্গে মানানসই নয়।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি। বড় ভালো লেখেন। আমি তাঁর ভক্ত, তাঁর সাংবাদিকসুলভ লেখার জন্য আর তাঁর অপরূপ গদ্যভঙ্গির জন্য। সৌম্যদা কিছুদিন আগে আমাকে পাঠিয়েছিলেন ছোট ছোট ডায়েরির মতো লেখার নমুনা। সেখান থেকে একটা হুবহু উদ্ধৃত করি, ভালো লেখার উদাহরণ হিসেবে আমরা যারা সাংবাদিকতার ছাত্র, তারা তা পড়তে পারি:
‘মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান ফিলিপ হিউজ বাউন্সারের মোকাবিলা ঠিকঠাক করতে না পেরে যেদিন মারা গেলেন, সেদিনই হর্ষবর্ধনের সঙ্গে আমার কথোপকথনটা আবার মনে পড়ে গেল। এবং কী আশ্চর্য, ওই দিনেই বিজেপি শ্রীনগরে তাদের কাশ্মীর নির্বাচনের ইশতেহার প্রকাশ করল, যাতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ও সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ নিয়ে একটা শব্দও স্থান পায়নি!
‘হর্ষবর্ধন বিজেপির প্রথম সারির নেতা হলেও তিনি দিল্লির একজন নামকরা ডাক্তার। সৎ ও ভালো মানুষ বলে তাঁর সুনাম আছে। গুন্ডা-বদমাশদের নিয়ে রাজনীতি করেন না বলে অন্য দলের নেতারাও তাঁকে পছন্দ করেন। ভদ্রলোককে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী করা হবে ঠিক করে বিজেপি রাজ্যের গত ভোটটা লড়েছিল। কিন্তু বিজেপির তরি তীরে ভিড়তে ভিড়তেও ভিড়ল না। কংগ্রেসের সাহায্য নিয়ে সরকার গড়ল আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ৪৯ দিনের মাথায় তার পদত্যাগ। হঠকারিতার একশেষ। এসব গল্প এখন সবার জানা।
‘হর্ষবর্ধন অতঃপর লোকসভায় জিতে কেন্দ্রে মন্ত্রী হলেন এবং বিধানসভার পদ ছেড়ে দিলেন। দিল্লিতে রাষ্ট্রপতির শাসন চলছে। বিজেপি ঠিক করল, দিল্লিতে টু হুইলার চালানোর যে নীতি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন শীলা দীক্ষিত চালু করেছিলেন, তাতে সামান্য পরিবর্তন আনবে। আগের নীতিতে মহিলা আরোহীদের হেলমেট পরা জরুরি ছিল না। নতুন নীতিতে তা বাধ্যতামূলক করা হলো। শুরু হলো হইচই। শিখ সম্প্রদায়ের আপত্তি মেনে শিখ মহিলাদের হেলমেট পরায় ছাড় দিল সরকার। অর্থাৎ, শিখ পুরুষদের হেলমেট পরতে হয় না। শিখ মহিলারাও পেছনে বসলে তাঁদের ছাড়।
‘সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনে পার্লামেন্ট হাউসে ওই সময় একদিন হর্ষবর্ধনের মুখোমুখি। তারপর তাঁর সঙ্গে আমার এই ধরনের কথাবার্তা হয়।
“আপনারাও তাহলে সবার জন্য প্রযোজ্য টু হুইলার নীতি চালু করতে পারলেন না! নীতিটা ধর্মভিত্তিক হলো। শিখদের বাদ দিলেন!”
“কী করা যাবে বলুন। শিখদের এমন চাপ। পাগড়ির ওপর হেলমেট পরা যায় না। ওদের ধর্মের ব্যাপার। তাই...।”
“তাই ওদের ছাড়। কিন্তু শিখ ক্রিকেটাররা তো দিব্যি হেলমেট পরে ব্যাট করতে নামে। সিলিতে হেলমেট পরে ফিল্ডিং দেয়। তখন ধর্মে আটকায় না? কিংবা খনিতে যখন শিখ শ্রমিক নামে, ফ্রন্ট লাইনে যখন শিখ জওয়ানদের যুদ্ধ করতে হয়, অথবা শিখ কনস্ট্রাকশন লেবাররা যখন সাইটে কাজ করে, তখনো তো নিরাপত্তার জন্যই হেলমেট মাস্ট? ধর্মের যুক্তি তখন পাত্তা পায় না কেন?”
‘হর্ষবর্ধন কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, “আইনটা হওয়া উচিত টু হুইলার স্পেসিফিক। যারাই স্কুটার বা বাইক চালাবে ও চড়বে, তাদের সব্বাইকেই তাদেরই নিরাপত্তার জন্য হেলমেট পরতে হবে। কারও ধর্মে আঘাত করলে সে চালাবে না। এটাই সহজ শর্ত। শিখ পুরুষ-নারীদের ছাড় আর অন্যদের জন্য বজ্র আঁটুনি, এটা স্যার বাজে আইন। এটাই অন্য অর্থে ভোটব্যাংক রাজনীতি।”
‘হর্ষবর্ধন আমতা-আমতা করে বলেছিলেন, “আপনার যুক্তি অকাট্য সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদেরও অনেক কিছু ভাবতে হয়।” কথাটা বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার আগে ওকে বলেছিলাম, “যারা সারা দেশের জন্য অভিন্ন স্কুটার বা বাইক আইন করতে পারে না, তারা করবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি? কস্মিনকালেও হবে না। বাজি ধরবেন?”’
রাজনীতি জিনিসটা কঠিন, রাষ্ট্র ব্যাপারটা আরও কঠিন। তবু মনে হয়, ভারতকে, পাকিস্তানকে তাদের প্রতিষ্ঠাতা-পুরুষদের ১৯৪৭-এর আগস্ট বক্তৃতাগুলোই বারবার পড়তে হবে, সেই দিকেই যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments