পারমাণবিক প্রকল্পের নিরাপত্তা by ডিইএস ব্রাউন ও ইগর এস ইভানভ
চার
বছর আগে জাপানের উপকূল বিধ্বংসী সুনামির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ৫০ ফুট
উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়। সেই তোড়ে ফুকুশিমা ডাইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎ
প্রকল্পের সুরক্ষা দেয়াল ভেঙে পানি ভেতরে ঢুকে পড়ে। ফলে এর জরুরি বিদ্যুৎ
সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং শীতলীকরণ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে।
সেই ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পারমাণবিক প্রকল্পে দুর্ঘটনার পর এটাই ছিল সবচেয়ে মারাত্মক পারমাণবিক দুর্ঘটনা। তদন্তকারীরা খুঁজে বের করেন, এই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ছিল আত্মতুষ্টি। যারা এর দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের ধারণা ছিল প্রকল্পের নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল খুবই শক্তিশালী। আর সেখানে কোনো কার্যকর স্বাধীন নজরদারিও ছিল না।
জাপানের এই বিপর্যয়ের পর সারা দুনিয়াতেই নিরাপদ পারমাণবিক বিদ্যুতের জগতে নানা সংস্কার শুরু হয়। কিন্তু পারমাণবিক নিরাপত্তার ব্যাপারটি আসলেই মনে হয়, সবার মধ্যে আত্মসন্তুষ্টি ভর করেছে। বিয়োগান্ত ঘটনা এসে নাড়া না দেওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব, ব্যাপারটা যেন এমন না হয়। আজ সারা দুনিয়ার বিভিন্ন পারমাণবিক প্রকল্পে অতি সমৃদ্ধ দেড় মিলিয়ন কেজি ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম বিশ্বের ২৫টি দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেগুলোর কিছু অংশের নিরাপত্তা খুবই নাজুক। কিন্তু লাখ লাখ মানুষকে হত্যা ও মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিসাধন করতে ছোট এক ব্যাগ চিনির সমপরিমাণ পারমাণবিক উপাদানই যথেষ্ট, অস্ত্র বানানোর জন্য এটুকু উপাদানই যথেষ্ট।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পারমাণবিক নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য অনেক কিছুই করা হয়েছে, কিন্তু সব দেশের সরকারের উচিত, বিধ্বংসী পারমাণবিক কর্মসূচির হাত থেকে তার জনগণকে রক্ষা করার জন্য আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া। ফুকুশিমা সংকট থেকে যে শিক্ষা আমরা পেয়েছি, সেটা এই লক্ষ্যে সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করতে পারে।
যারা শুরু করছে, তাদের উচিত হবে পারমাণবিক নিরাপত্তার ব্যাপারটি সার্বক্ষণিক উন্নতির ব্যাপার হিসেবে গ্রহণ করা। আর নতুন নতুন হুমকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য তাল মিলিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে হবে। যে ব্যবস্থা আজ থেকে ২০ বছর আগে নিরাপদ ভাবা হতো, সেটা হয়তো এখন আর নিরাপদ নয়। সেটা এখন সাইবার হামলার মুখে ভেঙে পড়তে পারে। সাইবার হামলা পারমাণবিক উপাদানগুলো নজরে রাখার প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
অরাষ্ট্রীয় কিন্তু সুসংগঠিত সংগঠন যেমন ইসলামিক স্টেট নতুন নতুন কৌশল, প্রযুক্তি ও সক্ষমতা ব্যবহার করে পারমাণবিক উপাদান চুরি করতে পারে। ফলে সরকারকে বিকাশমান প্রযুক্তি ও হুমকি ভালোভাবে মূল্যায়ন করতে হবে, যাতে সেই ব্যবস্থা এসব সম্ভাব্য চোরের হুমকির চেয়েও শক্তিশালী থাকে।
দ্বিতীয়ত, প্রতিটি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে নিরাপদ সংস্কৃতির মতো নিরাপত্তা সংস্কৃতি পারমাণবিক প্রকল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত কমান্ডের প্রধান কমান্ডার জেনারেল ইউজেন হাবিজার, যাঁকে মার্কিন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ‘নিরাপত্তা জার (রাজা)’ বলা হতো, বলেছিলেন, ‘ভালো নিরাপত্তার ২০ শতাংশ হচ্ছে যন্ত্রপাতি, আর ৮০ শতাংশ মানুষি সক্ষমতা।’
সরকার ও শিল্পকে একত্র হয়ে শক্তিশালী নিরাপত্তা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। পারমাণবিক প্রকল্পের সব কর্মীকে, অর্থাৎ প্রহরী থেকে বিজ্ঞানী পর্যন্ত, মনে করতে হবে যে নিরাপত্তা তাদের কাজের প্রয়োজনীয় অংশ। তৃতীয়ত, সরকারকে নিয়মিত পারমাণবিক প্রকল্পের নিরাপত্তা পর্যালোচনা করতে হবে। শুধু পারমাণবিক প্রকল্পের পরিচালকদের বললে হবে না যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা ‘যথেষ্ট ভালো’। বস্তুত কার্যকর নজরদারি আত্মসন্তুষ্টি দূর করতে পারে।
ফুকুশিমা কাণ্ড অন্যান্য পারমাণবিক প্রকল্পের পরিচালকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, নিয়মিত চাপ পরীক্ষা করতে হবে। পারমাণবিক কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে, এমন আকস্মিক সম্ভাবনা মোকাবিলাও করতে শিখিয়েছে এই ঘটনা। পরিচালকদের নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যবস্থার হুমকি মোকাবিলার সক্ষমতা নিরূপণ করতে হবে। কেন্দ্রের জ্ঞানী চোরেরা যাতে চুরি করতে না পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
শেষমেশ, বিশ্বনেতাদের পারমাণবিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে। চেরনোবিল ও ফুকুশিমার ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে, এক দেশের পারমাণবিক প্রকল্পে নিরাপত্তার ঘাটতি অন্য দেশে কতটা গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। পারমাণবিক নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়েও একই কথা প্রযোজ্য।
সন্ত্রাসীরা যেন এসব মারাত্মক উপাদানের নাগাল না পায় সেটা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের অভিন্ন রাজনৈতিক ও নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত নান-লুগার কো-অপারেটিভ থ্রেট রিডাকশন কর্মসূচি থেকে অন্যদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। যেসব দেশের পারমাণবিক শক্তি আছে, তাদের উচিত নিরাপত্তা জোরদার করা, সাধারণ পারমাণবিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ও মান পর্যবেক্ষণের সম্ভাবনা খুঁজে বের করা।
নিউক্লিয়ার থ্রেট ইনিশিয়েটিভের কো-চেয়ারম্যান আমাদের বন্ধু ও সহকর্মী স্যাম নান প্রায়ই সতর্ক করে বলেন, আমরা সহযোগিতা ও বিপর্যয়ের মধ্যকার প্রতিযোগিতায় পড়ে গেছি। ফুকুশিমার শিক্ষা নিয়ে পারমাণবিক সন্ত্রাস মোকাবিলায় আমাদের আরও সমৃদ্ধ হতে হবে। এই প্রতিযোগিতায় আমাদের পিছিয়ে পড়লে চলবে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ডিইএস ব্রাউন: সাবেক ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
ইগর এস ইভানভ: রাশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
সেই ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পারমাণবিক প্রকল্পে দুর্ঘটনার পর এটাই ছিল সবচেয়ে মারাত্মক পারমাণবিক দুর্ঘটনা। তদন্তকারীরা খুঁজে বের করেন, এই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ছিল আত্মতুষ্টি। যারা এর দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের ধারণা ছিল প্রকল্পের নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল খুবই শক্তিশালী। আর সেখানে কোনো কার্যকর স্বাধীন নজরদারিও ছিল না।
জাপানের এই বিপর্যয়ের পর সারা দুনিয়াতেই নিরাপদ পারমাণবিক বিদ্যুতের জগতে নানা সংস্কার শুরু হয়। কিন্তু পারমাণবিক নিরাপত্তার ব্যাপারটি আসলেই মনে হয়, সবার মধ্যে আত্মসন্তুষ্টি ভর করেছে। বিয়োগান্ত ঘটনা এসে নাড়া না দেওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব, ব্যাপারটা যেন এমন না হয়। আজ সারা দুনিয়ার বিভিন্ন পারমাণবিক প্রকল্পে অতি সমৃদ্ধ দেড় মিলিয়ন কেজি ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম বিশ্বের ২৫টি দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেগুলোর কিছু অংশের নিরাপত্তা খুবই নাজুক। কিন্তু লাখ লাখ মানুষকে হত্যা ও মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিসাধন করতে ছোট এক ব্যাগ চিনির সমপরিমাণ পারমাণবিক উপাদানই যথেষ্ট, অস্ত্র বানানোর জন্য এটুকু উপাদানই যথেষ্ট।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পারমাণবিক নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য অনেক কিছুই করা হয়েছে, কিন্তু সব দেশের সরকারের উচিত, বিধ্বংসী পারমাণবিক কর্মসূচির হাত থেকে তার জনগণকে রক্ষা করার জন্য আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া। ফুকুশিমা সংকট থেকে যে শিক্ষা আমরা পেয়েছি, সেটা এই লক্ষ্যে সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করতে পারে।
যারা শুরু করছে, তাদের উচিত হবে পারমাণবিক নিরাপত্তার ব্যাপারটি সার্বক্ষণিক উন্নতির ব্যাপার হিসেবে গ্রহণ করা। আর নতুন নতুন হুমকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য তাল মিলিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে হবে। যে ব্যবস্থা আজ থেকে ২০ বছর আগে নিরাপদ ভাবা হতো, সেটা হয়তো এখন আর নিরাপদ নয়। সেটা এখন সাইবার হামলার মুখে ভেঙে পড়তে পারে। সাইবার হামলা পারমাণবিক উপাদানগুলো নজরে রাখার প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
অরাষ্ট্রীয় কিন্তু সুসংগঠিত সংগঠন যেমন ইসলামিক স্টেট নতুন নতুন কৌশল, প্রযুক্তি ও সক্ষমতা ব্যবহার করে পারমাণবিক উপাদান চুরি করতে পারে। ফলে সরকারকে বিকাশমান প্রযুক্তি ও হুমকি ভালোভাবে মূল্যায়ন করতে হবে, যাতে সেই ব্যবস্থা এসব সম্ভাব্য চোরের হুমকির চেয়েও শক্তিশালী থাকে।
দ্বিতীয়ত, প্রতিটি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে নিরাপদ সংস্কৃতির মতো নিরাপত্তা সংস্কৃতি পারমাণবিক প্রকল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত কমান্ডের প্রধান কমান্ডার জেনারেল ইউজেন হাবিজার, যাঁকে মার্কিন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ‘নিরাপত্তা জার (রাজা)’ বলা হতো, বলেছিলেন, ‘ভালো নিরাপত্তার ২০ শতাংশ হচ্ছে যন্ত্রপাতি, আর ৮০ শতাংশ মানুষি সক্ষমতা।’
সরকার ও শিল্পকে একত্র হয়ে শক্তিশালী নিরাপত্তা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। পারমাণবিক প্রকল্পের সব কর্মীকে, অর্থাৎ প্রহরী থেকে বিজ্ঞানী পর্যন্ত, মনে করতে হবে যে নিরাপত্তা তাদের কাজের প্রয়োজনীয় অংশ। তৃতীয়ত, সরকারকে নিয়মিত পারমাণবিক প্রকল্পের নিরাপত্তা পর্যালোচনা করতে হবে। শুধু পারমাণবিক প্রকল্পের পরিচালকদের বললে হবে না যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা ‘যথেষ্ট ভালো’। বস্তুত কার্যকর নজরদারি আত্মসন্তুষ্টি দূর করতে পারে।
ফুকুশিমা কাণ্ড অন্যান্য পারমাণবিক প্রকল্পের পরিচালকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, নিয়মিত চাপ পরীক্ষা করতে হবে। পারমাণবিক কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে, এমন আকস্মিক সম্ভাবনা মোকাবিলাও করতে শিখিয়েছে এই ঘটনা। পরিচালকদের নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যবস্থার হুমকি মোকাবিলার সক্ষমতা নিরূপণ করতে হবে। কেন্দ্রের জ্ঞানী চোরেরা যাতে চুরি করতে না পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
শেষমেশ, বিশ্বনেতাদের পারমাণবিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে। চেরনোবিল ও ফুকুশিমার ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে, এক দেশের পারমাণবিক প্রকল্পে নিরাপত্তার ঘাটতি অন্য দেশে কতটা গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। পারমাণবিক নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়েও একই কথা প্রযোজ্য।
সন্ত্রাসীরা যেন এসব মারাত্মক উপাদানের নাগাল না পায় সেটা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের অভিন্ন রাজনৈতিক ও নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত নান-লুগার কো-অপারেটিভ থ্রেট রিডাকশন কর্মসূচি থেকে অন্যদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। যেসব দেশের পারমাণবিক শক্তি আছে, তাদের উচিত নিরাপত্তা জোরদার করা, সাধারণ পারমাণবিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ও মান পর্যবেক্ষণের সম্ভাবনা খুঁজে বের করা।
নিউক্লিয়ার থ্রেট ইনিশিয়েটিভের কো-চেয়ারম্যান আমাদের বন্ধু ও সহকর্মী স্যাম নান প্রায়ই সতর্ক করে বলেন, আমরা সহযোগিতা ও বিপর্যয়ের মধ্যকার প্রতিযোগিতায় পড়ে গেছি। ফুকুশিমার শিক্ষা নিয়ে পারমাণবিক সন্ত্রাস মোকাবিলায় আমাদের আরও সমৃদ্ধ হতে হবে। এই প্রতিযোগিতায় আমাদের পিছিয়ে পড়লে চলবে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ডিইএস ব্রাউন: সাবেক ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
ইগর এস ইভানভ: রাশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
No comments