বৈসাবি উৎসবের মধ্যে পরীক্ষা! by ইলিরা দেওয়ান
পাহাড়ে
বৈসাবি উৎসব সন্নিকটে। ছোট-বড় সবার মাঝে এখন উৎসবের আমেজ। আমরা যাঁরা
জীবিকার তাগিদে দুমুঠো খেয়ে বাঁচার জন্য পাহাড়ের বাইরে চাকরি করি, তাঁরাও
প্রিয়জনের সঙ্গে সারা বছরের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য এ সময় পাহাড়ের দিকে
ছুটে যাই।
এ দেশের প্রকৃতির রূপই এমন যে চৈত্র ও বৈশাখ মাসে প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়তে থাকে দেশ। তবে এ বছর প্রকৃতি দাবদাহের রূঢ়তায় নয়, কালবৈশাখীর তাণ্ডবে সারা দেশে ইতিমধ্যে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। অসংখ্য গ্রাম তছনছ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রকৃতির রুদ্রতা অর্থাৎ দাবদাহ কিংবা কালবৈশাখীর কালো মেঘ পাহাড়ের বৈসাবির আমেজে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। পাড়ায়-মহল্লায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কোলাহল, ঐতিহ্যবাহী খেলায় ছেলে-বুড়ো সবার উছলে পড়া ‘রেং’ (আনন্দে চিৎকার করা)।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, পাহাড়ের সবচেয়ে বড় এ উৎসবের সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পরীক্ষার সময়সূচি রাখা হয়। ফলে কোমলমতি শিশুরা পরীক্ষার জন্য মানসিক চাপে থেকে উৎসবের আমেজটা উপভোগ করতে পারে না। ছোট্ট সোমা চাকমা খাগড়াছড়ির একটি স্কুলের প্রাথমিক গ্রেডের শিক্ষার্থী। বৈসাবির পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সে অকপটে জানাল, সে সময় পরীক্ষা থাকবে, তাই বৈসাবির জন্য আলাদাভাবে কোনো পরিকল্পনা সে করেনি।
সোমা চাকমার জায়গায় আমরা কি কুমিল্লা বা রাজশাহীর শিশু কোনো সোমা বেগমের ঈদের সময়ে পরীক্ষার কথা ভাবতে পারি? বৈসাবির দিনে নতুন জামা গায়ে দিয়ে এ শিশুরা যে আনন্দটুকু পাবে, সে আনন্দ সারা বছর নতুন জামা গায়ে দিলেও তা পাবে না। কেবল এক দিনের ছুটি ঘোষণা দিয়ে পরীক্ষার মতো জগদ্দল বোঝা মাথায় চাপিয়ে দিয়ে পাহাড়ের শিশুদের অধিকারকেই মূলত কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, তিন পার্বত্য জেলায় প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’র জন্য সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির তালিকা সমন্বয় করে থাকে পার্বত্য জেলা পরিষদ। কিন্তু জাতীয়ভাবে পরীক্ষাসহ অন্যান্য কারিকুলাম প্রস্তুত করে মূলত ন্যাশনাল কারিকুলাম টেক্সট বুক বোর্ড (এনসিটিবি)।
সম্প্রতি এনসিটিবি সারা দেশ থেকে ৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নির্বাচন করেছে ‘ট্রাই আউট কার্যক্রম পরিচালনা’ শীর্ষক একটি প্রশিক্ষণের জন্য। এ কর্মসূচির লক্ষ্য হলো পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক সংস্করণ। পাঠ্যপুস্তক কিংবা শিক্ষকদের মানোন্নয়নের জন্য এ ধরনের হাজারো কর্মসূচি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে থাকবেই, সে বিষয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, প্রশিক্ষণের সময়সূচি নিয়ে (১২-১৩ এপ্রিল)। এ দুদিন পাহাড়ের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ উৎসব পালিত হয়ে থাকে।
জানা যায়, সারা দেশের ৩০টি সৌভাগ্যবান স্কুলের মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা থেকে নয়টি স্কুলের শিক্ষকেরা এ প্রশিক্ষণের আওতাভুক্ত হয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশ আদিবাসী। এনসিটিবি সারা দেশের স্কুলের কারিকুলাম নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার একটি দায়িত্বশীল দপ্তর হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষকদের বেলায় এনসিটিবির এত বড় বৈষম্য কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ একটি বহু জাতি, বহু সংস্কৃতি, বহু ভাষীর দেশ। বৃহত্তর বাঙালি গোষ্ঠী (মুসলমান ও হিন্দু) ছাড়াও এ দেশের আরও অন্যান্য যেসব জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়াদি সম্পর্কে আমাদের আরও সচেতন হওয়া উচিত।
কেননা, আদিবাসী শিক্ষকেরা যে মুহূর্তে বৈসাবি উৎসবের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখনই এ নোটিশ তাঁদের নিঃসন্দেহে হতাশ করেছে। আর এমন বড় উৎসবে পরিবারের প্রধান ব্যক্তির অনুপস্থিতির অর্থ সারা বছরের পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়া।
যথাক্রমে নার্সারি ও প্রথম শ্রেণির ছাত্রী রূপকথা ও তুলি। বৈসাবির প্রস্তুতি হিসেবে কয়েক দিন ধরে পরিদের মতো গোলাপি রঙের ফোলা জামা, লাল রঙের স্কার্ট, গোলাপি রঙের ক্লিপ, গোলাপি নেইল পলিশ ইত্যাদির বায়না চলছিল। কিন্তু তাদের স্কুলশিক্ষক মায়ের হঠাৎ ঢাকায় প্রশিক্ষণের নোটিশে তাদের সেই আনন্দ বিষাদে ভরে গেছে। কারণ তারা এখনো বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর বয়সে পৌঁছায়নি। তাই তাদের বৈসাবির সব আনন্দ মায়ের দুই হাত ধরে পাশের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এ বছর তারা সেই সীমাবদ্ধ আনন্দ থেকেও বঞ্চিত হবে।
আমরা কেবল শিশু অধিকার, শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন এসব নিয়ে সভা সেমিনারের কক্ষ গরম করে ফেলি। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এসব কোমলমতি শিশুদের কথা কেন আমরা বারবার ভুলে যাই। শিক্ষানীতিতে জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা বিকশিত করে প্রজন্ম পরম্পরায় সঞ্চালনের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে।
আমরা কি এ প্রজন্মকে সেই পরিবেশ সঠিকভাবে দিতে পারছি?
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
এ দেশের প্রকৃতির রূপই এমন যে চৈত্র ও বৈশাখ মাসে প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়তে থাকে দেশ। তবে এ বছর প্রকৃতি দাবদাহের রূঢ়তায় নয়, কালবৈশাখীর তাণ্ডবে সারা দেশে ইতিমধ্যে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। অসংখ্য গ্রাম তছনছ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রকৃতির রুদ্রতা অর্থাৎ দাবদাহ কিংবা কালবৈশাখীর কালো মেঘ পাহাড়ের বৈসাবির আমেজে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। পাড়ায়-মহল্লায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কোলাহল, ঐতিহ্যবাহী খেলায় ছেলে-বুড়ো সবার উছলে পড়া ‘রেং’ (আনন্দে চিৎকার করা)।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, পাহাড়ের সবচেয়ে বড় এ উৎসবের সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পরীক্ষার সময়সূচি রাখা হয়। ফলে কোমলমতি শিশুরা পরীক্ষার জন্য মানসিক চাপে থেকে উৎসবের আমেজটা উপভোগ করতে পারে না। ছোট্ট সোমা চাকমা খাগড়াছড়ির একটি স্কুলের প্রাথমিক গ্রেডের শিক্ষার্থী। বৈসাবির পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সে অকপটে জানাল, সে সময় পরীক্ষা থাকবে, তাই বৈসাবির জন্য আলাদাভাবে কোনো পরিকল্পনা সে করেনি।
সোমা চাকমার জায়গায় আমরা কি কুমিল্লা বা রাজশাহীর শিশু কোনো সোমা বেগমের ঈদের সময়ে পরীক্ষার কথা ভাবতে পারি? বৈসাবির দিনে নতুন জামা গায়ে দিয়ে এ শিশুরা যে আনন্দটুকু পাবে, সে আনন্দ সারা বছর নতুন জামা গায়ে দিলেও তা পাবে না। কেবল এক দিনের ছুটি ঘোষণা দিয়ে পরীক্ষার মতো জগদ্দল বোঝা মাথায় চাপিয়ে দিয়ে পাহাড়ের শিশুদের অধিকারকেই মূলত কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, তিন পার্বত্য জেলায় প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’র জন্য সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির তালিকা সমন্বয় করে থাকে পার্বত্য জেলা পরিষদ। কিন্তু জাতীয়ভাবে পরীক্ষাসহ অন্যান্য কারিকুলাম প্রস্তুত করে মূলত ন্যাশনাল কারিকুলাম টেক্সট বুক বোর্ড (এনসিটিবি)।
সম্প্রতি এনসিটিবি সারা দেশ থেকে ৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নির্বাচন করেছে ‘ট্রাই আউট কার্যক্রম পরিচালনা’ শীর্ষক একটি প্রশিক্ষণের জন্য। এ কর্মসূচির লক্ষ্য হলো পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক সংস্করণ। পাঠ্যপুস্তক কিংবা শিক্ষকদের মানোন্নয়নের জন্য এ ধরনের হাজারো কর্মসূচি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে থাকবেই, সে বিষয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, প্রশিক্ষণের সময়সূচি নিয়ে (১২-১৩ এপ্রিল)। এ দুদিন পাহাড়ের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ উৎসব পালিত হয়ে থাকে।
জানা যায়, সারা দেশের ৩০টি সৌভাগ্যবান স্কুলের মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা থেকে নয়টি স্কুলের শিক্ষকেরা এ প্রশিক্ষণের আওতাভুক্ত হয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশ আদিবাসী। এনসিটিবি সারা দেশের স্কুলের কারিকুলাম নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার একটি দায়িত্বশীল দপ্তর হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষকদের বেলায় এনসিটিবির এত বড় বৈষম্য কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ একটি বহু জাতি, বহু সংস্কৃতি, বহু ভাষীর দেশ। বৃহত্তর বাঙালি গোষ্ঠী (মুসলমান ও হিন্দু) ছাড়াও এ দেশের আরও অন্যান্য যেসব জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়াদি সম্পর্কে আমাদের আরও সচেতন হওয়া উচিত।
কেননা, আদিবাসী শিক্ষকেরা যে মুহূর্তে বৈসাবি উৎসবের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখনই এ নোটিশ তাঁদের নিঃসন্দেহে হতাশ করেছে। আর এমন বড় উৎসবে পরিবারের প্রধান ব্যক্তির অনুপস্থিতির অর্থ সারা বছরের পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়া।
যথাক্রমে নার্সারি ও প্রথম শ্রেণির ছাত্রী রূপকথা ও তুলি। বৈসাবির প্রস্তুতি হিসেবে কয়েক দিন ধরে পরিদের মতো গোলাপি রঙের ফোলা জামা, লাল রঙের স্কার্ট, গোলাপি রঙের ক্লিপ, গোলাপি নেইল পলিশ ইত্যাদির বায়না চলছিল। কিন্তু তাদের স্কুলশিক্ষক মায়ের হঠাৎ ঢাকায় প্রশিক্ষণের নোটিশে তাদের সেই আনন্দ বিষাদে ভরে গেছে। কারণ তারা এখনো বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর বয়সে পৌঁছায়নি। তাই তাদের বৈসাবির সব আনন্দ মায়ের দুই হাত ধরে পাশের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এ বছর তারা সেই সীমাবদ্ধ আনন্দ থেকেও বঞ্চিত হবে।
আমরা কেবল শিশু অধিকার, শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন এসব নিয়ে সভা সেমিনারের কক্ষ গরম করে ফেলি। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এসব কোমলমতি শিশুদের কথা কেন আমরা বারবার ভুলে যাই। শিক্ষানীতিতে জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা বিকশিত করে প্রজন্ম পরম্পরায় সঞ্চালনের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে।
আমরা কি এ প্রজন্মকে সেই পরিবেশ সঠিকভাবে দিতে পারছি?
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
No comments