ঢাকাকে যেমন দেখেছিলেন গুন্টার গ্রাস by কাজল ঘোষ
গ্রাস।
পুরো নাম গুন্টার ভিলহেম গ্রাস। বিশ্বব্যাপী গুন্টার গ্রাস নামে সমধিক
পরিচিত। ‘টিনড্রাম’ উপন্যাসের জন্য ১৯৯৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার
পেয়েছেন। জন্মেছেন পোল্যান্ডের বাল্টিকে। জন্মসূত্রে জার্মানি এই লেখক
লিখেছেন দশটি উপন্যাস, বেশ ক’টি নাটক ও কয়খানা ভ্রমণকাহিনী। খ্যাতনামা এই
মানুষটির ঢাকা ড্রাম রয়েছে। ঢাকা নিয়ে রয়েছে অগাধ ভালবাসা। নোবেল পুরস্কার
অর্জনের প্রায় এক যুগ আগেই তিনি ঢাকায় বেড়াতে এসেছেন। শুধু ঢাকা নয় গিয়েছেন
সোনারগাঁ, টাঙ্গাইল। সময়টা ১৯৮৬ সাল। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে গুন্টার গ্রাস
ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন টানা সাতদিন। ডিসেম্বরের ২ তারিখ থেকে ৯ তারিখ।
সঙ্গী করেছিলেন স্ত্রী উটে গ্রাসকে। মানবতাবাদী এই লেখক ঢাকায় এসে বেড়াতে
গিয়েছিলেন বুড়িগঙ্গা, শাঁখারীবাজার, লালবাগের কেল্লা, মোহাম্মদপুরের জেনেভা
ক্যাম্প, মৌলভীবাজার। অংশ নিয়েছেন বেশ কিছু ঘরোয়া অনুষ্ঠানাদিতেও।
সাতদিনের এই বর্ণাঢ্য ভ্রমণে সঙ্গী করেছিলেন কখনও কবি বেলাল চৌধুরী, কখনও
শিল্পী এসএম সুলতান। ভ্রমণের প্রতিটি মুহূর্ত ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন
আলোকচিত্র সাংবাদিক নাসির আলী মামুন।
গুন্টার গ্রাস জার্মানি ফিরে লিখেছেন ঢাকা ভ্রমণের নানা বৃত্তান্ত। তিনি লিখেছেন, ‘বিমানবন্দরের একদল লেখক আমাদেরকে ফুলসহ বরণ করে নেয়। চীনা-খাবার নেয়ার পর আমরা মশারি ছাড়াই নিদ্রা যাই আর ল্যাংটা বোধ করি। পরদিন সকালে একটি রংচঙে রিকশায় চড়ে আমরা পুরাতন শহরে যাই। ভাড়া ঠিক করতে কিছুটা সময় লাগে। জনৈক লেখক বেলাল চৌধুরী আমাদের গাইড। মুসলমানদের এ নগরীতে পুরুষরাই সড়কে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। কেবল একটি অংশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা বাস করে। দাউদের মতো বেলালও হইচই ছাড়াই আমাদেরকে কারখানায় ঢোকায়, পরিবারগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তক্তার ছাউনি দিয়ে পরিসর বাড়ানো একটি ঘিঞ্জি বাড়িতে এক যুবক আলমারির মতো সিন্দুক খুলে দেখালো গোপন গৃহবেদী: যেখানে আছে টুকিটাকি সামগ্রীর মতো দুর্গা, গণেশ আর লক্ষ্মীর মূর্তি; আর আছে মশারি সমেত একটি পুতুলের খাট যেখানে ঘুমানোর সময় দেব-দেবীদের শুইয়ে রাখা হয়। নতুন হত্যাযজ্ঞের আশঙ্কা হাসিমুখে নাকচ করে দিল যুবকÑএর অবশ্য সামান্য গুরুত্ব আছে। পরিবারে আছে অনেকগুলো শিশু।
কারখানাগুলোতে লোহার পাত দিয়ে ঝিনুক কেটে চুড়ি বানানো হয়। বাম পা দিয়ে কাষ্ঠখ-ের উপরে রাখা ঝিনুক চেপে ধরা হয় আর পায়ের আঙুলের পাশে করাত স্থাপন করে দুহাত দিয়ে চালানো হয়। করাতের পাতটি ধাতুর তৈরি হলেও উৎপাদন পদ্ধতিটি প্রস্তরযুগীয়। এরপর আমরা মোগল আমলে নির্মিত লালবাগ কেল্লার অবশিষ্ট দেখতে যাই। একটি ক্ষুদ্রাকৃতির জাদুঘর, তবু সংস্কৃতির পূজারি ইংরেজরা কিভাবে জাদুঘরগুলোকে সমৃদ্ধ করেছিল তারই নিদর্শন। এর সঙ্গে বৃহত্তর জার্মানির ফিল্ড মার্শাল গোয়েরিংয়ের বিদেশী শিল্প সম্পদের প্রতি অনুরাগের তুলনা চলে। সেদিন বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর পরিকল্পিত বিনাশের ওপর একটি আলোচনা। বস্তুত বাঙালি জাতীয়তাবাদ জাতীয় সীমানা মানে না। বাংলাদেশের ভেতরে সামরিক সরকার এই বিনাশ অভিযানের সমালোচনা করতে দেয় না। কিন্তু মধ্যবিত্তশ্রেণী দ্বারা নির্বাচিত বিরোধী দলও উপজাতীদের ভাগ্যের ব্যাপারে সামান্যই উদ্বিগ্ন। কলকাতার মতো এখানেও বেঁচে থাকার প্রাত্যহিক সংগ্রাম পরিবারের বাইরে সহানুভূতি শুষে নেয়।
পরদিন এক সাহিত্যপ্রেমিক শিল্পপতির বাসায় রাতের খাবারের দাওয়াত। এতে অন্য লেখকরাও উপস্থিত ছিলেন। তবে বেলাল সঙ্গত কারণেই দাওয়াতটি কবুল করেনি। শিল্পপতির স্ত্রী হারমোনিয়াম সহযোগে ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে দুটো রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করে। আহারের সময় আলাপচারিতায় এমন সব প্রশ্ন ছোড়া হলো যেগুলোর কদাচিৎই উত্তর দেয়ার সুযোগ থাকে। টেবিলের চারদিকে রাজনৈতিক রসালাপ উপভোগের পর আমরা মূল প্রসঙ্গে এলাম। যদিও বাংলা চিরতরে বিভক্ত হয়ে গেছে একমাত্র যে কারণে তা জার্মানির সঙ্গে তুলনীয়-তবুও সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এখনও নিঃসন্দেহে অবিভাজ্য।
পরদিন গেলাম কুমোরদের পাড়ায়। প্লাস্টিকের তৈরি তৈজস দ্রুত বাজার দখল করায় এরা এখন বেকার হতে বসেছে। বিকালে বেলাল আমাদের জেনেভা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। একটি সুবিস্তৃত ও ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি যেখানে বিশ হাজার মুসলিম বিহারি বাস করে।
গুন্টার গ্রাস জার্মানি ফিরে লিখেছেন ঢাকা ভ্রমণের নানা বৃত্তান্ত। তিনি লিখেছেন, ‘বিমানবন্দরের একদল লেখক আমাদেরকে ফুলসহ বরণ করে নেয়। চীনা-খাবার নেয়ার পর আমরা মশারি ছাড়াই নিদ্রা যাই আর ল্যাংটা বোধ করি। পরদিন সকালে একটি রংচঙে রিকশায় চড়ে আমরা পুরাতন শহরে যাই। ভাড়া ঠিক করতে কিছুটা সময় লাগে। জনৈক লেখক বেলাল চৌধুরী আমাদের গাইড। মুসলমানদের এ নগরীতে পুরুষরাই সড়কে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। কেবল একটি অংশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা বাস করে। দাউদের মতো বেলালও হইচই ছাড়াই আমাদেরকে কারখানায় ঢোকায়, পরিবারগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তক্তার ছাউনি দিয়ে পরিসর বাড়ানো একটি ঘিঞ্জি বাড়িতে এক যুবক আলমারির মতো সিন্দুক খুলে দেখালো গোপন গৃহবেদী: যেখানে আছে টুকিটাকি সামগ্রীর মতো দুর্গা, গণেশ আর লক্ষ্মীর মূর্তি; আর আছে মশারি সমেত একটি পুতুলের খাট যেখানে ঘুমানোর সময় দেব-দেবীদের শুইয়ে রাখা হয়। নতুন হত্যাযজ্ঞের আশঙ্কা হাসিমুখে নাকচ করে দিল যুবকÑএর অবশ্য সামান্য গুরুত্ব আছে। পরিবারে আছে অনেকগুলো শিশু।
কারখানাগুলোতে লোহার পাত দিয়ে ঝিনুক কেটে চুড়ি বানানো হয়। বাম পা দিয়ে কাষ্ঠখ-ের উপরে রাখা ঝিনুক চেপে ধরা হয় আর পায়ের আঙুলের পাশে করাত স্থাপন করে দুহাত দিয়ে চালানো হয়। করাতের পাতটি ধাতুর তৈরি হলেও উৎপাদন পদ্ধতিটি প্রস্তরযুগীয়। এরপর আমরা মোগল আমলে নির্মিত লালবাগ কেল্লার অবশিষ্ট দেখতে যাই। একটি ক্ষুদ্রাকৃতির জাদুঘর, তবু সংস্কৃতির পূজারি ইংরেজরা কিভাবে জাদুঘরগুলোকে সমৃদ্ধ করেছিল তারই নিদর্শন। এর সঙ্গে বৃহত্তর জার্মানির ফিল্ড মার্শাল গোয়েরিংয়ের বিদেশী শিল্প সম্পদের প্রতি অনুরাগের তুলনা চলে। সেদিন বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর পরিকল্পিত বিনাশের ওপর একটি আলোচনা। বস্তুত বাঙালি জাতীয়তাবাদ জাতীয় সীমানা মানে না। বাংলাদেশের ভেতরে সামরিক সরকার এই বিনাশ অভিযানের সমালোচনা করতে দেয় না। কিন্তু মধ্যবিত্তশ্রেণী দ্বারা নির্বাচিত বিরোধী দলও উপজাতীদের ভাগ্যের ব্যাপারে সামান্যই উদ্বিগ্ন। কলকাতার মতো এখানেও বেঁচে থাকার প্রাত্যহিক সংগ্রাম পরিবারের বাইরে সহানুভূতি শুষে নেয়।
পরদিন এক সাহিত্যপ্রেমিক শিল্পপতির বাসায় রাতের খাবারের দাওয়াত। এতে অন্য লেখকরাও উপস্থিত ছিলেন। তবে বেলাল সঙ্গত কারণেই দাওয়াতটি কবুল করেনি। শিল্পপতির স্ত্রী হারমোনিয়াম সহযোগে ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে দুটো রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করে। আহারের সময় আলাপচারিতায় এমন সব প্রশ্ন ছোড়া হলো যেগুলোর কদাচিৎই উত্তর দেয়ার সুযোগ থাকে। টেবিলের চারদিকে রাজনৈতিক রসালাপ উপভোগের পর আমরা মূল প্রসঙ্গে এলাম। যদিও বাংলা চিরতরে বিভক্ত হয়ে গেছে একমাত্র যে কারণে তা জার্মানির সঙ্গে তুলনীয়-তবুও সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এখনও নিঃসন্দেহে অবিভাজ্য।
পরদিন গেলাম কুমোরদের পাড়ায়। প্লাস্টিকের তৈরি তৈজস দ্রুত বাজার দখল করায় এরা এখন বেকার হতে বসেছে। বিকালে বেলাল আমাদের জেনেভা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। একটি সুবিস্তৃত ও ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি যেখানে বিশ হাজার মুসলিম বিহারি বাস করে।
No comments