পুনর্গঠন ও আন্দোলনের যৌথপ্রস্তুতি বিএনপিতে by কাফি কামাল
উপজেলা নির্বাচনের পর আন্দোলন ও সাংগঠনিক
পুনর্গঠনের নানামুখী প্রস্তুতি শুরু হয়েছে বিএনপিতে। একদিকে সাংগঠনিক
দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে কাউন্সিলসহ মহানগর কমিটি পুনর্গঠন অন্যদিকে
সরকারবিরোধী আন্দোলন।
দুই
ইস্যুতেই প্লাটফর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে সদ্যসমাপ্ত উপজেলা
নির্বাচনকে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে এ
ব্যাপারে পর্যালোচনা ও প্রাকপ্রস্তুতি শুরুর তাগিদ দিয়েছেন। তবে বর্তমানে
দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা
কারাবন্দি ও স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ারসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা
চিকিৎসাধীন থাকায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপেক্ষা করছেন চেয়ারপারসন। নেতাদের
মুক্তি ও সুস্থতার পর আনুষ্ঠানিকভাবেই সে প্রস্তুতি শুরু হবে। সূত্র জানায়,
উপজেলা নির্বাচনে আন্দোলনের একটি যৌক্তিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এখন সঠিক
একটি ইস্যুতে রুখে দাঁড়ানোর অপেক্ষা। একই ভাবে তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলন ও
উপজেলা নির্বাচনে নেতাদের সাংগঠনিক দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার পরীক্ষা হলেও
অন্তর্কোন্দল নিরসনের মাধ্যমে পুনর্গঠনে কিছুটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাই
পরবর্তী আন্দোলনে যাওয়ার আগে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাঠিয়ে ওঠার জন্য কিছুটা
সময় নিচ্ছে বিএনপি। তবে উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে
তত্ত্বাবধায়ক দাবির যৌক্তিকতা পাকাপোক্ত হওয়ায় নির্বাচন কমিশনকে দিয়েই শুরু
হতে পারে পরবর্তী আন্দোলন। ইতিমধ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের
মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে সরানোর দাবি তুলেছেন বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা।
সূত্র জানায়, শিগগির নীতিনির্ধারক মহল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে আন্দোলনের
রোডম্যাপ ও কর্মসূচি নির্ধারণ করবে বিএনপি। তবে শিগগিরই রাজপথের কঠোর
আন্দোলনে যাচ্ছে না দলটি। এ ব্যাপারে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর
চন্দ্র রায় বলেন, পরিস্থিতির বিচার-বিবেচনা চলছে। সঠিক সময়ে সঠিক কর্মসূচি
নিয়েই আন্দোলনে নামবে বিএনপি। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান
বলেন, উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল আমাদের আন্দোলনের একটি কৌশল। সরকার
ব্যাপক অনিয়ম করায় আমাদের সে কৌশল সফল হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনকে আমরা
আন্দোলনের প্লাটফর্ম হিসেবে নিয়েছি। কিন্তু কোন হঠকারিতা নয়, জনগণের দল
হিসেবে বিএনপি এখন সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে। নিজেদের দুর্বলতা
কাটিয়ে সঠিক ইস্যুতে বিএনপি আন্দোলনে যাবে। এদিকে উপজেলা নির্বাচনের পর এখন
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন জাতীয় সংসদ
নির্বাচন আদায়ের দাবিতে রাজপথে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলাই বিএনপির সামনে বড়
চ্যালেঞ্জ। ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টানা আন্দোলনের পর
রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির ধকল কাটাতে বিরতি দেয় বিএনপি। দলীয় সরকারের অধীনে
জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলেও আন্দোলনের অংশ হিসেবে উপজেলা নির্বাচনে অংশ
নেয় বিএনপি। সে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের ঘটনা ঘটলেও কঠোর কোন কর্মসূচি
দেয়া হয়নি দলের তরফে। বিএনপি নেতারা জানান, উপজেলা নির্বাচনে বিজয় অর্জনই
একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না ১৮ দলের। দলীয় সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন সুষ্ঠু
হওয়া সম্ভব নয়- এই বিষয়টি দেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে প্রমাণের
বিষয়টিই ছিল আসল চ্যালেঞ্জ। সে চ্যালেঞ্জে সফল হয়েছে বিএনপি। উপজেলা
নির্বাচনে ক্ষমতার পটপরিবর্তন না হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের জন্য অনিয়মের
সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে সরকার। শেষ দিকের উপজেলা নির্বাচনগুলোর
গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ- যা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি খুলে দিয়েছে। এছাড়া
আওয়ামী লীগের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে যাদের কৌতূহল ছিল তারাও
জবাব পেয়েছে। এদিকে উপজেলা নির্বাচনের পর ফের সরকার বিরোধী আন্দোলনে নামার
ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ১৮ দলীয় শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া। তবে
নির্বাচন পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে দলের নেতারা বলেছেন, জনদুর্ভোগ
সৃষ্টিকারী কোন কর্মসূচি দেবে না বিএনপি। দলীয় সূত্র জানায়, উপজেলা
নির্বাচনের অনিয়ম ও নৈরাজ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। দলের পক্ষ
থেকে শিগগিরই সে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। ওদিকে নির্বাচন কমিশনের বিধি ও
দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল
আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু করেছিল বিএনপি। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন শুরু ও দলের
একাধিক সিনিয়র নেতা কারাবন্দি হওয়ায় কাউন্সিল আয়োজন থেকে সরে আসে দলটি।
নেতারা জানান, দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা ও নিষ্ক্রিয় নেতাদের
সম্মানজনক বিদায় জানাতেই কাউন্সিল আয়োজনকে প্রাধান্য দিয়েছিল বিএনপি।
উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূল ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের অন্তর্কোন্দল প্রকাশ্যে
চলে আসায় সাংগঠনিক পুনর্গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। নেতাদের দলের প্রতি আনুগত্য ও
নিষ্ঠার একটি পরীক্ষা হয়েছে উপজেলা নির্বাচনে। ফলে কাউন্সিলের মাধ্যমে
আগামীতে দলের প্রতি একনিষ্ঠ নেতাদের নেতৃত্বে আনার ব্যাপারে এক ধাপ এগিয়ে
গেছে বিএনপি। দলীয় সূত্র জানায়, উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের কয়েকজন
সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ জমা হয়েছে চেয়ারপারসনের কাছে।
নির্বাচনী বাস্তবতা ও ফলাফলসহ সার্বিক বিবেচনায় সে সব অভিযোগের অনেকগুলো
প্রমাণও হয়েছে। এছাড়া উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করায় জাতীয়
নির্বাহী কমিটির সদস্যসহ অন্তত অর্ধশতাধিক কাউন্সিলরকে বহিষ্কার করেছে
বিএনপি। ফলে নতুন করে সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সে পদগুলোতে নতুন
নেতৃত্বের পদায়ন করতে হবে। অন্যদিকে দলের স্থায়ী কমিটিসহ কেন্দ্রীয় কমিটির
শতাধিক নিষ্ক্রিয় নেতাকে সরিয়ে নতুন নেতৃত্ব আনার একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত
হয়েছে বিএনপিতে। সব মিলিয়ে দলের কাউন্সিল আয়োজনের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ
অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দেখা হচ্ছে। নেতারা জানান, কাউন্সিলের নতুন করে
প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম
আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা কারামুক্ত হলেই কাউন্সিনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি
শুরু হবে। এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন ও ৫ই জানুয়ারির
নির্বাচন প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য অভিযোগের সর্বাধিক তীর ছিল মহানগর
কমিটির দিকে। দলের তৃণমূল থেকে শীর্ষ নেতৃত্ব প্রকাশ্যেই মহানগর নেতাদের
ব্যর্থতার সমালোচনা করেছেন। তারই প্রেক্ষিতে দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
ইউনিট ঢাকা মহানগর কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয় বিএনপি। মহানগরের আহ্বায়ক
সাদেক হোসেন খোকা সংবাদ সম্মেলন করে অব্যাহতি চাইলেও তিনি সমালোচকদের এক
হাত নেন। দলের সবমহলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরাসরি কমিটির চেয়ে স্বল্প
সময়ের জন্য একটি সমন্বয়ক কমিটির ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছিলেন খোদ খালেদা জিয়া।
দলের স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ও চেয়ারপারসনের দুই উপদেষ্টাসহ ৫০ জনকে নিয়ে
সে কমিটির একটি খসড়াও তৈরি করা হয়েছিল। সে কমিটিকে দিয়ে তিন মাসের মধ্যে
মহানগরের প্রতিটি ওয়ার্ড কমিটি পুনর্গঠনের মাধ্যমে মহানগর কমিটি গঠনের
সিদ্ধান্ত ছিল বিএনপির। কিন্তু কেন্দ্রীয় ও মহানগরের কয়েকজন প্রভাবশালী
নেতার কারণে সে কমিটির শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ
করে। ফলে মহানগর কমিটি পুনর্গঠন থমকে যায়। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন সূত্র
জানায়, মহানগর পুনর্গঠন থেকে সরে আসেনি বিএনপি। কোন্দল এড়াতে বিকল্প পথে
এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
No comments