মোদি না রাহুল জটিল অঙ্ক ভারতে by পরিতোষ পাল
ভারতের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন নানা দিক
থেকেই বেশ জটিল বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য জনমত সমীক্ষার একচেটিয়া রায়,
পরিবর্তন হচ্ছেই। ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন হিন্দুবাদী
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের এক সময়ের প্রচারক এবং বর্তমানে গুজরাট রাজ্যের
মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। বিজেপির নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী
গণতান্ত্রিক জোট বা এনডিএ শেষ পর্যন্ত সরকার গঠন করবে বলে একদল নিশ্চিত
হলেও সরকার গঠন নিয়ে সংশয়ের কথাও বলছেন অনেকে। আর জনমত সমীক্ষার ফল যে সব
সময় মিলে যায় তা-ও নয়।
তবে
এটা ঠিক যে, দিল্লিতে ক্ষমতা দখলের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কট্টর
হিন্দুবাদী সংঘ পরিবারের পরিকল্পনা অনুযায়ী অনেক আগে থেকেই দলের প্রবীণদের
মতামতকে অগ্রাহ্য করে নরেন্দ্র মোদীকে বিজেপি তথা এনডিএ‘র প্রধানমন্ত্রী
প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণা করা হয়েছে। আর এরপর চা-ওয়ালা থেকে গুজরাটের সফল
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদীকে তুলে ধরা হয়েছে এমনভাবে যে, দেশজুড়ে মোদীর নামে
একটা উন্মাদনা তৈরি হয়েছে একাংশের মধ্যে। ভারতের শিল্পপতিরাও এখন ‘নমো’
(মোদীর সংক্ষেপ) মন্ত্রে মুগ্ধ। মোদীর নেতৃত্বে গুজরাট সরকারের সাফল্য
সম্পর্কে যে ফানুস ওড়ানো হয়েছে তা যে সঠিক নয় তা অর্থনীতিবিদদের একাংশ
স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন। তবু মোদী হাওয়া সর্বত্র বিরাজ করছে। এর কারণ
সম্পর্কে অবশ্য বিশ্লেষকরা কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট বা
ইউপিএ সরকারের ব্যর্থতাকেই পরোক্ষে দায়ী করেছেন। প্রথম ইউপিএ সরকার
কোনরকমে আস্থা তৈরি করতে পারলেও দ্বিতীয় দফায় ইউপিএ সরকার স্ক্যাম আর
দুর্নীতিতে এমনভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিল যে, মানুষ এই সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে
মুক্তি চাইছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিং যে দুর্বলতার পরিচয়
দিয়েছেন সেটা সবাই মেনে নিয়েছেন। ফলে ইউপিএ সরকার দিশাহীনতায় ভুগেছে গত
পাঁচটি বছর। অর্থনীতির ক্ষেত্রে নীতি পঙ্গুত্ব সার্বিকভাবে দেশকে দুর্বল
করেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ১০ বছর সরকারে থাকার প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধিতা।
আর তাই কংগ্রেস এবারের নির্বাচনে ১০০ পেরোতে পারবে না বলে একটা হাওয়া
সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে দলের অনেক তাবড় নেতা নির্বাচনে অংশ নিতেই ভয় পেয়েছেন।
কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী দলকে চাঙ্গা করার চেষ্টায় সবাইকে এগিয়ে
আসতে আহ্বান জানালেও অনেকেই পিছিয়ে থেকেছেন। তবে এটা ঠিক যে, প্রথম দিকে
কংগ্রেস সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়েছিল মিডিয়ার দৌলতে তা অনেকটাই পাল্টে
গেছে। এখন অবশ্য বলা হচ্ছে কংগ্রেস ১০০ পেরিয়ে যাবে অনায়াসেই। গত নির্বাচনে
এই কংগ্রেসই পেয়েছিল ২০৬টি আসন। এবারের নির্বাচনী লড়াইয়ে কংগ্রেসের সবচেয়ে
বড় অসুবিধা হয়েছে মিত্রদের ছেড়ে যাওয়ার ঘটনা। দক্ষিণে করুণানিধির ডিএমকে
কংগ্রেস সঙ্গ ত্যাগ করেছে। বিহারে রামবিলাস পাসোয়ানের লোক জনমুক্তি পার্টি
কংগ্রেসকে ছেড়ে নাম লিখিয়েছে বিজেপির খাতায়। মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি
এবং মুলায়ম সিংয়ের সমাজবাদী পার্টি ইউপিএ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন যুগিয়ে
সরকার বাঁচিয়ে রাখলেও নির্বাচনী ময়দানে এরাও কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে
রেখেছে। অন্ধ্রপ্রদেশে দলের মধ্যে ভাঙন নিশ্চিত জেনেও তেলেঙ্গানা রাজ্য
গঠনের মাধ্যমে কংগ্রেস শক্তি সঞ্চয়ের যে স্বপ্ন দেখেছিল তাকে ধূলিসাৎ করে
দিয়েছে তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় পরিষদ। চন্দ্রশেখর রাও কংগ্রেসে মিশে যাওয়ার
প্রতিশ্রুতি থেকে শুধু সরেই যাননি, বরং কংগ্রেসকে বেকায়দায়ই ফেলে দিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস অনেকদিন আগেই ইউপিএ ছেড়ে আলাদাভাবে শক্তি
সঞ্চয়ের লক্ষ্যে এবার কারও সঙ্গে জোট না করেই লড়াইয়ে নেমেছে। অন্যদিকে
ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ও আসাউদ্দিন ওয়াইসির দলও এবার কংগ্রেস থেকে দূরত্ব
বজায় রেখে নির্বাচনে নেমেছে। ফলে কংগ্রেসের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত
ধরে নিয়েই ভারতের সব ক’টি দল তাদের ঘুঁটি সাজিয়েছেন। পরবর্তী সরকার গঠনের
ক্ষেত্রে অনেক আঞ্চলিক দল নির্ণায়কের ভূমিকা নেয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এ
তালিকায় তামিলনাডুর এআইডিএমকে নেত্রী জয়ললিতা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন
মুলায়ম সিং যাদব, মায়াবতী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীন পট্টনায়েক বা
নীতিশকুমারের মতো নেতারা। ফলে এবারের নির্বাচনী লড়াই হচ্ছে বহুমুখী। ভোট
কাটাকুটির জটিল অঙ্কে কার ভাগ্য কিভাবে কোনদিকে ঢলে পড়বে তা নিশ্চিত ভাবে
কেউই বলতে চাইছেন না। বিজেপি যদিও শেষ মুহূর্তে হিন্দুত্বের তাস গুটিয়ে
রেখে ভালভাবে সরকার চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু সংখ্যালঘু মানুষ
হিন্দুবাদী মোদীর যে ভয়ঙ্কর রূপ গুজরাট দাঙ্গায় দেখেছেন তা আজও ভুলতে
পারছেন না। তাই প্রায় ১৮-২০ শতাংশ মুসলমানের ভোট কোনদিকে কিভাবে প্রয়োগ হবে
তার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। দিল্লি শাহি ইমাম যদিও মুসলমানদের
কংগ্রেসকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু বিভিন্ন মুসলমান সংগঠনের
নেতারা জানিয়েছেন, কোন দলের কথা ঘোষণা না করে বরং সেকুলার দলকে ভোট দেয়ার
কথা বলা উচিত। মুসলমান নেতাদের এই মনোভাব থেকে এটা স্পষ্ট যে, বিজেপির
পক্ষে মুসলমান ভোট খুব একটা যাবে না। তবে কংগ্রেসকে মুসলমানরা প্রথম থেকে
ভোট দিয়ে এলেও এখন তারা কংগ্রেস সম্পর্কে মোহমুক্ত। তাই তাদের ভোট এবার
আঞ্চলিক দলগুলোর দিকেই যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ধরনের অনিশ্চতার মাঝে
স্বচ্ছ রাজনীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে এবারের নির্বাচনী
লড়াইকে বর্ণময় করে তুলেছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি। ৪৯ দিন
দিল্লিতে রাজ্য সরকার চালাতে গিয়ে কেজরিওয়াল বুঝেছেন, এই ব্যবস্থায়
দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের নেতৃত্ব দেয়া খুবই কঠিন কাজ। তবুও এবারের
নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী দিয়ে আরবিন্দ কেজরিওয়াল ভারতের রাজনীতিতে
একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন,
নির্বাচনে জেতার লক্ষ্যে নয়, তাদের বিশুদ্ধ রাজনীতির কথা তুলে ধরতেই এই
লড়াই। মাত্র ১৫ মাসের এই দল ভারতের মতো বিশাল দেশে এখন পর্যন্ত তেমন প্রভাব
ফেলতে পারবে না বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একমত হলেও দিল্লি, হরিয়ানা,
পাঞ্জাব বা মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে আম আদমি পার্টি জাতীয় রাজনৈতিক
দলগুলোকে অনেক আসনেই নাকানি চুবানি খাইয়ে দিতে পারে। এই দলের মূল শক্তি
তরুণ শিক্ষিত ভোটাররা। এদের প্রার্থীরা কেউ গরিব গুর্বো নয়। সবাই সমাজের
উপর ও মাঝারি তলার প্রতিনিধি। তাই শেষ পর্যন্ত এবারের নির্বাচনের পরে সরকার
গঠনের ক্ষেত্রে বিজেপি কতটা সফল হতে পারবে তা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে।
বিজেপি অবশ্য দক্ষিণে তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে ৬টি দলের সঙ্গে জোট তৈরি
করেছে। তেমনি অন্ধ্র প্রদেশে চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টির সঙ্গে
জোট গঠন করে এসব রাজ্যের দুর্বল জমিতে পা ফেলতে সক্রিয় হয়েছে। তবে বিজেপির
প্রভাব প্রতিপত্তি সবই উত্তর ও পশ্চিম নির্ভর। সারাদেশে বিজেপির প্রভাব
বিন্যস্ত নয়। ফলে লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে অর্ধেকের কাছাকাছি যাওয়া তাদের
পক্ষে খুবই কঠিন। অবশ্য মোদীর নামে যদি কোন ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয় তাহলে
অবশ্য আলাদা কথা। তাই সরকার গঠনের জন্য ২৭২ আসনের ম্যাজিক নম্বরে পৌঁছতে
হলে বিজেপিকেও জটিল অঙ্কের মধ্যেই ঘোরাফেরা করতে হবে।
No comments