ভারত-পাকিস্তান শান্তি কোন পথে? by টি ভি পল
ভারত-পাকিস্তান শান্তি আলোচনা দৃশ্যত
ভারতের সাধারণ নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিলম্বিত হবে। নির্বাচনের পরও
আলোচনা কতটা কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির
(বিজেপি) সম্ভাব্য বিজয়, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের
প্রেক্ষাপটে তালেবানের আবার চাঙা হয়ে ওঠা এবং পাকিস্তানি তালেবানের সঙ্গে
আলোচনা কিংবা তাদের দমনে পাকিস্তানের অব্যাহত ব্যর্থতা—সবকিছুই চরম
অনিশ্চয়তা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দেয়।
শান্তি স্থাপন
বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির ওপর আস্থা ইতিমধ্যেই ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশে
প্রবলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। গুজরাটে ২০০২ সালের দাঙ্গার সময় তিনিই ছিলেন
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। অনেকের আশঙ্কা, প্রধানমন্ত্রী হলে মোদি ভারতকে
সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভক্ত করে ফেলবেন। এ ছাড়া পাকিস্তান বিষয়ে
তিনি এ পর্যন্ত আপসহীন মনোভাবই দেখিয়েছেন। অন্তত আপাতত কিছুদিন তিনি কড়া
কথাবার্তাই চালিয়ে যাবেন। কিন্তু
মোদি হয়তো শেষ পর্যন্ত তাঁর দলের পূর্বসূরি অটল বিহারি বাজপেয়ির শিক্ষাটা
নেবেন। বাজপেয়ি নওয়াজ শরিফের সঙ্গে শান্তি আলোচনার জন্য ১৯৯৯ সালে লাহোর
সফর করেছিলেন। সেই নওয়াজ আবার ২০১৩ সালে ক্ষমতায় এসেছেন। মোদির বাজপেয়ির
নজির অনুসরণ করার যৌক্তিক কারণ আছে। পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি স্থাপন জাতীয়
ও আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর অবস্থান জোরদার করবে। ভারতকে বড় শক্তি হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত করার যে উচ্চাভিলাষ বিজেপির মনে রয়েছে, তা পূরণেও সহায়তা করবে
এটি। অন্যদিকে, নওয়াজ শরিফ নিজেও ভারতের প্রতি শান্তির বার্তা পাঠিয়েছেন।
এর পেছনেও কারণ আছে। প্রতিবেশী আফগানিস্তানের কাছে তাঁর অবস্থান জোরদার করা
ও স্বদেশে সহিংসতা দমনে তাঁর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ভারতের সঙ্গে
আপস-মীমাংসা অত্যাবশ্যক। ভারতের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করা গেলে তা নওয়াজকে
তাঁর দেশের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রভাব খর্ব করারও
সুযোগ করে দেবে। ভবিষ্যৎ মোদি সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনার পথে গেলে নওয়াজ
শরিফের স্বদেশে তোপের মুখে পড়ার ঝুঁকি আছে বটে, কিন্তু প্রধান দলগুলোর
সমর্থন পেলে তিনি হয়তো এর পরও সম্পর্কের বরফ গলানোর চেষ্টা করবেন।
বস্তুত,
ভারত-পাকিস্তান শান্তি আলোচনার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে সম্ভাব্য বাগড়ার
মুখে এর নাজুক অবস্থা। শান্তি-প্রক্রিয়া শুরু হতে না হতেই শক্তিশালী কায়েমি
স্বার্থবাদীদের হাতে তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
কারণ, শান্তি চুক্তি হয়ে গেলে তাদের ক্ষমতার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। সংঘাত
অব্যাহত থাকলে তারা যে রাজনৈতিক সমর্থন পায়, তারও অবসান ঘটবে। এর বহু নজির
রয়েছে। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ভারত-নিয়ন্ত্রিত
কাশ্মীরের কারগিল পাহাড়ে সেনা পাঠিয়ে লাহোর শান্তি-প্রক্রিয়াকে নড়বড়ে করে
দেন। এর জবাবে ভারতের চালানো সামরিক অভিযান শান্তি আলোচনার কবর রচনা করে।
২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবা
(এলইটি) ও জইশ-ই-মোহাম্মদ (জেইএম) ভারতের পার্লামেন্ট ভবনে যে হামলা চালায়,
তা বিজেপি সরকার ও মোশাররফের সেনা সরকারের মধ্যে চলমান অনানুষ্ঠানিক
আলোচনা ভেস্তে দেয়। শান্তি-প্রক্রিয়া বানচালের শক্তি ভারতেও সক্রিয়।
নয়াদিল্লি ও লাহোরের মধ্যে মৈত্রী ট্রেন সার্ভিস ‘সমঝোতা এক্সপ্রেস’-এ ২০০৭
সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক বোমা হামলায় (দৃশ্যত হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কাজ)
উভয় দেশের ৬৮ জন নাগরিক নিহত হয়। নয়াদিল্লিতে পাকিস্তানি
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের ঠিক আগে ওই হামলা চালানো হয়।
উভয় দেশেই সরকারের প্রতি জনসমর্থন কম থাকায় শান্তি উদ্যোগের বিরোধী মহলটির হাত শক্তিশালী হয়। ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানকেই বিজেপি ও অন্য বিরোধী দলগুলোর সমালোচনা মোকাবিলার একমাত্র অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। আর ভারতীয়দের অনেকেই নওয়াজ শরিফের সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালানোর উপযোগিতা নিয়েও সংশয়ে ভুগছে। কারণ, সামরিক-বেসামরিক দ্বন্দ্বের কারণে এ সরকার হয়তো মেয়াদ পূর্ণ না-ও করতে পারে। নওয়াজ-অনুগত জেনারেল রাহিল শরিফকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করায় দ্বন্দ্ব এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তবে আফগানিস্তানে পাকিস্তান ও ভারত পরস্পরবিরোধী পক্ষকে সমর্থন করছে বলে সে দেশে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও আইএসআই আবার তাদের কর্তৃত্ব জাহিরে তৎপর হয়ে উঠতে পারে।
সৌভাগ্যজনকভাবে কাশ্মীরের অভ্যন্তরে সহিংসতা আপাতত কমেছে। তবে আফগানিস্তানে তালেবান আবার তাদের অবস্থান সংহত করতে পারলে এবং আইএসআই, এলইটি ও জেইএমের মতো সংগঠনগুলোকে মদদ দিলে কাশ্মীরের পরিস্থিতি সহজেই আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় অন্তত সাময়িকভাবে পূর্ণ শান্তি আলোচনার অবকাশ নেই। কিন্তু এটি পক্ষ দুটির জন্য কিছু আস্থা গঠনমূলক ব্যবস্থার সূচনা করার ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে না। সিয়াচেন ও স্যার ক্রিকের ভূখণ্ডগত বিরোধ ও উলার ব্যারাজের মতো তুলনামূলকভাবে নিচু মাত্রার মতানৈক্যের বিষয়গুলো সমাধানের চেষ্টার মাধ্যমে এটি করা যেতে পারে। পানির অধিকার ও বাঁধ তৈরি নিয়ে মতবিরোধগুলো কূটনৈতিক পর্যায়ে বা নেপথ্যের আলোচনায় মীমাংসা করা যেতে পারে।
এ ছাড়া ভারত ও পাকিস্তান অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে পারে। সন্ত্রাসবাদ ও মাদক পাচার মোকাবিলা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিষয়টি এগিয়ে নিতেও একত্রে কাজ করতে পারে তারা। বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হলে তা শান্তির পক্ষে অবদান রাখতে পারে। সীমান্তে আরও বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও ব্যাংকের শাখা স্থাপনের বিষয়ে মতৈক্য শুরু হিসেবে ভালো উদ্যোগ। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত পাকিস্তানকে সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের (মোস্ট ফেভার্ড নেশন) যে মর্যাদা দিয়েছে, অন্য একটি নামে তার প্রতিদান দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পাকিস্তান।
শুধু এগুলোই হয়তো শান্তি আলোচনায় সাফল্যের নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। তবে এগুলো আলোচনা বানচাল করার ঝুঁকিগুলোকে দূর করতে পারে। আর দেশ দুটি যদি ছোট ছোট বিবাদগুলোর বড় হয়ে ওঠা ঠেকানোর উপায় খুঁজে পায়, তাহলে কাশ্মীর সমস্যা মোকাবিলার জন্য অধিকতর অনুকূল একটি পরিবেশ সৃষ্টি হবে—যেটি কিনা দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের সবচেয়ে বড় উৎস।
ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
টি ভি পল: কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক। দ্য ওয়ারিয়র স্টেট: পাকিস্তান ইন দ্য কনটেম্পোরারি ওয়ার্ল্ড গ্রন্থের লেখক।
উভয় দেশেই সরকারের প্রতি জনসমর্থন কম থাকায় শান্তি উদ্যোগের বিরোধী মহলটির হাত শক্তিশালী হয়। ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানকেই বিজেপি ও অন্য বিরোধী দলগুলোর সমালোচনা মোকাবিলার একমাত্র অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। আর ভারতীয়দের অনেকেই নওয়াজ শরিফের সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালানোর উপযোগিতা নিয়েও সংশয়ে ভুগছে। কারণ, সামরিক-বেসামরিক দ্বন্দ্বের কারণে এ সরকার হয়তো মেয়াদ পূর্ণ না-ও করতে পারে। নওয়াজ-অনুগত জেনারেল রাহিল শরিফকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করায় দ্বন্দ্ব এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তবে আফগানিস্তানে পাকিস্তান ও ভারত পরস্পরবিরোধী পক্ষকে সমর্থন করছে বলে সে দেশে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও আইএসআই আবার তাদের কর্তৃত্ব জাহিরে তৎপর হয়ে উঠতে পারে।
সৌভাগ্যজনকভাবে কাশ্মীরের অভ্যন্তরে সহিংসতা আপাতত কমেছে। তবে আফগানিস্তানে তালেবান আবার তাদের অবস্থান সংহত করতে পারলে এবং আইএসআই, এলইটি ও জেইএমের মতো সংগঠনগুলোকে মদদ দিলে কাশ্মীরের পরিস্থিতি সহজেই আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় অন্তত সাময়িকভাবে পূর্ণ শান্তি আলোচনার অবকাশ নেই। কিন্তু এটি পক্ষ দুটির জন্য কিছু আস্থা গঠনমূলক ব্যবস্থার সূচনা করার ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে না। সিয়াচেন ও স্যার ক্রিকের ভূখণ্ডগত বিরোধ ও উলার ব্যারাজের মতো তুলনামূলকভাবে নিচু মাত্রার মতানৈক্যের বিষয়গুলো সমাধানের চেষ্টার মাধ্যমে এটি করা যেতে পারে। পানির অধিকার ও বাঁধ তৈরি নিয়ে মতবিরোধগুলো কূটনৈতিক পর্যায়ে বা নেপথ্যের আলোচনায় মীমাংসা করা যেতে পারে।
এ ছাড়া ভারত ও পাকিস্তান অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে পারে। সন্ত্রাসবাদ ও মাদক পাচার মোকাবিলা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিষয়টি এগিয়ে নিতেও একত্রে কাজ করতে পারে তারা। বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হলে তা শান্তির পক্ষে অবদান রাখতে পারে। সীমান্তে আরও বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও ব্যাংকের শাখা স্থাপনের বিষয়ে মতৈক্য শুরু হিসেবে ভালো উদ্যোগ। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত পাকিস্তানকে সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের (মোস্ট ফেভার্ড নেশন) যে মর্যাদা দিয়েছে, অন্য একটি নামে তার প্রতিদান দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পাকিস্তান।
শুধু এগুলোই হয়তো শান্তি আলোচনায় সাফল্যের নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। তবে এগুলো আলোচনা বানচাল করার ঝুঁকিগুলোকে দূর করতে পারে। আর দেশ দুটি যদি ছোট ছোট বিবাদগুলোর বড় হয়ে ওঠা ঠেকানোর উপায় খুঁজে পায়, তাহলে কাশ্মীর সমস্যা মোকাবিলার জন্য অধিকতর অনুকূল একটি পরিবেশ সৃষ্টি হবে—যেটি কিনা দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের সবচেয়ে বড় উৎস।
ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
টি ভি পল: কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক। দ্য ওয়ারিয়র স্টেট: পাকিস্তান ইন দ্য কনটেম্পোরারি ওয়ার্ল্ড গ্রন্থের লেখক।
No comments