বাংলাদেশকে কীভাবে ঝুলিয়ে রাখছে ভারত! by আনু মুহাম্মদ
কিশোরী
ফেলানী হত্যার আগে ও পরে সীমান্তে বাংলাদেশের আরও বহু লোক ভারতীয়
সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। তারা সবাই গরিব, কৃষক অথবা
দিনমজুর, সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে সপ্তাহে গড়ে
একটি খুনের খবর থাকেই। নির্যাতন এমনকি ধর্ষণের খবরও আসে। গত ৪ বছরে নিহতের
সংখ্যা ২৪১। পৃথিবীর আর কোথাও বন্ধু হিসেবে ঘোষিত দুই রাষ্ট্রের সীমান্তে
তো নয়ই, শত্র“ হিসেবে পরিচিত দুই রাষ্ট্রের সীমান্তেও যুদ্ধ ছাড়া নিয়মিত এ
ধরনের হত্যাকাণ্ড আর নির্যাতনের ঘটনা ঘটে না। এমনকি ভারত-পাকিস্তান
সীমান্তেও নয়। আমরা ভুলতে পারি না যে, বাংলাদেশকে ভারত এখন কাঁটাতারের বেড়া
দিয়ে ঘিরে রেখেছে। বাংলাদেশের এখন তিনদিকে কাঁটাতার, একদিকে বঙ্গোপসাগর।
ভারতের বিখ্যাত গবেষণা পত্রিকা ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-তে
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এই কাঁটাতারের বেড়া দিতে দারিদ্রপীড়িত ভারত ব্যয়
করেছে ৫০০ কোটি ডলার বা প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা। কারণ কী? কেন সার্বভৌম
বাংলাদেশকে একটা খাঁচার মধ্যে রাখার দরকার পড়ল ভারতের? ভারতের পত্রপত্রিকায়
বা সরকারি ও বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের মুখে এরকম কথা মাঝে মধ্যেই শোনা যায়,
বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা ভারতে যাচ্ছে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা বিঘিœত
হচ্ছে।
ভারতে খুন, সন্ত্রাস, ধর্ষণের খবর আমরা নিয়মিতই পাই। বাংলাদেশের মতো সেদেশেও বহু অঞ্চলে সাধারণ নারী-পুরুষের জীবন মাফিয়া সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি। পাশাপাশি এটাও দেখি, বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের সহিংসতা আর নির্মমতার প্রাথমিক পাঠ নেয়ার অন্যতম উৎস হচ্ছে হিন্দি সিনেমা, যার অনুকরণে আবার বাংলাদেশেও সন্ত্রাস-সহিংসতা ভরা অনেক ছবি তৈরি হয়। আমরা এটাও দেখি যে, বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা যেসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে তার বেশিরভাগের জোগান আসে ভারত থেকে। আমরা আরও দেখি, বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে যে নেশা দ্রব্য ভাইরাসের মতো শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে, যার বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসী জাল তৈরি হচ্ছে সেই ফেনসিডিলসহ আরও নানা নেশাদ্রব্য আসে ভারত থেকেই। শোনা যায়, বাংলাদেশে জোগান দেয়ার জন্য ফেনসিডিলের বহু কারখানা তৈরি হয়েছে সীমান্ত এলাকায়।
বাংলাদেশে বেআইনিভাবে অস্ত্র, মাদকদ্রব্য পাচার করে, এদেশে সন্ত্রাস, সহিংসতা আর মাদক ব্যবসা ছড়িয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে ভারতের প্রভাবশালী মাফিয়া চক্র আর সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগী চোরাই টাকার মালিকরা। আর চোরাচালান সন্ত্রাসীর কথা বলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী প্রতিনিয়ত খুন করছে বাংলাদেশে গরিব নাগরিকদের।
যে দেশের সন্ত্রাসীদের ভয়ে ভারত বাংলাদেশের তিনদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছে, সে দেশে বহু হাজার ভারতীয় আইনি-বেআইনিভাবে কাজ করছেন। সেই সন্ত্রাসীভরা দেশের এক মাথায় প্রবেশ করে অন্য মাথা দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের জন্য সড়ক, রেলপথ ও নৌপথে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চলছে। বিনিয়োগ বাড়ছে, বাজারের বিস্তার ঘটছে। প্রশ্ন হল, এ রকম একটি দেশে এগুলো কীভাবে হচ্ছে? ট্রানজিট নামের নানা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে গোপনে। নদী ভরাট করে ভারতের ভারি যন্ত্রপাতি পণ্য পরিবহনের ঘটনাও ঘটেছে। নিজের দেশের নদীপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে অন্য দেশের পরিবহনের দৃষ্টান্ত আর কোথাও আছে বলে জানি না।
ভারতের সরকার এবং সেদেশের বৃহৎ ব্যবসায়ীরা যা যা চায়, তা দিতে এদেশের কোনো সরকার কখনোই কার্পণ্য করেনি। বাংলাদেশে ভারতের বৈধ ও অবৈধ পণ্যের বাজার বিস্তৃত হয়েছে সব সরকারের আমলে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আদমজী পাটকল বন্ধ করে পাটের ক্ষেত্রে ভারতের আপেক্ষিক শক্তি বাড়ানো হয়েছে। ওই সরকারের সময় ভারতে গ্যাস রফতানি, টাটার বিপজ্জনক বিনিয়োগ নিয়ে বহু চেষ্টা করা হয়েছে। জনগণের প্রতিরোধ না থাকলে দেশ আরও বড় সর্বনাশে পতিত হতো।
এত বছরেও অনেক ছাড় দেয়া সত্ত্বেও ভারত নদী নিয়ে কোনো সম্মানজনক সমাধানে আসেনি, ছিটমহল জটিলতা জিইয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের পণ্য বৈধভাবে ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে শুল্ক ও অশুল্ক নানা বাধার প্রাচীর তৈরি করে রেখেছে। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করতে নানা জটিলতা অব্যাহত রেখেছে। টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের নদী-জীববৈচিত্র্যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা এখনও চলছে। ভারতের আইন অনুযায়ী যা অবৈধ, ভারতের কোম্পানি এনটিপিসি সেটাই করছে বাংলাদেশে। সুন্দরবন ধ্বংস করে এই কোম্পানির উচ্চ মুনাফার স্বার্থে বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার আয়োজন চলছে। ভারত সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বহুবার বন্ধ করার প্রতিশ্র“তি দেয়া সত্ত্বেও অবিরাম সীমান্ত হত্যা এটাই প্রমাণ করছে যে, তাদের কথার ওপর কোনোভাবেই ভরসা করা যায় না।
ভারতের ক্রমাগত প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ, সীমান্ত হত্যা, বাংলাদেশের জন্য সর্বনাশা নানা প্রকল্প গ্রহণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিক্ষুব্ধ জনগণ আত্মরক্ষার জন্য তাদের নির্বাচিত সরকারের দিকেই তাকান। কিন্তু সেখানে স্বাধীন দেশের জনগণের মর্যাদার প্রতিফলন ঘটানোর, তাদের ক্ষোভ, দাবি প্রকাশের জন্য কোনো শক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। সরকার নামে যারা আছে, তারা ভারতের পক্ষে সাফাই গাইতেই ব্যস্ত থাকে। বিভিন্ন মন্ত্রী-উপদেষ্টার মুখে আমরা শুনি, ‘ফেলানী বাংলাদেশের নাগরিক নয়’, ‘টিপাইমুখ বাঁধে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না’, ‘ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের লাভ হবে’, ‘ভারতীয় কোম্পানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না’, ‘সীমান্তে যারা খুন হচ্ছে তারা চোরাচালানি’ ‘ভারত কথা দিয়েছে তারা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না’। এ ধরনের কথা ভারতের নানা কর্তাব্যক্তির মুখেও শোনা যায়। ফলে কে ভারতের কে বাংলাদেশের তা আলাদা করা যায় না।
বহু অনুসন্ধান আর আদালতের দীর্ঘ শুনানিতেও প্রমাণ হয়নি, ফেলানী চোরাচালানি করতে সীমান্ত পার হচ্ছিল। বিএসএফ বা ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সে দাবিও করেনি। তাহলে ফেলানী কেন গিয়েছিল সীমান্তে? বস্তুত, সীমান্ত দিয়ে ভাগ করলেও ওই অঞ্চলে এপার-ওপারের মানুষের সামাজিক বন্ধন, আত্মীয়তার সম্পর্ক বহু প্রজন্মের, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েও তা ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি। এখনও উৎসব-পার্বণে যাতায়াত, প্রেম-বিয়ে, লেনদেন সবই হচ্ছে। কৃষিজমি চাষবাসেও এখনও এপার-ওপারের ভাইবেরাদরের যোগাযোগ আছে। ছিটমহল সমস্যা জিইয়ে রাখায় সম্পর্কের জটিলতা আরও বাড়ছে, কিন্তু থাকছেই।
ঘটনা হল এ রকম যে, ভারতের পুঁজি প্রবাহ বাংলাদেশে বাড়ছে, ভারত থেকে বিভিন্ন পেশার মানুষও আসছেন এখানে। এসব ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ কমছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য, পুঁজি ও মানুষ- সব ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিধিনিষেধ বজায় থাকছে। আর সর্বোপরি থাকছে অসম্মান।
চোরাচালানি নিয়মিতই হচ্ছে। সবার জানাশোনার মধ্যেই হচ্ছে। এতে জড়িত আছে দুই দেশেরই প্রভাবশালী লোকজন, আর পারাপারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে দুই দেশেরই গরিব মানুষ। এ রকম বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা জানি যেখানে গরু ও ফেনসিডিল চোরাচালানির ঘুষের বখরা নিয়ে বিএসএফ সদস্যরা অতিরিক্ত দাবি করছে বা দরকষাকষিতে ক্ষিপ্ত হয়ে নানাজনকে হয়রানি করছে। খুনও হচ্ছে। এ রকম এক ঘটনার শিকার একজন বাংলাদেশী তরুণের ওপর চালানো বিএসএফ সদস্যদের ভয়ংকর নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ভারতের এনডিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিল।
আমরা প্রতিনিয়ত খুন হচ্ছি। তার সঙ্গে বাংলাদেশ হচ্ছে অপমানিত। ভারতের সরকার বাংলাদেশ নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে। প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ, মিথ্যাচার সব করতে পারে। বাংলাদেশের সম্পদ, অবকাঠামোর সবকিছুর দিকে তারা নজর দিতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ভারতের বৃহৎ পুঁজি নানা প্রকল্প বিছাতে পারে। কিন্তু ভারতের বৈষম্যমূলক আচরণ, প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ, এমনকি হত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে যথাযোগ্য প্রতিবাদের ভাষাও আমরা আমাদের সরকারের কাছ থেকে পাই না।
মুক্তিযুদ্ধ করে এদেশের মানুষ দেশ স্বাধীন করেছে, অপমান আর দাসত্বের জন্য নয়। এদেশে যে সম্পদ আছে, মানুষের যে শক্তি আছে তাতে অনেক সম্মানজনক জীবন নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে। নানা দলের ব্যানারে লুটেরা, দখলদার, কমিশনভোগীদের দাপটে দেশ এখনও ভয়ংকর অনিশ্চতায়, অপমানে। ফেলানী কাঁটাতারে ঝুলেছিল কয়েক ঘণ্টা। এই ঝুলে থাকার চিত্র এখন স্থায়ী রূপকে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব দেখেছে বাংলাদেশকে ভারত কীভাবে ঝুলিয়ে রাখছে। ভারতের ভেতর থেকেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। সেখানেও জনগণ আমাদের মতোই নিজেদের জীবন ও সম্পদের জন্য লড়াই করছেন। বিচারের প্রহসন করে ভারত কর্তৃপক্ষ খুনিদের সাহস বাড়িয়েছে, আরও খুনের জায়গা তৈরি করেছে। আমাদের প্রতিবাদ ও ক্ষোভে সোচ্চার হতে হবে এবং তা ভারতের জনগণ পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে, যাতে আমরা যৌথভাবে দুই দেশের মাফিয়াদের হাত থেকে মুক্তির পথ সন্ধান করতে পারি।
আনু মুহাম্মদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
ভারতে খুন, সন্ত্রাস, ধর্ষণের খবর আমরা নিয়মিতই পাই। বাংলাদেশের মতো সেদেশেও বহু অঞ্চলে সাধারণ নারী-পুরুষের জীবন মাফিয়া সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি। পাশাপাশি এটাও দেখি, বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের সহিংসতা আর নির্মমতার প্রাথমিক পাঠ নেয়ার অন্যতম উৎস হচ্ছে হিন্দি সিনেমা, যার অনুকরণে আবার বাংলাদেশেও সন্ত্রাস-সহিংসতা ভরা অনেক ছবি তৈরি হয়। আমরা এটাও দেখি যে, বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা যেসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে তার বেশিরভাগের জোগান আসে ভারত থেকে। আমরা আরও দেখি, বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে যে নেশা দ্রব্য ভাইরাসের মতো শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে, যার বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসী জাল তৈরি হচ্ছে সেই ফেনসিডিলসহ আরও নানা নেশাদ্রব্য আসে ভারত থেকেই। শোনা যায়, বাংলাদেশে জোগান দেয়ার জন্য ফেনসিডিলের বহু কারখানা তৈরি হয়েছে সীমান্ত এলাকায়।
বাংলাদেশে বেআইনিভাবে অস্ত্র, মাদকদ্রব্য পাচার করে, এদেশে সন্ত্রাস, সহিংসতা আর মাদক ব্যবসা ছড়িয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে ভারতের প্রভাবশালী মাফিয়া চক্র আর সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগী চোরাই টাকার মালিকরা। আর চোরাচালান সন্ত্রাসীর কথা বলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী প্রতিনিয়ত খুন করছে বাংলাদেশে গরিব নাগরিকদের।
যে দেশের সন্ত্রাসীদের ভয়ে ভারত বাংলাদেশের তিনদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছে, সে দেশে বহু হাজার ভারতীয় আইনি-বেআইনিভাবে কাজ করছেন। সেই সন্ত্রাসীভরা দেশের এক মাথায় প্রবেশ করে অন্য মাথা দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের জন্য সড়ক, রেলপথ ও নৌপথে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চলছে। বিনিয়োগ বাড়ছে, বাজারের বিস্তার ঘটছে। প্রশ্ন হল, এ রকম একটি দেশে এগুলো কীভাবে হচ্ছে? ট্রানজিট নামের নানা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে গোপনে। নদী ভরাট করে ভারতের ভারি যন্ত্রপাতি পণ্য পরিবহনের ঘটনাও ঘটেছে। নিজের দেশের নদীপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে অন্য দেশের পরিবহনের দৃষ্টান্ত আর কোথাও আছে বলে জানি না।
ভারতের সরকার এবং সেদেশের বৃহৎ ব্যবসায়ীরা যা যা চায়, তা দিতে এদেশের কোনো সরকার কখনোই কার্পণ্য করেনি। বাংলাদেশে ভারতের বৈধ ও অবৈধ পণ্যের বাজার বিস্তৃত হয়েছে সব সরকারের আমলে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আদমজী পাটকল বন্ধ করে পাটের ক্ষেত্রে ভারতের আপেক্ষিক শক্তি বাড়ানো হয়েছে। ওই সরকারের সময় ভারতে গ্যাস রফতানি, টাটার বিপজ্জনক বিনিয়োগ নিয়ে বহু চেষ্টা করা হয়েছে। জনগণের প্রতিরোধ না থাকলে দেশ আরও বড় সর্বনাশে পতিত হতো।
এত বছরেও অনেক ছাড় দেয়া সত্ত্বেও ভারত নদী নিয়ে কোনো সম্মানজনক সমাধানে আসেনি, ছিটমহল জটিলতা জিইয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের পণ্য বৈধভাবে ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে শুল্ক ও অশুল্ক নানা বাধার প্রাচীর তৈরি করে রেখেছে। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করতে নানা জটিলতা অব্যাহত রেখেছে। টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের নদী-জীববৈচিত্র্যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা এখনও চলছে। ভারতের আইন অনুযায়ী যা অবৈধ, ভারতের কোম্পানি এনটিপিসি সেটাই করছে বাংলাদেশে। সুন্দরবন ধ্বংস করে এই কোম্পানির উচ্চ মুনাফার স্বার্থে বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার আয়োজন চলছে। ভারত সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বহুবার বন্ধ করার প্রতিশ্র“তি দেয়া সত্ত্বেও অবিরাম সীমান্ত হত্যা এটাই প্রমাণ করছে যে, তাদের কথার ওপর কোনোভাবেই ভরসা করা যায় না।
ভারতের ক্রমাগত প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ, সীমান্ত হত্যা, বাংলাদেশের জন্য সর্বনাশা নানা প্রকল্প গ্রহণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিক্ষুব্ধ জনগণ আত্মরক্ষার জন্য তাদের নির্বাচিত সরকারের দিকেই তাকান। কিন্তু সেখানে স্বাধীন দেশের জনগণের মর্যাদার প্রতিফলন ঘটানোর, তাদের ক্ষোভ, দাবি প্রকাশের জন্য কোনো শক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। সরকার নামে যারা আছে, তারা ভারতের পক্ষে সাফাই গাইতেই ব্যস্ত থাকে। বিভিন্ন মন্ত্রী-উপদেষ্টার মুখে আমরা শুনি, ‘ফেলানী বাংলাদেশের নাগরিক নয়’, ‘টিপাইমুখ বাঁধে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না’, ‘ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের লাভ হবে’, ‘ভারতীয় কোম্পানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না’, ‘সীমান্তে যারা খুন হচ্ছে তারা চোরাচালানি’ ‘ভারত কথা দিয়েছে তারা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না’। এ ধরনের কথা ভারতের নানা কর্তাব্যক্তির মুখেও শোনা যায়। ফলে কে ভারতের কে বাংলাদেশের তা আলাদা করা যায় না।
বহু অনুসন্ধান আর আদালতের দীর্ঘ শুনানিতেও প্রমাণ হয়নি, ফেলানী চোরাচালানি করতে সীমান্ত পার হচ্ছিল। বিএসএফ বা ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সে দাবিও করেনি। তাহলে ফেলানী কেন গিয়েছিল সীমান্তে? বস্তুত, সীমান্ত দিয়ে ভাগ করলেও ওই অঞ্চলে এপার-ওপারের মানুষের সামাজিক বন্ধন, আত্মীয়তার সম্পর্ক বহু প্রজন্মের, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েও তা ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি। এখনও উৎসব-পার্বণে যাতায়াত, প্রেম-বিয়ে, লেনদেন সবই হচ্ছে। কৃষিজমি চাষবাসেও এখনও এপার-ওপারের ভাইবেরাদরের যোগাযোগ আছে। ছিটমহল সমস্যা জিইয়ে রাখায় সম্পর্কের জটিলতা আরও বাড়ছে, কিন্তু থাকছেই।
ঘটনা হল এ রকম যে, ভারতের পুঁজি প্রবাহ বাংলাদেশে বাড়ছে, ভারত থেকে বিভিন্ন পেশার মানুষও আসছেন এখানে। এসব ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ কমছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য, পুঁজি ও মানুষ- সব ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিধিনিষেধ বজায় থাকছে। আর সর্বোপরি থাকছে অসম্মান।
চোরাচালানি নিয়মিতই হচ্ছে। সবার জানাশোনার মধ্যেই হচ্ছে। এতে জড়িত আছে দুই দেশেরই প্রভাবশালী লোকজন, আর পারাপারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে দুই দেশেরই গরিব মানুষ। এ রকম বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা জানি যেখানে গরু ও ফেনসিডিল চোরাচালানির ঘুষের বখরা নিয়ে বিএসএফ সদস্যরা অতিরিক্ত দাবি করছে বা দরকষাকষিতে ক্ষিপ্ত হয়ে নানাজনকে হয়রানি করছে। খুনও হচ্ছে। এ রকম এক ঘটনার শিকার একজন বাংলাদেশী তরুণের ওপর চালানো বিএসএফ সদস্যদের ভয়ংকর নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ভারতের এনডিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিল।
আমরা প্রতিনিয়ত খুন হচ্ছি। তার সঙ্গে বাংলাদেশ হচ্ছে অপমানিত। ভারতের সরকার বাংলাদেশ নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে। প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ, মিথ্যাচার সব করতে পারে। বাংলাদেশের সম্পদ, অবকাঠামোর সবকিছুর দিকে তারা নজর দিতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ভারতের বৃহৎ পুঁজি নানা প্রকল্প বিছাতে পারে। কিন্তু ভারতের বৈষম্যমূলক আচরণ, প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ, এমনকি হত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে যথাযোগ্য প্রতিবাদের ভাষাও আমরা আমাদের সরকারের কাছ থেকে পাই না।
মুক্তিযুদ্ধ করে এদেশের মানুষ দেশ স্বাধীন করেছে, অপমান আর দাসত্বের জন্য নয়। এদেশে যে সম্পদ আছে, মানুষের যে শক্তি আছে তাতে অনেক সম্মানজনক জীবন নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে। নানা দলের ব্যানারে লুটেরা, দখলদার, কমিশনভোগীদের দাপটে দেশ এখনও ভয়ংকর অনিশ্চতায়, অপমানে। ফেলানী কাঁটাতারে ঝুলেছিল কয়েক ঘণ্টা। এই ঝুলে থাকার চিত্র এখন স্থায়ী রূপকে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব দেখেছে বাংলাদেশকে ভারত কীভাবে ঝুলিয়ে রাখছে। ভারতের ভেতর থেকেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। সেখানেও জনগণ আমাদের মতোই নিজেদের জীবন ও সম্পদের জন্য লড়াই করছেন। বিচারের প্রহসন করে ভারত কর্তৃপক্ষ খুনিদের সাহস বাড়িয়েছে, আরও খুনের জায়গা তৈরি করেছে। আমাদের প্রতিবাদ ও ক্ষোভে সোচ্চার হতে হবে এবং তা ভারতের জনগণ পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে, যাতে আমরা যৌথভাবে দুই দেশের মাফিয়াদের হাত থেকে মুক্তির পথ সন্ধান করতে পারি।
আনু মুহাম্মদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
No comments