শুধু সংলাপই সমাধান দেবে না by মাহমুদুল বাসার
নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সংলাপ।
কিন্তু রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমঝোতা। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
বলেছেন, If we cannot agree let us agree to disagree. এটাই আসল কথা।
রাজনীতিতে সমঝোতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। সমঝোতা হবে রাজনীতিতে সুস্থ
প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করার জন্য। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যেসব হঠকারিতা,
অগণতান্ত্রিক আচরণ, অভব্যতা, হুমকি ও পাল্টা হুমকির গলাবাজি চলছে, তার
অবসানে সব পক্ষের সমঝোতার প্রয়োজন আছে। সমঝোতামূলক মনোভঙ্গিকে প্রাধান্য না
দিয়ে নিজস্ব ইগোতে চড়ে সংলাপ চালালে তার ফলাফল শূন্য হতে বাধ্য। এর নজির
নিকট-অতীতের ঘটনায় লুকিয়ে আছে। গত জাতীয় নির্বাচনের আগেও তত্ত্বাবধায়ক
সরকার নিয়ে, প্রধান উপদেষ্টা নিয়ে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়ে জটিলতা
লেগেছিল। তখন মান্নান ভূঁইয়া ও আবদুল জলিলের মধ্যে সংলাপও হয়েছিল, কোনো লাভ
হয়নি। এরপরই লগি-বৈঠার আবির্ভাব ঘটেছিল। অবশ্য তারেক রহমানও
কাস্তে-কোদালের আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, যা সফলতার মুখ দেখেনি। এরপর একটা
উত্তেজনাকর পরিবেশে পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে তাদের পছন্দমতো
একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে দেয়। এতে প্রমাণিত হয়, কেবল সংলাপই
রাজনৈতিক সমাধানের জাদুর কাঠি নয়।
১৯৭১ সালে নিজস্ব মতলববাজি দৃষ্টিতে, বগলে ইট রেখে, মুখে শেখ ফরিদ বলে ভুট্টো-ইয়াহিয়াও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সংলাপে বসেছিলেন। তাতে কোনো লাভ হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুই সমঝোতার কথা বলতেন। ৭ মার্চের ভাষণেও বলেছিলেন, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও কেউ ন্যায্য কথা বললে তা মেনে নেব। চোরে কখনও ধর্মের কাহিনী শোনে না, তাই ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সংলাপ প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে যে সূক্ষ্ম সমঝোতার ফাঁকটুকু ছিল, তাও ছিল না ভুট্টো-ইয়াহিয়ার মধ্যে। তাই তাদের সংলাপের পরিণতি হল ৩০ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ।
অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত বলেছেন, নির্বাচনের বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকবে। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে অতীতের মতো অবশ্যই সংলাপ হবে। তবে তার আগে সবার মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। সবার আগে যদি মানসিকতা পরিবর্তন না হয়, তাহলে অতীতের মতোই সংলাপ অনুষ্ঠান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া কিংবা কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর দৃষ্টিভঙ্গি সমঝোতার দৃষ্টিভঙ্গি নয়। দুই পক্ষ যেহেতু সমান সমান, সেহেতু এক পক্ষের মনের মাধুরী মেশানো প্রস্তাব অন্য পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। হাতের পাঁচটি আঙুল সমান নয়, কেউ যদি আঙুল কেটে সমান করে সমাধান করতে চান, তাহলে তার ফল হবে উল্টো। এক পক্ষ তো আগেই ঘোষণা দিয়েছে, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে রূপরেখা আছে, সেখান থেকে একটি দাঁত খুলে নিয়ে তারা পছন্দমতো একটি দাঁত বসিয়ে দেবেন, তারপর তারা তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন করবেন। আর অন্য পক্ষ তত্ত্বাবধায়কই বর্জন করেছে। এরপর সংঘাত চরমে উঠেছে।
অতি সম্প্রতি লক্ষ্য করছি, সাম্প্রদায়িক হামলার আশংকা করেছে কোনো কোনো মহল। আমাদের অন্যতম দাতা দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, নির্বাচনের সময় আবারও ২০০১ সালের মতো বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হতে পারে। ফলে তারা ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবে না। খুব সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর মনের কোণেও এ খণ্ডমেঘ জমাট বেঁধেছে যে, কোনো তত্ত্বাবধায়কই জামায়াত ও মৌলবাদীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না, তারা তিন মাসের মধ্যেই নৌকার ভোটারদের কচুকাটা করে ফেলবে। তাই তিনি সংবিধানের দোহাই দিয়ে নির্বাচনের সময় নির্বাহী ক্ষমতা হাতে রাখতে চান। এটা ওপেন সিক্রেট যে, সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে জামায়াতকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে। একে তো তারা মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী নীতিতে বিশ্বাসী, তার ওপর সরকার এ বিচার হাতে নিয়ে তাদের সর্বোচ্চ চাপের মুখে ফেলেছে। তাই অনেকের আশংকা, তত্ত্বাবধায়কের বাতাবরণ পাওয়া মাত্র তারা শুরু করবে কিলিং মিশন। এসব সম্ভাব্য দৃশ্যপট সামনে এনেই সমঝোতা করতে হবে।
নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থেকে সংলাপ চালালে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। উভয় পক্ষ যদি সহজ কথাটা মেনে নেয়- বিড়াল সাদা হোক বা কালো হোক, ইঁদুর মারতে পারে কি-না দেখা দরকার সেটাই- তাহলে আর সমস্যা থাকে না। দরকার সুষ্ঠু বা ফেয়ার নির্বাচন। সেজন্য দরকার একটি সিস্টেম। সব পক্ষ মিলে এ সিস্টেমের কাঠামো দাঁড় করাবে, তারপর নির্বাচন হবে। এমন মনোভাব তৈরি হলে, এমন পরিবেশ সৃষ্টি হলে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে এবং ফেয়ার নির্বাচন হবে।
মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক, গবেষক
১৯৭১ সালে নিজস্ব মতলববাজি দৃষ্টিতে, বগলে ইট রেখে, মুখে শেখ ফরিদ বলে ভুট্টো-ইয়াহিয়াও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সংলাপে বসেছিলেন। তাতে কোনো লাভ হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুই সমঝোতার কথা বলতেন। ৭ মার্চের ভাষণেও বলেছিলেন, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও কেউ ন্যায্য কথা বললে তা মেনে নেব। চোরে কখনও ধর্মের কাহিনী শোনে না, তাই ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সংলাপ প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে যে সূক্ষ্ম সমঝোতার ফাঁকটুকু ছিল, তাও ছিল না ভুট্টো-ইয়াহিয়ার মধ্যে। তাই তাদের সংলাপের পরিণতি হল ৩০ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ।
অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত বলেছেন, নির্বাচনের বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকবে। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে অতীতের মতো অবশ্যই সংলাপ হবে। তবে তার আগে সবার মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। সবার আগে যদি মানসিকতা পরিবর্তন না হয়, তাহলে অতীতের মতোই সংলাপ অনুষ্ঠান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া কিংবা কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর দৃষ্টিভঙ্গি সমঝোতার দৃষ্টিভঙ্গি নয়। দুই পক্ষ যেহেতু সমান সমান, সেহেতু এক পক্ষের মনের মাধুরী মেশানো প্রস্তাব অন্য পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। হাতের পাঁচটি আঙুল সমান নয়, কেউ যদি আঙুল কেটে সমান করে সমাধান করতে চান, তাহলে তার ফল হবে উল্টো। এক পক্ষ তো আগেই ঘোষণা দিয়েছে, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে রূপরেখা আছে, সেখান থেকে একটি দাঁত খুলে নিয়ে তারা পছন্দমতো একটি দাঁত বসিয়ে দেবেন, তারপর তারা তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন করবেন। আর অন্য পক্ষ তত্ত্বাবধায়কই বর্জন করেছে। এরপর সংঘাত চরমে উঠেছে।
অতি সম্প্রতি লক্ষ্য করছি, সাম্প্রদায়িক হামলার আশংকা করেছে কোনো কোনো মহল। আমাদের অন্যতম দাতা দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, নির্বাচনের সময় আবারও ২০০১ সালের মতো বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হতে পারে। ফলে তারা ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবে না। খুব সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর মনের কোণেও এ খণ্ডমেঘ জমাট বেঁধেছে যে, কোনো তত্ত্বাবধায়কই জামায়াত ও মৌলবাদীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না, তারা তিন মাসের মধ্যেই নৌকার ভোটারদের কচুকাটা করে ফেলবে। তাই তিনি সংবিধানের দোহাই দিয়ে নির্বাচনের সময় নির্বাহী ক্ষমতা হাতে রাখতে চান। এটা ওপেন সিক্রেট যে, সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে জামায়াতকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে। একে তো তারা মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী নীতিতে বিশ্বাসী, তার ওপর সরকার এ বিচার হাতে নিয়ে তাদের সর্বোচ্চ চাপের মুখে ফেলেছে। তাই অনেকের আশংকা, তত্ত্বাবধায়কের বাতাবরণ পাওয়া মাত্র তারা শুরু করবে কিলিং মিশন। এসব সম্ভাব্য দৃশ্যপট সামনে এনেই সমঝোতা করতে হবে।
নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থেকে সংলাপ চালালে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। উভয় পক্ষ যদি সহজ কথাটা মেনে নেয়- বিড়াল সাদা হোক বা কালো হোক, ইঁদুর মারতে পারে কি-না দেখা দরকার সেটাই- তাহলে আর সমস্যা থাকে না। দরকার সুষ্ঠু বা ফেয়ার নির্বাচন। সেজন্য দরকার একটি সিস্টেম। সব পক্ষ মিলে এ সিস্টেমের কাঠামো দাঁড় করাবে, তারপর নির্বাচন হবে। এমন মনোভাব তৈরি হলে, এমন পরিবেশ সৃষ্টি হলে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে এবং ফেয়ার নির্বাচন হবে।
মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক, গবেষক
No comments