ছাত্রলীগ কথা শুনবে তো? by ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ আগস্ট ঢাকার
ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে যখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের
সংগঠন করার পাশাপাশি লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে আহ্বান জানাচ্ছিলেন, ঠিক সেদিনই
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই
পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আর এতে কমপক্ষে ১৩ জন আহত হন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ শতাধিক রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল
ছুড়ে। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি এর আগে অনেক এমপি-মন্ত্রীও ছাত্রলীগকে দেশ ও
জাতি গঠনে ভালো কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন, দিয়েছেন অনেক পরামর্শ এবং
সর্বোপরি বারবার বলেছেন নীতি আর আদর্শের কথা। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
প্রকৃত অবস্থা হল, কীভাবে লাখ লাখ টাকা কামাই করা যাবে, কীভাবে প্রভাব
বিস্তার করা যাবে সেদিকে মন থাকায় এসব নীতিকথা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের এক
কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায়।
ক্ষমতায় আসার পর সরকারের পক্ষ হতে বলা হয়েছিল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে কেউ রেহাই পাবে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও বলেছিলেন, ছাত্ররাজনীতির নামে গুণ্ডামি বন্ধ করতে হবে। এসব বন্ধ না করলে তিনি যে-ই হোন না কেন, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু ছাত্রলীগের উদ্দেশে করা এতসব আহ্বান, পরামর্শ ও সতর্ক জারি করার ফলাফল যে শেষ পর্যন্ত শূন্যের কোঠায় গিয়েছে এবং বর্তমানেও যাচ্ছে, তা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ নামধারীদের কৃতকর্ম দেখে সহজেই অনুমান করা যায়। একেই বুঝি বলে, কথায় শুধু চিঁড়া ভেজে না। আর এ ক্ষেত্রে সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে যদি মিল না হয়, তবে তা হবে জনগণের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা। তবে জনগণও যে এ ক্ষেত্রে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো কাজ করতে যথেষ্ট সক্ষম, তা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচনের ফলাফলই প্রমাণ করে। সরকারের উচিত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণে রাখা।
বিগত চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ছাত্রদল-ছাত্রশিবির নামধারী সন্ত্রাসীরা দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেমন অব্যাহতভাবে শুরু করেছিল সন্ত্রাস, হত্যা, হামলা, ভাংচুর, দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড; ঠিক তেমনিভাবেই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা অব্যাহতভাবে শুরু করে সন্ত্রাস, হত্যা, হামলা, ভাংচুর, দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এ যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নমুনা বা প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরা যেতে পারে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের গত কমিটির বয়স যখন মাত্র ছয় মাসে পৌঁছে, তখন ওই ছয় মাসেই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে বড় ধরনের সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটে অন্তত ২০ থেকে ২৫টি। এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছেন প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী, ক্ষতি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু মূল্যবান সম্পদ- যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। দেশের অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এতটাই প্রকট যে, ছাত্রলীগের এক পক্ষের কর্মীদের কাছে অপর পক্ষের কর্মীরা মোটেও নিরাপদ নন। এর একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে খাবারের টোকেন বিতরণকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সভাপতি (তৎকালীন) সমর্থিত কর্মীদের দ্বারা সাধারণ সম্পাদক (তৎকালীন) সমর্থিত কর্মী নাছরুল্লাহ্ নাসিমকে মারধর করার ঘটনায়। ওই ঘটনায় নাসিমকে শাহ্ মখদুম হলের দোতলা থেকে নিক্ষেপ করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত নাসিমের মৃত্যু হয়। এসব ঘটনার পরও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দ্বারা অনেক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে- যার ফলে বেশ কয়েকজন ছাত্রের প্রাণহানি ঘটাসহ অনেকে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া মারাÍকভাবে বিঘিœত হওয়াসহ ক্ষতি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু মূল্যবান সম্পদের। তবে এ ধরনের চিত্র শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ছাত্রের হতাহতের ঘটনাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোটা অংকের টাকার সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার খবর আজ আর কারও অজানা নয়। সম্প্রতি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালানোর মাধ্যমে তাদের অপকর্মের তালিকায় আরও একটি নতুন বিষয় যোগ করে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেও ছাত্রলীগ নামধারী এসব সন্ত্রাসী বারবার রেহাই পেয়ে যাচ্ছে এবং আবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। এসব ঘটনার ফলে একদিকে যেমন দেশ-জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি শিক্ষাঙ্গনগুলোয় বারবার বিঘিœত হচ্ছে লেখাপড়ার স্বাভাবিক পরিবেশ। সৃষ্টি হচ্ছে সেশনজট। ফলে শিক্ষার্থীদের পেছনে তাদের অভিভাবকদের ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। দেশের উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আধিপত্য বিস্তার, স্বার্থগত দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার কারণেই যে এসব সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটে চলছে, তা সহজেই অনুমেয়। এর আগে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আয়োজিত এক সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ছাত্রদল ও শিবিরের নেতাকর্মীরা ছাত্রলীগে ঢুকে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এ কথা যদি সত্য হয়, তবে তা হবে বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা বাঁধারই নামান্তর। আর সেক্ষেত্রে ঘোগদের তাড়াতে নিশ্চই বাঘকেই এগিয়ে আসতে হবে! সরকার বা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের নিজেদের স্বার্থেই ছাত্রলীগের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী ছাত্রশিবির বা ছাত্রদলের চর কিংবা সুবিধাভোগীদের বাছাই করে ছাত্রলীগকে ঢেলে সাজানো উচিত।
ছাত্রলীগের বিভিন্ন অপতৎপরতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে সাধারণ মানুষ রীতিমতো বিষিয়ে উঠেছে। তাদের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ছাত্রলীগ কি অপ্রতিরোধ্য? ছাত্রলীগকে কি সামলানো সম্ভব নয়? আর যদি ছাত্রলীগকে সামলানো সম্ভব হয়, তাহলে সামলানোর দায়িত্ব কার? সরকারের নাকি অন্য কারও? ছাত্রলীগকে সামলানোর দায়িত্ব যদি প্রধানমন্ত্রী বা ছাত্রলীগের মাতৃসংগঠন কিংবা সরকারেরই হয়ে থাকে, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের দ্বারা বারবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটলেও কেন ছাত্রলীগকে সামলানো হচ্ছে না? কেন তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাব্যক্তিরাই বা কী ভূমিকা পালন করছেন? এ কথা বলাবাহুল্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে জ্ঞানের আধার। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-গবেষণা চর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা। পাশাপাশি মেধাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে তাদের দেশ গঠন, জাতি ও সমাজ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কথা। অতীতের ছাত্ররাজনীতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে ঠিক এমনই ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমান ছাত্ররাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। ছাত্ররাজনীতি করে যাদের দেশ ও জাতি গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কথা, আজ তারাই হত্যা, হামলা, ভাংচুর, হল দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা ধরনের অপতৎপরতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে একদিকে যেমন তাদের মধ্য থেকে দেশ গঠন ও জাতি গঠনের জন্য যোগ্য ও উপযুক্ত নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না, তেমনি এসব ঘটনার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলেরই একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ রাখা দরকার- কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন কর্তৃক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানো হলে সেই সংগঠনের ভাবমূর্তি বিশেষভাবে ক্ষুণ্ন হয়। তাছাড়া পরে সরকার গঠনে বা নির্বাচনে ওই রাজনৈতিক দলের ওপর এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বর্তমান সরকারসহ সব রাজনৈতিক সংগঠনেরই উচিত হবে দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু-স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা। এ ব্যাপারে যদি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন সম্মিলিতভাবে ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হয়, তবে তা হবে সবার জন্যই মঙ্গলজনক। সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সম্মিলিতভাবে ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেবে- এটাই সবার প্রত্যাশা। সর্বোপরি এ কথা সবারই ভালোভাবে স্মরণে রাখা প্রয়োজন, দলের প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জনসহ অবৈধ নানা সুযোগ-সুবিধা অর্জনের পথ বন্ধ না করলে শুধু নীতি কথায় বা পরামর্শে কোনো কাজ হবে না।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ইউআইটিএস; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
ক্ষমতায় আসার পর সরকারের পক্ষ হতে বলা হয়েছিল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে কেউ রেহাই পাবে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও বলেছিলেন, ছাত্ররাজনীতির নামে গুণ্ডামি বন্ধ করতে হবে। এসব বন্ধ না করলে তিনি যে-ই হোন না কেন, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু ছাত্রলীগের উদ্দেশে করা এতসব আহ্বান, পরামর্শ ও সতর্ক জারি করার ফলাফল যে শেষ পর্যন্ত শূন্যের কোঠায় গিয়েছে এবং বর্তমানেও যাচ্ছে, তা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ নামধারীদের কৃতকর্ম দেখে সহজেই অনুমান করা যায়। একেই বুঝি বলে, কথায় শুধু চিঁড়া ভেজে না। আর এ ক্ষেত্রে সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে যদি মিল না হয়, তবে তা হবে জনগণের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা। তবে জনগণও যে এ ক্ষেত্রে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো কাজ করতে যথেষ্ট সক্ষম, তা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচনের ফলাফলই প্রমাণ করে। সরকারের উচিত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণে রাখা।
বিগত চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ছাত্রদল-ছাত্রশিবির নামধারী সন্ত্রাসীরা দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেমন অব্যাহতভাবে শুরু করেছিল সন্ত্রাস, হত্যা, হামলা, ভাংচুর, দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড; ঠিক তেমনিভাবেই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা অব্যাহতভাবে শুরু করে সন্ত্রাস, হত্যা, হামলা, ভাংচুর, দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এ যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নমুনা বা প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরা যেতে পারে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের গত কমিটির বয়স যখন মাত্র ছয় মাসে পৌঁছে, তখন ওই ছয় মাসেই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে বড় ধরনের সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটে অন্তত ২০ থেকে ২৫টি। এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছেন প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী, ক্ষতি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু মূল্যবান সম্পদ- যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। দেশের অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এতটাই প্রকট যে, ছাত্রলীগের এক পক্ষের কর্মীদের কাছে অপর পক্ষের কর্মীরা মোটেও নিরাপদ নন। এর একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে খাবারের টোকেন বিতরণকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সভাপতি (তৎকালীন) সমর্থিত কর্মীদের দ্বারা সাধারণ সম্পাদক (তৎকালীন) সমর্থিত কর্মী নাছরুল্লাহ্ নাসিমকে মারধর করার ঘটনায়। ওই ঘটনায় নাসিমকে শাহ্ মখদুম হলের দোতলা থেকে নিক্ষেপ করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত নাসিমের মৃত্যু হয়। এসব ঘটনার পরও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দ্বারা অনেক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে- যার ফলে বেশ কয়েকজন ছাত্রের প্রাণহানি ঘটাসহ অনেকে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া মারাÍকভাবে বিঘিœত হওয়াসহ ক্ষতি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু মূল্যবান সম্পদের। তবে এ ধরনের চিত্র শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ছাত্রের হতাহতের ঘটনাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোটা অংকের টাকার সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার খবর আজ আর কারও অজানা নয়। সম্প্রতি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালানোর মাধ্যমে তাদের অপকর্মের তালিকায় আরও একটি নতুন বিষয় যোগ করে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেও ছাত্রলীগ নামধারী এসব সন্ত্রাসী বারবার রেহাই পেয়ে যাচ্ছে এবং আবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। এসব ঘটনার ফলে একদিকে যেমন দেশ-জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি শিক্ষাঙ্গনগুলোয় বারবার বিঘিœত হচ্ছে লেখাপড়ার স্বাভাবিক পরিবেশ। সৃষ্টি হচ্ছে সেশনজট। ফলে শিক্ষার্থীদের পেছনে তাদের অভিভাবকদের ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। দেশের উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আধিপত্য বিস্তার, স্বার্থগত দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার কারণেই যে এসব সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটে চলছে, তা সহজেই অনুমেয়। এর আগে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আয়োজিত এক সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ছাত্রদল ও শিবিরের নেতাকর্মীরা ছাত্রলীগে ঢুকে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এ কথা যদি সত্য হয়, তবে তা হবে বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা বাঁধারই নামান্তর। আর সেক্ষেত্রে ঘোগদের তাড়াতে নিশ্চই বাঘকেই এগিয়ে আসতে হবে! সরকার বা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের নিজেদের স্বার্থেই ছাত্রলীগের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী ছাত্রশিবির বা ছাত্রদলের চর কিংবা সুবিধাভোগীদের বাছাই করে ছাত্রলীগকে ঢেলে সাজানো উচিত।
ছাত্রলীগের বিভিন্ন অপতৎপরতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে সাধারণ মানুষ রীতিমতো বিষিয়ে উঠেছে। তাদের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ছাত্রলীগ কি অপ্রতিরোধ্য? ছাত্রলীগকে কি সামলানো সম্ভব নয়? আর যদি ছাত্রলীগকে সামলানো সম্ভব হয়, তাহলে সামলানোর দায়িত্ব কার? সরকারের নাকি অন্য কারও? ছাত্রলীগকে সামলানোর দায়িত্ব যদি প্রধানমন্ত্রী বা ছাত্রলীগের মাতৃসংগঠন কিংবা সরকারেরই হয়ে থাকে, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের দ্বারা বারবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটলেও কেন ছাত্রলীগকে সামলানো হচ্ছে না? কেন তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাব্যক্তিরাই বা কী ভূমিকা পালন করছেন? এ কথা বলাবাহুল্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে জ্ঞানের আধার। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-গবেষণা চর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা। পাশাপাশি মেধাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে তাদের দেশ গঠন, জাতি ও সমাজ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কথা। অতীতের ছাত্ররাজনীতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে ঠিক এমনই ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমান ছাত্ররাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। ছাত্ররাজনীতি করে যাদের দেশ ও জাতি গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কথা, আজ তারাই হত্যা, হামলা, ভাংচুর, হল দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা ধরনের অপতৎপরতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে একদিকে যেমন তাদের মধ্য থেকে দেশ গঠন ও জাতি গঠনের জন্য যোগ্য ও উপযুক্ত নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না, তেমনি এসব ঘটনার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলেরই একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ রাখা দরকার- কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন কর্তৃক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানো হলে সেই সংগঠনের ভাবমূর্তি বিশেষভাবে ক্ষুণ্ন হয়। তাছাড়া পরে সরকার গঠনে বা নির্বাচনে ওই রাজনৈতিক দলের ওপর এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বর্তমান সরকারসহ সব রাজনৈতিক সংগঠনেরই উচিত হবে দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু-স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা। এ ব্যাপারে যদি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন সম্মিলিতভাবে ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হয়, তবে তা হবে সবার জন্যই মঙ্গলজনক। সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সম্মিলিতভাবে ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেবে- এটাই সবার প্রত্যাশা। সর্বোপরি এ কথা সবারই ভালোভাবে স্মরণে রাখা প্রয়োজন, দলের প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জনসহ অবৈধ নানা সুযোগ-সুবিধা অর্জনের পথ বন্ধ না করলে শুধু নীতি কথায় বা পরামর্শে কোনো কাজ হবে না।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ইউআইটিএস; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
No comments