ভিআইপি গণতন্ত্র ও সাধারণ মানুষের বিড়ম্বনা by এ কে এম শাহ নাওয়াজ
আমাদের
চলমান রাজনীতির সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে রাজনীতিক ও রাষ্ট্রব্যবস্থা উভয়ের
মধ্যে গণতান্ত্রিক বোধের অভাব। গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতর জননেতাদের হওয়ার
কথা জনকল্যাণকামী। কিন্তু এদেশের জননেতারা বিশেষ করে ক্ষমতাসীন জননেতারা
সরকারি বড় বড় পদ-পদবিতে থাকলে জনবিচ্ছিন্ন হতে পছন্দ করেন। নিজেদের ভিআইপি
হিসেবে চিহ্নিত করে একমাত্র ভোট প্রার্থনার সময়টুকু ছাড়া বাকি সময়ে সাধারণ
মানুষকে অতি সাধারণ বিবেচনা করে অস্পৃশ্য ভাবতে থাকেন। মানুষের কষ্ট তাদের
ছুঁয়ে যায় না। ভিআইপি হিসেবে নিজেদের অধিকারকেই সুরক্ষা করেন। তরুণ তুর্কি
ভিআইপি থেকে শুরু করে প্রবীণ পোড়খাওয়া রাজনীতিকও এই রোগ থেকে মুক্ত নন।
তারা বুঝতে চান না যে, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে অনেক স্পর্শকাতর ভোটার
রাজনৈতিক দলগুলোর খেরোখাতা খুলে বসে। এ সময় ভিআইপিদের আচরণ নতুন মূল্যায়নে
সামনে এসে দাঁড়ায়। এ বাস্তবতা দলের জন্য ততটা না হলেও ব্যক্তি ভিআইপির জন্য
খুব সুখপ্রদ হয় না। সাম্প্রতিক সময়ের এমনই একটি অভিজ্ঞতা পাঠকের সামনে
উপস্থাপনের জন্যই আজকের এ লেখা।
গত ঈদুল ফিতরের পর ১৫ আগস্ট শরীয়তপুর বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ভেবেছিলাম, এ সময়টা ফেরিঘাটে ভিড় কম হবে। কাঁঠালবাড়ি ঘাটের উদ্দেশে প্রথম ফেরি মাওয়া ছেড়ে যাবে সকাল ৮টায়। তাই একটু হাতে সময় রেখে মাওয়া ঘাটে পৌঁছে গেলাম ৭টার মধ্যে। মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বের সিরিয়ালে আমার গাড়ি দাঁড়াল। ৮টা বাজার আগেই প্রচুর গাড়ি এসে গেল পদ্মা পাড়ি দিতে। যে ফেরিটি ঘাটে লাগল, আকারে খুব বড় নয়। নাম ‘কেতকি’। সব গাড়ির জায়গা হবে বলে মনে হল না। কিছুক্ষণ পর আমাদের ফেরির গা ঘেঁষে আরেকটি বড় ফেরি দাঁড়াল। সম্ভবত ফেরিটির নাম ‘ফরিদপুর’। জানলাম ওটি ভিআইপির জন্য। ওপারে নড়িয়া-ভেদেরগঞ্জ ডেপুটি স্পিকারের নির্বাচনী এলাকা। তিনি বাড়ি যাবেন। সঙ্গে দলীয় লোকজনও থাকতে পারে। আমাদের মনে হল, বড় ফেরিটি সাধারণের জন্য থাকলে অধিকাংশ গাড়ি উঠতে পারে। আর অনায়াসেই ছোট ফেরিতে ‘ভিআইপি’দের জায়গা হয়ে যায়। ঘাটের এক কর্মকর্তাকে বললামও। তিনি আমার বোকা বোকা কথার জন্য অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন। ভিআইপিদের জন্য ওটা নির্ধারিত। ভিআইপি একজন হলেও তাকে নিয়ে ওই ফেরি ছাড়বে। তাছাড়া কেতকিতে ভিআইপিদের জন্য রেস্ট নেয়ার, ফ্রেস হওয়ার ব্যবস্থা নেই। তবে ভিআইপি অনুমতি দিলে পাবলিকের দু’-চারটি গাড়ি ওই ফেরিতেও উঠতে পারবে।
যাই হোক, আমরা অতি সাধারণ আদার ব্যাপারী (এখনকার আদার মূল্যমানে নয়), জাহাজের খোঁজ নিয়ে লাভ নেই। আমাদের ফেরি ছাড়ল। জায়গার অভাবে অনেক হতভাগ্য গাড়ি উঠতে পারল না। মনে মনে প্রার্থনা করলাম, ভিআইপির মন আজ ফুরফুরে থাক। সাধারণ মানুষের গাড়িগুলো ফেরিতে ওঠার অনুমতি পাক। শরীয়তপুরের যাত্রাটি নির্বিঘেœই কাটল। বিপত্তিতে পড়লাম ফিরতি পথে।
ফেরি ছাড়বে সকাল ১০টায়। আমরা সাড়ে ৮টার মধ্যে ঘাটে পৌঁছলাম। ঈদফেরত গাড়ির ভারি চাপ। কাঁঠালবাড়ি ঘাটে সোজাসুজি ফেরিতে ওঠার রাস্তায় অনেক ট্রাক সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাটের তদারকিতে যারা আছে, তারা আমাদের প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসগুলো ডান দিকের বিকল্প পথে নামিয়ে দিল। সাড়ে ৯টার মধ্যে মাওয়া ঘাট থেকে ‘কেতকি’ ফেরিটি চলে এলো। আনলোড করার পর এখন আমাদের গাড়ি ফেরিতে ওঠার পালা। ১৪তম সিরিয়ালে আমার গাড়ি। হিসাব করে দেখলাম, অনায়াসে আমরা ফেরিতে উঠতে পারব। কিন্তু দ্রুতই সে আশা নির্বাপিত হতে লাগল। প্রথমদিকের চার-পাঁচটা গাড়ি যাওয়ার পর আমাদের থামিয়ে দেয়া হল। যে সোজা পথে আমাদের গাড়ি আসতে মানা ছিল, সে পথেই নবাগত অনেক কার, মাইক্রোবাস ও বাস তরতর করে ফেরিতে উঠে ফেরি পূর্ণ করে দিল। আর এর জন্য ইজারাদারসহ একটি সিন্ডিকেট প্রকাশ্যেই টাকা লেনদেন করল। পাশের টং দোকানে বসে চা খেতে খেতে একজন মাঝবয়সী স্থানীয় ভদ্রলোক বললেন, এগুলো স্বাভাবিক। গাড়ির চাপ থাকলে এমন দুই নম্বরি প্রকাশ্যেই হয়। এই টাকা বহু মহলে যায় বলে এরা বেপরোয়া। আমাদের কোনো প্রতিবাদই কেউ কানে তুলল না। আমাদের অসহায় অবস্থা দেখে পান দোকানদার বলল, স্যার, ওদের সঙ্গে লাইন না করলে আপনি সহজে ফেরিতে উঠতে পারবেন না। আমাদের হতাশার নদীতে ফেলে দিয়ে ছেড়ে দিল ফেরি।
এর পরের ফেরি বেলা ২টায়। অর্থাৎ সকাল ৮টায় এসে বেলা ২টা পর্যন্ত পদ্মার ঢেউ গুনতে হবে। এর মধ্যে ফেরিঘাটের একজন আশার কথা শোনালেন। বললেন, এমন গাড়ির চাপ থাকলে মাঝে মাঝে বিশেষ ফেরি দেয়া হয়। কপাল ভালো থাকলে এর মধ্যে একটি ফেরি পেয়েও যেতে পারেন।
কপাল বোধহয় খুলল। দেখলাম ‘ফরিদপুর’ নামের সেই ফেরিটি আসছে ঘাটের দিকে। আমাদের উদ্ধার করতেই বোধহয় মাওয়া থেকে একেবারে খালি এসেছে। কিন্তু ফেরিটি আমাদের ঘাটে না ভিড়ে কয়েকশ’ গজ দূরে আরেকটি ঘাটের পন্টুনে গিয়ে ভিড়ল। ঘাট-সংশ্লিষ্ট একজন বললেন, এটি এসেছে ভিআইপি নেয়ার জন্য। ডেপুটি স্পিকার মহোদয় ফিরবেন। তিনি রাজি থাকলে আপনারাও যেতে পারবেন। কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি বলে মনটা হালকা লাগল। জননেতা নিশ্চয়ই মানুষের কষ্ট বুঝবেন। আমরা প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। ঘাটের ভদ্রলোক বললেন, স্পিকার সাহেব ওঠার পর ফেরি এই ঘাটে ভিড়বে। তখন আপনারা উঠতে পারবেন।
আধা ঘণ্টা পর খবর এলো স্পিকার সাহেব মত পাল্টেছেন। এখনই ফিরবেন না। মধ্যাহ্নভোজের পর ফিরবেন। আমরা বললাম, তাহলে এই ফেরিটি একবার মাওয়া ঘুরে আসতে পারে। তাতে আটকে পড়া মানুষের অনেক উপকার হয়। ভিআইপিও যথাসময়ে ফিরতে পারবেন। আমার কথা শুনে স্বয়ংক্রিয় উত্তর এলো, ‘ফেরিটি ভিআইপিদের জন্য, সাধারণ মানুষের জন্য নয়।’ এদিকে ফেরির আশায় বসে থাকা যাত্রীদের অবস্থা করুণ। গত দু’দিন থেকে থেকে বৃষ্টি হওয়ার পর এ দিনটিতে ছিল মেঘভাঙা রোদ। ভীষণ গরমে পদ্মার পাড়ে মানুষের ত্রাহি অবস্থা। মাইক্রোবাসে শিশুদের কান্না। অন্যদের হাঁসফাঁস।
অবশেষে বেলা ২টার পর একটি ফেরি এলো। মুক্তি পেলাম আমরা। ৩টার পরপর কাঁঠালবাড়ি ঘাট ছাড়লাম। এই ছয়-সাত ঘণ্টায় সঞ্চয় হল অনেক অভিজ্ঞতা। বুঝতে পারলাম, ভিআইপি আর সাধারণ মানুষের মধ্যে ফারাক কত। মনে পড়ল ২০০৪-এর কথা। আমি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষক পশ্চিমবঙ্গের মালদহে একটি সেমিনারে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। সোনামসজিদ সীমান্ত পাড়ি দেয়ার পর ভারতীয় কাস্টমস খুব ভালো ব্যবহার করেনি কারও সঙ্গে। সেমিনার উদ্বোধন করতে এসেছিলেন রাজ্য সরকারের একজন পূর্ণ মন্ত্রী। পৌঢ় সৌম্যকান্তি মানুষ। রাজশাহীর একজন শিক্ষক তার কাছে এই হয়রানির কথা বললেন। মন্ত্রী লজ্জায় যেন মাথা নিচু করলেন। দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, শিক্ষকদের আমরা সবচেয়ে বেশি সম্মান দেই। কাস্টমস কর্মকর্তাদের অমন ব্যবহার করা উচিত হয়নি। আমি বিষয়টি দেখব। ফিরতি পথে আমরা এর প্রমাণ পেলাম। ভারতীয় কাস্টমস কর্মকর্তারা দ্রুত করণীয় কর্তব্য সম্পাদন করে সসম্মানে আমাদের সীমান্ত পাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন।
আমরা আমাদের ভিআইপিদের দেখে বিস্মিত হই। জনগণের নেতা হয়েও তারা জনগণের সঙ্গে চলেন না। সাধারণ মানুষের ফেরি ‘কেতকি’তে না চড়ে ভিআইপিদের জন্য আলাদা করে রাখা ‘ফরিদপুর’ নামের ফেরিতে চড়েন। ফেরিঘাটের এই জনদুর্ভোগের সময়ও তাদের সেবার জন্য রাষ্ট্রের বহু সহস্র টাকার জ্বালানি পুড়ে মাওয়াঘাট থেকে খালি ফেরি এসে অপেক্ষা করছে। সাধারণ মানুষের টাকায় এসব বিশেষ ফেরি চলে আর বিপদে পড়া সাধারণ মানুষ অসহায় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আমি এজন্য অবশ্য ব্যক্তি ডেপুটি স্পিকারকে দায়ী করি না। ভিআইপি হিসেবে তাদের জন্য এসব প্রাপ্য অধিকার রাষ্ট্রযন্ত্রই নির্ধারণ করে দিয়েছে। তার এ ধারার সুবিধাভোগকে কোনোভাবেই বেআইনি বলা যাবে না। প্রশ্ন থেকে যায় শুধু নৈতিকতা আর মানবিকতার।
আমরা যখন কাঁঠালবাড়ি ঘাট ছেড়ে আসি, তখনও ঘাটে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। কৌতূহলী আমাদের জানা হল না সেসব হতভাগ্য গাড়ি ভিআইপির অনুগ্রহ পেল কি-না। নাকি এসব গাড়ি আর তাদের দুর্ভাগা ‘সাধারণ’ যাত্রীদের সন্ধ্যা ৬টার ফেরি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
বছর দেড়েক আগে একটি টিভি টকশো দেখছিলাম। বিএনপির এক মাঝারি নেতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনারা সংসদ সদস্য হিসেবে সব সুবিধা নিচ্ছেন অথচ সংসদে গিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন না। এতে আপনাদের খারাপ লাগে না?’ মাননীয় সংসদ সদস্য বিব্রত না হয়ে সপ্রতিভ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এসব সুবিধা পাওয়া সংসদ সদস্য হিসেবে আমাদের প্রিভিলেজ। অর্থাৎ আমাদের জন্য নির্ধারিত সুবিধা।’ বুঝলাম, এই মাননীয়রা জনগণের জন্য দায়িত্ব-কর্তব্য না বুঝলেও নিজেদের প্রিভিলেজটা ঠিকই বোঝেন। এভাবে আমরা সাধারণরা সংসদ সদস্যদের প্রিভিলেজ ও ভিআইপিদের অধিকার জোগান দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছি এবং ঘাম ঝরাচ্ছি রাজধানীর জ্যামে আটকে থেকে বা পদ্মা পাড়ে রোদে পুড়ে। আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের বসতি যেসব রাজনৈতিক দলে, সেসব দল যদি মানবিক হতে পারে, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে, তবেই সাধারণ মানুষের মূল্যায়ন হবে এদেশে। নয়তো বারবার অমানিশায় পথ
হারাবে গণতন্ত্র।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
গত ঈদুল ফিতরের পর ১৫ আগস্ট শরীয়তপুর বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ভেবেছিলাম, এ সময়টা ফেরিঘাটে ভিড় কম হবে। কাঁঠালবাড়ি ঘাটের উদ্দেশে প্রথম ফেরি মাওয়া ছেড়ে যাবে সকাল ৮টায়। তাই একটু হাতে সময় রেখে মাওয়া ঘাটে পৌঁছে গেলাম ৭টার মধ্যে। মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বের সিরিয়ালে আমার গাড়ি দাঁড়াল। ৮টা বাজার আগেই প্রচুর গাড়ি এসে গেল পদ্মা পাড়ি দিতে। যে ফেরিটি ঘাটে লাগল, আকারে খুব বড় নয়। নাম ‘কেতকি’। সব গাড়ির জায়গা হবে বলে মনে হল না। কিছুক্ষণ পর আমাদের ফেরির গা ঘেঁষে আরেকটি বড় ফেরি দাঁড়াল। সম্ভবত ফেরিটির নাম ‘ফরিদপুর’। জানলাম ওটি ভিআইপির জন্য। ওপারে নড়িয়া-ভেদেরগঞ্জ ডেপুটি স্পিকারের নির্বাচনী এলাকা। তিনি বাড়ি যাবেন। সঙ্গে দলীয় লোকজনও থাকতে পারে। আমাদের মনে হল, বড় ফেরিটি সাধারণের জন্য থাকলে অধিকাংশ গাড়ি উঠতে পারে। আর অনায়াসেই ছোট ফেরিতে ‘ভিআইপি’দের জায়গা হয়ে যায়। ঘাটের এক কর্মকর্তাকে বললামও। তিনি আমার বোকা বোকা কথার জন্য অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন। ভিআইপিদের জন্য ওটা নির্ধারিত। ভিআইপি একজন হলেও তাকে নিয়ে ওই ফেরি ছাড়বে। তাছাড়া কেতকিতে ভিআইপিদের জন্য রেস্ট নেয়ার, ফ্রেস হওয়ার ব্যবস্থা নেই। তবে ভিআইপি অনুমতি দিলে পাবলিকের দু’-চারটি গাড়ি ওই ফেরিতেও উঠতে পারবে।
যাই হোক, আমরা অতি সাধারণ আদার ব্যাপারী (এখনকার আদার মূল্যমানে নয়), জাহাজের খোঁজ নিয়ে লাভ নেই। আমাদের ফেরি ছাড়ল। জায়গার অভাবে অনেক হতভাগ্য গাড়ি উঠতে পারল না। মনে মনে প্রার্থনা করলাম, ভিআইপির মন আজ ফুরফুরে থাক। সাধারণ মানুষের গাড়িগুলো ফেরিতে ওঠার অনুমতি পাক। শরীয়তপুরের যাত্রাটি নির্বিঘেœই কাটল। বিপত্তিতে পড়লাম ফিরতি পথে।
ফেরি ছাড়বে সকাল ১০টায়। আমরা সাড়ে ৮টার মধ্যে ঘাটে পৌঁছলাম। ঈদফেরত গাড়ির ভারি চাপ। কাঁঠালবাড়ি ঘাটে সোজাসুজি ফেরিতে ওঠার রাস্তায় অনেক ট্রাক সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাটের তদারকিতে যারা আছে, তারা আমাদের প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসগুলো ডান দিকের বিকল্প পথে নামিয়ে দিল। সাড়ে ৯টার মধ্যে মাওয়া ঘাট থেকে ‘কেতকি’ ফেরিটি চলে এলো। আনলোড করার পর এখন আমাদের গাড়ি ফেরিতে ওঠার পালা। ১৪তম সিরিয়ালে আমার গাড়ি। হিসাব করে দেখলাম, অনায়াসে আমরা ফেরিতে উঠতে পারব। কিন্তু দ্রুতই সে আশা নির্বাপিত হতে লাগল। প্রথমদিকের চার-পাঁচটা গাড়ি যাওয়ার পর আমাদের থামিয়ে দেয়া হল। যে সোজা পথে আমাদের গাড়ি আসতে মানা ছিল, সে পথেই নবাগত অনেক কার, মাইক্রোবাস ও বাস তরতর করে ফেরিতে উঠে ফেরি পূর্ণ করে দিল। আর এর জন্য ইজারাদারসহ একটি সিন্ডিকেট প্রকাশ্যেই টাকা লেনদেন করল। পাশের টং দোকানে বসে চা খেতে খেতে একজন মাঝবয়সী স্থানীয় ভদ্রলোক বললেন, এগুলো স্বাভাবিক। গাড়ির চাপ থাকলে এমন দুই নম্বরি প্রকাশ্যেই হয়। এই টাকা বহু মহলে যায় বলে এরা বেপরোয়া। আমাদের কোনো প্রতিবাদই কেউ কানে তুলল না। আমাদের অসহায় অবস্থা দেখে পান দোকানদার বলল, স্যার, ওদের সঙ্গে লাইন না করলে আপনি সহজে ফেরিতে উঠতে পারবেন না। আমাদের হতাশার নদীতে ফেলে দিয়ে ছেড়ে দিল ফেরি।
এর পরের ফেরি বেলা ২টায়। অর্থাৎ সকাল ৮টায় এসে বেলা ২টা পর্যন্ত পদ্মার ঢেউ গুনতে হবে। এর মধ্যে ফেরিঘাটের একজন আশার কথা শোনালেন। বললেন, এমন গাড়ির চাপ থাকলে মাঝে মাঝে বিশেষ ফেরি দেয়া হয়। কপাল ভালো থাকলে এর মধ্যে একটি ফেরি পেয়েও যেতে পারেন।
কপাল বোধহয় খুলল। দেখলাম ‘ফরিদপুর’ নামের সেই ফেরিটি আসছে ঘাটের দিকে। আমাদের উদ্ধার করতেই বোধহয় মাওয়া থেকে একেবারে খালি এসেছে। কিন্তু ফেরিটি আমাদের ঘাটে না ভিড়ে কয়েকশ’ গজ দূরে আরেকটি ঘাটের পন্টুনে গিয়ে ভিড়ল। ঘাট-সংশ্লিষ্ট একজন বললেন, এটি এসেছে ভিআইপি নেয়ার জন্য। ডেপুটি স্পিকার মহোদয় ফিরবেন। তিনি রাজি থাকলে আপনারাও যেতে পারবেন। কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি বলে মনটা হালকা লাগল। জননেতা নিশ্চয়ই মানুষের কষ্ট বুঝবেন। আমরা প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। ঘাটের ভদ্রলোক বললেন, স্পিকার সাহেব ওঠার পর ফেরি এই ঘাটে ভিড়বে। তখন আপনারা উঠতে পারবেন।
আধা ঘণ্টা পর খবর এলো স্পিকার সাহেব মত পাল্টেছেন। এখনই ফিরবেন না। মধ্যাহ্নভোজের পর ফিরবেন। আমরা বললাম, তাহলে এই ফেরিটি একবার মাওয়া ঘুরে আসতে পারে। তাতে আটকে পড়া মানুষের অনেক উপকার হয়। ভিআইপিও যথাসময়ে ফিরতে পারবেন। আমার কথা শুনে স্বয়ংক্রিয় উত্তর এলো, ‘ফেরিটি ভিআইপিদের জন্য, সাধারণ মানুষের জন্য নয়।’ এদিকে ফেরির আশায় বসে থাকা যাত্রীদের অবস্থা করুণ। গত দু’দিন থেকে থেকে বৃষ্টি হওয়ার পর এ দিনটিতে ছিল মেঘভাঙা রোদ। ভীষণ গরমে পদ্মার পাড়ে মানুষের ত্রাহি অবস্থা। মাইক্রোবাসে শিশুদের কান্না। অন্যদের হাঁসফাঁস।
অবশেষে বেলা ২টার পর একটি ফেরি এলো। মুক্তি পেলাম আমরা। ৩টার পরপর কাঁঠালবাড়ি ঘাট ছাড়লাম। এই ছয়-সাত ঘণ্টায় সঞ্চয় হল অনেক অভিজ্ঞতা। বুঝতে পারলাম, ভিআইপি আর সাধারণ মানুষের মধ্যে ফারাক কত। মনে পড়ল ২০০৪-এর কথা। আমি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষক পশ্চিমবঙ্গের মালদহে একটি সেমিনারে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। সোনামসজিদ সীমান্ত পাড়ি দেয়ার পর ভারতীয় কাস্টমস খুব ভালো ব্যবহার করেনি কারও সঙ্গে। সেমিনার উদ্বোধন করতে এসেছিলেন রাজ্য সরকারের একজন পূর্ণ মন্ত্রী। পৌঢ় সৌম্যকান্তি মানুষ। রাজশাহীর একজন শিক্ষক তার কাছে এই হয়রানির কথা বললেন। মন্ত্রী লজ্জায় যেন মাথা নিচু করলেন। দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, শিক্ষকদের আমরা সবচেয়ে বেশি সম্মান দেই। কাস্টমস কর্মকর্তাদের অমন ব্যবহার করা উচিত হয়নি। আমি বিষয়টি দেখব। ফিরতি পথে আমরা এর প্রমাণ পেলাম। ভারতীয় কাস্টমস কর্মকর্তারা দ্রুত করণীয় কর্তব্য সম্পাদন করে সসম্মানে আমাদের সীমান্ত পাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন।
আমরা আমাদের ভিআইপিদের দেখে বিস্মিত হই। জনগণের নেতা হয়েও তারা জনগণের সঙ্গে চলেন না। সাধারণ মানুষের ফেরি ‘কেতকি’তে না চড়ে ভিআইপিদের জন্য আলাদা করে রাখা ‘ফরিদপুর’ নামের ফেরিতে চড়েন। ফেরিঘাটের এই জনদুর্ভোগের সময়ও তাদের সেবার জন্য রাষ্ট্রের বহু সহস্র টাকার জ্বালানি পুড়ে মাওয়াঘাট থেকে খালি ফেরি এসে অপেক্ষা করছে। সাধারণ মানুষের টাকায় এসব বিশেষ ফেরি চলে আর বিপদে পড়া সাধারণ মানুষ অসহায় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আমি এজন্য অবশ্য ব্যক্তি ডেপুটি স্পিকারকে দায়ী করি না। ভিআইপি হিসেবে তাদের জন্য এসব প্রাপ্য অধিকার রাষ্ট্রযন্ত্রই নির্ধারণ করে দিয়েছে। তার এ ধারার সুবিধাভোগকে কোনোভাবেই বেআইনি বলা যাবে না। প্রশ্ন থেকে যায় শুধু নৈতিকতা আর মানবিকতার।
আমরা যখন কাঁঠালবাড়ি ঘাট ছেড়ে আসি, তখনও ঘাটে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। কৌতূহলী আমাদের জানা হল না সেসব হতভাগ্য গাড়ি ভিআইপির অনুগ্রহ পেল কি-না। নাকি এসব গাড়ি আর তাদের দুর্ভাগা ‘সাধারণ’ যাত্রীদের সন্ধ্যা ৬টার ফেরি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
বছর দেড়েক আগে একটি টিভি টকশো দেখছিলাম। বিএনপির এক মাঝারি নেতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনারা সংসদ সদস্য হিসেবে সব সুবিধা নিচ্ছেন অথচ সংসদে গিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন না। এতে আপনাদের খারাপ লাগে না?’ মাননীয় সংসদ সদস্য বিব্রত না হয়ে সপ্রতিভ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এসব সুবিধা পাওয়া সংসদ সদস্য হিসেবে আমাদের প্রিভিলেজ। অর্থাৎ আমাদের জন্য নির্ধারিত সুবিধা।’ বুঝলাম, এই মাননীয়রা জনগণের জন্য দায়িত্ব-কর্তব্য না বুঝলেও নিজেদের প্রিভিলেজটা ঠিকই বোঝেন। এভাবে আমরা সাধারণরা সংসদ সদস্যদের প্রিভিলেজ ও ভিআইপিদের অধিকার জোগান দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছি এবং ঘাম ঝরাচ্ছি রাজধানীর জ্যামে আটকে থেকে বা পদ্মা পাড়ে রোদে পুড়ে। আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের বসতি যেসব রাজনৈতিক দলে, সেসব দল যদি মানবিক হতে পারে, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে, তবেই সাধারণ মানুষের মূল্যায়ন হবে এদেশে। নয়তো বারবার অমানিশায় পথ
হারাবে গণতন্ত্র।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments