পাকা ফল বাদুড়ে খায় by ফরহাদ মজহার

সমাজে অর্থনীতিতে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কী রাজনীতিতে যেসব সম্পর্ক আমাদের জাপটে ধরে রাখে, মুক্ত হতে দেয় না, আমি তা উপড়ে ফেলার পক্ষপাতী। কেবল তখনই নতুন কিছুর নির্মাণ সম্ভব। সে নতুনের রূপ কেমন হবে সেটা বর্তমানের ভেতরে থেকেই অনুমান ও চিহ্নিত করা সম্ভব। বর্তমানের মধ্যে কাজ করেই তাকে ‘বর্তমান’ করে তোলা যায়, বাস্তবায়নও সম্ভব। একসময় মনে করা হতো ইতিহাস সরলরেখার মতো। পেছনের যা কিছু সবই বাতিল করে দিয়ে আমরা শুধু সামনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। সামনে এগিয়ে যাওয়া মানেই ‘আধুনিক’ হওয়া, প্রগতির অর্থও তাই। ইতিহাসের গতি রৈখিক, অর্থাৎ সরলরেখার মতো শুধু সামনে দিকে- এই চিন্তা ক্ষয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ‘আধুনিক’ হওয়ার মধ্যে বিশেষ কোনো মহত্ত্ব নাই, ইতিহাস যদি সরলরেখা না হয়, তাহলে ‘প্রগতি’ কথাটাও অন্তঃসারশূন্য হয়ে ওঠে। তাগিদ বোধ করলে জনগণ তাদের অতীত ঐতিহ্য থেকেও নতুন কিছু করার তাগিদ বোধ করতে পারে।
সমাজে যখন নতুন সম্ভাবনা জেগে ওঠে, তাকে বিকশিত করতে না দিলে সে সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। এই পরিবর্তন আপসেআপ বা প্রাকৃতিকভাবে ঘটে না। সজ্ঞানে বা সচেতনভাবে সেই পরিবর্তন ঘটাতে হয়। বাংলাদেশে আমরা এ ধরনের একটি মুহূর্তের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছি। বর্তমানের মধ্যে যে সম্ভাবনা রয়েছে তাকে শনাক্ত করা এবং তাকে ‘বর্তমান’ করে তোলার একটা কর্তব্য হাজির হয়েছে আমাদের সবার জন্য। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাবার জন্যই যা কিছু আমাদের জাপটে ধরে রেখেছে, সেই সব শৃংখল ভেঙে বেরিয়ে আসার ওপর আমি জোর দিয়ে থাকি।
ঐতিহাসিক পরিবর্তন একটি সচেতন কাজ। মানুষই সেই কাজটা করে। হতে পারে সেটা প্রাকৃতিক ইতিহাসের বিধিবিধানের অধীনতা মেনে। কারণ মানুষ প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতির বাইরের কিছু নয়। ফলে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কেরও প্রাকৃতিক চরিত্র আছে। তাকে খেতে হয়, তার প্রয়োজনীয় উপকরণাদি তাকে প্রকৃতি থেকেই সংগ্রহ করতে হয়, কিংবা প্রকৃতিকে কখনও উৎপাদনের উপায়, কিংবা কখনও কাঁচামালের উৎস হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। করতে হয় ভোগের দ্রব্যাদি উৎপাদনের প্রয়োজনে। কিন্তু এ কাজকেও বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক ব্যাপার বলা যায় না, তাই একে বলা হয় সমাজের মধ্যে থেকে সামাজিক উৎপাদন। ভোগ, উৎপাদন, বিতরণ ও বিনিময় সমাজের মধ্যেই ঘটে। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কই এই সামাজিক রূপ পরিগ্রহ করে। এই সম্পর্কই অর্থশাস্ত্রের বিষয়। এ শাস্ত্রের কাজ মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক বিচার। এই সম্পর্ককে যিনি সবার আগে সবচেয়ে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করেছিলেন, তিনি কার্ল মার্কস। তিনি পথ দেখিয়েছিলেন কিভাবে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক বিচার করতে হবে যাতে এই সম্পর্কের বাধ্যবাধকতার অধীনে থেকেও মানুষ বর্তমানের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ইতিহাসের কর্তাশক্তি হতে পারে। আর, ইতিহাস অর্থ মানুষ ও প্রকৃতি উভয়েরই যুগপৎ ইতিহাস হয়ে ওঠা।
মার্কসের অর্থশাস্ত্রকে যে কারণে আসলে অর্থশাস্ত্র না বলে বলা যায় সম্পর্কশাস্ত্র : মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক বিচার। এ সম্পর্ককে শুধু উৎপাদনী বা অর্থনৈতিক সম্পর্ক হিসেবে নয় বরং অপরাপর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আইনি, রাজনৈতিক ইত্যাদি নানা সম্পর্কের সামগ্রিকতা দিয়ে বোঝাটা রেওয়াজ। এই বিদ্যা আত্মস্থ করা গেলে কী ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক একটি জনগোষ্ঠীর শক্তি ও সম্ভাবনাকে দাবিয়ে রেখেছে, কিভাবে তাকে উপড়ে ফেলতে হবে, পুরাতন সম্পর্কের জায়গায় নতুন কী ধরনের সম্পর্ক কায়েম দরকার, সেই লক্ষ্যে বাস্তবোচিত পদক্ষেপ কী হবে তার হদিস পাওয়া সম্ভব।
সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পতন ঘটেছে অনেক আগে; চীন সমাজতান্ত্রিক পথে নয়, এগিয়ে যাচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক পথে; ইউরোপীয় ‘আধুনিকতা’র বিপ্লবী প্রকল্পের সম্প্র্রসারণ হিসেবে যে ‘কমিউনিজমে’র সঙ্গে আমরা পরিচিত, ইউরোকেন্দ্রিকতার কারণে তার মতাদর্শিক ক্ষয়ও ঘটেছে। সেই ক্ষয় কাটিয়ে উঠতে হলে ইউরোপের বাইরে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। বাঁধাবুলি আউড়িয়ে কিংবা পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে এখনকার সংকটের সমাধান করা যাবে না। আমাদের নতুনভাবে ভাবতে শিখতে হবে। কিন্তু তারপরও কার্ল মার্কস আছেন দাপটের সঙ্গে। কারণ তাকে ছাড়া ইতিহাস বোঝা এবং ইতিহাসের অধিবাসী ঐতিহাসিক মানুষের কর্তব্য নির্ধারণ কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা সম্পর্কের জঞ্জাল থেকে মুক্তিও কঠিন হয়।
কেউ চাক বা না চাক ধর্ম রাজনীতিতে ফিরে আসছে শক্তিশালীভাবে। এই ফিরে আসার মোকাবেলায় ধর্মের বিরুদ্ধে ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতি’, ‘সভ্যতা’ ইত্যাদির পুরনো মতাদর্শিক বয়ান খাড়া করে করা যাবে না। যা আসলে পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক আধিপত্যকেই নিশ্চিত করে। তারপরও ভাঙন ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বিশ্বসভ্যতার ‘কেন্দ্র ’ হয়ে যে ‘আলোকিত ইউরোপ’ এতকাল মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বজায় রাখতে পেরেছিল, সেই কেন্দ্র থেকে ইউরোপের চ্যুতি ঘটা শুরু হয়েছে অনেক আগেই। এ বাস্তবতাকে হিসাবে নিতে হবে। ‘আলোকিত ইউরোপ’ এতদিন যা কিছু দাবিয়ে রেখেছিল তারা ফিরে আসছে আবার, কারণ তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা ফুরিয়ে যায়নি। বর্তমানে কী সেই ভূমিকা, সেটা শনাক্ত করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
দুই
কথাগুলো তত্ত্ব আকারে বলা যত সহজ, কাজের পরিকল্পনা বা কর্তব্য আকারে হাজির করা কঠিন। কিন্তু আসলে কি তাই? বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার কথাই বলা যাক। এটা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতি চরম ক্ষতির কারণ হয়ে রয়েছে। যদি খুবই উদার রাজনীতির লক্ষ্যের দিক থেকে বিচার করি, তাহলে বাগাড়ম্বর বাদ দিয়ে বাংলাদেশের জন্য দরকারি কাজগুলো ভাবা ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মত তৈরির চেষ্টা করা দরকার। বিশাল ও বকোয়াজিতে ভরপুর রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচির মতো নয়, বরং খুবই সংক্ষিপ্ত একটি তালিকা করা যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে এবং দলীয় আনুগত্য নির্বিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তা সমর্থন করে। রাষ্ট্র গঠনের পর্যায়ে ও রাজনীতিতে যেসব আবর্জনা জমেছে তাকে সাফ করতে হলে আমাদের ভাবতে হবে আমাদের আশু কর্তব্যগুলো কী।
এক. রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে অখণ্ডতা ও ঐক্য রক্ষা করা।
সারার্থ : বাংলাদেশ ছোট দেশ, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দুর্বল। যদি আন্তর্জাতিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমরা টিকে থাকতে চাই, তাহলে অভ্যন্তরীণ হানাহানি দ্বন্দ্ব^-সংঘাত বন্ধ করতে হবে। এর জন্য এক পক্ষের উগ্র বাঙালিত্ব আর অপর পক্ষের তার প্রতিক্রিয়ায় উগ্র মুসলমান হওয়ার পথ পরিহার করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। বাংলাদেশে শুধু বাঙালি বা মুসলমান নাই, অন্যান্য জাতিসত্তা ও অন্যান্য ধর্মের মানুষও বাস করে। এই দেশ তাদেরও মাতৃভূমি। যদি আমরা তা চাই তাহলে আমাদের বুঝতে হবে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিচয়টা হচ্ছে নাগরিকতার পরিচয়। এই পরিচয় অনুযায়ী বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আমরা প্রত্যেকেই নাগরিক। এখানেই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা এক ও অখণ্ড। বাঙালি বা মুসলমান হিসেবে নয়। বাঙালি হিসেবে আমার যা অধিকার, একজন সাঁওতাল, ম্রং কিংবা অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরও একই অধিকার। বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে রাষ্ট্র তার প্রতি কোনো পক্ষপাত দেখাবে না। দেখানো ভুল নীতি। এতে রাজনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য ক্ষুণœ হয়। ঠিক তেমনি মুসলমান এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শুধু মুসলমানদের প্রতি রাষ্ট্রের পক্ষপাত রাষ্ট্রকে দুর্বল করবে। তারা যেমন রাষ্ট্রের নাগরিক, ঠিক তেমনি অন্য ধর্মাবলম্বীরাও। যারা ইসলামপন্থী রাজনীতি করেন, তাদের সচেতনতা ও সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে ইসলামী রাজনীতির উদ্দেশ্য কি ‘আধুনিক’ ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা? এই তর্ক ইসলামপন্থী রাজনীতির খুবই সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ তর্ক। কিন্তু এ তর্কের মীমাংসা ছাড়া রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশ নিজের অখণ্ডতা ও ঐক্য রক্ষা করতে পারবে কি-না আমি সন্দেহ করি।
কিন্তু অখণ্ডতা ও ঐক্য রক্ষার জন্য শুধু চিন্তা-চেতনার দিক থেকে উগ্র বাঙালিবাদ বা উগ্র মুসলমানি পরিচয় পরিহারই যথেষ্ট নয়, নাগরিক ও মানবিক অধিকারের অলঙ্ঘনীয়তা কায়েম করা ছাড়া বাংলাদেশ টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। অর্থাৎ এমন একটি রাষ্ট্র আমাদের দরকার যে রাষ্ট্রের জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ কিংবা নির্বাহী বিভাগের কারুরই কোনো ব্যক্তির নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ ও লঙ্ঘন করার কোনো ক্ষমতা থাকবে না।
সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের নানা পরিচয় থাকতে পারে ও আছে। আমরা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, নাস্তিক কিংবা অন্য যে কোনো পরিচয়ের অধিকারী হতে পারি। ধর্ম এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সামাজিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আরও বহুবিধ ভূমিকা পালন করতেই পারে। নতুন রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিগঠনে ধর্ম দার্শনিক ও নীতিগত ভূমিকা রাখতেই পারে। কোনো অসুবিধা নাই। ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ এই সে­াগানের মধ্যে ধর্মের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ভূমিকা অস্বীকার করার নিয়ত নিহিত রয়েছে। ধর্মকে তার ভূমিকা পালন করতে দিতে হবে, এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের ধর্মরাষ্ট্র কায়েম করতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের পার্থক্য অস্পষ্ট থাকলে নানা বিভ্রান্তি ও বিভ্রান্ত সে­াগান তৈরি হয়। সমাজে ধর্ম পালনের এবং ধর্ম প্রচারের অধিকার থাকবে প্রত্যেকেরই। রাষ্ট্রকে তা নিশ্চিত করতে হবে। মূল যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত স্পষ্ট থাকলে আমরা ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষা করতে পারব সেটা হচ্ছে নাগরিকতা এবং নাগরিক ও মানবিক অধিকারের অলঙ্ঘনীয়তা। অন্য কিছু নয়।
দুই. সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ কায়েম
সারার্থ : স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল ১০ এপ্রিল তারিখে। অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাক্ষরিত ঘোষণায় পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সাম্য মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করিলাম’। মনে রাখতে হবে, এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এবং এর জন্যই তিরিশ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। এই ঘোষণার মধ্যে কোনো বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতা নাই। এমনকি শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে আসার পর যে সাময়িক সংবিধান দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে নিজের স্বাক্ষরে জারি করেন, তার মধ্যেও স্বাধীনতার এই ঘোষণাকেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সংবিধানকে দলীয় কর্মসূচিতে পরিণত করার চেষ্টা ও পাল্টা চেষ্টার মধ্য দিয়ে আমরা রক্তক্ষয়ী ৪২ বছর অতিক্রম করে এসেছি। এখন আমাদের হুঁশ হওয়া উচিত।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার মধ্যে যে ঐক্য ও সংহতির বীজ রয়েছে, আমাদের সেই মুহূর্তগুলোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে হবে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে নতুনভাবে গঠন করার সূত্র এখানে নিহিত রয়েছে। অর্থাৎ আমাদের দরকার নতুন একটি রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ। এই কাজটিই এখন জরুরি।
তিন. পুঁজিতান্ত্রিক গোলোকায়ন মোকাবেলার জন্য শক্তিশালী শ্রমনীতি, কৃষিনীতি ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন
সারার্থ : এর মানে প্রথমত বাংলাদেশে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের যে বিস্তার কাঠামোগত সংস্কার এবং দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানের জবরদস্তিতে হয়েছে তার প্রতিরোধ করা। একে অনেক সময় নব্য উদারনীতিবাদ বলা হয়। নীতির বিরোধিতা করার অর্থ বাজার ব্যবস্থার বিরোধিতা করা নয়, কিংবা এখনই পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা উৎখাত করে ‘সমাজতন্ত্র’ কায়েমও নয়, বরং সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশকে লুণ্ঠন ও মুনাফা কামাবার স্বর্গরাজ্যে পরিণত না করে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বি^তামূলক বাজার ব্যবস্থাকে কাজ করতে দেয়া, যাতে বিনিয়োগ ও কাজের সুযোগ বাড়ে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগে বাংলাদেশের স্থান শক্তিশালী হয়।
দ্বিতীয়ত, কারখানা মালিকদের স্বার্থ রক্ষার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিহিত- এই অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসা। শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষার মধ্য দিয়েই সু®ু¤ বাজার ব্যবস্থার বিকাশ এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বিস্তার সম্ভব। সব ধরনের কারখানা ও কাজের ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করা অবিলম্বে দরকার। পোশাক তৈরি কারখানায় পুড়িয়ে বা ধসে পড়া ছাদের তলে শ্রমিক হত্যা করার পরিস্থিতি বদলাতে হবে।
চার : প্রাণের সুরক্ষা এবং পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রাণের ব্যবস্থাপনা মজবুত করা।
সারার্থ : অর্থনৈতিক বিকাশকে টেকসই করতে হলে তাকে পরিবেশসম্মত হতে হবে। বাংলাদেশ প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশ। প্রাণ ও পরিবেশের সুরক্ষা অর্থনৈতিক বিকাশের জন্যও দরকার। সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার প্রশ্ন জড়িত। এ দিকগুলোর প্রতি গুরুত্ব কম দেয়া হয় বলে পরিবেশ দূষিত হয়ে চলেছে। যদি আমরা বেঁচেই থাকতে না পারি তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিংবা রাষ্ট্রের রূপান্তরের কী আর মানে থাকতে পারে?
পাঁচ. জাতীয় প্রতিরক্ষার অংশ হিসেবে শক্তিশালী গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
সারার্থ : বাংলাদেশ অরক্ষিত। বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের নাগরিকদের কুকুর-বেড়ালের মতো হত্যা করার যে চর্চা আমরা ভারতীয় বিএসএফের মধ্যে দেখি তাকে মোকাবেলার পথ এটাই। ফেলানীকে নিয়ে আমরা বিস্তর কাব্য রচনা ও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে পারি, কিন্তু ফেলানীরা মরবে যদি বাংলাদেশ নিজের সীমান্ত নিজে রক্ষা করতে অক্ষম হয়। মিয়ানমারও বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এ কারণে বাংলাদেশের সব নাগরিকের বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা একটি জরুরি দাবি।
এই পাঁচটি দাবি, কর্মসূচি নয়, কিন্তু এ মুহূর্তের দরকারি বিষয়। এ বিষয় নিয়ে আমরা ভাবতে পারি। এই কাজগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে কী ধরনের আবর্জনা আমাদের সাফ করতে হবে সে সম্পর্কেও কিছু আগাম ধারণা করা দরকার।
বাংলাদেশের রাজনীতির যে অবস্থা তাতে নিশ্চিত বলতে পারি, এই দাবিগুলো পেকে গিয়েছে। অর্থাৎ এগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব। গ্রাম দেশে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো নিয়ে মশকরা বাক্য ব্যবহারের রীতি আছে। আমি পাকা কাঁঠাল গাছ থেকে পাকাই পেতে চাই, অকালে গাছ থেকে কেটে এনে কিলিয়ে পাকাতে চাই না। সাধারণ মানুষের প্রজ্ঞা শুধু কিলিয়ে পাকানোর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নাই, গাছে পাকা ফেলে রাখলে কী ফল হয় সে সম্পর্কে তাদের নিরীক্ষণ চমৎকার। সে ক্ষেত্রে প্রবাদ হচ্ছে- পাকা ফল বাদুড়ে খায়। তার মানে ফল যদি পেকে গিয়ে থাকে, তাহলে তাকে গাছে রেখে দেয়া নিরাপদ নয়। পেড়ে ফেলতে হয়। নইলে বাদুড়ে খাবে। গাছে ফল পেকেছে, কিন্তু বাদুড়ে খেয়ে নেবে সেটা হয় না।
কথাটা বলছি এ কারণে যে, বাংলাদেশের এখনকার যে পরিস্থিতি তাতে তা যে কোনো দিকেই গড়াতে পারে। সেই দিক থেকে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মত তৈরির চেষ্টা আমাদের করা উচিত। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি শক্তিশালী অংশ দীর্ঘদিন ধরে ‘তৃতীয় শক্তি’র উত্থান চাইছে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকে মতাদর্শিক বা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার কোনো হিম্মত এদের নাই। এরা রাজনৈতিক দলও করে না। না করাটা দোষের নয়। তার পরও তারা ইতিবাচক রাজনীতির সহায়ক নানা সামাজিক ভূমিকা পালন করতে কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান রাখতে পারে যাতে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার গুণগত রূপান্তরের বুদ্ধিবৃত্তিক শর্ত তৈরি হয়। কিন্তু সেই সব গঠনমূলক কাজের চেয়ে তাদের কাজ হচ্ছে রাজনীতির বিদ্যমান উদারনৈতিক বয়ানের মধ্যে ভাসা ভাসা কথাবার্তা বলা। এই অভ্যাস পরিহার করে উচিত কাজ হচ্ছে কী সম্ভব আর কী সম্ভব নয় তার একটি বাস্তবোচিত মূল্যায়ন। তারা জানে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে এবং ‘তৃতীয় শক্তি’র আবির্ভাবের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। পাশ্চাত্য দেশগুলোর সহায়তা ছাড়া সেটা সম্ভবও নয়। জাতিসংঘের ভূমিকা আরও গণ নজরদারির মধ্যে রাখা দরকার।
কিন্তু অনেক কিছুই পেকে গেছে, পেড়ে ফেলা দরকার। পাকা ফল যেন বাদুড়ে নিয়ে না যায়, সে ব্যাপারে যারা দেশের মানুষের জন্য কাজ করেন সেই দিকে নজর রাখবেন আশা করি।
সর্বোপরি দরকার নিজদের ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য চেষ্টা করা। এই আকুতিই হয়তো আমাদের সঠিক পথ দেখাবে।

No comments

Powered by Blogger.