পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ সমস্যা ও সম্ভাবনা
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ সরোয়ার হোসেন
জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ এবং বিগত বছরগুলোর অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও প্রবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ও গার্মেন্ট শিল্পে নিয়োজিত লাখ লাখ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রম বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এই বিপুল জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা পূরণ করা রাষ্ট্রের একটি অন্যতম দায়িত্ব। এটা অনস্বীকার্য যে, এই বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য ও আবাসনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা মেটাতে প্রতিনিয়তই আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। তাই সার্বিক কল্যাণের জন্য আমাদের প্রাপ্ত সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বদিকে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এক অপার সম্ভাবনাময় অঞ্চল। দুর্ভাগ্যবশত, ভ্রাতৃঘাতী সশস্ত্র সংঘাত আর বিরাজমান ভূমি সমস্যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় অর্থনীতিতে আশানুরূপ অবদান রাখতে পারছে না। ভূমি সমস্যার সমাধান বিলম্বিত হওয়ায় প্রত্যাশিত উন্নয়নও ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি ভূমি সমস্যা সমাধানে দীর্ঘসূত্রতা শান্তি চুক্তির মতো ঐতিহাসিক অর্জনকে খানিকটা ম্লান করেছে।
গত কয়েকশ’ বছর ধরে বিভিন্ন উপজাতি ও তাদের পূর্বপুরুষরা সীমান্ত অতিক্রম করে পার্বত্য এলাকায় প্রবেশ করে এবং বিশেষ বিধানের আওতায় এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। ‘ঞযব ঈযরঃঃধমড়হম ঐরষষ ঞৎধপঃং জবমঁষধঃরড়হ, ১৯০০’ অনুযায়ী এ এলাকার জমির প্রকৃত মালিক জেলা প্রশাসক তথা সরকার। জমির ওপর উপজাতীয় জনগণের অধিকারের ভিত্তি বা যুক্তি যাই হোক না কেন এটা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর এই সনাতনী চিন্তা-ভাবনা এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রভাব বিস্তার করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়রা আজ থেকে কয়েকশ’ বছর আগে মূলত তৎকালীন বার্মা ও আরাকান বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে সীমান্ত অতিক্রম করে এ অঞ্চলে আগমন করে। একই সময়ে অর্থাৎ ১৬৬০ দশকের দিকে মোগলরাও এ এলাকায় আসে এবং বাণিজ্যিক প্রয়োজনে চট্টগ্রামের সমতল ভূমি থেকে বাঙালিদের এনে বসবাসের সুযোগ করে দেয়। মোগল ও ব্রিটিশদের পর পাকিস্তান সরকার পাহাড়িদের জমি ও আবাসস্থল থেকে উচ্ছেদ করে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে। উচ্ছেদ-পরবর্তী সময়ে প্রদত্ত ক্ষতিপূরণের টাকা না পেয়ে উপজাতীয় জনগোষ্ঠী প্রচণ্ডভাবে সংক্ষুব্ধ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে পার্বত্য এলাকায় সশস্ত্র বিদ্রোহের কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে দীর্ঘ অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে। যাই হোক, সার্বিক প্রেক্ষাপটে বিরাজমান ভূমি সমস্যাই এখন গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। ভূমি ব্যবস্থাপনার সঠিক নিয়মনীতির অভাব, এ বিষয়ে সনাতনী চিন্তা-চেতনা, একাধিক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এবং সবশেষে সমতল ভূমি থেকে বাঙালিদের এনে পাহাড়ে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে তোলে।
ভূমি সমস্যা নিরসনকল্পে বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে একটি আইন পাস করেছে এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে প্রধান করে ভূমি কমিশন গঠন করেছে। পরপর চারটি কমিশন গঠিত হলেও অদ্যাবধি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি। সম্প্রতি জনসংহতি সমিতি ‘ঈঐঞ খধহফ উরংঢ়ঁঃব ঝবঃঃষবসবহঃ ঈড়সসরংংরড়হ অপঃ ২০০১’ সংশোধনের কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে যা সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। অতি সম্প্রতি সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদনের মাধ্যমে ভূমি সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তদুপরি, ভূমি সমস্যা সংশ্লিষ্ট অন্তরায়গুলো সবার প্রজ্ঞা, সহনশীলতা ও সর্বোপরি দেশপ্রেম ছাড়া সমাধান করা কঠিন হতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এক অনন্য সাধারণ ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল, যেখানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও বিভিন্ন শ্রেণী-গোত্রের মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর পাহাড়-লেক বেষ্টিত বৈচিত্র্যময় ভূমির অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে। জনসংখ্যার জীবনযাত্রার মান পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত কয়েক বছরে এ অঞ্চল আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য এলাকার মোট জনসংখ্যা ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ২৯১ জন। বাঙালি ছাড়াও এখানে বিভিন্ন ধরনের ১৩টি উপজাতি বসবাস করে। এরা হচ্ছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, বোম, পাংখোয়া, খুমি, চাক, লুসাই, উসাই, বনযোগী ও খিয়াং। মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ বাঙালি, ২৬ শতাংশ চাকমা, ১২ শতাংশ মারমা এবং ১৫ শতাংশ অন্যান্য উপজাতি। সব উপজাতির মধ্যে চাকমা উপজাতি শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধন-সম্পদে যথেষ্ট এগিয়ে আছে। ভূমি সমস্যা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভের জন্য এ অঞ্চলে উপজাতি জনগণের আগমন, ধারাবাহিক প্রসার আর ঐতিহাসিক বিবর্তন সম্বন্ধে জানা প্রয়োজন, যার কিছুটা এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজরা যখন বঙ্গোপসাগর এলাকায় আসেন, তখন আরাকান সাম্রাজ্য তাদের সহজ শর্তে চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবস্থান করে ব্যবসা পরিচালনার অনুমতি দেয়। এর মাধ্যমে রেভেনিউ সংগ্রহ ছাড়াও আরাকান রাজা পরবর্তী সময়ে শক্তিশালী মোগলদের বিরুদ্ধে সমর বিদ্যায় পারদর্শী পর্তুগিজ বাহিনীকে কাজে লাগায়। ১৬০০ সালের শুরুর দিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে কিছু ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী খাগড়াছড়ি এলাকায় আসে এবং সেখানে জুম চাষের মাধ্যমে জীবনযাপন শুরু করে। চাকমাদের আগমনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও কিছু কল্পকথা প্রচলিত রয়েছে, যার ব্যাপারে অনেক গবেষক একমত পোষণ করেন। ধারণা করা হয়, চাকমারা আরাকানের চম্পকনগর এলাকা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, ভারতবর্ষের বিহার থেকে আরাকান পর্যন্ত বেশ কয়েকটি চম্পকনগর রয়েছে। এমনকি রাঙ্গামাটিতেও চম্পকনগর নামক একটি জায়গা রয়েছে। মোগলদের আগমনের পূর্ব-অবধি চাকমা জাতির ইতিহাস কল্পনাপ্রসূত হলেও তা যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। পৌরাণিক সূত্র মোতাবেক, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজপুত্র বিজয়গিরী রাজ্য জয়ের জন্য একদা বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে পূর্বদিকে রওনা দেন। তিনি মেঘনা নদী অতিক্রম করে আরাকান রাজ্য জয় করে সেখানে চাকমা বসতি গড়ে তোলেন। তখন এ অঞ্চলটি ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল থেকে প্রভাবশালী হিন্দু ও শক্তিশালী মুসলিম সভ্যতার প্রভাবে নিষ্পেষিত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আশ্রয়স্থল হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। এছাড়া বিভিন্ন পর্তুগিজ কলোনি যেমন- গোয়া, সেলন, কোচিন, মালাক্কা ও অন্যান্য জায়গার ফেরারি আসামিদের জন্যও এটি ছিল স্বর্গরাজ্য। যাই হোক, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের পর বিভিন্ন রেকর্ড, দলিল-দস্তাবেজ, মুদ্রা, ছবি ও কাগজপত্র থেকে এ জাতির ইতিহাস আরও গ্রহণযোগ্যতা ও স্বাতন্ত্র্য লাভ করে। এ এলাকার প্রথম ব্রিটিশ জেলা প্রশাসক Captain T.H. Lewin রচিত ‘The Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers Therein’-এ লিপিবদ্ধ তথ্যাদি সে অর্থে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। ১৬৬০ সালের শুরুর দিকে বার্মা ও আরাকান বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য চাকমারা নাফ নদীর অপর পাড়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণে অবস্থিত রামু পুলিশ স্টেশনের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৬৫৭ সালে যখন ভারতবর্ষের সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন সিংহাসন দখলের জন্য তার চার পুত্র ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬৫৮ সালে শাহজাহান পুত্র বাংলার সুবেদার শাহ সুজা তার বড় ভাই আওরঙ্গজেবের কাছে ভারতের উত্তর প্রদেশের ‘খাওজা যুদ্ধে’ পরাজিত হয়ে চট্টগ্রামে পালিয়ে আসেন। তখনও চট্টগ্রাম তৎকালীন আরাকান রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি মীর জুমলা সুজাকে হত্যার জন্য পিছু নেন। সুজার সঙ্গে তার অনুসারী সেনাবাহিনীর ১৮ জন সেনাপতি এবং লক্ষাধিক সৈন্য চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থান নেয়। মীর জুমলা ঢাকা পৌঁছানোর পর সুজাকে আত্মসমর্পণের জন্য সংবাদ পাঠান। শাহ সুজা তার পরিবার ও অল্প কয়েকজন সৈন্য-সামন্ত নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে আরাকানের মোরোহংয়ে আশ্রয় গ্রহণ করাকেই বেশি নিরাপদ মনে করেন। মোগল বাহিনীর অন্য সহযোগীরা তখন রামুতে অবস্থান নিয়ে দিনাতিপাত শুরু করে। রমণী বিবর্জিত মোগল সৈন্যবাহিনীর সদস্যরা ধীরে ধীরে চাকমা রমণীদের সঙ্গে মিলেমিশে সংসার জীবন শুরু করে। তখন থেকে চাকমারা মোগল সেনাপতিদের রাজা হিসেবে গ্রহণ করে।
এদিকে আরাকানের বৌদ্ধ রাজা সান্ডা থুডাম্মা সুজার সুন্দরী মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সুজা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হন। এ নিয়ে আরাকান সীমান্তে পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি ঘটে। বিয়ে নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে বৌদ্ধ রাজা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। ফলে মোগল সৈন্য এবং আরাকান সৈন্যদের মধ্যে বহু খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মোগল সৈন্যরা তখন কৌশলগত কারণে রামু ছেড়ে আলীকদমের গহিন অরণ্যে আবাসস্থল গড়ে তোলে এবং চাকমারাও তাদের সঙ্গে এই এলাকায় এসে বসবাস শুরু করে। মোগল সৈন্যরা হজরত আলীর (রা.) অনুসারী ছিল। তারই নামানুসারে এই জায়গার নাম রাখা হয় আলীকদম, যা এখনও প্রচলিত। (চলবে)
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ সরোয়ার হোসেন, এইচডিএমসি, পিএসসি : পার্বত্য এলাকায় ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে কর্মরত
জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ এবং বিগত বছরগুলোর অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও প্রবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ও গার্মেন্ট শিল্পে নিয়োজিত লাখ লাখ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রম বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এই বিপুল জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা পূরণ করা রাষ্ট্রের একটি অন্যতম দায়িত্ব। এটা অনস্বীকার্য যে, এই বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য ও আবাসনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা মেটাতে প্রতিনিয়তই আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। তাই সার্বিক কল্যাণের জন্য আমাদের প্রাপ্ত সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বদিকে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এক অপার সম্ভাবনাময় অঞ্চল। দুর্ভাগ্যবশত, ভ্রাতৃঘাতী সশস্ত্র সংঘাত আর বিরাজমান ভূমি সমস্যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় অর্থনীতিতে আশানুরূপ অবদান রাখতে পারছে না। ভূমি সমস্যার সমাধান বিলম্বিত হওয়ায় প্রত্যাশিত উন্নয়নও ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি ভূমি সমস্যা সমাধানে দীর্ঘসূত্রতা শান্তি চুক্তির মতো ঐতিহাসিক অর্জনকে খানিকটা ম্লান করেছে।
গত কয়েকশ’ বছর ধরে বিভিন্ন উপজাতি ও তাদের পূর্বপুরুষরা সীমান্ত অতিক্রম করে পার্বত্য এলাকায় প্রবেশ করে এবং বিশেষ বিধানের আওতায় এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। ‘ঞযব ঈযরঃঃধমড়হম ঐরষষ ঞৎধপঃং জবমঁষধঃরড়হ, ১৯০০’ অনুযায়ী এ এলাকার জমির প্রকৃত মালিক জেলা প্রশাসক তথা সরকার। জমির ওপর উপজাতীয় জনগণের অধিকারের ভিত্তি বা যুক্তি যাই হোক না কেন এটা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর এই সনাতনী চিন্তা-ভাবনা এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রভাব বিস্তার করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়রা আজ থেকে কয়েকশ’ বছর আগে মূলত তৎকালীন বার্মা ও আরাকান বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে সীমান্ত অতিক্রম করে এ অঞ্চলে আগমন করে। একই সময়ে অর্থাৎ ১৬৬০ দশকের দিকে মোগলরাও এ এলাকায় আসে এবং বাণিজ্যিক প্রয়োজনে চট্টগ্রামের সমতল ভূমি থেকে বাঙালিদের এনে বসবাসের সুযোগ করে দেয়। মোগল ও ব্রিটিশদের পর পাকিস্তান সরকার পাহাড়িদের জমি ও আবাসস্থল থেকে উচ্ছেদ করে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে। উচ্ছেদ-পরবর্তী সময়ে প্রদত্ত ক্ষতিপূরণের টাকা না পেয়ে উপজাতীয় জনগোষ্ঠী প্রচণ্ডভাবে সংক্ষুব্ধ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে পার্বত্য এলাকায় সশস্ত্র বিদ্রোহের কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে দীর্ঘ অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে। যাই হোক, সার্বিক প্রেক্ষাপটে বিরাজমান ভূমি সমস্যাই এখন গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। ভূমি ব্যবস্থাপনার সঠিক নিয়মনীতির অভাব, এ বিষয়ে সনাতনী চিন্তা-চেতনা, একাধিক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এবং সবশেষে সমতল ভূমি থেকে বাঙালিদের এনে পাহাড়ে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে তোলে।
ভূমি সমস্যা নিরসনকল্পে বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে একটি আইন পাস করেছে এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে প্রধান করে ভূমি কমিশন গঠন করেছে। পরপর চারটি কমিশন গঠিত হলেও অদ্যাবধি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি। সম্প্রতি জনসংহতি সমিতি ‘ঈঐঞ খধহফ উরংঢ়ঁঃব ঝবঃঃষবসবহঃ ঈড়সসরংংরড়হ অপঃ ২০০১’ সংশোধনের কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে যা সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। অতি সম্প্রতি সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদনের মাধ্যমে ভূমি সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তদুপরি, ভূমি সমস্যা সংশ্লিষ্ট অন্তরায়গুলো সবার প্রজ্ঞা, সহনশীলতা ও সর্বোপরি দেশপ্রেম ছাড়া সমাধান করা কঠিন হতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এক অনন্য সাধারণ ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল, যেখানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও বিভিন্ন শ্রেণী-গোত্রের মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর পাহাড়-লেক বেষ্টিত বৈচিত্র্যময় ভূমির অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে। জনসংখ্যার জীবনযাত্রার মান পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত কয়েক বছরে এ অঞ্চল আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য এলাকার মোট জনসংখ্যা ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ২৯১ জন। বাঙালি ছাড়াও এখানে বিভিন্ন ধরনের ১৩টি উপজাতি বসবাস করে। এরা হচ্ছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, বোম, পাংখোয়া, খুমি, চাক, লুসাই, উসাই, বনযোগী ও খিয়াং। মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ বাঙালি, ২৬ শতাংশ চাকমা, ১২ শতাংশ মারমা এবং ১৫ শতাংশ অন্যান্য উপজাতি। সব উপজাতির মধ্যে চাকমা উপজাতি শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধন-সম্পদে যথেষ্ট এগিয়ে আছে। ভূমি সমস্যা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভের জন্য এ অঞ্চলে উপজাতি জনগণের আগমন, ধারাবাহিক প্রসার আর ঐতিহাসিক বিবর্তন সম্বন্ধে জানা প্রয়োজন, যার কিছুটা এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজরা যখন বঙ্গোপসাগর এলাকায় আসেন, তখন আরাকান সাম্রাজ্য তাদের সহজ শর্তে চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবস্থান করে ব্যবসা পরিচালনার অনুমতি দেয়। এর মাধ্যমে রেভেনিউ সংগ্রহ ছাড়াও আরাকান রাজা পরবর্তী সময়ে শক্তিশালী মোগলদের বিরুদ্ধে সমর বিদ্যায় পারদর্শী পর্তুগিজ বাহিনীকে কাজে লাগায়। ১৬০০ সালের শুরুর দিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে কিছু ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী খাগড়াছড়ি এলাকায় আসে এবং সেখানে জুম চাষের মাধ্যমে জীবনযাপন শুরু করে। চাকমাদের আগমনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও কিছু কল্পকথা প্রচলিত রয়েছে, যার ব্যাপারে অনেক গবেষক একমত পোষণ করেন। ধারণা করা হয়, চাকমারা আরাকানের চম্পকনগর এলাকা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, ভারতবর্ষের বিহার থেকে আরাকান পর্যন্ত বেশ কয়েকটি চম্পকনগর রয়েছে। এমনকি রাঙ্গামাটিতেও চম্পকনগর নামক একটি জায়গা রয়েছে। মোগলদের আগমনের পূর্ব-অবধি চাকমা জাতির ইতিহাস কল্পনাপ্রসূত হলেও তা যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। পৌরাণিক সূত্র মোতাবেক, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজপুত্র বিজয়গিরী রাজ্য জয়ের জন্য একদা বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে পূর্বদিকে রওনা দেন। তিনি মেঘনা নদী অতিক্রম করে আরাকান রাজ্য জয় করে সেখানে চাকমা বসতি গড়ে তোলেন। তখন এ অঞ্চলটি ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল থেকে প্রভাবশালী হিন্দু ও শক্তিশালী মুসলিম সভ্যতার প্রভাবে নিষ্পেষিত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আশ্রয়স্থল হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। এছাড়া বিভিন্ন পর্তুগিজ কলোনি যেমন- গোয়া, সেলন, কোচিন, মালাক্কা ও অন্যান্য জায়গার ফেরারি আসামিদের জন্যও এটি ছিল স্বর্গরাজ্য। যাই হোক, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের পর বিভিন্ন রেকর্ড, দলিল-দস্তাবেজ, মুদ্রা, ছবি ও কাগজপত্র থেকে এ জাতির ইতিহাস আরও গ্রহণযোগ্যতা ও স্বাতন্ত্র্য লাভ করে। এ এলাকার প্রথম ব্রিটিশ জেলা প্রশাসক Captain T.H. Lewin রচিত ‘The Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers Therein’-এ লিপিবদ্ধ তথ্যাদি সে অর্থে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। ১৬৬০ সালের শুরুর দিকে বার্মা ও আরাকান বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য চাকমারা নাফ নদীর অপর পাড়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণে অবস্থিত রামু পুলিশ স্টেশনের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৬৫৭ সালে যখন ভারতবর্ষের সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন সিংহাসন দখলের জন্য তার চার পুত্র ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬৫৮ সালে শাহজাহান পুত্র বাংলার সুবেদার শাহ সুজা তার বড় ভাই আওরঙ্গজেবের কাছে ভারতের উত্তর প্রদেশের ‘খাওজা যুদ্ধে’ পরাজিত হয়ে চট্টগ্রামে পালিয়ে আসেন। তখনও চট্টগ্রাম তৎকালীন আরাকান রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি মীর জুমলা সুজাকে হত্যার জন্য পিছু নেন। সুজার সঙ্গে তার অনুসারী সেনাবাহিনীর ১৮ জন সেনাপতি এবং লক্ষাধিক সৈন্য চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থান নেয়। মীর জুমলা ঢাকা পৌঁছানোর পর সুজাকে আত্মসমর্পণের জন্য সংবাদ পাঠান। শাহ সুজা তার পরিবার ও অল্প কয়েকজন সৈন্য-সামন্ত নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে আরাকানের মোরোহংয়ে আশ্রয় গ্রহণ করাকেই বেশি নিরাপদ মনে করেন। মোগল বাহিনীর অন্য সহযোগীরা তখন রামুতে অবস্থান নিয়ে দিনাতিপাত শুরু করে। রমণী বিবর্জিত মোগল সৈন্যবাহিনীর সদস্যরা ধীরে ধীরে চাকমা রমণীদের সঙ্গে মিলেমিশে সংসার জীবন শুরু করে। তখন থেকে চাকমারা মোগল সেনাপতিদের রাজা হিসেবে গ্রহণ করে।
এদিকে আরাকানের বৌদ্ধ রাজা সান্ডা থুডাম্মা সুজার সুন্দরী মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সুজা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হন। এ নিয়ে আরাকান সীমান্তে পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি ঘটে। বিয়ে নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে বৌদ্ধ রাজা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। ফলে মোগল সৈন্য এবং আরাকান সৈন্যদের মধ্যে বহু খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মোগল সৈন্যরা তখন কৌশলগত কারণে রামু ছেড়ে আলীকদমের গহিন অরণ্যে আবাসস্থল গড়ে তোলে এবং চাকমারাও তাদের সঙ্গে এই এলাকায় এসে বসবাস শুরু করে। মোগল সৈন্যরা হজরত আলীর (রা.) অনুসারী ছিল। তারই নামানুসারে এই জায়গার নাম রাখা হয় আলীকদম, যা এখনও প্রচলিত। (চলবে)
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ সরোয়ার হোসেন, এইচডিএমসি, পিএসসি : পার্বত্য এলাকায় ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে কর্মরত
No comments