যুক্তরাষ্ট্র কেন পিছু হটল by আসিফ রশীদ
সিরিয়া
সংকট নিরসনের কলকাঠি এখন রাশিয়ার হাতে। এ সংকট নিরসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে
চার ধাপের রুশ পরিকল্পনা অনুযায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘যুদ্ধ’ হুমকি
কোনো কাজে আসেনি। প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, আপাতত সামরিক হামলা নয়। তিনি
এখন কূটনৈতিক পন্থায় এ সংকট সমাধানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ওবামা যা-ই
বলুন না কেন, রাশিয়ার কঠোর অবস্থানের কারণেই যে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায়
হামলার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। নিউইয়র্ক টাইমসে
প্রকাশিত রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের লেখা এক নিবন্ধেও সিরিয়ায় সম্ভাব্য
হামলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে হুশিয়ার করে দেয়া রয়েছে। রাশিয়ার
মধ্যস্থতায় সিরিয়া তার রাসায়নিক অস্ত্র আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণাধীনে দিতে
রাজি হয়েছে বলেই নয়, সিরিয়ায় হামলার বিরুদ্ধে মস্কোর কঠোর মনোভাব দেখেই
ওয়াশিংটনের সুর নরম হয়েছে। এটা নিশ্চিত, রাশিয়া যদি ইরাকের ক্ষেত্রেও একই
অবস্থান নিত, সে ক্ষেত্রে দেশটি আজকের বিশৃংখল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেত।
জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক আইন ও বিশ্ব জনমতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র
সেদিন ইরাকে হামলা চালিয়েছিল। আজ সিরিয়ার বিরুদ্ধে আস্ফালন,
যুদ্ধোউন্মাদনার ক্ষেত্রেও আইন, জাতিসংঘ, জনমত হয়েছে উপেক্ষিত। কাজ করেছে
শুধু রাশিয়ার হুশিয়ারি। বিশ্ব রাজনীতিতে আজ স্নায়ুযুদ্ধকালীন বাস্তবতা এবং
ন্যাটোর বিপরীতে মস্কোর নেতৃত্বে সামরিক জোট ‘ওয়ারশ প্যাক্ট’ নেই সত্য- তবে
সামরিক শক্তি, জনসংখ্যা, আয়তন, সম্পদ, সর্বোপরি বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের
ক্ষমতার দিক থেকে একমাত্র রাশিয়াই পারে যুক্তরাষ্ট্রকে যে-কোনো জবরদখল তথা
আন্তর্জাতিক আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ড থেকে নিবৃত্ত করতে। চীনও ক্রমে এ ধরনের
সক্ষমতা অর্জন করছে বটে, তবে এখনও তারা যুক্তরাষ্ট্রকে রুখে দেয়ার পর্যায়ে
পৌঁছেনি।
স্নায়ুযুদ্ধকালীন বিশ্ব ছিল দ্বিমেরুকেন্দ্রিক। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সমান শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বী। শক্তির ভারসাম্যপূর্ণ সেই পরিস্থিতিতে আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায় মার্কিন দখলবাজির মতো ঘটনা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু আজকের একমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় মার্কিন স্বার্থরক্ষার বলি হতে পারে যে-কোনো দুর্বল রাষ্ট্র। এ বাস্তবতা যে কোনো অজুহাতে মার্কিন হামলা বা খবরদারি থেকে বিশ্বের দেশগুলোকে বাঁচাতে আবারও একটি দ্বিমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাই তুলে ধরে। শক্তির এক অদ্ভুত স্বভাব হল, যখন কেউ এর অধিকারী হয়, তখন তা প্রকাশ না করা তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে তাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ যখন থাকে না, একে নিয়ন্ত্রণ করা তখন আরও অসম্ভব হয়ে পড়ে। নব্বই দশকের শুরুতে দ্বিমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর ওই রাষ্ট্রটি গড়ে উঠেছিল, তা ভেঙে পড়ার পর তার উত্তরাধিকারী রাশিয়ার পক্ষে চটজলদি ধকল সামলে ওঠা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এতদিনে তারা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, বিশ্বের জন্য এটা এক ধরনের আশার কথা। ইতিহাস বলে, পৃথিবীর বৃহত্তম (আয়তনে) এ দেশটি সব সময়ই বিশ্বব্যাপী বড় ধরনের প্রভাব রেখে এসেছে, তা সে যুদ্ধবিগ্রহেই হোক কিংবা শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে হোক। কাজেই বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য যে আর খুব বেশি দিন থাকছে না এটা প্রায় নিশ্চিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী নীতির কারণে এখন সারা বিশ্বে যুদ্ধবাজ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন দেশটির বৈদেশিক নীতি ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার নীতি গ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তার সেই নীতি শুধু ত্যাগই করেনি, বরং অন্য দেশের ওপর হস্তক্ষেপ ক্রমে তার জাতীয় নীতিরই অংশে পরিণত হয়। ওই যুদ্ধের শেষ লগ্নে জাপানের দুটি শহরের ওপর যুক্তরাষ্ট্র আণবিক বোমা ফেলে যে ধ্বংসলীলা চালায়, সেই ঘটনার পেছনেও ছিল তার সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষ। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল জাপানের যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশগ্রহণ প্রতিরোধ করা। এ প্রসঙ্গে নোবেল বিজয়ী ব্রিটিশ পদার্থবিদ অধ্যাপক পিএমএস ব্ল্যাকেট বলেছেন, ‘আণবিক বোমা নিক্ষেপের ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সামরিক প্রক্রিয়া নয়, বরং তা রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রথম প্রক্রিয়া।’ আসলে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে তার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু এর মাত্র চার বছরের মাথায় সোভিয়েত ইউনিয়ন তার প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেই ইচ্ছায় বাদ সাধে।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর যুক্তরাষ্ট্র আশা করেছিল, বিশ্ব তার নির্দেশিত মুক্তবাজার ও উদার গণতন্ত্র বরণ করে নেবে। কিন্তু এটি উপলব্ধি করেনি যে, নিজ স্বার্থরক্ষায় ক্ষমতার প্রয়োগ অন্যদের মাঝে ক্ষোভের জন্ম দেবে। আসলে যুদ্ধ একটি সেকেলে ধারণা। প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষ খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য যুদ্ধ করেছে। মধ্যযুগে হালাকু খান-চেঙ্গিস খান আর রাজা-রাজড়ারা যুদ্ধ করেছে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য। এরপর ব্রিটিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ প্রভৃতি শক্তি বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশে বণিকের বেশে এসে দু’শ বছর শাসন করেছে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এসব শক্তির দখলমুক্ত হয়ে অধিকাংশ দেশ একে একে স্বাধীন হয়ে যায়। কাজেই বল প্রয়োগের সেই বাস্তবতা আজ আর নেই। সামরিক সম্ভারের বদলে গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও প্রযুক্তিই বর্তমানে শক্তির প্রকৃত মানদণ্ড।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের চিন্তা-চেতনায় এখনও শক্তি প্রয়োগের সেকেলে ধারণাই প্রাধান্য পাচ্ছে। সভ্যতা ও মানবকল্যাণে বিশ্বের এত অগ্রগতি সত্ত্বেও মানব ইতিহাসের প্রাথমিক যুগের সেই ‘জোর যার মুল্লুক তার’-এর ধারণাই আবার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে যুদ্ধের উন্মাদনা দিয়ে- এটি সত্যিই লজ্জাজনক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল ভাবনা ছিল আগ্রাসী ও শক্তিধর দেশগুলোর কাছ থেকে দুর্বল দেশগুলোকে রক্ষা করা। সেই বিশ্ব সংস্থাকে সরাসরি অগ্রাহ্য করে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালিয়েছিল এবং এরপর সিরিয়ায় হামলা চালাতে উদ্যত হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে জাতিসংঘ নয়, অপর একটি শক্তিই (রাশিয়া) যুক্তরাষ্ট্রকে সিরিয়ায় হামলা থেকে নিবৃত্ত করতে পেরেছে। অর্থাৎ নিরাপত্তার স্নায়ুযুদ্ধকালীন ডেটারেন্ট বা নিবৃত্তমূলক ধারণাই এখনও কাজ করছে। এর অর্থ হল, আমার কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে, আমি শক্তিধর- তাই তুমি আমার ওপর হামলা চালাতে সাহস পাবে না কিংবা আমি কোনো হুমকি দিলে তুমি তাতে ভয় পেয়ে হুমকিকে আমলে নেবে। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক আইন, বিশ্ব জনমত- এসব কিছুই নয়!
এর বিপজ্জনক দিকটি হল, এ ধারণা বিশ্বে নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দেবে। আসলে আঞ্চলিক পর্যায়ে এর কার্যকারিতা এখনও রয়েছে- যেমন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে এক ধরনের ডেটারেন্ট কাজ করে আসছে। তবে বৈশ্বিক পর্যায়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আবার অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হলে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়বে। উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে ব্যয় কমে যাবে। তবে এক্ষেত্রে ‘মন্দের ভালো’ দিকটি হল, বিশ্বে আবার শক্তির ভারসাম্য ফিরে এলে মার্কিন খবরদারি থেকে বিশ্ব কিছুটা হলেও রেহাই পাবে। আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ার মতো ঘটনা সহসা আর ঘটবে না। অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোর নিরাপত্তাহীনতার ভাবনা কমে আসবে অনেকটাই।
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
স্নায়ুযুদ্ধকালীন বিশ্ব ছিল দ্বিমেরুকেন্দ্রিক। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সমান শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বী। শক্তির ভারসাম্যপূর্ণ সেই পরিস্থিতিতে আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায় মার্কিন দখলবাজির মতো ঘটনা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু আজকের একমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় মার্কিন স্বার্থরক্ষার বলি হতে পারে যে-কোনো দুর্বল রাষ্ট্র। এ বাস্তবতা যে কোনো অজুহাতে মার্কিন হামলা বা খবরদারি থেকে বিশ্বের দেশগুলোকে বাঁচাতে আবারও একটি দ্বিমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাই তুলে ধরে। শক্তির এক অদ্ভুত স্বভাব হল, যখন কেউ এর অধিকারী হয়, তখন তা প্রকাশ না করা তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে তাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ যখন থাকে না, একে নিয়ন্ত্রণ করা তখন আরও অসম্ভব হয়ে পড়ে। নব্বই দশকের শুরুতে দ্বিমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর ওই রাষ্ট্রটি গড়ে উঠেছিল, তা ভেঙে পড়ার পর তার উত্তরাধিকারী রাশিয়ার পক্ষে চটজলদি ধকল সামলে ওঠা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এতদিনে তারা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, বিশ্বের জন্য এটা এক ধরনের আশার কথা। ইতিহাস বলে, পৃথিবীর বৃহত্তম (আয়তনে) এ দেশটি সব সময়ই বিশ্বব্যাপী বড় ধরনের প্রভাব রেখে এসেছে, তা সে যুদ্ধবিগ্রহেই হোক কিংবা শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে হোক। কাজেই বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য যে আর খুব বেশি দিন থাকছে না এটা প্রায় নিশ্চিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী নীতির কারণে এখন সারা বিশ্বে যুদ্ধবাজ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন দেশটির বৈদেশিক নীতি ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার নীতি গ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তার সেই নীতি শুধু ত্যাগই করেনি, বরং অন্য দেশের ওপর হস্তক্ষেপ ক্রমে তার জাতীয় নীতিরই অংশে পরিণত হয়। ওই যুদ্ধের শেষ লগ্নে জাপানের দুটি শহরের ওপর যুক্তরাষ্ট্র আণবিক বোমা ফেলে যে ধ্বংসলীলা চালায়, সেই ঘটনার পেছনেও ছিল তার সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষ। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল জাপানের যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশগ্রহণ প্রতিরোধ করা। এ প্রসঙ্গে নোবেল বিজয়ী ব্রিটিশ পদার্থবিদ অধ্যাপক পিএমএস ব্ল্যাকেট বলেছেন, ‘আণবিক বোমা নিক্ষেপের ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সামরিক প্রক্রিয়া নয়, বরং তা রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রথম প্রক্রিয়া।’ আসলে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে তার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু এর মাত্র চার বছরের মাথায় সোভিয়েত ইউনিয়ন তার প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেই ইচ্ছায় বাদ সাধে।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর যুক্তরাষ্ট্র আশা করেছিল, বিশ্ব তার নির্দেশিত মুক্তবাজার ও উদার গণতন্ত্র বরণ করে নেবে। কিন্তু এটি উপলব্ধি করেনি যে, নিজ স্বার্থরক্ষায় ক্ষমতার প্রয়োগ অন্যদের মাঝে ক্ষোভের জন্ম দেবে। আসলে যুদ্ধ একটি সেকেলে ধারণা। প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষ খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য যুদ্ধ করেছে। মধ্যযুগে হালাকু খান-চেঙ্গিস খান আর রাজা-রাজড়ারা যুদ্ধ করেছে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য। এরপর ব্রিটিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ প্রভৃতি শক্তি বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশে বণিকের বেশে এসে দু’শ বছর শাসন করেছে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এসব শক্তির দখলমুক্ত হয়ে অধিকাংশ দেশ একে একে স্বাধীন হয়ে যায়। কাজেই বল প্রয়োগের সেই বাস্তবতা আজ আর নেই। সামরিক সম্ভারের বদলে গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও প্রযুক্তিই বর্তমানে শক্তির প্রকৃত মানদণ্ড।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের চিন্তা-চেতনায় এখনও শক্তি প্রয়োগের সেকেলে ধারণাই প্রাধান্য পাচ্ছে। সভ্যতা ও মানবকল্যাণে বিশ্বের এত অগ্রগতি সত্ত্বেও মানব ইতিহাসের প্রাথমিক যুগের সেই ‘জোর যার মুল্লুক তার’-এর ধারণাই আবার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে যুদ্ধের উন্মাদনা দিয়ে- এটি সত্যিই লজ্জাজনক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল ভাবনা ছিল আগ্রাসী ও শক্তিধর দেশগুলোর কাছ থেকে দুর্বল দেশগুলোকে রক্ষা করা। সেই বিশ্ব সংস্থাকে সরাসরি অগ্রাহ্য করে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালিয়েছিল এবং এরপর সিরিয়ায় হামলা চালাতে উদ্যত হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে জাতিসংঘ নয়, অপর একটি শক্তিই (রাশিয়া) যুক্তরাষ্ট্রকে সিরিয়ায় হামলা থেকে নিবৃত্ত করতে পেরেছে। অর্থাৎ নিরাপত্তার স্নায়ুযুদ্ধকালীন ডেটারেন্ট বা নিবৃত্তমূলক ধারণাই এখনও কাজ করছে। এর অর্থ হল, আমার কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে, আমি শক্তিধর- তাই তুমি আমার ওপর হামলা চালাতে সাহস পাবে না কিংবা আমি কোনো হুমকি দিলে তুমি তাতে ভয় পেয়ে হুমকিকে আমলে নেবে। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক আইন, বিশ্ব জনমত- এসব কিছুই নয়!
এর বিপজ্জনক দিকটি হল, এ ধারণা বিশ্বে নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দেবে। আসলে আঞ্চলিক পর্যায়ে এর কার্যকারিতা এখনও রয়েছে- যেমন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে এক ধরনের ডেটারেন্ট কাজ করে আসছে। তবে বৈশ্বিক পর্যায়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আবার অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হলে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়বে। উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে ব্যয় কমে যাবে। তবে এক্ষেত্রে ‘মন্দের ভালো’ দিকটি হল, বিশ্বে আবার শক্তির ভারসাম্য ফিরে এলে মার্কিন খবরদারি থেকে বিশ্ব কিছুটা হলেও রেহাই পাবে। আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ার মতো ঘটনা সহসা আর ঘটবে না। অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোর নিরাপত্তাহীনতার ভাবনা কমে আসবে অনেকটাই।
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
No comments