জনগণের সাড়া মিলবে কি? by ইকতেদার আহমেদ
উন্নয়নের
বহুবিধ দিক রয়েছে। যে কোনো উন্নয়ন সব সময় জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট হয়ে
থাকে। একটি দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য
আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অপরিহার্য। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও সব
ধরনের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের পূর্বশর্ত। এর পাশাপাশি উন্নয়নের জন্য
প্রয়োজন সঠিক জাতীয় নেতৃত্ব এবং দক্ষ, মেধাবী, সৎ ও আত্মনিবেদিত জনশক্তি।
সঠিক জাতীয় নেতৃত্বের মধ্যে সততা, একাগ্রতা, ত্যাগ ও দেশপ্রেম- এ চারটি
গুণের সমন্বয়ের আবশ্যকতা রয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণের
প্রত্যক্ষ ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন বা ভোটপ্রাপ্ত দল একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের
জন্য সরকার পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। একটি দল নির্বাচনে বিজয়ী হলে
দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তা নির্বাচনী
ইশতেহারে ব্যক্ত করা হয়। তবে নির্বাচনী ইশতেহারের চেয়ে নির্বাচন-পরবর্তী
ক্ষমতাসীন দলের সরকার পরিচালনায় সফলতা ও ব্যর্থতা ভোটের ওপর বেশি প্রভাব
ফেলে।
আমাদের দেশের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ’৯০-পূর্ববর্তী ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ চারটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল বিজয় অর্জনে সমর্থ হয়। অপরদিকে ’৯০-পরবর্তী অনুষ্ঠিত ৫টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া ৫ম, ৭ম, ৮ম ও ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তী অথবা নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলেও সে সংসদ এক মাসেরও কম সময়ের ব্যাপ্তিকালে শুধু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিল পাসের পর অবলুপ্ত হয়।
বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে সংসদ বহাল থাকাকালীন মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে সংবিধানে সংশোধনী আনার আবশ্যকতা আছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে দেয়া হলে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে সাংবিধানিক কোনো বাধা নেই।
সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি স্বপদে বহাল থাকবেন এবং সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং সংসদ সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে মন্ত্রী নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার অব্যবহিত পূর্বে যারা সংসদ সদস্য ছিলেন, তাদের মধ্য থেকে নিয়োগদানে সাংবিধানিকভাবে কোনো বাধা নেই।
সংবিধানের উপরোক্ত বিধানাবলি পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, বর্তমান সরকার মেয়াদ অবসান পূর্ববর্তী সংসদ ভেঙে দিয়ে বা না দিয়ে নির্বাচন করতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী স্বপদে বহাল থেকে অব্যবহিত আগের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে তিনি যাদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে মন্ত্রিসভা গঠনপূর্বক অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। ইতিমধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সরকারি ও দলীয় উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সমাবেশে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য তার দলের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিভিন্ন দেশে সরকারের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষায় একটি দলকে পরপর দু’মেয়াদের জন্য নির্বাচিত করার অসংখ্য নজির রয়েছে। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সংবিধান সংশোধন করে জাতীয় স্বার্থে তিন মেয়াদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে স্বপদে বহাল রাখা হয়েছিল।
একাদিক্রমে একাধিক মেয়াদে সরকার পরিচালনার সুযোগ পেয়ে দেশকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছে দেয়ার নজির আমাদের পার্শ্ববর্তী এশিয়া মহাদেশের দু’-তিনটি দেশের ক্ষেত্রে রয়েছে। এসব দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, সততা, দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যনিষ্ঠা অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল। আমাদের দেশের জনগণের জিজ্ঞাসা- আমরা কি আমাদের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে উপরোক্ত সব গুণের প্রতিফলন দেখতে পাই?
দলীয় ঐক্য অটুট রাখার অভিপ্রায়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীর রাজনীতিতে আগমন। রাজনীতিক হয়ে দেশের কর্ণধার হবেন তা যে তার চিন্তা-চেতনায় ছিল না, এ বিষয়টি দলীয় প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর বিবিসিতে প্রদত্ত সাক্ষাৎকার থেকে অনুধাবন করা যায়। পারিবারিক ধারাবাহিকতার সূত্র ধরে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীর রাজনীতিতে আগমন ঘটলেও তার নেতৃত্বের যোগ্যতার গুণে তিনি দু’বার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দলের জন্য বিজয় অর্জনে সমর্থ হয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কোনো এক সময় ভারত ও শ্রীলংকার রাজনীতিতে পারিবারিক ধারাবাহিকতা প্রাধান্য পেত। কিন্তু সে ধারাবাহিকতা শ্রীলংকার ক্ষেত্রে বলতে গেলে অবলুপ্ত আর ভারতের ক্ষেত্রে ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে রয়েছে। উন্নত দেশের রাজনীতিতে পারিবারিক ধারাবাহিকতা কদাচিৎ পরিলক্ষিত হয়। এসব দেশে যোগ্যতাই একজন ব্যক্তিকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে পৌঁছে দেয়।
আমাদের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী পারিবারিক ধারাবাহিকতার ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে স্বীয় পুত্রকে তার উত্তরসূরি হিসেবে দেখতে চান এমনই আভাস পাওয়া যায়। ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীর তনয় রাজনীতিতে কতটুকু সফল হবেন, তা দেখতে দেশবাসীকে হয়তো আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু যারা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী তাদের প্রশ্ন- ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যদি পারিবারিক ধারাবাহিকতার ঐতিহ্যই লালন করা হয় তবে সৎ, দক্ষ, যোগ্য, মেধাবী ও দেশপ্রেমিকরা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হবেন কেন?
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে ব্যথিত হয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীকে বলতে শোনা গেছে, জনগণ তার দলের বিদায়ী মেয়রদের উন্নয়ন কার্যক্রম ও যোগ্যতা বিবেচনা না করে নির্বাচনে তাদের পরাভূত করায় চোর ও লুটেরা বিজয়ী হয়েছে। এ ৫টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বর্তমান ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল কারও কাছে প্রশ্নবিদ্ধ নয়। তাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তিকে চোর ও লুটেরা বললে যে জনগণ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন, তাদের অবমাননা করা হয় কি-না, সে প্রশ্নটি এসে যায়।
পদ্মা সেতু বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার এবং এ সরকারের বর্তমান মেয়াদকালেই এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। এ সেতু নির্মাণ করা গেলে অবহেলিত দক্ষিণ অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ সহজতর হতো, যা অর্থনীতি ও জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক অবদান রাখত। ব্যক্তিবিশেষের দুর্নীতি সংশ্লিষ্টতায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। পদ্মা সেতু বিষয়ে বিশ্বব্যাংক প্রাথমিক পর্যায়ে যখন অভিযোগ উত্থাপন করে, তখন সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে প্রকল্পটি অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আবদ্ধ হতো না। যদিও পরে দুর্নীতি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কিন্তু সে উদ্যোগ একপেশে হওয়ায় তা প্রকল্পটির বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নে সুফল এনে দিতে পারেনি।
পদ্মা সেতু ছাড়াও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ, শেয়ারবাজার, রেলের কর্মচারী নিয়োগ, হলমার্ক, ডেসটিনি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, সরকারের উচ্চপদে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ প্রভৃতি দুর্নীতি জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এ বিরূপ প্রভাব ভোটের ময়দানে প্রতিফলিত হলে তা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের জন্য হবে উদ্বেগজনক।
সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার রাস্তার দু’পাশের বিভিন্ন সংস্থার বিলবোর্ড দখল করে সরকারের উন্নয়ন প্রচারণার যে প্রয়াস নেয়া হয়েছিল, তা জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। এটি যে ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক প্রভাব বেশি ফেলবে সে বিষয়ে দলের অনেকের মধ্যে এবং দলবহির্ভূত কারও মধ্যে কোনো ধরনের সংশয় আছে বলে মনে হয় না। যদিও আশার কথা, সরকারদলীয় নেত্রী বিলবোর্ডের উন্নয়ন প্রচারণার ব্যানার অপসারণপূর্বক সংশ্লিষ্টদের ভাড়াবাবদ অর্থ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে তা হারানো ভাবমূর্তি উদ্ধারে যে সম্পূর্ণ সক্ষম হবে না, এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
আমাদের দেশে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিসহ ছোট-বড় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন অবকাঠামো বিনির্মাণে দুর্নীতি সম্পৃক্ততা বর্তমানে গোপন কিছু নয়। বর্তমান সরকারের সময় যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে তা নিয়ে এবং উন্নয়নের কাজের মান নিয়ে দেশবাসী সন্তুষ্ট নয়। তাছাড়া উন্নয়ন ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। রাজনৈতিক দলকে সুষ্ঠু ও সাবলীলভাবে সরকার পরিচালনায় দক্ষ প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করতে হয়। ’৯০-পরবর্তী দলীয়করণের কারণে প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে চলেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাপনায় স্থবিরতা নেমে আসবে।
আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান ও সরকারপ্রধান একই ব্যক্তি হওয়ায় সার্বিক ক্ষমতা একই ব্যক্তিকে ঘিরে কেন্দ্রীভূত। এ ধরনের ব্যবস্থা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। এ ব্যবস্থা বহাল রাখা হলে যোগ্য ব্যক্তির পক্ষে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে আসা দুরূহ হবে। কাউন্সিল অধিবেশনের মাধ্যমে গোপন ব্যালটে নেতা নির্বাচন করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা গেলে যে কোনো দলে সময়ের ব্যবধানে সঠিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল এমন এক সময় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যখন নির্বাচন আদৌ হবে কি-না তা নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে। রাজনৈতিক সমঝোতার অনুপস্থিতিতে একতরফা নির্বাচন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। দেশবাসীর বিশ্বাস, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনে সরকার গঠিত হবে। আর সেক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় পুনঃআগমনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার আহ্বানে জনগণের সাড়া না মিললে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ ও কলামিস্ট
আমাদের দেশের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ’৯০-পূর্ববর্তী ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ চারটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল বিজয় অর্জনে সমর্থ হয়। অপরদিকে ’৯০-পরবর্তী অনুষ্ঠিত ৫টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া ৫ম, ৭ম, ৮ম ও ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তী অথবা নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলেও সে সংসদ এক মাসেরও কম সময়ের ব্যাপ্তিকালে শুধু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিল পাসের পর অবলুপ্ত হয়।
বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে সংসদ বহাল থাকাকালীন মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে সংবিধানে সংশোধনী আনার আবশ্যকতা আছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে দেয়া হলে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে সাংবিধানিক কোনো বাধা নেই।
সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি স্বপদে বহাল থাকবেন এবং সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং সংসদ সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে মন্ত্রী নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার অব্যবহিত পূর্বে যারা সংসদ সদস্য ছিলেন, তাদের মধ্য থেকে নিয়োগদানে সাংবিধানিকভাবে কোনো বাধা নেই।
সংবিধানের উপরোক্ত বিধানাবলি পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, বর্তমান সরকার মেয়াদ অবসান পূর্ববর্তী সংসদ ভেঙে দিয়ে বা না দিয়ে নির্বাচন করতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী স্বপদে বহাল থেকে অব্যবহিত আগের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে তিনি যাদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে মন্ত্রিসভা গঠনপূর্বক অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। ইতিমধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সরকারি ও দলীয় উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সমাবেশে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য তার দলের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিভিন্ন দেশে সরকারের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষায় একটি দলকে পরপর দু’মেয়াদের জন্য নির্বাচিত করার অসংখ্য নজির রয়েছে। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সংবিধান সংশোধন করে জাতীয় স্বার্থে তিন মেয়াদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে স্বপদে বহাল রাখা হয়েছিল।
একাদিক্রমে একাধিক মেয়াদে সরকার পরিচালনার সুযোগ পেয়ে দেশকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছে দেয়ার নজির আমাদের পার্শ্ববর্তী এশিয়া মহাদেশের দু’-তিনটি দেশের ক্ষেত্রে রয়েছে। এসব দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, সততা, দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যনিষ্ঠা অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল। আমাদের দেশের জনগণের জিজ্ঞাসা- আমরা কি আমাদের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে উপরোক্ত সব গুণের প্রতিফলন দেখতে পাই?
দলীয় ঐক্য অটুট রাখার অভিপ্রায়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীর রাজনীতিতে আগমন। রাজনীতিক হয়ে দেশের কর্ণধার হবেন তা যে তার চিন্তা-চেতনায় ছিল না, এ বিষয়টি দলীয় প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর বিবিসিতে প্রদত্ত সাক্ষাৎকার থেকে অনুধাবন করা যায়। পারিবারিক ধারাবাহিকতার সূত্র ধরে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীর রাজনীতিতে আগমন ঘটলেও তার নেতৃত্বের যোগ্যতার গুণে তিনি দু’বার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দলের জন্য বিজয় অর্জনে সমর্থ হয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কোনো এক সময় ভারত ও শ্রীলংকার রাজনীতিতে পারিবারিক ধারাবাহিকতা প্রাধান্য পেত। কিন্তু সে ধারাবাহিকতা শ্রীলংকার ক্ষেত্রে বলতে গেলে অবলুপ্ত আর ভারতের ক্ষেত্রে ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে রয়েছে। উন্নত দেশের রাজনীতিতে পারিবারিক ধারাবাহিকতা কদাচিৎ পরিলক্ষিত হয়। এসব দেশে যোগ্যতাই একজন ব্যক্তিকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে পৌঁছে দেয়।
আমাদের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী পারিবারিক ধারাবাহিকতার ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে স্বীয় পুত্রকে তার উত্তরসূরি হিসেবে দেখতে চান এমনই আভাস পাওয়া যায়। ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীর তনয় রাজনীতিতে কতটুকু সফল হবেন, তা দেখতে দেশবাসীকে হয়তো আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু যারা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী তাদের প্রশ্ন- ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যদি পারিবারিক ধারাবাহিকতার ঐতিহ্যই লালন করা হয় তবে সৎ, দক্ষ, যোগ্য, মেধাবী ও দেশপ্রেমিকরা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হবেন কেন?
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে ব্যথিত হয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীকে বলতে শোনা গেছে, জনগণ তার দলের বিদায়ী মেয়রদের উন্নয়ন কার্যক্রম ও যোগ্যতা বিবেচনা না করে নির্বাচনে তাদের পরাভূত করায় চোর ও লুটেরা বিজয়ী হয়েছে। এ ৫টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বর্তমান ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল কারও কাছে প্রশ্নবিদ্ধ নয়। তাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তিকে চোর ও লুটেরা বললে যে জনগণ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন, তাদের অবমাননা করা হয় কি-না, সে প্রশ্নটি এসে যায়।
পদ্মা সেতু বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার এবং এ সরকারের বর্তমান মেয়াদকালেই এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। এ সেতু নির্মাণ করা গেলে অবহেলিত দক্ষিণ অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ সহজতর হতো, যা অর্থনীতি ও জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক অবদান রাখত। ব্যক্তিবিশেষের দুর্নীতি সংশ্লিষ্টতায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। পদ্মা সেতু বিষয়ে বিশ্বব্যাংক প্রাথমিক পর্যায়ে যখন অভিযোগ উত্থাপন করে, তখন সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে প্রকল্পটি অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আবদ্ধ হতো না। যদিও পরে দুর্নীতি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কিন্তু সে উদ্যোগ একপেশে হওয়ায় তা প্রকল্পটির বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নে সুফল এনে দিতে পারেনি।
পদ্মা সেতু ছাড়াও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ, শেয়ারবাজার, রেলের কর্মচারী নিয়োগ, হলমার্ক, ডেসটিনি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, সরকারের উচ্চপদে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ প্রভৃতি দুর্নীতি জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এ বিরূপ প্রভাব ভোটের ময়দানে প্রতিফলিত হলে তা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের জন্য হবে উদ্বেগজনক।
সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার রাস্তার দু’পাশের বিভিন্ন সংস্থার বিলবোর্ড দখল করে সরকারের উন্নয়ন প্রচারণার যে প্রয়াস নেয়া হয়েছিল, তা জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। এটি যে ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক প্রভাব বেশি ফেলবে সে বিষয়ে দলের অনেকের মধ্যে এবং দলবহির্ভূত কারও মধ্যে কোনো ধরনের সংশয় আছে বলে মনে হয় না। যদিও আশার কথা, সরকারদলীয় নেত্রী বিলবোর্ডের উন্নয়ন প্রচারণার ব্যানার অপসারণপূর্বক সংশ্লিষ্টদের ভাড়াবাবদ অর্থ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে তা হারানো ভাবমূর্তি উদ্ধারে যে সম্পূর্ণ সক্ষম হবে না, এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
আমাদের দেশে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিসহ ছোট-বড় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন অবকাঠামো বিনির্মাণে দুর্নীতি সম্পৃক্ততা বর্তমানে গোপন কিছু নয়। বর্তমান সরকারের সময় যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে তা নিয়ে এবং উন্নয়নের কাজের মান নিয়ে দেশবাসী সন্তুষ্ট নয়। তাছাড়া উন্নয়ন ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। রাজনৈতিক দলকে সুষ্ঠু ও সাবলীলভাবে সরকার পরিচালনায় দক্ষ প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করতে হয়। ’৯০-পরবর্তী দলীয়করণের কারণে প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে চলেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাপনায় স্থবিরতা নেমে আসবে।
আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান ও সরকারপ্রধান একই ব্যক্তি হওয়ায় সার্বিক ক্ষমতা একই ব্যক্তিকে ঘিরে কেন্দ্রীভূত। এ ধরনের ব্যবস্থা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। এ ব্যবস্থা বহাল রাখা হলে যোগ্য ব্যক্তির পক্ষে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে আসা দুরূহ হবে। কাউন্সিল অধিবেশনের মাধ্যমে গোপন ব্যালটে নেতা নির্বাচন করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা গেলে যে কোনো দলে সময়ের ব্যবধানে সঠিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল এমন এক সময় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যখন নির্বাচন আদৌ হবে কি-না তা নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে। রাজনৈতিক সমঝোতার অনুপস্থিতিতে একতরফা নির্বাচন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। দেশবাসীর বিশ্বাস, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনে সরকার গঠিত হবে। আর সেক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় পুনঃআগমনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার আহ্বানে জনগণের সাড়া না মিললে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ ও কলামিস্ট
No comments