সিরিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রতিবেদন
সিরিয়ায় সাধারণ মানুষের ওপর সে দেশের
শাসকগোষ্ঠী রাসায়নিক অস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে
যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তা-ই নয়। দামেস্কের বেসামরিক লোকজনের ওপর ব্যবহার করা
হয়েছে স্নায়ু অস্ত্রও।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন
কেরি বলেছেন, সিরিয়া পরিস্থিতি নিয়ে এখন কংগ্রেস ও বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে
পরামর্শ করছেন। ৩০শে আগস্ট তিনি কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে
আলোচনা করতে তার জাতীয় নিরাপত্তা টিমের সবাইকে আহ্বান জানান। এখানে পরামর্শ
করা হয় যদি সামরিক হামলা করাই হয় তবে তা কবে, কিভাবে করা হতে পারে। গতকাল
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে
সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। সেখান থেকে চুম্বক অংশ এখানে
সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
২১শে আগস্ট সিরীয় সরকারের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার: একটি ব্যাপক সংখ্যক নিরপেক্ষ উৎস ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, গত ২১শে আগস্ট দামেস্কের শহরতলিতে রাসায়নিক অস্ত্র হামলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য ছাড়াও আরও যেসব মাধ্যম থেকে তথ্য পাওয়া গেছে সেগুলো হলো- বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও সিরীয় চিকিৎসা কর্মীবৃন্দ, ভিডিও, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য, দামেস্ক ও এর আশপাশের কমপক্ষে ১২টি এলাকার হাজার হাজার সোশ্যাল মিডিয়া রিপোর্ট, সংবাদকর্মীদের ভাষ্য এবং অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য বেসরকারি সংগঠনসমূহের প্রতিবেদন।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একটি প্রাথমিক যাচাই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে যে, রাসায়নিক অস্ত্র হামলায় ১৪২৯ জন ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কমপক্ষে ৪২৬টি শিশু, যদিও এই তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই হিসাবেরও আরও পরিবর্তন ঘটবে।
পটভূমি: সিরীয় শাসকগোষ্ঠী মাস্টার্ড, সারিন ও ভিএক্সসহ ব্যাপক সংখ্যক রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত বজায় রাখে। এছাড়াও তাদের আছে হাজার যুদ্ধোপকরণ যা দ্বারা রাসায়নিক অস্ত্র হামলায় ব্যবহার করা সম্ভব। রাসায়নিক অস্ত্র কর্মসূচির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের এবং নিরাপত্তা ও আনুগত্য নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করে এই কর্মসূচির সদস্যদেরকে বেছে নেয়া হয়। সিরীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘সিরিয়ান সায়েন্টিফিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’ (এসএসআরসি) সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র কর্মসূচির তত্ত্বাবধান করে থাকে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে আমরা যাচাই করে দেখেছি যে, সিরীয় শাসকগোষ্ঠী বিগত বছরে বেশ কয়েক বার দামেস্ক শহরতলিসহ বিরোধীদের ওপর স্বল্প মাত্রায় রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছে। এই যাচাই প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সিরিয়ার সরকারি কর্মকর্তাদের রাসায়নিক অস্ত্র হামলার পরিকল্পনা ও সেগুলো বাস্তবায়ন এবং বেশকিছু আক্রান্ত ব্যক্তিকে পরীক্ষা করে গবেষণাগারে বিশ্লেষণে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। আর এ থেকে জানা গেছে যে, তারা সারিন দ্বারা আক্রান্ত। আমরা অনুমান করি যে বিরোধীরা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেনি। গত ২১শে আগস্ট দামেস্ক-এর যে সব এলাকা লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছিল সে সব এলাকাসহ দামেস্ক-এর ডজনখানেক এলাকা বিরোধী শক্তির আওতামুক্ত করতে সিরীয় শাসকগোষ্ঠী ব্যর্থ হয়েছে। এই হামলায় প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রায় সব ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। আমরা অনুমান করি যে দামেস্ক-এর বড় অংশ দখল করতে না পারার হতাশাই হয়তো সিরীয় শাসকগোষ্ঠীকে গত ২১শে আগস্ট রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিতে ভূমিকা রেখেছে।
প্রস্তুতি: আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে যা থেকে আমরা জানতে পারি যে এসএসআরসি কর্মসূচির কর্মীরাসহ সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র কর্মসূচির কর্মীরা ওই হামলার আগে রাসায়নিক গোলাবারুদ প্রস্তুত করছিল।
হামলার তিন দিন আগে আমরা মানুষ, বিভিন্ন সংকেত এবং এবং ভূ-স্পেস সংক্রান্ত বার্তাসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করি যা সিরীয় শাসকগোষ্ঠীর কার্যক্রম প্রকাশ করে যা রাসায়নিক অস্ত্র হামলার প্রস্তুতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে আমরা জানি। সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র কর্মসূচির কর্মীরা দামেস্ক-এর শহরতলী আদ্রায় গত ১৮ই আগস্ট, রোববার থেকে ২১শে আগস্ট বুধবার ভোর পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। এটি এমন একটি এলাকার কাছে যেটি সিরীয় শাসকগোষ্ঠী সারিনসহ তাদের অন্যান্য রাসায়নিক অস্ত্র মেশানোর জন্য ব্যবহার করে থাকে। ২১শে আগস্ট সিরীয় শাসকগোষ্ঠী দামেস্ক-এর কিছু এলাকায় গ্যাসমাস্ক ব্যবহারসহ রাসায়নিক অস্ত্র হামলা চালানোর জন্য প্রস্তুতি নেয়। দামেস্ক এলাকায় আমাদের গোয়েন্দা উৎস এমন কোন ইঙ্গিত পায়নি যে ওই হামলার আগে বিরোধীরা রাসায়নিক অস্ত্র হামলার পরিকল্পনা করছিল।
হামলা: একাধিক গোয়েন্দা ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য নির্দেশ করে যে শাসকগোষ্ঠী দামেস্কের শহরতলীতে ২১শে আগস্টের রাতে রকেট ও আর্টিলারি হামলা চালায়। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য হতে এটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে যে, হামলাটি শাসকগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে চালানো হয় এবং কাফ্র বাতনা, জবার, আইন তারমা, দারায়া এবং মু’আদদামিয়াহসহ এমন লোকালয়ে আঘাত হানে যেখানে রাসায়নিক হামলা সংঘটিত হয় বলে প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে রাসায়নিক হামলার প্রথম খবর প্রকাশিত হওয়ার প্রায় ৯০ মিনিট আগে ভোরের দিকে, শাসকগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে রকেট উৎক্ষেপণের তথ্যও এর অন্তর্ভুক্ত। উড়োজাহাজ পরিবহন সংশ্লিষ্ট বা মিসাইল উৎক্ষেপণ সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের অনুপস্থিতিও আমাদের এই উপসংহারের দিকে নির্দেশ করে যে, শাসকগোষ্ঠী এই আক্রমণে রকেট ব্যবহার করে। হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একশ’টি ভিডিও আমরা চিহ্নিত করেছি যার অধিকাংশই বিপুল সংখ্যক মানবদেহ প্রদর্শন করে যেগুলোতে স্নায়ু প্রভাবক রাসায়নিক দ্রব্যের সংক্রমণের চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। এই চিহ্নগুলো স্নায়ু প্রভাবক রাসায়নিক দ্রব্যের সংক্রমণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যদিও কেবল এমন সংক্রমণের ক্ষেত্রেই নয়, অন্য ক্ষেত্রেও এসব চিহ্ন দেখা যেতে পারে। ঘটনার শিকারদের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তার মধ্যে সংজ্ঞাহীনতা, নাক ও মুখ হতে ফেনা উদগীরণ, চোখের মণির স্থির থাকা, দ্রুত হৃদস্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে জটিলতা অন্তর্ভুক্ত। অনেকগুলো ভিডিওতে অসংখ্য মরদেহ দেখা যায় যাদের শরীরে কোন প্রকাশ্য আঘাতের চিহ্ন নেই যা রাসায়নিক অস্ত্রের হামলার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং ছোট আগ্নেয়াস্ত্র, উচ্চবিস্ফোরক গোলাবারুদ বা ব্লিস্টার অস্ত্রের হামলার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সকলের জন্য উন্মুক্ত এমন ভিডিওগুলোতে কমপক্ষে ১২টি স্থান প্রদর্শিত হয় এবং সেই ভিডিওগুলোর একটি নমুনার পর্যালোচনায় নিশ্চিত করা গিয়েছে যে এগুলোর কিছু কিছু ভিডিও’র বিবরণ মোতাবেক সাধারণ সময় ও স্থানে রেকর্ড করা হয়েছে। আমাদের পর্যালোচনা মতে এসব ভিডিও, এনজিও ও চিকিৎসাকর্মী কর্তৃক পুনঃনিশ্চিত করা শারীরিক লক্ষণসমূহ এবং এই রাসায়নিক আক্রমণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য তথ্য জালিয়াতি করার মতো সামর্থ্য সিরীয় বিরোধীগোষ্ঠীর নেই। অতীত সিরীয় চর্চাসহ বিপুল পরিমাণ তথ্য আমাদের হাতে রয়েছে যা থেকে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে, শাসকগোষ্ঠীর কর্মকর্তাগণ ২১শে আগস্টের হামলা সম্বন্ধে অবগত ছিলেন এবং এই হামলা পরিচালনার নির্দেশ দেন। এই হামলার সম্বন্ধে গভীরভাবে অবগত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার একটি কথোপকথন সম্বন্ধে আমরা অবগত হই যিনি এটা নিশ্চিত করেন যে, ২১শে আগস্ট রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয় এবং জাতিসংঘ ইন্সপেক্টরগণ এ সম্বন্ধে তথ্য পেয়ে যাবেন বলে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে যার মতে ২১শে আগস্টের অপরাহ্ণে সিরিয়ান রাসায়নিক অস্ত্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাজ স্থগিত করার নির্দেশ দেয়া হয়। একই সময়ে, যেসব স্থানে রাসায়নিক হামলা দেখা দেয় সেসব এলাকায় শাসকগোষ্ঠী আর্টিলারি হামলার পরিমাণ বৃদ্ধি করে। হামলা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা তার আগের দশ দিনের তুলনায় চারগুণ অধিক আর্টিলারি ও রকেট আক্রমণের লক্ষণ চিহ্নিত করতে পারি। ২৬শে আগস্টের সকাল পর্যন্ত আমরা সেসব লোকালয়ে অনবরত হামলার লক্ষণ দেখতে পাই।
No comments