পরিবেশ অধিদফতরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন by হাসান কামরুল
বাংলায়
বহুল প্রচলিত একটা প্রবাদ আছে- যে যায় লংকায় সেই-ই হয় রাবণ। সরকার
সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার অদূরে ভারতের সহযোগিতায় যৌথভাবে
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। সাইট
সিলেকশন, অবস্থানগত ছাড়পত্র ও সবশেষে পরিবেশ অধিদফতর ইআইএ (পরিবেশগত
সমীক্ষা নিরূপণ) সার্টিফিকেটও দিয়েছে। সরকার বলছে, রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র
হলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হবে না। উন্নত প্রযুক্তি
ব্যবহার করে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখবে। আর এজন্য
জ্বালানি উপদেষ্টা পরিবেশবাদীদের উন্নত প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনার উপদেশ
দিয়েছেন। কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে রামপালে বিদ্যুৎ
কেন্দ্র কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ সমর্থন করবে না। কারণ সুন্দরবন
ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের একটি অংশ। এ বনে এমন কিছু প্রাণী আছে যারা বিপন্ন
প্রজাতির। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনের আশপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে
সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করে ১৯৯৯ সালে। রেড জোন বা সংকটাপন্ন এলাকায় তাপ
বিদ্যুৎ কেন্দ্র কেন, ভারি যানবাহন চলাচলও নিষিদ্ধ করা হয়েছে পরিবেশ আইনে।
এখন পরিবেশ অধিদফতর তাদের করা আইনকেই অমান্য করছে?
রামপালে কয়লা আনা-নেয়ার কাজে সুন্দরবনের আকরাম পয়েন্টকে ব্যবহার করবে ভারত। সরকার হয়তো সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব বুঝতেই পারছে না। সরকার ভারতের সঙ্গে যৌথ কারবারি ব্যবসা খুলেছে। তাই ভারত থেকে কয়লা আমদানি করে সুন্দরবনের সন্নিকটে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতরের কী কাজ? কেন তারা অবস্থানগত ছাড়পত্র ও ইআইএ সার্টিফিকেট ইস্যু করল? তাহলে কি পরিবেশ অধিদফতর তাদের কর্মপরিধি বা গাইডলাইন ভুলে গেল? একটি রাজনৈতিক সরকারের নানা রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকতেই পারে। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতর এ দেশের পরিবেশ সুরক্ষার অভিভাবক। সরকার ভুল সিদ্ধান্ত নিলে অধিদফতর তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ক্ষমতা সংরক্ষণ করে। তারা কোনো ধরনের উদ্যোগ না নিয়েই ছাড়পত্র ইস্যু করল, যা কোনোভাবেই উচিত হয়নি। অধিদফতর যদি সত্যিই রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে পরিবেশগত সমীক্ষা নিরূপণ করে থাকে, তাহলে তো নিরূপণের রেজাল্ট পজিটিভ হওয়ার কথা নয়। নেতিবাচক প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অধিদফতর পরিবেশের ক্লিয়ারেন্স দিল! এ দায়ভার অধিদফতর এড়াতে পারবে কি? রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবন বিপর্যস্ত হবে, জীববৈচিত্র্য চরমভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে- এ কথাগুলো তো মিথ্যা নয়। পরিবেশ অধিদফতর সুন্দরবন ধ্বংসে মেতে উঠেছে এমন অভিযোগে যদি কেউ মামলা করে, তাহলে অধিদফতরকে আইনি জটিলতার মুখে পড়তে হবে।
পরিবেশ অধিদফতর এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার জন্ম সরকারের তাঁবেদারি করার জন্য হয়নি। অধিদফতর সব ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে দেশের পরিবেশের ওপর নজর রাখবে, এটা অধিদফতরের গঠনতন্ত্রে বলা আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অধিদফতর সরকারের চাপের মুখেই হোক বা সরকারের পছন্দমতো লোকজন এ অধিদফতরের দায়িত্বে থাকার কারণেই হোক, অধিদফতর পক্ষান্তরে দেশের পরিবেশকেই ভারাক্রান্ত করে তুলছে। এ সরকারের আমলেই পারকির চরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে শেষ পর্যন্ত অব্যাহত সমালোচনার মুখে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। সেখানেও অধিদফতর থেকে সাইট ক্লিয়ারেন্স দেয়া হয়েছিল। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কোম্পানি এনটিপিসি সুন্দরবনের পাশে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে যাচ্ছে। অথচ ভারতের ওয়ার্ল্ড লাইফ প্রটেকশন আইন ১৯৭২-এ বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে বাঘ বা হাতির সংরক্ষণ অঞ্চল, জৈববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্য কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না। অথচ বাংলাদেশে প্রকল্প এলাকাটি ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে হওয়ায় অধিদফতর থেকে বলা হচ্ছে, এতে সুন্দরবনের ওপর প্রভাব পড়বে না। সাধারণত কোথাও একটা ইটভাটা থাকলেই ইটভাটার আশপাশের ৫ কিলোমিটার এলাকার বাতাস ঘন কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে। আর উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রভাব তো ২০-২৫ কিলোমিটার এলাকায় এমনিতেই প্রভাবিত হবে। ইআইএ রিপোর্টে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রকল্প এলাকায় ধান, মাছ, গৃহপালিত পশুপাখি ইত্যাদি ধ্বংস হবে বলে স্বীকার করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের নির্মাণকাজ, ড্রেজিং, রাসায়নিক ও তৈল নিঃসরণের ফলে পশুর ও মাইদারা নদী, সংযোগ খাল, জোয়ার-ভাটার প্লাবন ভূমি ইত্যাদি এলাকার মৎস্য আবাস, মৎস্য চলাচল ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতির মুখে পড়বে বলে ইআইএ রিপোর্টে বলা হয়েছে (ইআইএ, পৃষ্ঠা ২৬৬ ও ২৬৭)। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে মালামাল ও যন্ত্রপাতি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে পরিবহনের ফলে বাড়তি নৌযান চলাচল, তেল নিঃসরণ, বর্জ্য নিঃসরণ, আলো, শব্দ দূষণ ইত্যাদি পরিবেশ আইন অনুসারে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সুন্দরবনের ইকো-সিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বলেও ইআইএ রিপোর্টে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে (ইআইএ, পৃষ্ঠা ২৬৮)। ইআইএ রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন নির্গত হবে। স্বভাবতই এ বিপুল বিষাক্ত গ্যাস সুন্দরবনের বাতাসে মিশে গোটা সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে।
কয়লাভিত্তিক সাধারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় উন্নত প্রযুক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মাত্র ১০ শতাংশ কম কার্বন নিঃসরণ হয় এবং ৮০ শতাংশ লোড ফ্যাক্টর ধরলে প্রতিবছর কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ হবে ৭৯ লাখ মেট্রিক টন, যা সুন্দরবনের সৌন্দর্যকে চিরতরে ধ্বংস করে দেবে। অথচ এ নিয়ে ইআইএ রিপোর্টে কিছুই বলা হয়নি। ইআইএ রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য প্রতি ঘণ্টায় পশুর নদী থেকে ৯১৫০ ঘনমিটার পানি প্রত্যাহার করতে হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি শীতলকরণসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের পর ৫১৫০ ঘনমিটার পানি আবার নদীতে ফেরত আনা হবে। ঘণ্টায় প্রায় ৪ হাজার ঘনমিটার পানির প্রবাহ কমবে। তার মানে প্রতিদিন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি যদি ২০ ঘণ্টা উৎপাদনে থাকে, তাহলে প্রতিদিন ৮০ হাজার ঘনমিটার পানির প্রবাহ স্বাভাবিকভাবেই নষ্ট হবে। এ হিসাবটাও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৯৯৫ সালে নেয়া। পশুর নদীর বর্তমান পানির প্রভাব হিসাব করলে এ হিসাবের অংকটা অনেক উঁচু হবে। এ এনপিটিসি ভারতে যখন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে, তখন জিরো ডিসচার্জ নীতি অনুসরণ করে। যেমন ভারতের ছত্তিশগড়ে রায়গড়ের কাছে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র। অথচ এনপিটিসি রামপালে জিরো ডিসচার্জ নীতি অনুসরণ না করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে (রায়গড় ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এক্সিকিউটিভ সামারি, পৃষ্ঠা ২)। এ বিদ্যুৎ কেন্দে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লাখ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। এ ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ, স্নারি তরল বা ঘনীভূত অবস্থায় ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ করবে। এতে বিভিন্ন ধাতু সংমিশ্রিত অবস্থায় থাকে যেমন- আর্সেনিক, পারদ, সিসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ও রেডিয়াম, যা পশুপাখিসহ মানুষের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ বলে বিবেচিত। পরিবেশ অধিদফতর তাদের ইআইএ’র এক জায়গায় বলছে, এ বিষাক্ত ছাই পরিবেশে নির্গত হলে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হবে (ইআইএ পৃষ্ঠা ২৮৭)। অন্যদিকে বলছে, নির্গত বিষাক্ত ছাই ১৮৩৪ একর জমির মধ্যে ১৪১৪ একর জমি ভরাটের কাজে ব্যবহৃত হবে (ইআইএ, পৃষ্ঠা ২৬৩), যা পরিবেশের সঙ্গে নিছক তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।
পরিবেশ অধিদফতর সত্যিই যদি দেশের পরিবেশের ওপর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভিভাবক হয়ে থাকে, তাহলে অন্তত বিবেকের তাড়নায় হলেও সুন্দরবনের কাছে এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সরকারকে নিরুৎসাহিত করবে। প্রয়োজনে ইস্যু করা ইআইএ ছাড়পত্র প্রত্যাহার করে নিরপেক্ষ পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সঠিক ইআইএ রিপোর্ট প্রস্তুত করার জন্য অনুরোধ করছি। বিদ্যুৎ আমাদের দরকার কিন্তু সুন্দরবনকে ধ্বংস করে আমরা বিদ্যুৎ চাই না।
হাসান কামরুল : জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক
রামপালে কয়লা আনা-নেয়ার কাজে সুন্দরবনের আকরাম পয়েন্টকে ব্যবহার করবে ভারত। সরকার হয়তো সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব বুঝতেই পারছে না। সরকার ভারতের সঙ্গে যৌথ কারবারি ব্যবসা খুলেছে। তাই ভারত থেকে কয়লা আমদানি করে সুন্দরবনের সন্নিকটে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতরের কী কাজ? কেন তারা অবস্থানগত ছাড়পত্র ও ইআইএ সার্টিফিকেট ইস্যু করল? তাহলে কি পরিবেশ অধিদফতর তাদের কর্মপরিধি বা গাইডলাইন ভুলে গেল? একটি রাজনৈতিক সরকারের নানা রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকতেই পারে। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতর এ দেশের পরিবেশ সুরক্ষার অভিভাবক। সরকার ভুল সিদ্ধান্ত নিলে অধিদফতর তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ক্ষমতা সংরক্ষণ করে। তারা কোনো ধরনের উদ্যোগ না নিয়েই ছাড়পত্র ইস্যু করল, যা কোনোভাবেই উচিত হয়নি। অধিদফতর যদি সত্যিই রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে পরিবেশগত সমীক্ষা নিরূপণ করে থাকে, তাহলে তো নিরূপণের রেজাল্ট পজিটিভ হওয়ার কথা নয়। নেতিবাচক প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অধিদফতর পরিবেশের ক্লিয়ারেন্স দিল! এ দায়ভার অধিদফতর এড়াতে পারবে কি? রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবন বিপর্যস্ত হবে, জীববৈচিত্র্য চরমভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে- এ কথাগুলো তো মিথ্যা নয়। পরিবেশ অধিদফতর সুন্দরবন ধ্বংসে মেতে উঠেছে এমন অভিযোগে যদি কেউ মামলা করে, তাহলে অধিদফতরকে আইনি জটিলতার মুখে পড়তে হবে।
পরিবেশ অধিদফতর এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার জন্ম সরকারের তাঁবেদারি করার জন্য হয়নি। অধিদফতর সব ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে দেশের পরিবেশের ওপর নজর রাখবে, এটা অধিদফতরের গঠনতন্ত্রে বলা আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অধিদফতর সরকারের চাপের মুখেই হোক বা সরকারের পছন্দমতো লোকজন এ অধিদফতরের দায়িত্বে থাকার কারণেই হোক, অধিদফতর পক্ষান্তরে দেশের পরিবেশকেই ভারাক্রান্ত করে তুলছে। এ সরকারের আমলেই পারকির চরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে শেষ পর্যন্ত অব্যাহত সমালোচনার মুখে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। সেখানেও অধিদফতর থেকে সাইট ক্লিয়ারেন্স দেয়া হয়েছিল। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কোম্পানি এনটিপিসি সুন্দরবনের পাশে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে যাচ্ছে। অথচ ভারতের ওয়ার্ল্ড লাইফ প্রটেকশন আইন ১৯৭২-এ বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে বাঘ বা হাতির সংরক্ষণ অঞ্চল, জৈববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্য কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না। অথচ বাংলাদেশে প্রকল্প এলাকাটি ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে হওয়ায় অধিদফতর থেকে বলা হচ্ছে, এতে সুন্দরবনের ওপর প্রভাব পড়বে না। সাধারণত কোথাও একটা ইটভাটা থাকলেই ইটভাটার আশপাশের ৫ কিলোমিটার এলাকার বাতাস ঘন কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে। আর উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রভাব তো ২০-২৫ কিলোমিটার এলাকায় এমনিতেই প্রভাবিত হবে। ইআইএ রিপোর্টে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রকল্প এলাকায় ধান, মাছ, গৃহপালিত পশুপাখি ইত্যাদি ধ্বংস হবে বলে স্বীকার করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের নির্মাণকাজ, ড্রেজিং, রাসায়নিক ও তৈল নিঃসরণের ফলে পশুর ও মাইদারা নদী, সংযোগ খাল, জোয়ার-ভাটার প্লাবন ভূমি ইত্যাদি এলাকার মৎস্য আবাস, মৎস্য চলাচল ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতির মুখে পড়বে বলে ইআইএ রিপোর্টে বলা হয়েছে (ইআইএ, পৃষ্ঠা ২৬৬ ও ২৬৭)। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে মালামাল ও যন্ত্রপাতি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে পরিবহনের ফলে বাড়তি নৌযান চলাচল, তেল নিঃসরণ, বর্জ্য নিঃসরণ, আলো, শব্দ দূষণ ইত্যাদি পরিবেশ আইন অনুসারে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সুন্দরবনের ইকো-সিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বলেও ইআইএ রিপোর্টে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে (ইআইএ, পৃষ্ঠা ২৬৮)। ইআইএ রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন নির্গত হবে। স্বভাবতই এ বিপুল বিষাক্ত গ্যাস সুন্দরবনের বাতাসে মিশে গোটা সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে।
কয়লাভিত্তিক সাধারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় উন্নত প্রযুক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মাত্র ১০ শতাংশ কম কার্বন নিঃসরণ হয় এবং ৮০ শতাংশ লোড ফ্যাক্টর ধরলে প্রতিবছর কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ হবে ৭৯ লাখ মেট্রিক টন, যা সুন্দরবনের সৌন্দর্যকে চিরতরে ধ্বংস করে দেবে। অথচ এ নিয়ে ইআইএ রিপোর্টে কিছুই বলা হয়নি। ইআইএ রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য প্রতি ঘণ্টায় পশুর নদী থেকে ৯১৫০ ঘনমিটার পানি প্রত্যাহার করতে হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি শীতলকরণসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের পর ৫১৫০ ঘনমিটার পানি আবার নদীতে ফেরত আনা হবে। ঘণ্টায় প্রায় ৪ হাজার ঘনমিটার পানির প্রবাহ কমবে। তার মানে প্রতিদিন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি যদি ২০ ঘণ্টা উৎপাদনে থাকে, তাহলে প্রতিদিন ৮০ হাজার ঘনমিটার পানির প্রবাহ স্বাভাবিকভাবেই নষ্ট হবে। এ হিসাবটাও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৯৯৫ সালে নেয়া। পশুর নদীর বর্তমান পানির প্রভাব হিসাব করলে এ হিসাবের অংকটা অনেক উঁচু হবে। এ এনপিটিসি ভারতে যখন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে, তখন জিরো ডিসচার্জ নীতি অনুসরণ করে। যেমন ভারতের ছত্তিশগড়ে রায়গড়ের কাছে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র। অথচ এনপিটিসি রামপালে জিরো ডিসচার্জ নীতি অনুসরণ না করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে (রায়গড় ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এক্সিকিউটিভ সামারি, পৃষ্ঠা ২)। এ বিদ্যুৎ কেন্দে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লাখ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। এ ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ, স্নারি তরল বা ঘনীভূত অবস্থায় ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ করবে। এতে বিভিন্ন ধাতু সংমিশ্রিত অবস্থায় থাকে যেমন- আর্সেনিক, পারদ, সিসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ও রেডিয়াম, যা পশুপাখিসহ মানুষের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ বলে বিবেচিত। পরিবেশ অধিদফতর তাদের ইআইএ’র এক জায়গায় বলছে, এ বিষাক্ত ছাই পরিবেশে নির্গত হলে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হবে (ইআইএ পৃষ্ঠা ২৮৭)। অন্যদিকে বলছে, নির্গত বিষাক্ত ছাই ১৮৩৪ একর জমির মধ্যে ১৪১৪ একর জমি ভরাটের কাজে ব্যবহৃত হবে (ইআইএ, পৃষ্ঠা ২৬৩), যা পরিবেশের সঙ্গে নিছক তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।
পরিবেশ অধিদফতর সত্যিই যদি দেশের পরিবেশের ওপর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভিভাবক হয়ে থাকে, তাহলে অন্তত বিবেকের তাড়নায় হলেও সুন্দরবনের কাছে এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সরকারকে নিরুৎসাহিত করবে। প্রয়োজনে ইস্যু করা ইআইএ ছাড়পত্র প্রত্যাহার করে নিরপেক্ষ পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সঠিক ইআইএ রিপোর্ট প্রস্তুত করার জন্য অনুরোধ করছি। বিদ্যুৎ আমাদের দরকার কিন্তু সুন্দরবনকে ধ্বংস করে আমরা বিদ্যুৎ চাই না।
হাসান কামরুল : জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক
No comments