অ্যামনেস্টির বার্ষিক প্রতিবেদন : নিরাপত্তা বাহিনী ‘ব্যাপক মাত্রায়’ নির্যাতন চালাচ্ছে : ৩০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ১০ জন গুম ইলিয়াস আলীর ব্যাপারে কথা রাখেনি সরকার
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেও ‘ব্যাপক মাত্রায়’ নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ
এনেছে লন্ডনভিত্তিক খ্যাতনামা মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি
ইন্টারন্যাশনাল।
গতকাল প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে
অ্যামনেস্টি বলেছে, ‘কার্যত দায়মুক্তি পেয়ে পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী ও
গোয়েন্দা সংস্থা ব্যাপক মাত্রায় নির্যাতন ও অন্যান্য দুর্ব্যবহার করে
থাকে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্যাতনের ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, সেগুলোর মধ্যে মারধর করা, লাথি মারা, ছাদ থেকে ঝুলিয়ে রাখা, খাবার ও ঘুম থেকে বঞ্চিত করা এবং বৈদ্যুতিক শক দেয়া অন্যতম।
অ্যামনেস্টির রিপোর্টের তাত্পর্যপূর্ণ দিক হলো এবার নির্যাতনের সঙ্গে সেনাবাহিনীকেও জড়ানো হয়েছে।
গতকাল লন্ডনে অ্যামনেস্টির বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৩ প্রকাশ করা হয়। এতে বিশ্বের ১৫৯টি দেশের গত বছরের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি প্রতিবছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিস্তারিত পর্যালোচনা প্রকাশ করে থাকে।
৩০০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে চারটি পৃষ্ঠা রয়েছে। এতে বলা হয়, ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে র্যাব ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ৩০টি বিচাবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
তারা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে পুলিশ দাবি করেছে। আর নিহতদের পরিবারগুলো বলেছে, বেসামরিক পোশাক পরিহিত লোকজন র্যাব বা পুলিশের পরিচয় দিয়ে তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর মেরে ফেলা হয়েছে। এসব ঘটনার কোনো বিচার হয়নি।
উদাহরণ হিসেবে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া জেলার একজন কৃষক আতিয়ার রহমান ওরফে তোফা মোল্লার নিহত হওয়ার ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়। র্যাবের দাবি, তিনি ক্রসফায়ারে মারা গেছেন। তার পরিবার ও অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, র্যাব তাকে আগের দিন সন্ধ্যায় বাসা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তার মৃতদেহে তিনটি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে, যেগুলোর মধ্যে দুটো ছিল পেছন দিকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরে মোট ১০ জন গুম হয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হতভাগ্য ব্যক্তিদের কোনো সন্ধান মেলেনি। আর যাদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, তাদের দেহে মারধর ও আঘাতের চিহ্ন ছিল। এক্ষেত্রে গত বছরের ১৭ এপ্রিল গুম হওয়া বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর কথা তুলে ধরা হয়েছে। সরকার এ ব্যাপারে তদন্ত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও বছর শেষ হওয়া পর্যন্ত তার সম্পর্কে কোনো তথ্য জানায়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত জানুয়ারিতে বলেছিলেন, দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে গত ডিসেম্বর থেকেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। বিরোধী দলের হরতালের মধ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন, গুম, নারী ও সংখ্যালঘু এবং পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর ওপর নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
গত নভেম্বরে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ঘটনায় অন্তত ১১১ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আগুন লাগার পরও কারখানা কর্তৃপক্ষ বহু শ্রমিককে বেরোতে দেয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর বাংলাদেশে একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে এবং এ সময় আদালত ৪৫ জনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপড়েনের প্রসঙ্গ টেনে অ্যামনেস্টি বলেছে, দুর্নীতির ওই অভিযোগ নিয়ে সরকারের সাড়া যথেষ্ট ছিল না।
বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অ্যামনেস্টির এবারের প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশে অভিবাসী ও শরণার্থীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধ দেশে দেশে সরকারি পর্যায়ে ব্যবস্থা না নেয়ায় বিশ্বব্যাপী অভিবাসী ও শরণার্থীদের বসবাস ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে বলে মন্তব্য করছে অ্যামনেস্টি।
লন্ডনে অ্যামনেস্টি কার্যালয়ে এ প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সংস্থার মহাসচিব সলিল সেট্টি বলেন, সংঘাত ও সহিংসতা বন্ধে সরকারগুলো সঠিকভাবে সাড়া দিতে না পারায় বিশ্বজুড়ে উদ্বাস্তু হওয়া বা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হওয়া মানুষের একটি শ্রেণী তৈরি হচ্ছে।
অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের নামে বহু দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো সীমান্ত সুরক্ষার নামে যা করছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অন্যায্য।
শরণার্থীদের কারণে দরিদ্র দেশগুলোতে যে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয় তা লাঘবে সহযোগিতা করার জন্য ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান অ্যামনেস্টি মহাসচিব।
অ্যামনেস্টির অভিবাসী ও শরণার্থী অধিকারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ শেরিফ আল সৈয়দ আলী সম্প্রতি গ্রিসে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা তুলে ধরে বলেন, গ্রিস ইতালির মতো দেশগুলোতে বিদেশি শ্রমিকরা মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না। ফলে তাদের দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার দেশগুলোতে রাজপথ এবং অনলাইন উভয় ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর রাষ্ট্রের নির্মম আক্রমণ একটি অভিন্ন প্রবণতায় পরিণত হয়েছে।
নারী এবং মেয়ে শিশুদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌতুক দিতে না পারায় হত্যা, ধর্মীয় বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে সালিশের মাধ্যমে দোররা মারা, পারিবারিক সহিংসতা এবং যৌন সহিংসতার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এতে উদহারণ হিসেবে কুষ্টিয়া জেলার খোকসা থানায় গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর আলেয়া বেগম এবং তার মেয়েতে গ্রেফতার করে নির্যাতন করে। তাদের দুই দিন খোকসা থানায় আটক রাখার পর কুষ্টিয়া সদর থানায় নিয়ে একটি অন্ধকার ঘরে আটকে রাখা হয়। এরপর কলেজপড়ুয়া মেয়েটিকে মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে পুলিশ যৌন নিপীড়ন চালায়। ১৮ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির করার পর তারা ছাড়া পেয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে এসব অভিযোগ জানালে পুলিশ ২৬ সেপ্টেম্বর আবার তাদের গ্রেফতার করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি এবং কাজের পরিবেশ উন্নয়নের দাবি সমর্থন করেছেন যেসব শ্রমিকনেতা, তাদের হয়রানি করা এবং ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে।
গত বছরের ৪ এপ্রিল শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের গুম হওয়া এবং পরে ঘাটাইলে তার লাশ পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। পরিবার তার দেহে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছে। পরিবার বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতার কথা বলতে গিয়ে প্রতিবেদনে রামুর বৌদ্ধ মন্দির ও বসতিতে হামলার ঘটনা উল্লেখ করা হয়।
No comments